গার্মেন্টসে ফের আগুন ॥ পুড়ে মরল ৭- হতাহতদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে জীবন্তদগ্ধ হয়ে ৭ পোশাক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ পোশাক শ্রমিক।
আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৭ জনের অবস্থা গুরুতর। ফায়ার সার্ভিসের বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে গেলেন অনেকেই। নতুবা মৃতের সংখ্যা ৭ জনের জায়গায় ৫০ জনও হতে পারত। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হতাহতদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকেই মোবাইল ফোনে সর্বক্ষণ হতাহতদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন। ঘটনা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় মালিকপক্ষের কোন দুর্বলতা থাকলে ওই মালিকের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। এছাড়া রাজধানীর ভাটারায় একটি ফার্নিচারের দোকানে এবং ধানম-ির বেসরকারী এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে।শনিবার বেলা পৌনে ৩টার দিকে মোহাম্মদপুর বেডিবাঁধ এলাকার স্মার্ট গার্মেন্টসে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হচ্ছেন, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানাধীন কালুদাসকাঠি গ্রামের আলফাজ উদ্দিনের মেয়ে রাজিয়া (১৬), ফাতেমা (১৮), রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলাবস্তির জাবেদ হোসেনের মেয়ে কোহিনুর (১৮), ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানার চরগাজীপুর গ্রামের আজিজুল হকের মেয়ে নাছিমা (৩০) ও ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার দেউলা গ্রামের নয়া মিয়ার মেয়ে নাছিমা আক্তার (১৭) এবং লাইজু (১৬)। এদিকে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত চিকিৎসাধীন লাইজু (১৬) মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃত্যের সংখ্যা ৭ জনে দাঁড়াল।
অগ্নিকান্ডে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন স্মার্ট গার্মেন্টসের শ্রমিক রোজিনা (১৮), হাসিনা (২৫), জ্যোৎস্না (২০), রিয়া (১৭) ও ছবির (২০) অবস্থা গুরুতর। আহত অন্যরা আশঙ্কাম্ক্তু।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনের মতো গার্মেন্টসে কাজ চলছিল। এ সময় আচমকা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকেন। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা হুড়াহুড়ি করে গার্মেন্টস থেকে নামতে থাকেন। এ সময় হুড়াহুড়িতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
এমন পরিস্থিতি মাত্র ৪/৫ মিনিটের মাথায় পুরো গার্মেন্টসের নিচতলা থেকে দাউ দাউ করে আগুন বের হতে থাকে। মুহূর্তেই আগুন দোতলায় চলে যায়। গার্মেন্টসের নিচতলায় তৈরি কাপড়, কাগজ, প্যাকেট, এক্সেসরিজ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় গার্মেন্টস জুড়ে সৃষ্টি হয় এক ভীতিকর পরিস্থিতির।
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর, হেডকোয়ার্টার, লালবাগ, পোস্তা, হাজারীবাগসহ আশপাশের ১০টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হয়। কিন্তু সরু রাস্তার কারণে দমকল বাহিনীর পানিবাহী ভারি গাড়ি সেখানে পৌঁছতে পারছিল না। অগ্নিকা-ের ঘটনায় শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করে। এতে পুরো রাস্তা অবরোধ হয়ে পড়ে। যদিও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন খবর দেয়ার অনেক পরে দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে।
এদিকে ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে হাজির হন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি স্থানীয় আওয়ামী, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য দলীয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। তিনি হ্যান্ডমাইক দিয়ে গার্মেন্টসের আশপাশের মানুষজনকে নিরাপদে সরে যেতে বলেন। এতেও কর্ণপাত না করলে প্রতিমন্ত্রী পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় এক প্রকার জোর করে গার্মেন্টসের আশপাশের লোকজনদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেন।
উৎসুক জনতার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারছিল না। ফায়ার সার্ভিস কাজও শুরু করতে পারছিল না। লোকজনকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হলে ফায়ার সার্ভিস দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করে।
দমকল বাহিনীর ৬টি ইউনিট প্রথমেই ভবনের চারদিকে অবস্থান নেয়। এরপর চারদিক থেকে প্রচ- গতিতে ভবনের ভেতরে হুস পাইপ দিয়ে পানি ছিটাতে থাকে। পানির চাপে ভবনের দরজা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা জায়গা দিয়ে পানি প্রবেশ করে পুরো ভবনের ফ্লোর পানিতে ভেসে যায়। ভবনটি দোতলা। দোতলায় গার্মেন্টস। নিচতলায় মালামালা রাখা হয়। গার্মেন্টসটিতে ৩ শিফটে প্রায় ৫ পোশাক শ্রমিক কাজ করেন। ঘটনার সময় কারখানায় শতাধিক শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। দমকল বাহিনী বিকেল ৪টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে হতাহতদের উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃতদের স্থানীয় ও বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, দোতলা গার্মেন্টসটির দ্বিতীয় তলায় জামাকাপড় তৈরির কাজ চলছিল। আর নিচতলায় গুদাম ছিল। আগুন লাগলে শুকনো কাপড়ের কারণে পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। এ সময় পুরো এলাকায় এ ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শ্রমিকরা দরজা, জানালা ও লোহার গ্রিল ভেঙ্গে বের হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মীরা আগেই কলাপসিবল গেট আটকিয়ে চলে যায়। এতে অতিরিক্ত কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। কালো ধোয়ার কারণে সেখানে কোন অক্সিজেন থাকে না। অক্সিজেন না থাকায় পোশাক শ্রমিকরা ভবনের ভেতরে আটকা পড়েন। অনেক শ্রমিক দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। বেশির ভাগ শ্রমিক অক্সিজেনের অভাবে আর অগ্নিদ্ধগ্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে মারা যান।
পরে দমকল বাহিনী দ্রুত ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ৫ পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পেরেছে ফায়ার সার্ভিস। এদিকে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মঞ্জরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আগুনে ৬ পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মোঃ শাহিদুল্লাহসহ ফায়ার সার্ভিসের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে হাজির হন। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জরুরী নিত্যপ্রয়োজনীয় দব্র্যসামগ্রী সরবরাহ করেন। আগুনে সরাসরি অন্তত ৫ শতাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার মালামাল।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের জানান, এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে। অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় গার্মেন্টস মালিকের কোন দুর্বলতা থাকলে ওই মালিকের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের সব ধরনের সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বলেও তিনি জানান।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের বুদ্ধিমত্তার কারণে রক্ষা পেয়েছেন অনেকেই। কারণ ফায়ার সার্ভিস প্রচন্ড গতিতে দরজা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে হুস পাইপ দিয়ে পানি ভেতরে প্রবেশ করানো গার্মেন্টসের ভেতরের কালো ধোঁয়া চলে গেছে। আটকে পড়ারা মোটামুটি স্বাভাবিক নিশ্বাস নিতে পারায় হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। নতুবা গার্মেন্টসটিতে যে ধরনের পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল ৭ জনের পরিবর্তে ৫০ জনের মৃত্যু হওয়ায়ও অস্বাভাবিক ছিলনা। পুরো বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী উৎসুক জনতা ও আহতদের বুঝানোর পর তাঁরা ফায়ার সার্ভিসকে ধন্যবাদ দেন।
বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটতে পারে বলে ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে।
রাজধানীর ভাটারায় ফার্নিচারের দোকানে আগুন ॥ শনিবার ভোর ৫টায় রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বারিধারার ব্রাদার্স ফার্নিচারের দোকানে ভয়াবহ অগ্নিকার ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে গেছে কয়েক কোটি টাকার মালামাল। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিটি ঘটনাস্থলে যায়। প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, বেলা প্রায় ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। কাঠ ও প্লাইউডের তৈরি ফার্নিচার থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে ফার্নিচারের গোডাউন পুড়ে যায়। কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার ফার্নিচার পুড়ে গেছে বলে ফার্নিচারের দোকানের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। তবে আগুনে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
বেসরকারী এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে আগুন ॥ শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি বেসরকারী এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির দোতলায় অবস্থিত লাইব্রেরীতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন বেশি ছড়াতে পারেনি। অগ্নিকান্ডের সময় ছাত্ররা সেখানে পড়াশোনা করছিলেন। ধানমন্ডি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ৪তলা ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত লাইবেরীতে আগুন লাগে। ওই সময় ছাত্ররা পড়াশোনা করছিলেন। আগুনে কয়েকটি বই পুড়ে গেছে। ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নিভিয়ে ফেলে। আগুনে কোন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
No comments