ঝর্ণাধারা চৌধুরী ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিব ঝর্ণাধারা চৌধুরী সমাজকর্মে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব ফোন করে তাঁকে ওই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার কথা অবহিত করেন।
ইতোপূর্বে তিনি ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজাজ পুরস্কার, ২০০০ সালে শান্তি পুরস্কার-ওল্ড ওয়েস্টবেরি বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা, ২০০১ সালে অনন্যা পুরস্কার, ২০০৩ সালে দুর্বার নেটওয়ার্ক, জেলা প্রশাসন, নোয়াখালী ২০০৭ সালে সাদা মনের মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি, ২০১০ সালে শ্রীচৈতন্য পদক, একই সালে চ্যানেল আই এবং স্কয়ার কীর্তিমতী নারী, ২০১১ সালে গান্ধী স্মৃতি শান্তি সদ্ভাবনা পুরষ্কারে ভূষিত হন।সংসার ত্যাগী, ব্রহ্মচারিণী শ্রীযুক্তা ঝর্ণাধারা চৌধুরী নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিব। সমাজসেবা ও জনকল্যাণে আত্মনিবেদিতা চিরকুমারী পরম শ্রদ্ধেয়া এই মহীয়সী নারী মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষীপুর জেলায় ঝর্ণাধারা চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী দাঙ্গার সময় মাহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে উড়িষ্যা থেকে সত্যনারায়ণজী দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে কাজ করেন এবং আমৃত্যু তিনি এখানে অবস্থান করে সমাজসেবার কাজ করেছেন। ঝর্ণাধারা চৌধুরী তাঁর জীবনী ‘সত্যনারায়ণজী’ প্রকাশ করেন।
তাঁর পিতা প্রমথ চৌধুরী এবং মাতা আশালতা চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
শনিবার বিকেলে নোয়াখালী গান্ধী আশ্রম টাস্ট কার্যালয়ে ঝর্ণাধারা চৌধুরী বলেন, সারাজীবন ধরে আমি যে আছি, তাঁরা আমাকে ভুলেননি। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে। ভারত সরকারের এ পুরস্কার অর্থের দিক দিয়ে ১০ লাখ টাকা। এই টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন আমার মনে হয় আমি এ সমাজের জন্য যা করেছি তা যথেষ্ট নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃপণ কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আমি অল্প করেছি তাই ভারত সরকার আমাকে অল্প দিয়েছে। তবুও যা দিয়েছে এ অর্থের পুরোটাই গান্ধি আশ্রম ট্রাস্টের মাধ্যমে জনমানুষের কল্যাণে ব্যয় করব।
ঝর্ণাধারা চৌধুরী ১৯৫৪ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী থানার জয়াগে প্রতিষ্ঠিত গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত হন। এই ট্রাস্ট নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও কুমিল্লা জেলার প্রায় বারো লক্ষ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংসা প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এই ট্রাস্টের দ্বারা আটটি উপজেলার পৌনে দু’লক্ষ দরিদ্র পরিবার উপকৃত হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে ঝর্ণাধারা চৌধুরীর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের মাধ্যমে দরিদ্র জনগণ শিক্ষার আলো লাভ করছে। তাছাড়া কৃষি, মৎস্যচাষ, কুটিরশিল্প প্রভৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সাবলম্বী হচ্ছে।
চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘের শিক্ষিকা এবং অনাথালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁর মানবসেবা আরম্ভ হয়। অনাথ শিশুদের জীবন গঠনে তিনি মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছেন। অনাথ শিশুদের সেবা দিয়ে তিনি তাদের আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। তিনি তাদের শিখিয়েছেন জীবনে পরাজিত হতে নেই- জয় পতাকা হাতে অগ্রসর হয়ে জীবনকে সার্থক করে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবর্তক সংঘের প্রায় ৫০০ শিশু ও কিশোরীকে পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়ে তিনি আগরতলা নিয়ে যান। সেখানে ত্রাণ কাজে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত প্রবর্তক সংঘের কর্তাব্যক্তিদের মরদেহ সৎকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিধ্বস্ত প্রবর্তক সংঘ পুণর্গঠনে তিনি নিরলস কাজ করেছেন।
ঝর্ণাধারা চৌধুরী আজীবন হতদরিদ্র, অসহায়, নির্যাতিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ আলোর পথ যেমন খুঁজে পেয়েছে, তেমনি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছে সমানতালে। গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র্যতা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়েছে।
No comments