রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন ও নির্জন এককে আমরা by ঝুমুর আহমেদ

'চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে'_ এমনই প্রত্যয় নিয়ে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের ৩০তম বার্ষিক অধিবেশন হয়ে গেল ২৫ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে।
রবীন্দ্রনাথের গানকে দেশের মানুষের শ্রবণে, অন্তরে, মননে পেঁৗছে দেওয়ার জন্যই রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ যাত্রা শুরু করেছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চল, জেলা শহরগুলো ঘুরে বছরব্যাপী কর্মশালা করে রবীন্দ্রনাথের গানকে আমাদের সংস্কৃতির অনিবার্য অবলম্বন করে তুলেছে প্রধানত এই সম্মিলন পরিষদ। আর কে না জানে, রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষের চেতনা-জগৎকে বদলে দিতে পারে নিমিষেই। এ রচনাটির লক্ষ্য এটিই দেখানো, সম্মিলন পরিষদে যারা গানের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের নিজেদের বিকাশ দরকার, নইলে তার কর্মফল নিয়েই সন্দেহ জাগবে মানুষের মনে। নইলে সঙ্গীত সম্মিলনের এ কার্যক্রম কেবল কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচিহ্নিত কিছু গায়কের গাওয়ার জায়গা ছাড়া আর কোনো শুভ ফলই বয়ে আনবে না_ সত্যের ছন্দের চলার ব্যাপারটি অনেক দূরবর্তী হয়ে গেছে, তা সবাইকে জানানো দরকার একজন শিল্পী হিসেবে। এতে তারা হয়তো নিজেদের শুধরে নিতে চাপ বোধ করতেও পারেন। আমি না-হয় তাদের নাকের ডগাতেই থাকি, আমাকে আর ক'দিন গান গাইতে না ডেকে পারবে (সারাজীবন পারবে না বোধ হয়)? আমি ভাবছি সেই আলোকবর্তিকার কথা, যাকে ওয়াহিদুল হক তার 'গানের ভেতর দিয়ে' বইটিতে জাগ্রত রেখেছিলেন, আর জানিয়েছিলেন তার একান্ত সংগোপনতা আমাদের তার আলোক থেকে কীভাবে বঞ্চিত করেছে। কী মর্মান্তিকই না লেগেছিল ওয়াহিদুল হকের সেই শঙ্কার কথা! আমার এই লেখা, এ দেশে আড়ালে থাকা, সংগোপনে থাকা কোনো আলোকবর্তিকার আলো দেখতে চাই বলেই; আর সম্মিলন পরিষদের নিজেদের শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে, সময় এসেছে এ দেশের শিল্পীদের সঙ্গে তাদের একাকী সংঘাত মেটানোর_ এ কথা জানিয়ে দেওয়ার জন্য।
সম্মিলন পরিষদ, আমার সঙ্গে তো আপনাদের দেখা হয়। ছায়ানটে কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা সূত্রে আপনাদের অনেক কাছেই আমি থাকি। একবার আমাকে দিয়ে আপনাদের মহানগর শাখা শরতের অনুষ্ঠানের রিহার্সেলও করিয়ে নিল। আরেকবার গাজীপুর গেলাম কর্মশালা করতে সম্মিলন পরিষদের হয়ে। আর তা ছাড়া আমি ছায়ানটের শিক্ষক সেই ক্রাইটেরিয়া বাদ দিলেও, আমি ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে সঙ্গীত বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যথাক্রমে ছিয়াত্তর ভাগ ও সত্তর ভাগ পাওয়া একজন গায়ক। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়ানোর জায়গা না-হতে পারে, কারণ সেই কাজটি অন্যতর জাগতিক সাধনার অপেক্ষা রাখে। আমি আপনাদের এখানে গান গাওয়ার উপযুক্ত বলে মনে করি (আমার স্বামী অভী চৌধুরী পাশ থেকে বলছেন, উনিও নাকি নিজেকে সেই উপযুক্ত মনে করেন; কারণ সম্মিলন পরিষদের সম্পাদক মাত্র ক'দিন আগে নাকি অভীকে অনুরোধ করেছিলেন ফরিদপুরে গানের বিচারক হিসেবে যাওয়ার জন্য। অভী তা নাকচ করেছে এই বলে যে, 'যেহেতু আপনারা আমাকে কখনও গাইতে ডাকেননি, তাই আমি নিজেকে এই কার্যের উপযুক্ত মনে করি না!')। আন্তরিক যোগ্যতা গান গাওয়ার ক্ষেত্রে সবসময় বিবেচ্য নয়, তা হয়তো মান্য। তা বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান আছে অনেককে দিয়ে গাওয়ানো যাবে না, রবীন্দ্রনাথও তা-ই মনে করতেন। তবে কণ্ঠের যোগ্যতা একদিন গায়কের অন্তরকে বিকশিত করবে। আমি আন্তরিক প্রার্থনা করি, গায়কদের তালিকা প্রস্তুতিতে যারা জড়িত, যাতে কণ্ঠযোগ্যতার পাশাপাশি আপনাদের অন্তরও বিকশিত করতে পারে রবীন্দ্রনাথের গান। আর সেই বিকশিত অন্তর দেশের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোনো 'আতাঈ'-জনকে খুঁজে বের করে আনতে পারে। যার দেখানো আলোকে আমরা আমাদের গানের পথকে খুঁজে নিতে পারি, যৌথ জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারি রবীন্দ্রনাথের হাতে
হাত রেখে।

No comments

Powered by Blogger.