জানুন, নিয়ন্ত্রণ করুন- ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়েছে কয়েক বছর করে। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে,
মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাক্সিক্ষত হারের চেয়ে বেশি হারে, মানুষের দৈহিক শ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ, সর্বোপরি বেশিসংখ্যায় রোগ শনাক্ত করা যাচ্ছে যেটা আগে এতটা ছিল না।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস (টাইপ২) হওয়ার কিছুটা চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে। উন্নত দেশে মহিলাদের বেশি সংখ্যায় টাইপ২ ডায়াবেটিসে ভুগতে দেখা যায়, আর উন্নয়নশীল দেশে পুরুষরা টাইপ২ ডায়াবেটিসে বেশি সংখ্যায় ভুগে। আগের তথ্যটি কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যেরই প্রকাশ ঘটায়। যেমন খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম, আনুপাতিক হারে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায় কিছুটা ভিন্নতর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ/অভ্যাস দেখা যায়। আর টাইপ২ ডায়াবেটিস জনিত জটিলতায় ভোগার হার ও প্রাবল্যও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখার প্রায় ৬% ডায়াবেটিসে ভুগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে অর্থাৎ তখন বাংলাদেশে দু’কোটির বেশি ডায়াবেটিক রোগী থাকবে।
ডায়াবেটিসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ডায়াবেটিসের কোন উপসর্গ থাক বা না থাক, যে কোন অপারেশন বা অন্যান্য অসুখে রক্তের গ্লুকোজ মাপাটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে অনেকেই হয়ত মনোক্ষুণ্ণ হন; কিন্তু তাতে রোগীরই লাভ। কেননা শুরুতে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর ডায়াবেটিস ধরা পড়তে দেরি হলে অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি সাধিত হবে।
খালি পেটে (কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর) রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ ৩.৫ থেকে ৫.৫ মিলিমোল/লিটার ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে পাঁচ মিনিট ধরে খাবার ২ ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ হবে ৭.৮ মিলিমোল/লিটার সর্বোচ্চ। যদি খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৫.৫ থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লিটার বা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোল/লিটার হয়, তাকে বলা হবে ওএঞ (ওসঢ়ধৎবফ এষঁপড়ংব ঞড়ষবৎবহপব); এদের এক-তৃতীয়াংশ পরবর্তীতে পরিপূর্ণভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আর এক-তৃতীয়াংশ এ অবস্থাতেই থেকে যায়। বাকি এক-তৃতীয়াংশ স্বাভাবিক অবস্থায়ই থাকে। খালিপেটে রক্ত পরীক্ষায় যদি গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.০ মিলিমোল/লিটারের বেশি হয় অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমোল/লিটার এর বেশি হয়, তবে তার ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নেয়া হবে।
ডায়াবেটিস : কারণ ও লক্ষণ
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ডায়াবেটিসের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মধ্যেও ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে তবে তা এতটা আতঙ্কজনক হারে নয়। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৩৫%-ই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী। বাংলাদেশও এর মধ্যে রয়েছে। এসব মানুষের একটি বড় অংশ বাস করে শহরাঞ্চলে বা উপশহরাঞ্চলে। তবে একটু সচেতন হলেই রুখে দেয়া যেতে পারে এ ব্যাপক বিস্তারি ডায়াবেটিসকে-আছে নিয়ন্ত্রণের নানা পথ। ডায়াবেটিস ও তার প্রতিরোধের উপায় নিয়ে এখানে আলোচনা করছি।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ
দিন দিন খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে! হঠাৎ হজম শক্তি বেড়ে গেল নাকি; কিন্তু এত খাবার যাচ্ছে কোথায়, হাতি-লোফা মোবারকের মতো না, চেহারা হচ্ছে তালপাতার সেপাইয়ের মতো। ডায়াবেটিসের অন্যতম লক্ষণ অনেকটা এ রকমই। তাছাড়া আছে ঘন প্রস্রাব হওয়া, দুর্বলতা বোধ করা, ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া ইত্যাদি। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে খিদে ও জল তেষ্টা বেড়ে যায়। আর বহুবার মূত্রালয়ে দৌড়াতে হয়। এ জন্য এ সমস্যাকে অনেকে বহুমূত্র রোগ বলে থাকেন। কারও কারও দুর্বলতা এত বেশি হয় যে, কোন ভারি বা বাড়তি কাজ-কর্ম ছাড়াই যখন তখন হাঁফ ধরে যায়। কারও কারও আবার বারে বারে শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বকে নানা রকম জীবাণু সংক্রমণ ও ফোঁড়া হয়। মধুমেহের উপসর্গের তালিকা আরও বড়। ডায়াবেটিস হলে অনেকেরই অন্যান্য উপসর্গ তেমন একটা থাকে না, শুধু বার বার চশমার পাওয়ার বদল করতে হয়। কারও বা কোন ছোট কাটা বা জুতোর ফোসকা সহজে সারে না, ঘা হয়ে যায়; কারও মাথা ঘোরে, অনেকেরই সহবাসে অনীহা দেখা দেয়। কোন অসুখের জন্য বা অপারেশনের আগে রুটিন রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অনেকের।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করতে গিয়ে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করকে প্রথমেই; তবেই ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে টেকনিক্যাল মনিটরিং।
রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনটি পদ্ধতির একেকটি পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা যায়, অথবা কারও কারও জন্য যে কোন দুইটি বা তিনটিই ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা একটি একটি করে আলোচনা করছি।
(ক) খাদ্যাভাসের পরিবর্তন
(খ) নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম
(গ) ওষুধ গ্রহণ করা
ক. খাদ্যাভাসের পরিবর্তন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বেলায় একটি কথা কখনই ভুললে চলবে না যে শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে পুরোটা কাজ আদায় করা সম্ভব নয়। অন্য দু’টি মাধ্যমও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, যাদের তেমন কোন জটিলতা দেখা দেয় নাই এবং যারা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে নেইÑ তাদের বেলায় প্রথম দিকে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এতে কাজও হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে তার জন্য উপযোগী খাদ্যদ্রব্যগুলো কি কি, কোন কোন খাবার অল্প পরিমাণে পাওয়া যাবে, কোন কোন খাবার মোটেই খাওয়া যাবে না সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। রোগী যদি ব্যাপারটি ঠিকমতো বুঝতে পারে এবং এটি করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তবে এতে খুব ভাল কাজ দিবে।
রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য মূলত শর্করা জাতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করার দরকার হলেও অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহণের হারও কিছুটা পরিবর্তিত হবে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর ওজন স্বাভাবিক, তাদের বয়স ও উচ্চতা হিসেব করে তার জন্য আদর্শ ক্যালরি থেকে ২০০-৩০০ ক্যালরি বাদ দিয়ে প্রতিদিন গ্রহণ করতে হবে। এজন্য শর্করা যেমন কমবে, চর্বি জাতীয় খাদ্যও তেমনি কমবে। এর জন্য ভাত, রুটি, আলু আগের চেয়ে কম খেতে হবে। সরাসরি চিনি বা গ্লুকোজ পাওয়া যায় তেমন খাদ্য বর্জন করতে হবে বা খুব কম পরিমাণে খেতে হবে। ফলে মিষ্টি, সরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ও এ জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি খাওয়া অনেক কমাতে হবে। চর্বি জাতীয় খাদ্য যেমনÑ মাংসের চর্বি, হাঁস মুরগির চামড়া, ঘি, ডালডা, মাখন, পনির ইত্যাদি খাওয়াও খুব কমিয়ে আনতে হবে। তবে ভোজ্য তেল (উদ্ভিদ) পরিমাণমত খাওয়া যাবে। মাছের চর্বি বরং ভাল। মাছ ও মাংস কম পরিমাণে প্রতিদিন খাওয়া যাবে। তবে ফাস্টফুড জাতীয় খাদ্য ও কোমল পানীয় পুরোপুরি বর্জন করতে হবে। ফাস্টফুড প্রচুর ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার এবং এগুলো খাবার পর আমরা ভুলে যাই যে, ক্যালরির বিশাল উৎস আমরা গলাধকরণ করছি। আর এতে যে মিয়োনেজ থাকে, তাতে প্রচুর কোলেস্টেরল আছে। এসব কমিয়ে তাজা শাকসবজি, ফলমূল বেশি করে খাওয়ার অভ্যেস করতে হবে। যত শাকসবজি খাওয়া যাবে তত ভাল। তার থেকে আমরা প্রচুর ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, আঁশ পাব এবং খুব কম পরিমাণে ক্যালারি পাব। সে জন্য ডায়াবেটিক রোগীদের তো বটেই, সকল মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ বয়সী লোককে তার খাদ্য তালিকায় মাছ মাংসকে শাকসবজি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে বলা হয়। আর ফলমূল খাবার বেলায় কিছুটা হিসেব রাখতে হবে। যেসব ফলে চিনি কম/মিষ্টি নয়/পাকলে মিঠা হয় না, সেগুলো যত ইচ্ছে খাওয়া যাবে। এর মধ্যে আছে আপেল, পেয়ারা, বাতাবি লেবু, আমলকী ইত্যাদি। আর যেসব ফলে প্রচুর মিষ্টি আছে, সেগুলো সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। যেমন একটি মাঝারি আকারের পাঁকা আম প্রতিদিন খাওয়া যাবে, ২ কোষ কাঁঠাল, ১ টুকরো পেঁপে, একটি কমলা, ১টি কলা, তরমুজ ২/৩টি আঙুর প্রতিদিন খাওয়া যাবে। তবে একই দিনে ১টির বেশি এসব ফল খাওয়া যাবে না। প্রচুর পরিমাণে শসা খাওয় যাবে। তবে ডাব একদিনে ১টির বেশি খাওয়া মোটেও উচিত হবে না। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশী ফলগুলো সব দিক দিয়েই ভাল।
আরও আছে খাবারের সময় বিবেচনা। অন্য দশ জন মানুষের হয়ত দিনে ৩ বার খেলেই চলে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের দিনের মোট গৃহীত পরিমাণকে প্রায় সমান সময়ের ব্যবধানে ভাগ করে নিতে হবে; যাতে একবারে খুব বেশি খাদ্য গ্রহণ না হয় অথবা অন্য সময় শরীর শর্করা অভাবে ভোগে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)। আমাদের খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে ৩টি প্রধান খাদ্য ও ২টি ছোট খাদ্যে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। দৈনিক মোট গৃহীত ক্যালরির ২৫% সকালে, ৩০% দুপুরে ও রাতে ২০% সকাল ১১টার দিকে ১৫% এবং ১০% সন্ধ্যার দিকে দিতে হবে। কোনভাবেই দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা যাবে না অর্থাৎ নির্ধারিত খাবার কোন কারণেই যেন বাদ না পড়ে সেদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে।
খ. শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম
ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই নিয়মিত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। যদি কারো শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয় বা হাঁটার বা অন্য কোন শারীরিক শ্রম/ব্যায়াম করার মতো অবস্থা না থাকে তবে হয়ত রেহাই নিতে পারেন। শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম বিভিন্নভাবেই হতে পারে। সেটা ব্যায়ামাগারে গিয়ে সুশৃঙ্খল ব্যায়ামও হতে পারে; বাসায় ব্যায়াম হতে পারে অথবা অন্য কোন শ্রম করার কাজ হতে পারে। যাদের পক্ষে এরূপ সুশৃঙ্খল ব্যায়াম করা সম্ভব, তাদের জন্যই সেটাই উত্তম। আর যাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, তাদের জন্য হাঁটা হলো সবচেয়ে ভাল। হাঁটা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। কখন হাঁটবেন সেটা ঠিক করে নিতে হবে ডায়াবেটিস রোগীকেই। সকাল-বিকেল, সন্ধ্যা বা রাত যে কোন সময়ই হাঁটতে পারবেন। আপনার প্রাত্যহিক কর্মকা-ের সঙ্গে হাঁটার সময়টি ঠিক করে নিন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন হাঁটতে হবে। প্রতিবার হাঁটার গতি এমন হবে যেন তিনি ৪০ মিনিটে ৩ মাইল যেতে পারেন। আরেকটি হিসেব আছে। হাঁটার মাঝপথে হৃদস্পন্দন দেখা যেতে পারে। এ সময় হৃদস্পন্দন হতে পারে (২২০ - রোগীর বয়স)/ মিনিট। সাধারণ হাঁটাহাঁটির তালে হেঁটে কেউ যদি ধরে নেন যে, তার হাঁটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে তবে তা হবে না। সাঁতার বা জগিং ধরনের জটিল ব্যায়াম ও উপকারী।
গ. ওষুধ সেবন
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আর শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম দিয়ে কাক্সিক্ষত মাত্রায় রক্তের গ্লুকোজ পাওয়া যাচ্ছে; না যারা কোন স্ট্রোসের মধ্যে আছেন বা জরুরী অবস্থায় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ওষুধ দু’ধরনের আছে- খাবার ওষুধ ও ইনসুলিন। কার জন্য কোনটা প্রযোজ্য সেটা ডাক্তার ঠিক করে দেবেন। তিনি ওষুধের পরিমাণ, সেবনের সময় ও অন্যান্য উপদেশও দেবেন। আবার এ ব্যাপারে একটি কথা দয়া করে মনে রাখবেন, নিজের মতো করে ডায়াবেটিসের কোন ওষুধ খাবেন না বা ইনসুলিন কমাবেন না বা বাড়াবেন না। এতে যে কোন সময় বড় ধরনের কোন বিপদে পড়তে পারেন। সমস্যা হলে আপনার ডাক্তারকে জানান। তিনিই এটির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
শুধুমাত্র খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে বেশকিছু ডায়াবেটিক রোগী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। এর সঙ্গে শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম করতে হবে। আর এতে কাজ না হলে মুখে খাবার ওষুধ বা ইনসুলিন নিতে হবে। কারও কারও জন্য সবকটি উপায়ই প্রয়োজন হয়।
ঘ শৃংখলা :
শৃংখলা ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। রোগীকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে শৃংখলা মেনে চলতে হবে। তবে কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, যেমন- ১) নিয়মিত ও পরিমাণ মতো সুষম খাবার খেতে হবে, ২) নিয়মিত ও পরিমাণ মতো ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করতে হবে, ৩) চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র সৃষ্ঠভাবে মেনে চলতে হবে, ৪) শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, ৫) পায়ের বিশেষ যতœ নিতে হবে, ৬) নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হবে এবং ফলাফল প্রস্রাব পরীক্ষার বইতে লিখে রাখতে হবে, ৭) চিনি, মিষ্টি, গুড়, মধুযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ ছাড়তে হবে, ৮) শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, ৯) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন কারণেই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না, ১০) তাৎক্ষণিক রক্তে শর্করা পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে নিজে নিজেই রক্তের শর্করা পরিমাপ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল, ১১) রক্তে শর্করা পরিমাপক বিশেষ কাঠি দিয়েও তাৎক্ষণিকভাবে রক্তের শর্করা পরিমাপ করা যায়। রক্তে তাৎক্ষণিক শর্করা পরিমাপক যন্ত্র এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে।
(ঙ) শিক্ষা
ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যবস্থাগুলো রোগীকেই নিজ দায়িত্বে মেনে চলতে হবে এবং রোগীর পরিবারের নিকট সদস্যদের সহযোগিতা এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করতে পারে। তাই এ রোগের সুচিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি রোগীর নিকট আত্মীয়দেরও এই রোগ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার। কারণ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
ডা. শাহজাদা সেলিম
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বারডেম হাসপাতাল
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস (টাইপ২) হওয়ার কিছুটা চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে। উন্নত দেশে মহিলাদের বেশি সংখ্যায় টাইপ২ ডায়াবেটিসে ভুগতে দেখা যায়, আর উন্নয়নশীল দেশে পুরুষরা টাইপ২ ডায়াবেটিসে বেশি সংখ্যায় ভুগে। আগের তথ্যটি কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যেরই প্রকাশ ঘটায়। যেমন খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম, আনুপাতিক হারে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায় কিছুটা ভিন্নতর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ/অভ্যাস দেখা যায়। আর টাইপ২ ডায়াবেটিস জনিত জটিলতায় ভোগার হার ও প্রাবল্যও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখার প্রায় ৬% ডায়াবেটিসে ভুগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে অর্থাৎ তখন বাংলাদেশে দু’কোটির বেশি ডায়াবেটিক রোগী থাকবে।
ডায়াবেটিসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ডায়াবেটিসের কোন উপসর্গ থাক বা না থাক, যে কোন অপারেশন বা অন্যান্য অসুখে রক্তের গ্লুকোজ মাপাটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে অনেকেই হয়ত মনোক্ষুণ্ণ হন; কিন্তু তাতে রোগীরই লাভ। কেননা শুরুতে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর ডায়াবেটিস ধরা পড়তে দেরি হলে অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি সাধিত হবে।
খালি পেটে (কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর) রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ ৩.৫ থেকে ৫.৫ মিলিমোল/লিটার ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে পাঁচ মিনিট ধরে খাবার ২ ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ হবে ৭.৮ মিলিমোল/লিটার সর্বোচ্চ। যদি খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৫.৫ থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লিটার বা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোল/লিটার হয়, তাকে বলা হবে ওএঞ (ওসঢ়ধৎবফ এষঁপড়ংব ঞড়ষবৎবহপব); এদের এক-তৃতীয়াংশ পরবর্তীতে পরিপূর্ণভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আর এক-তৃতীয়াংশ এ অবস্থাতেই থেকে যায়। বাকি এক-তৃতীয়াংশ স্বাভাবিক অবস্থায়ই থাকে। খালিপেটে রক্ত পরীক্ষায় যদি গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.০ মিলিমোল/লিটারের বেশি হয় অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমোল/লিটার এর বেশি হয়, তবে তার ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নেয়া হবে।
ডায়াবেটিস : কারণ ও লক্ষণ
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ডায়াবেটিসের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের মধ্যেও ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে তবে তা এতটা আতঙ্কজনক হারে নয়। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৩৫%-ই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী। বাংলাদেশও এর মধ্যে রয়েছে। এসব মানুষের একটি বড় অংশ বাস করে শহরাঞ্চলে বা উপশহরাঞ্চলে। তবে একটু সচেতন হলেই রুখে দেয়া যেতে পারে এ ব্যাপক বিস্তারি ডায়াবেটিসকে-আছে নিয়ন্ত্রণের নানা পথ। ডায়াবেটিস ও তার প্রতিরোধের উপায় নিয়ে এখানে আলোচনা করছি।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ
দিন দিন খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে! হঠাৎ হজম শক্তি বেড়ে গেল নাকি; কিন্তু এত খাবার যাচ্ছে কোথায়, হাতি-লোফা মোবারকের মতো না, চেহারা হচ্ছে তালপাতার সেপাইয়ের মতো। ডায়াবেটিসের অন্যতম লক্ষণ অনেকটা এ রকমই। তাছাড়া আছে ঘন প্রস্রাব হওয়া, দুর্বলতা বোধ করা, ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া ইত্যাদি। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে খিদে ও জল তেষ্টা বেড়ে যায়। আর বহুবার মূত্রালয়ে দৌড়াতে হয়। এ জন্য এ সমস্যাকে অনেকে বহুমূত্র রোগ বলে থাকেন। কারও কারও দুর্বলতা এত বেশি হয় যে, কোন ভারি বা বাড়তি কাজ-কর্ম ছাড়াই যখন তখন হাঁফ ধরে যায়। কারও কারও আবার বারে বারে শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বকে নানা রকম জীবাণু সংক্রমণ ও ফোঁড়া হয়। মধুমেহের উপসর্গের তালিকা আরও বড়। ডায়াবেটিস হলে অনেকেরই অন্যান্য উপসর্গ তেমন একটা থাকে না, শুধু বার বার চশমার পাওয়ার বদল করতে হয়। কারও বা কোন ছোট কাটা বা জুতোর ফোসকা সহজে সারে না, ঘা হয়ে যায়; কারও মাথা ঘোরে, অনেকেরই সহবাসে অনীহা দেখা দেয়। কোন অসুখের জন্য বা অপারেশনের আগে রুটিন রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অনেকের।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করতে গিয়ে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করকে প্রথমেই; তবেই ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে টেকনিক্যাল মনিটরিং।
রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনটি পদ্ধতির একেকটি পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা যায়, অথবা কারও কারও জন্য যে কোন দুইটি বা তিনটিই ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা একটি একটি করে আলোচনা করছি।
(ক) খাদ্যাভাসের পরিবর্তন
(খ) নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম
(গ) ওষুধ গ্রহণ করা
ক. খাদ্যাভাসের পরিবর্তন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বেলায় একটি কথা কখনই ভুললে চলবে না যে শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে পুরোটা কাজ আদায় করা সম্ভব নয়। অন্য দু’টি মাধ্যমও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, যাদের তেমন কোন জটিলতা দেখা দেয় নাই এবং যারা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে নেইÑ তাদের বেলায় প্রথম দিকে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এতে কাজও হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে তার জন্য উপযোগী খাদ্যদ্রব্যগুলো কি কি, কোন কোন খাবার অল্প পরিমাণে পাওয়া যাবে, কোন কোন খাবার মোটেই খাওয়া যাবে না সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। রোগী যদি ব্যাপারটি ঠিকমতো বুঝতে পারে এবং এটি করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তবে এতে খুব ভাল কাজ দিবে।
রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য মূলত শর্করা জাতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করার দরকার হলেও অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহণের হারও কিছুটা পরিবর্তিত হবে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর ওজন স্বাভাবিক, তাদের বয়স ও উচ্চতা হিসেব করে তার জন্য আদর্শ ক্যালরি থেকে ২০০-৩০০ ক্যালরি বাদ দিয়ে প্রতিদিন গ্রহণ করতে হবে। এজন্য শর্করা যেমন কমবে, চর্বি জাতীয় খাদ্যও তেমনি কমবে। এর জন্য ভাত, রুটি, আলু আগের চেয়ে কম খেতে হবে। সরাসরি চিনি বা গ্লুকোজ পাওয়া যায় তেমন খাদ্য বর্জন করতে হবে বা খুব কম পরিমাণে খেতে হবে। ফলে মিষ্টি, সরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ও এ জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি খাওয়া অনেক কমাতে হবে। চর্বি জাতীয় খাদ্য যেমনÑ মাংসের চর্বি, হাঁস মুরগির চামড়া, ঘি, ডালডা, মাখন, পনির ইত্যাদি খাওয়াও খুব কমিয়ে আনতে হবে। তবে ভোজ্য তেল (উদ্ভিদ) পরিমাণমত খাওয়া যাবে। মাছের চর্বি বরং ভাল। মাছ ও মাংস কম পরিমাণে প্রতিদিন খাওয়া যাবে। তবে ফাস্টফুড জাতীয় খাদ্য ও কোমল পানীয় পুরোপুরি বর্জন করতে হবে। ফাস্টফুড প্রচুর ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার এবং এগুলো খাবার পর আমরা ভুলে যাই যে, ক্যালরির বিশাল উৎস আমরা গলাধকরণ করছি। আর এতে যে মিয়োনেজ থাকে, তাতে প্রচুর কোলেস্টেরল আছে। এসব কমিয়ে তাজা শাকসবজি, ফলমূল বেশি করে খাওয়ার অভ্যেস করতে হবে। যত শাকসবজি খাওয়া যাবে তত ভাল। তার থেকে আমরা প্রচুর ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, আঁশ পাব এবং খুব কম পরিমাণে ক্যালারি পাব। সে জন্য ডায়াবেটিক রোগীদের তো বটেই, সকল মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ বয়সী লোককে তার খাদ্য তালিকায় মাছ মাংসকে শাকসবজি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে বলা হয়। আর ফলমূল খাবার বেলায় কিছুটা হিসেব রাখতে হবে। যেসব ফলে চিনি কম/মিষ্টি নয়/পাকলে মিঠা হয় না, সেগুলো যত ইচ্ছে খাওয়া যাবে। এর মধ্যে আছে আপেল, পেয়ারা, বাতাবি লেবু, আমলকী ইত্যাদি। আর যেসব ফলে প্রচুর মিষ্টি আছে, সেগুলো সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। যেমন একটি মাঝারি আকারের পাঁকা আম প্রতিদিন খাওয়া যাবে, ২ কোষ কাঁঠাল, ১ টুকরো পেঁপে, একটি কমলা, ১টি কলা, তরমুজ ২/৩টি আঙুর প্রতিদিন খাওয়া যাবে। তবে একই দিনে ১টির বেশি এসব ফল খাওয়া যাবে না। প্রচুর পরিমাণে শসা খাওয় যাবে। তবে ডাব একদিনে ১টির বেশি খাওয়া মোটেও উচিত হবে না। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশী ফলগুলো সব দিক দিয়েই ভাল।
আরও আছে খাবারের সময় বিবেচনা। অন্য দশ জন মানুষের হয়ত দিনে ৩ বার খেলেই চলে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের দিনের মোট গৃহীত পরিমাণকে প্রায় সমান সময়ের ব্যবধানে ভাগ করে নিতে হবে; যাতে একবারে খুব বেশি খাদ্য গ্রহণ না হয় অথবা অন্য সময় শরীর শর্করা অভাবে ভোগে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)। আমাদের খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসের সাথে তাল মিলিয়ে ৩টি প্রধান খাদ্য ও ২টি ছোট খাদ্যে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। দৈনিক মোট গৃহীত ক্যালরির ২৫% সকালে, ৩০% দুপুরে ও রাতে ২০% সকাল ১১টার দিকে ১৫% এবং ১০% সন্ধ্যার দিকে দিতে হবে। কোনভাবেই দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা যাবে না অর্থাৎ নির্ধারিত খাবার কোন কারণেই যেন বাদ না পড়ে সেদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখতে হবে।
খ. শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম
ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই নিয়মিত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। যদি কারো শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয় বা হাঁটার বা অন্য কোন শারীরিক শ্রম/ব্যায়াম করার মতো অবস্থা না থাকে তবে হয়ত রেহাই নিতে পারেন। শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম বিভিন্নভাবেই হতে পারে। সেটা ব্যায়ামাগারে গিয়ে সুশৃঙ্খল ব্যায়ামও হতে পারে; বাসায় ব্যায়াম হতে পারে অথবা অন্য কোন শ্রম করার কাজ হতে পারে। যাদের পক্ষে এরূপ সুশৃঙ্খল ব্যায়াম করা সম্ভব, তাদের জন্যই সেটাই উত্তম। আর যাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, তাদের জন্য হাঁটা হলো সবচেয়ে ভাল। হাঁটা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। কখন হাঁটবেন সেটা ঠিক করে নিতে হবে ডায়াবেটিস রোগীকেই। সকাল-বিকেল, সন্ধ্যা বা রাত যে কোন সময়ই হাঁটতে পারবেন। আপনার প্রাত্যহিক কর্মকা-ের সঙ্গে হাঁটার সময়টি ঠিক করে নিন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন হাঁটতে হবে। প্রতিবার হাঁটার গতি এমন হবে যেন তিনি ৪০ মিনিটে ৩ মাইল যেতে পারেন। আরেকটি হিসেব আছে। হাঁটার মাঝপথে হৃদস্পন্দন দেখা যেতে পারে। এ সময় হৃদস্পন্দন হতে পারে (২২০ - রোগীর বয়স)/ মিনিট। সাধারণ হাঁটাহাঁটির তালে হেঁটে কেউ যদি ধরে নেন যে, তার হাঁটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে তবে তা হবে না। সাঁতার বা জগিং ধরনের জটিল ব্যায়াম ও উপকারী।
গ. ওষুধ সেবন
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আর শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম দিয়ে কাক্সিক্ষত মাত্রায় রক্তের গ্লুকোজ পাওয়া যাচ্ছে; না যারা কোন স্ট্রোসের মধ্যে আছেন বা জরুরী অবস্থায় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ওষুধ দু’ধরনের আছে- খাবার ওষুধ ও ইনসুলিন। কার জন্য কোনটা প্রযোজ্য সেটা ডাক্তার ঠিক করে দেবেন। তিনি ওষুধের পরিমাণ, সেবনের সময় ও অন্যান্য উপদেশও দেবেন। আবার এ ব্যাপারে একটি কথা দয়া করে মনে রাখবেন, নিজের মতো করে ডায়াবেটিসের কোন ওষুধ খাবেন না বা ইনসুলিন কমাবেন না বা বাড়াবেন না। এতে যে কোন সময় বড় ধরনের কোন বিপদে পড়তে পারেন। সমস্যা হলে আপনার ডাক্তারকে জানান। তিনিই এটির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
শুধুমাত্র খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে বেশকিছু ডায়াবেটিক রোগী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। এর সঙ্গে শারীরিক শ্রম ও ব্যায়াম করতে হবে। আর এতে কাজ না হলে মুখে খাবার ওষুধ বা ইনসুলিন নিতে হবে। কারও কারও জন্য সবকটি উপায়ই প্রয়োজন হয়।
ঘ শৃংখলা :
শৃংখলা ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। রোগীকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে শৃংখলা মেনে চলতে হবে। তবে কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, যেমন- ১) নিয়মিত ও পরিমাণ মতো সুষম খাবার খেতে হবে, ২) নিয়মিত ও পরিমাণ মতো ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করতে হবে, ৩) চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র সৃষ্ঠভাবে মেনে চলতে হবে, ৪) শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, ৫) পায়ের বিশেষ যতœ নিতে হবে, ৬) নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হবে এবং ফলাফল প্রস্রাব পরীক্ষার বইতে লিখে রাখতে হবে, ৭) চিনি, মিষ্টি, গুড়, মধুযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ ছাড়তে হবে, ৮) শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, ৯) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন কারণেই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না, ১০) তাৎক্ষণিক রক্তে শর্করা পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে নিজে নিজেই রক্তের শর্করা পরিমাপ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল, ১১) রক্তে শর্করা পরিমাপক বিশেষ কাঠি দিয়েও তাৎক্ষণিকভাবে রক্তের শর্করা পরিমাপ করা যায়। রক্তে তাৎক্ষণিক শর্করা পরিমাপক যন্ত্র এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে।
(ঙ) শিক্ষা
ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যবস্থাগুলো রোগীকেই নিজ দায়িত্বে মেনে চলতে হবে এবং রোগীর পরিবারের নিকট সদস্যদের সহযোগিতা এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করতে পারে। তাই এ রোগের সুচিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি রোগীর নিকট আত্মীয়দেরও এই রোগ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার। কারণ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
ডা. শাহজাদা সেলিম
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বারডেম হাসপাতাল
No comments