অবহেলিত রেলপথ-১-মন্ত্রী আসে মন্ত্রী যায় রেলের উন্নতি হয় না by পার্থ সারথি দাস
এক সময় ট্রেনই ছিল দেশের প্রধান পরিবহনমাধ্যম। ব্যাপক জনপ্রিয়ও। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে এই খাতে ভাটার টান। যাত্রীসেবা তলানিতে। স্রেফ অবহেলার খেসারতে ৪০ বছরে দেশে রেলপথ কমেছে ২৩ কিলোমিটার। বন্ধ হয়েছে ১৫৩ স্টেশন।
রেলকে দূরে ঠেলে সড়কপথে দেদার সম্পদ ঢেলেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকার। যে রেল হতে পারত দেশের যোগাযোগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম, দশকের পর দশকের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা আর ঢালাও দুর্নীতিতে তা এখন মৃতপ্রায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রেলের ওপর নজর ফেরায়। তাতে চার বছরে প্রাপ্তি একটি আলাদা মন্ত্রণালয় ও চার মন্ত্রীর আসা-যাওয়া; সেই সঙ্গে যাত্রীসেবার স্বার্থে নেওয়া প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার ৪৪ প্রকল্প, 'কালো বিড়াল' বের করা ও রেলের কয়েক হাজার একর জমি উদ্ধারের ঘোষণা।
তবে কোনো কিছুই পরিকল্পনামাফিক এগোয়নি। রেলওয়ের কর্মকর্তাদের মতে, বারবার মন্ত্রী বদল হওয়ায় নতুন মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বেলাইনে চলছে। বর্তমান রেলমন্ত্রীও খানিকটা একমত এই তত্ত্বে।
অভিযোগ, ঋণদাতা সংস্থাগুলোর নানা শর্তের ফাঁদে পড়েই বাংলাদেশ রেলওয়ে পেছনে হাঁটছে। তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার আন্তরিক হলে এবং ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে এই খাতে উন্নয়ন সম্ভব ছিল। ভারতের উদাহরণ টেনে তাঁরা বলেন, ১৮৫০ সালের আগে এক কিলোমিটার রেলপথও ছিল না তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে। এখন সেই দেশে ৬৫ হাজার কিলোমিটার রেলপথে প্রতিদিন ১০ হাজার ট্রেন চলছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, গণপরিবহন হিসেবে রেলের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হলে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা থাকতে হবে। অথচ বাংলাদেশে এর অভাব প্রকট। একমাত্রিকতা ঝেড়ে ফেলে বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়তে হবে। কিন্তু রেলপথ তো বাড়ছেই না বরং প্রায়ই ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে।
রেলওয়ের উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর একটি হলো 'পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'। সংগঠনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন রেলকে বাঁচাতে নতুন তৈরি রেল মন্ত্রণালয় বারবার অভিভাবকহীন হয়েছে। প্রথম মন্ত্রণালয়ের প্রথম মন্ত্রীর সময়ে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারের প্রথম দুই বছর সড়ক বিভাগের পাশাপাশি রেলও দেখভাল করেন তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী তাঁকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত সড়ক, রেল ও সেতু- এই তিনটি বিভাগের বড় বড় প্রকল্প গ্রহণেই বেশি মনোযোগী ছিলেন আবুল হোসেন। স্বাক্ষরিত হয় ৩৫টি চুক্তি। ট্রেনের সময়সূচি রক্ষা, জনবল সংকট দূর করা, বেদখল রেলজমি উদ্ধারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাঁর চেষ্টা ছিল সামান্যই। আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাকে রেলের পাশাপাশি সড়ক ও সেতু বিভাগও সামলাতে হয়েছে। আমিই প্রথমবারের মতো রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও আমার কর্মপ্রচেষ্টায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি আপনারা দুই-এক বছরের মধ্যেই দেখতে পাবেন।'
যোগাযোগ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে রেলপথ মন্ত্রণালয় আত্মপ্রকাশ করে ২০১১ সালে। নতুন এই মন্ত্রণালয় ১০ মাসের ব্যবধানে তিন মন্ত্রী পেয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান সরকারের প্রায় চার বছরে রেলের দায়িত্ব পান চার মন্ত্রী। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৪১ দিন দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজ এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সুরঞ্জিত রেলের কালো বিড়াল খোঁজা আর সময়সূচির উন্নয়নে জিহাদ ঘোষণা করেন। মাসখানেক পর ৩ জানুয়ারি রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি তাঁর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। ওই দিন রসিকতা করেই তিনি বলেন, 'আমি হইলাম পানির মানুষ, আমারে দিছে রেলে।' রসিক মানুষ সুরঞ্জিত মিটারগেজ ও ব্রডগেজ লাইন কী তা বোঝার জন্য ওই দিন রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহেরকে ডেকে নিয়ে আসেন। তখনই তাঁর মনে হয়েছিল, কারিগরি জ্ঞান না থাকলে রেল বোঝা কঠিন। সুরঞ্জিত আন্তনগর ট্রেনের শতকরা ৭০ ভাগ সময়মতো চলানোর কর্মপন্থা ঠিক করেছিলেন। নিজ এলাকা ঢাকা-সিলেট রুটে চালু করেন কালনী এক্সপ্রেস। রেলের টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে আগাম টিকিট ১০ দিনের বদলে তিন দিন আগে বিক্রির নিয়ম চালু করেন তিনি। তবে তাতে টিকিট বেচাকেনায় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। অর্থ কেলেঙ্কারির সূত্রে ১৬ এপ্রিল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সুরঞ্জিত।
১৮ এপ্রিল রেলের বাড়তি ভার চাপে যোগাযোগমন্ত্রী হওয়া ওবায়দুল কাদেরের ওপর। সড়ক ও সেতু বিভাগের পাশাপাশি চার মাস রেলের দেখভাল করেন তিনি। তাঁর আমলে গত ঈদুল ফিতরের সময় ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়ে। ফলে যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় তাঁকে। বর্ষা বিপর্যয়ের শঙ্কায় কাদেরকে বেশি ছোটাছুটি করতে হয় সড়ক-মহাসড়ক পরিদর্শনে। শেষ পর্যায়ে তিনি রেলের সময়সূচি ঠিক রাখা ও বেদখল জমি উদ্ধারে উদ্যোগী হন। এ অবস্থায় ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে সরিয়ে নতুন রেলমন্ত্রী করা হয় মুজিবুল হককে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, ৯টার গাড়ি ৯টায় যাবে। তবে সেটা কথার কথাই রয়ে গেছে। সুরঞ্জিতের মতো জীবনে প্রথমবার মন্ত্রিত্ব পাওয়া মুজিবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। রেলের সময়সূচি ঠিক রাখতে আমরা সতর্কর্ আছি।'
সৈয়দ আবুল হোসেনের সময় নেওয়া প্রকল্পগুলো সুরঞ্জিতের সময় দেখভাল করা হয়নি। কাদেরও যথেষ্ট সময় পাননি সেগুলোর ফলোআপে। বর্তমান মন্ত্রী মুজিবুল হক বলছেন, চেষ্টা করছেন। সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, রেলের নতুন লাইন সম্প্রসারণ ও প্রয়োজন অনুযায়ী ইঞ্জিন ও কোচ কেনা, ট্রানজিটের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এই সরকারের সময় একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়। বর্তমানে চলমান ৪৪ প্রকল্পেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। বেপরোয়া দুর্নীতি ও বাড়তি ব্যয়ের পর মাঝেমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও তা নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে না। ফলে এর সুফল পাচ্ছে না যাত্রীরা। যেমন দুই বছরে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও ১৩ বছর শেষে গত জুনে তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতু রেললাইন চালু হয়েছে। উদ্বোধনের চার মাসের মাথায় এই নতুন রেলপথের ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলার শহীদনগর, বারইপটল, হেমনগর ও ভূঞাপুর স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব ও সময়মতো ট্রেন চলাচল না করায় অধিকাংশ সময়ই স্টেশনগুলো বন্ধ থাকছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ও পণ্য সরবরাহের সুবিধার জন্য ২২০ কোটি টাকা খরচে বাস্তবায়িত ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ গত ৩০ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
রেলের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ কে এম মাহবুবুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মন্ত্রী বারবার বদল হলে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল ও পদ্ধতি পাল্টাতে হয়। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। তবে আমরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথেষ্ট তৎপর।'
বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন বসিয়ে এ অঞ্চলে রেলপথের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই খাতের যা কিছু অগ্রগতি তার প্রায় সবই হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মোট দুই হাজার ৬০৪ কিলোমিটার রেলপথ ছিল। এরপর পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে রেলপথের দৈর্ঘ্য বেড়েছে আড়াই শ কিলোমিটার। আর বাংলাদেশের ৪১ বছরে কমেছে প্রায় ২৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে পরিত্যক্ত পথ কমপক্ষে ৩০০ কিলোমিটার। আর সড়কপথ এখন বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার।
স্বাধীনতার পর রেল খাতে দুর্দশার শুরু। ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পদ্মা পেরিয়েছিল রেলপথ। আর যমুনা নদী পার হতে সময় লাগল ৭০ বছরের বেশি। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলসংযোগ ছাড়া স্বাধীনতার পর রেল খাতে উল্লেখযোগ্য আর কোনো সংযোজন নেই। সম্প্রসারণ দূরে থাক বরং অনেক শাখা লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন কমেছে। কমেছে জনবল। সময়সূচি বা যাত্রীসেবা বলতে আর কিছু নেই বললেই চলে।
রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন তৈরি ও মেরামতের জন্য সারা দেশে ছয়টি কারখানাকে কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এগুলোর আধুনিকায়নেও নেই বিনিয়োগ। বরং বিদেশি অনুদান বা ঋণে নতুন নতুন ক্রয় প্রকল্পেই যাবতীয় আগ্রহ সব সরকারের।
রেলের অপারেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এখন গড়ে ৩০ শতাংশ ট্রেনের জন্য ইঞ্জিনই পাওয়া যায় না। যদিও বা মেলে, পথে নেমে প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ে সেগুলো। বিকল হয়ে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে মাসে গড়ে ২৫টি। নতুন ইঞ্জিন আনার প্রকল্পগুলো ঝুলে থাকায় ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বারবার মন্ত্রী বদলের কারণে ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রেনের সময়সূচি রক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন পাওয়া গেলে সময়সূচি শত ভাগ রক্ষা করা যাবে। আমরা সে জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। ৪৪৩টি স্টেশনের মধ্যে ১৫৩টি এখন বন্ধ।' আরো কয়েকটি স্টেশন বন্ধের পথে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনবল সংকটের কারণে বন্ধ স্টেশনগুলো চালু করা যাচ্ছে না। আইনিসহ বিভিন্ন জটিলতায় জনবল সংকটও মেটানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, রেলে দিন দিন যাত্রী বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী পরিবহনক্ষমতা বাড়ছে না। তবে নতুন ইঞ্জিন ও কোচ কেনার প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। আর পুরনো রেলপথ বন্ধ হয়েছে লোকসানের কারণে।
তবে কোনো কিছুই পরিকল্পনামাফিক এগোয়নি। রেলওয়ের কর্মকর্তাদের মতে, বারবার মন্ত্রী বদল হওয়ায় নতুন মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বেলাইনে চলছে। বর্তমান রেলমন্ত্রীও খানিকটা একমত এই তত্ত্বে।
অভিযোগ, ঋণদাতা সংস্থাগুলোর নানা শর্তের ফাঁদে পড়েই বাংলাদেশ রেলওয়ে পেছনে হাঁটছে। তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার আন্তরিক হলে এবং ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে এই খাতে উন্নয়ন সম্ভব ছিল। ভারতের উদাহরণ টেনে তাঁরা বলেন, ১৮৫০ সালের আগে এক কিলোমিটার রেলপথও ছিল না তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে। এখন সেই দেশে ৬৫ হাজার কিলোমিটার রেলপথে প্রতিদিন ১০ হাজার ট্রেন চলছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, গণপরিবহন হিসেবে রেলের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হলে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা থাকতে হবে। অথচ বাংলাদেশে এর অভাব প্রকট। একমাত্রিকতা ঝেড়ে ফেলে বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়তে হবে। কিন্তু রেলপথ তো বাড়ছেই না বরং প্রায়ই ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে।
রেলওয়ের উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর একটি হলো 'পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'। সংগঠনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন রেলকে বাঁচাতে নতুন তৈরি রেল মন্ত্রণালয় বারবার অভিভাবকহীন হয়েছে। প্রথম মন্ত্রণালয়ের প্রথম মন্ত্রীর সময়ে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারের প্রথম দুই বছর সড়ক বিভাগের পাশাপাশি রেলও দেখভাল করেন তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী তাঁকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত সড়ক, রেল ও সেতু- এই তিনটি বিভাগের বড় বড় প্রকল্প গ্রহণেই বেশি মনোযোগী ছিলেন আবুল হোসেন। স্বাক্ষরিত হয় ৩৫টি চুক্তি। ট্রেনের সময়সূচি রক্ষা, জনবল সংকট দূর করা, বেদখল রেলজমি উদ্ধারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাঁর চেষ্টা ছিল সামান্যই। আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাকে রেলের পাশাপাশি সড়ক ও সেতু বিভাগও সামলাতে হয়েছে। আমিই প্রথমবারের মতো রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও আমার কর্মপ্রচেষ্টায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি আপনারা দুই-এক বছরের মধ্যেই দেখতে পাবেন।'
যোগাযোগ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে রেলপথ মন্ত্রণালয় আত্মপ্রকাশ করে ২০১১ সালে। নতুন এই মন্ত্রণালয় ১০ মাসের ব্যবধানে তিন মন্ত্রী পেয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান সরকারের প্রায় চার বছরে রেলের দায়িত্ব পান চার মন্ত্রী। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৪১ দিন দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজ এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সুরঞ্জিত রেলের কালো বিড়াল খোঁজা আর সময়সূচির উন্নয়নে জিহাদ ঘোষণা করেন। মাসখানেক পর ৩ জানুয়ারি রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি তাঁর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। ওই দিন রসিকতা করেই তিনি বলেন, 'আমি হইলাম পানির মানুষ, আমারে দিছে রেলে।' রসিক মানুষ সুরঞ্জিত মিটারগেজ ও ব্রডগেজ লাইন কী তা বোঝার জন্য ওই দিন রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহেরকে ডেকে নিয়ে আসেন। তখনই তাঁর মনে হয়েছিল, কারিগরি জ্ঞান না থাকলে রেল বোঝা কঠিন। সুরঞ্জিত আন্তনগর ট্রেনের শতকরা ৭০ ভাগ সময়মতো চলানোর কর্মপন্থা ঠিক করেছিলেন। নিজ এলাকা ঢাকা-সিলেট রুটে চালু করেন কালনী এক্সপ্রেস। রেলের টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে আগাম টিকিট ১০ দিনের বদলে তিন দিন আগে বিক্রির নিয়ম চালু করেন তিনি। তবে তাতে টিকিট বেচাকেনায় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। অর্থ কেলেঙ্কারির সূত্রে ১৬ এপ্রিল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সুরঞ্জিত।
১৮ এপ্রিল রেলের বাড়তি ভার চাপে যোগাযোগমন্ত্রী হওয়া ওবায়দুল কাদেরের ওপর। সড়ক ও সেতু বিভাগের পাশাপাশি চার মাস রেলের দেখভাল করেন তিনি। তাঁর আমলে গত ঈদুল ফিতরের সময় ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়ে। ফলে যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় তাঁকে। বর্ষা বিপর্যয়ের শঙ্কায় কাদেরকে বেশি ছোটাছুটি করতে হয় সড়ক-মহাসড়ক পরিদর্শনে। শেষ পর্যায়ে তিনি রেলের সময়সূচি ঠিক রাখা ও বেদখল জমি উদ্ধারে উদ্যোগী হন। এ অবস্থায় ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে সরিয়ে নতুন রেলমন্ত্রী করা হয় মুজিবুল হককে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেন, ৯টার গাড়ি ৯টায় যাবে। তবে সেটা কথার কথাই রয়ে গেছে। সুরঞ্জিতের মতো জীবনে প্রথমবার মন্ত্রিত্ব পাওয়া মুজিবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। রেলের সময়সূচি ঠিক রাখতে আমরা সতর্কর্ আছি।'
সৈয়দ আবুল হোসেনের সময় নেওয়া প্রকল্পগুলো সুরঞ্জিতের সময় দেখভাল করা হয়নি। কাদেরও যথেষ্ট সময় পাননি সেগুলোর ফলোআপে। বর্তমান মন্ত্রী মুজিবুল হক বলছেন, চেষ্টা করছেন। সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, রেলের নতুন লাইন সম্প্রসারণ ও প্রয়োজন অনুযায়ী ইঞ্জিন ও কোচ কেনা, ট্রানজিটের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এই সরকারের সময় একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়। বর্তমানে চলমান ৪৪ প্রকল্পেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। বেপরোয়া দুর্নীতি ও বাড়তি ব্যয়ের পর মাঝেমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও তা নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে না। ফলে এর সুফল পাচ্ছে না যাত্রীরা। যেমন দুই বছরে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও ১৩ বছর শেষে গত জুনে তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতু রেললাইন চালু হয়েছে। উদ্বোধনের চার মাসের মাথায় এই নতুন রেলপথের ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলার শহীদনগর, বারইপটল, হেমনগর ও ভূঞাপুর স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব ও সময়মতো ট্রেন চলাচল না করায় অধিকাংশ সময়ই স্টেশনগুলো বন্ধ থাকছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ও পণ্য সরবরাহের সুবিধার জন্য ২২০ কোটি টাকা খরচে বাস্তবায়িত ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ গত ৩০ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
রেলের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ কে এম মাহবুবুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মন্ত্রী বারবার বদল হলে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল ও পদ্ধতি পাল্টাতে হয়। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। তবে আমরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথেষ্ট তৎপর।'
বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন বসিয়ে এ অঞ্চলে রেলপথের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই খাতের যা কিছু অগ্রগতি তার প্রায় সবই হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মোট দুই হাজার ৬০৪ কিলোমিটার রেলপথ ছিল। এরপর পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে রেলপথের দৈর্ঘ্য বেড়েছে আড়াই শ কিলোমিটার। আর বাংলাদেশের ৪১ বছরে কমেছে প্রায় ২৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে পরিত্যক্ত পথ কমপক্ষে ৩০০ কিলোমিটার। আর সড়কপথ এখন বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার।
স্বাধীনতার পর রেল খাতে দুর্দশার শুরু। ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পদ্মা পেরিয়েছিল রেলপথ। আর যমুনা নদী পার হতে সময় লাগল ৭০ বছরের বেশি। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলসংযোগ ছাড়া স্বাধীনতার পর রেল খাতে উল্লেখযোগ্য আর কোনো সংযোজন নেই। সম্প্রসারণ দূরে থাক বরং অনেক শাখা লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন কমেছে। কমেছে জনবল। সময়সূচি বা যাত্রীসেবা বলতে আর কিছু নেই বললেই চলে।
রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন তৈরি ও মেরামতের জন্য সারা দেশে ছয়টি কারখানাকে কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এগুলোর আধুনিকায়নেও নেই বিনিয়োগ। বরং বিদেশি অনুদান বা ঋণে নতুন নতুন ক্রয় প্রকল্পেই যাবতীয় আগ্রহ সব সরকারের।
রেলের অপারেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এখন গড়ে ৩০ শতাংশ ট্রেনের জন্য ইঞ্জিনই পাওয়া যায় না। যদিও বা মেলে, পথে নেমে প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ে সেগুলো। বিকল হয়ে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে মাসে গড়ে ২৫টি। নতুন ইঞ্জিন আনার প্রকল্পগুলো ঝুলে থাকায় ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বারবার মন্ত্রী বদলের কারণে ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রেনের সময়সূচি রক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন পাওয়া গেলে সময়সূচি শত ভাগ রক্ষা করা যাবে। আমরা সে জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। ৪৪৩টি স্টেশনের মধ্যে ১৫৩টি এখন বন্ধ।' আরো কয়েকটি স্টেশন বন্ধের পথে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনবল সংকটের কারণে বন্ধ স্টেশনগুলো চালু করা যাচ্ছে না। আইনিসহ বিভিন্ন জটিলতায় জনবল সংকটও মেটানো যাচ্ছে না।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, রেলে দিন দিন যাত্রী বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী পরিবহনক্ষমতা বাড়ছে না। তবে নতুন ইঞ্জিন ও কোচ কেনার প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। আর পুরনো রেলপথ বন্ধ হয়েছে লোকসানের কারণে।
No comments