দরবার হলে ঐদিন আমারও থাকার কথা...- ক্যাপ্টেন মুরাদ (অব.)
আমি পরম করম্নণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞ। ২৫ ফেব্রুয়ারি আমার পিলখানায় দরবার হলে থাকার কথা ছিল। কেন থাকলাম না-সেটা পরম করুণাময়ই জানেন।
২০০৪ সালে নীলডুমুর (১ রাইফেল ব্যাটালিয়নে)
২০০৪ সালে নীলডুমুর (১ রাইফেল ব্যাটালিয়নে)
থাকার সময় সেই সময়কার সুন্দরবনের ত্রাস 'কালু বাহিনী'র প্রধান কালুর সাথে হাতাহাতি লড়াই করে, পরে তাকে হত্যা করে, তার বাকি পাঁচ সহচরকে অস্ত্রসহ বন্দী করে সুন্দরবনের দুর্গম অঞ্চল থেকে অপহৃত ১০ জন পর্যটককে উদ্ধার করেছিলাম। সেই সময় সুন্দরবন অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বুকভরা ভালবাসা পেয়েছিলাম। অনেক বাহবাও পেয়েছিলাম উর্ধতনের কাছ থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় নিজেই আমাকে পদক দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের গুরম্নত্বপূর্ণ ফাইলের গোলকধাঁধায় পড়ে শেষ পর্যনত্ম সেটা পেলাম ২০০৯ সালে। নাটক/সিনেমার মতো সেই দুর্ধর্ষ ক্যা. মুরাদ ততদিনে হয়ে গেছে 'রানার গ্রম্নপ লিঃ'-এর ক্রেডিট এ্যান্ড রিকভারি ম্যানেজার।
'বেটার লেট দেন নেভার।' তাই পদক পাওয়ার খবর পেয়ে খুবই আনন্দিত হলাম। 'রাইফেল্স পদক' একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। অফিসের লাঞ্চটাইমে যেতাম বিডিআর রিইউনিয়ন প্যারেডে প্র্যাকটিসে। হাজারো ইউনিফর্মের মাঝে আমি একাই সু্যট পরে প্যারেড করে পদক নেয়া ও 'ধন্যবাদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' বলার অনেক প্র্যাকটিস করতাম। সেই সাথে পুরনো সহকমর্ীদের সাথে দেখা সাাত তো ছিল লাঞ্চ করার চেয়েও আনন্দময়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পদক পরাবেন_ এ তো আর সাধারণ কথা নয়। নতুন সু্যট বানালাম। 'ক্যাটস আই' থেকে শার্টও কিনে ফেললাম। এক বন্ধুুকে তার ডিজিটাল ক্যামেরাসহ ফটোগ্রাফার হিসাবে বুক করলাম। প্যারেডে প্র্যাকটিসের সময় সে বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলত আর আমি ঠিক করতাম আসল প্যারেডের সময় ছবিটা কেমন হবে (মনে মনে ছবি বাঁধাই এবং ড্রইং রম্নমে ছবিটার পেস্নসিং তো আগেই শেষ)।
রি-ইউনিয়ন প্যারেডের আগের সন্ধ্যায় কর্নেল এলাহী (আলস্নাহ তার মঙ্গল করম্নন) ফোনে জানালেন, "এই রকম একটা সেরিমনিয়াল প্যারেডের মধ্যে একটা সিভিল ড্রেস দেখতে বেমানান লাগবে। আর তাই কাল নয়, তোমাকে অন্য সময় পদকটা দেওয়া হবে।" প্যারেড দেখতে চাইলেও আমার ছেলে, আমার স্ত্রী, বাবা, মা সবাইকে কড়া নিরাপত্তা ইত্যাদি বুঝিয়ে বলে সবাইকে বাসায় থেকে টিভিতেই দেখতে বললাম। আর আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
রিইউনিয়ন প্যারেডের ভোরে ফিটফাট হয়ে সেই উত্তরা থেকে পেঁৗছে গেলাম পিলখানায়। মনে তখনও আশা যে, আদেশটা বদলও হতে পারে। পিলখানায় পেঁৗছে গেট থেকে ফোন করে আবারও এ ব্যাপারে জানতে চাইলাম। ফলাফল শূন্য। অফিস থেকে ছুটি নেয়া আছে। সব কলিগ পদকের ব্যাপারে জানে। আমার ছেলে তো সকাল থেকেই টিভির সামনে। কাকে কী বলব? আমার তখন এতই মন খারাপ লাগছে, কী করব তাই ভাবছিলাম। তখন পিলখানার মেইন গেট থেকে একটু দূরে একটা চায়ের স্টলে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের পানি লুকিয়ে মুছে চলেছি। এমন স্মার্ট ড্রেসিংয়ে রাসত্মায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকে হাসবে । সেখানে দাঁড়িয়েই সম্পূর্ণ ধারাভাষ্য শুনতে পাচ্ছিলাম। মোট পদকপ্রাপ্ত ১৪ জন বললেও, পদক গ্রহণ করেছিল ১৩ জন। তা বোধহয় একমাত্র আমিই খেয়াল করেছিলাম। দিনটা কিভাবে কাটল বলতে পারব না।
রাতে ডিএজি মেজর সালেহ (আলস্নাহ তাঁর মঙ্গল করম্নন) আমাকে ফোন করলেন সানত্ম্বনা দেয়ার জন্য। স্যার বার বার বলছিলেন, "কাল দরবারে এসো, আমি চেষ্টা করব যেন ডিজিকে দিয়ে তোমার পদকটা দেয়াতে পারি।" আমি তখন বুকভরা অভিমান আর আপে নিয়ে তাঁকে বললাম, "স্যার, অনেক ধন্যবাদ। অনেক হয়েছে, পদকটা কুরিয়ারে পাঠালেই হবে, সিভিল ড্রেসে তো পদক পরা লাগে না। তাছাড়া আমার কাল অফিস আছে।" পরদিন অর্থাৎ ২৫ তারিখেও সকালে উত্তরা থেকে কোন কারণ ছাড়াই পিলখানার মেইন গেটের কাছ পর্যনত্ম এসেছিলাম। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার যথারীতি অফিসের উদ্দেশে মোটরসাইকেলটা ঘুরিয়ে ছুট দিলাম। অফিসে যাওয়ার কিছু পরে যা শুনলাম তা সবাই জানেন।
দু'দিন পর আবার পিলখানার মেইন গেট থেকে একটু দূরের সেই চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলাম। চোখের পানি কোনভাবেই বাধা মানলনা। তখন অবশ্য সেই স্মার্ট ড্রেসিংও নেই। রাসত্মায় দাঁড়িয়ে কাঁদলেই বা কি?
আমার মনের পর্দায় ছবির মতো ভাসছে... খোলাহাটি ক্যান্টনমেন্টে মেজর গাজালীর সাথে রাতভর বিলিয়ার্ড খেলা...। তিনি সাঁতার কাটতে খুবই ভয় পেতেন। ভাসছেন মেজর মাহবুব, আমার কিনহার্টের কমান্ডার। ভাসছেন মেজর আজহার, আমার শেষ ইউনিটের টুআইসি। তাঁর পিচ্চিটার নাম ছিল পৌষী। ভাসছেন মেজর সালেহ...গত রাতেও কথা হলো। ভাসল তৎকালীন কর্নেল লে. শাকিল (ডিজি)। ৯ ফিল্ড আর্টিলারির প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক, আর যেটা কি-না অর্মিতে আমার জন্মস্থান। শেষ পর্যনত্ম আর তাই পদকটি চাইনি। পরবতর্ীতে চেকটা (৫০,০০০/-) পেয়েছি। মাসে মাসে ১০০/- ভাতা অতিরিক্ত যোগ হচ্ছে যা চলবে আজীবন। চলুক। আমার ছেলে মাঝেমধ্যে জানতে চায়, 'আব্বু, তোমার মেডেলটার কী হলো?' তাকে বলি, 'তুমি অর্মিতে গিয়ে যখন এমন একটা পাবে তখন আব্বুরটাও চেয়ে নেবে।'
"পিলখানা নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার সকল শহীদের আত্মার শানত্মি হউক" আলস্নাহর কাছে এই একটি চাওয়া দিয়েই আমার লেখা শেষ করছি।
'বেটার লেট দেন নেভার।' তাই পদক পাওয়ার খবর পেয়ে খুবই আনন্দিত হলাম। 'রাইফেল্স পদক' একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। অফিসের লাঞ্চটাইমে যেতাম বিডিআর রিইউনিয়ন প্যারেডে প্র্যাকটিসে। হাজারো ইউনিফর্মের মাঝে আমি একাই সু্যট পরে প্যারেড করে পদক নেয়া ও 'ধন্যবাদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' বলার অনেক প্র্যাকটিস করতাম। সেই সাথে পুরনো সহকমর্ীদের সাথে দেখা সাাত তো ছিল লাঞ্চ করার চেয়েও আনন্দময়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পদক পরাবেন_ এ তো আর সাধারণ কথা নয়। নতুন সু্যট বানালাম। 'ক্যাটস আই' থেকে শার্টও কিনে ফেললাম। এক বন্ধুুকে তার ডিজিটাল ক্যামেরাসহ ফটোগ্রাফার হিসাবে বুক করলাম। প্যারেডে প্র্যাকটিসের সময় সে বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলত আর আমি ঠিক করতাম আসল প্যারেডের সময় ছবিটা কেমন হবে (মনে মনে ছবি বাঁধাই এবং ড্রইং রম্নমে ছবিটার পেস্নসিং তো আগেই শেষ)।
রি-ইউনিয়ন প্যারেডের আগের সন্ধ্যায় কর্নেল এলাহী (আলস্নাহ তার মঙ্গল করম্নন) ফোনে জানালেন, "এই রকম একটা সেরিমনিয়াল প্যারেডের মধ্যে একটা সিভিল ড্রেস দেখতে বেমানান লাগবে। আর তাই কাল নয়, তোমাকে অন্য সময় পদকটা দেওয়া হবে।" প্যারেড দেখতে চাইলেও আমার ছেলে, আমার স্ত্রী, বাবা, মা সবাইকে কড়া নিরাপত্তা ইত্যাদি বুঝিয়ে বলে সবাইকে বাসায় থেকে টিভিতেই দেখতে বললাম। আর আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
রিইউনিয়ন প্যারেডের ভোরে ফিটফাট হয়ে সেই উত্তরা থেকে পেঁৗছে গেলাম পিলখানায়। মনে তখনও আশা যে, আদেশটা বদলও হতে পারে। পিলখানায় পেঁৗছে গেট থেকে ফোন করে আবারও এ ব্যাপারে জানতে চাইলাম। ফলাফল শূন্য। অফিস থেকে ছুটি নেয়া আছে। সব কলিগ পদকের ব্যাপারে জানে। আমার ছেলে তো সকাল থেকেই টিভির সামনে। কাকে কী বলব? আমার তখন এতই মন খারাপ লাগছে, কী করব তাই ভাবছিলাম। তখন পিলখানার মেইন গেট থেকে একটু দূরে একটা চায়ের স্টলে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের পানি লুকিয়ে মুছে চলেছি। এমন স্মার্ট ড্রেসিংয়ে রাসত্মায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকে হাসবে । সেখানে দাঁড়িয়েই সম্পূর্ণ ধারাভাষ্য শুনতে পাচ্ছিলাম। মোট পদকপ্রাপ্ত ১৪ জন বললেও, পদক গ্রহণ করেছিল ১৩ জন। তা বোধহয় একমাত্র আমিই খেয়াল করেছিলাম। দিনটা কিভাবে কাটল বলতে পারব না।
রাতে ডিএজি মেজর সালেহ (আলস্নাহ তাঁর মঙ্গল করম্নন) আমাকে ফোন করলেন সানত্ম্বনা দেয়ার জন্য। স্যার বার বার বলছিলেন, "কাল দরবারে এসো, আমি চেষ্টা করব যেন ডিজিকে দিয়ে তোমার পদকটা দেয়াতে পারি।" আমি তখন বুকভরা অভিমান আর আপে নিয়ে তাঁকে বললাম, "স্যার, অনেক ধন্যবাদ। অনেক হয়েছে, পদকটা কুরিয়ারে পাঠালেই হবে, সিভিল ড্রেসে তো পদক পরা লাগে না। তাছাড়া আমার কাল অফিস আছে।" পরদিন অর্থাৎ ২৫ তারিখেও সকালে উত্তরা থেকে কোন কারণ ছাড়াই পিলখানার মেইন গেটের কাছ পর্যনত্ম এসেছিলাম। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার যথারীতি অফিসের উদ্দেশে মোটরসাইকেলটা ঘুরিয়ে ছুট দিলাম। অফিসে যাওয়ার কিছু পরে যা শুনলাম তা সবাই জানেন।
দু'দিন পর আবার পিলখানার মেইন গেট থেকে একটু দূরের সেই চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলাম। চোখের পানি কোনভাবেই বাধা মানলনা। তখন অবশ্য সেই স্মার্ট ড্রেসিংও নেই। রাসত্মায় দাঁড়িয়ে কাঁদলেই বা কি?
আমার মনের পর্দায় ছবির মতো ভাসছে... খোলাহাটি ক্যান্টনমেন্টে মেজর গাজালীর সাথে রাতভর বিলিয়ার্ড খেলা...। তিনি সাঁতার কাটতে খুবই ভয় পেতেন। ভাসছেন মেজর মাহবুব, আমার কিনহার্টের কমান্ডার। ভাসছেন মেজর আজহার, আমার শেষ ইউনিটের টুআইসি। তাঁর পিচ্চিটার নাম ছিল পৌষী। ভাসছেন মেজর সালেহ...গত রাতেও কথা হলো। ভাসল তৎকালীন কর্নেল লে. শাকিল (ডিজি)। ৯ ফিল্ড আর্টিলারির প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক, আর যেটা কি-না অর্মিতে আমার জন্মস্থান। শেষ পর্যনত্ম আর তাই পদকটি চাইনি। পরবতর্ীতে চেকটা (৫০,০০০/-) পেয়েছি। মাসে মাসে ১০০/- ভাতা অতিরিক্ত যোগ হচ্ছে যা চলবে আজীবন। চলুক। আমার ছেলে মাঝেমধ্যে জানতে চায়, 'আব্বু, তোমার মেডেলটার কী হলো?' তাকে বলি, 'তুমি অর্মিতে গিয়ে যখন এমন একটা পাবে তখন আব্বুরটাও চেয়ে নেবে।'
"পিলখানা নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার সকল শহীদের আত্মার শানত্মি হউক" আলস্নাহর কাছে এই একটি চাওয়া দিয়েই আমার লেখা শেষ করছি।
No comments