মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-স্ত্রীর ভিক্ষায় চলে নূরের সংসার by তারেক আলম
'১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর মধুমতীর কালনা ঘাটে যুদ্ধ হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। আমি ছিলাম আমাদের গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার। গুলি চালানোর সময় দু-একজন মাথা জাইগে (জাগিয়ে) দেখার চেষ্টা করছিল। ওগো মাথা জাগাইতে মানা করি। কথা না শুনে হাবিবুর মাথা উঁচু করে।
কপাল বরাবর গুলি লাগে ওর। আমার লাগে বুক বরাবর। আল্লাহর রহমত, গুলিডা বুকের ডানপাশে চামড়া ছিলে চলে যায়। দেহি রক্তে ভিজে যাচ্ছে।
সেদিক খেয়াল করার সময় নাই। এক সময় দুই পক্ষের গুলি ফুরোয়। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। তিন খানসেনার লাশ পাই, আর তিনজনকে ধইরে ফেলি। কয়জন পালায়ে যায়।' ৮০ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন ৪১ বছর আগের যুদ্ধের স্মৃতি। কথা বলার সময় চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন যুদ্ধক্ষেত্রেই আছেন।
কালনার ওই যুদ্ধক্ষেত্রের চার কিলোমিটার পশ্চিমে নড়াইল-লোহাগড়া সড়কের মাইটকুমড়া অশ্রায়ণ কেন্দ্রে বসে মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম জানান, ভিটেমাটি হারিয়ে ১৩ বছর ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে এ আশ্রয় কেন্দ্রে বাস করছেন তিনি। তাঁদের বাড়ি ছিল লোহাগড়া উপজেলার চাচই গ্রামে। ১৯৭১ সালে লোহাগড়া বাজারের বটতলায় রুটি বানিয়ে বিক্রি করতেন তিনি। নূর ইসলামের ভাষায়, 'নিজ হাতে বানানো রুটি আর গোস্তের ছালুন (তরকারি) খেতে আইসত নানা পেশার মানুষ। ব্যবসার অবস্থা তখন রমরমা। এরই মইধ্যে পাকিস্তানিরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালাতে শুরু করে। এক রাতে রাজাকাররা নিতে আসে আমারে। কিন্তু রাজাকারের খাতায় নাম লেখানোর ইচ্ছে ছিল না, তাই ওই রাইতেই বাড়ি থেকে পালাই। পরে কয়েকজনের সঙ্গে চইলে যাই ভারতে। সেখানে লে. মতিয়ার রহমানের সাহায্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসি। নাইমে পড়ি মুক্তিযুদ্ধে।'
দেশ স্বাধীন হলে নূর ইসলাম আবার ফিরে যান পুরনো পেশায়। ভাতের হোটেল দেন লোহাগড়া বাজারের বর্তমান পান হাটের পাশে। স্বাধীন দেশে ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু জমির দখল নিয়ে মামলা শুরু হয়। মামলায় জিতলেও জায়গাটি ধরে রাখতে পারেননি তিনি। প্রতিপক্ষের কুটচালে জায়গা থেকে বিতাড়িত হন। অভাবের সংসারে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। অভাবের তাড়নায় বিনা চিকিৎসায় প্রথম স্ত্রী আনোয়ারা বেগম মারা যান ১৯৯৪ সালে। বড় মেয়ে নাসিমাও মারা গেছেন। দুই ছেলে শহিদুল ইসলাম আর আমিনুল ইসলাম আলাদা থাকেন। তাঁরাও দিন এনে দিন খান। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হেনা বেগম আর ৮-৯ বছর বয়সী ছেলে রকিবুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর এখনকার সংসার। স্ত্রী কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। কাজ না থাকলে ভিক্ষাও করেন। স্ত্রীর রোজগার আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হিসেবে পাওয়া টাকায় চলে তাঁর সংসার।
যুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে নূর ইসলাম বলেন, 'নড়ালের ট্রেজারি লুট, কালনার যুদ্ধ, লোহাগড়া মুক্ত করার যুদ্ধ ও নড়াল মুক্ত করার যুদ্ধ করছি। মতিয়ার ভাই কতো (বলত)_মিয়া ভাই সাথের পোলাপানগুলোরে একটু দেইখে রাইখো। আমি সবাইরে দেইখে রাখতি পারিনি। কেউ গুলি খায়ে মরছে (শহীদ), কারও পাজর ফুটো হয়ে গেছে। গুলিতে আমার বুকের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। সেই চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি।'
সরেজমিন মাইটকুমড়া আশ্রয়ণ কেন্দ্রে গিয়ে নূর ইসলামের দৈন্যদশার চিত্র দেখা গেছে। ওই কেন্দ্রে তিনি যে ঘরে থাকেন, তাতে বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। আক্ষেপ নিয়েই তিনি বলেন, 'আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছি। বাংলা স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না বলে ওয়াদা করিছিলাম। স্বাধীন কইরেই ঘরে ফিরিছিলাম। কিন্তু সেই ঘর ধইরে রাখতি পারলাম না। ঘরে একখান চাল দিয়ার ক্ষেমতা নাই। তাই এহানে মাথা গুজিছি। এখন এহানে আছি। তাও কি থাহা যায়!' তবে ওই আশ্রয়ণ কেন্দ্রের অন্যরা নূর ইসলামাকে খুব ভালোবাসেন। ব্যারাকের সামনের দোকানদার রমজান বিশ্বাস বলেন, 'একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা সবাই তাঁকে দেখেশুনে রাখি। মাঝেমাঝে তাঁর যায়যায় দশা হয়।'
নূর ইসলাম তাঁর জীবনের গল্প বলেন এভাবে, 'ছাওয়াল দুডোরে স্কুলে পাঠালাম। লেহাপড়া শেষ করতে পারেনি। বউডার পেটে ব্যথা। ওষুধ কিনে দিতি পারিনি। পেটের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারে শেষে একদিন গলায় দড়ি নিয়ে মরল। ছাওয়াল দুডোও দূরে সরে গেল। শেষে আবার একডা বিয়া করলাম। এই বউও আমার লক্ষ্মী। যে কাজ কবেন, সে কাজ কইরে দেবে। বাসাবাড়িতে কাজ করে। সবাই তারে পাগলি কয়। আমি তো ঠিকমতো হাটতি পারি না। ভিক্ষে করতিও পারি না। তাই আমার পাগলিডা আমাগে খাওয়ায়ে বাঁচায়ে রাখিছে। ও যহন কিছু পারে না, খাতি দেবে কী দিয়ে। শেষে ভিক্ষে করে নিয়ে আইসে চুলোয় আগুন দেয়। এভাবে আমার দিন কাইটে যাচ্ছে।'
সেদিক খেয়াল করার সময় নাই। এক সময় দুই পক্ষের গুলি ফুরোয়। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। তিন খানসেনার লাশ পাই, আর তিনজনকে ধইরে ফেলি। কয়জন পালায়ে যায়।' ৮০ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন ৪১ বছর আগের যুদ্ধের স্মৃতি। কথা বলার সময় চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন যুদ্ধক্ষেত্রেই আছেন।
কালনার ওই যুদ্ধক্ষেত্রের চার কিলোমিটার পশ্চিমে নড়াইল-লোহাগড়া সড়কের মাইটকুমড়া অশ্রায়ণ কেন্দ্রে বসে মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম জানান, ভিটেমাটি হারিয়ে ১৩ বছর ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে এ আশ্রয় কেন্দ্রে বাস করছেন তিনি। তাঁদের বাড়ি ছিল লোহাগড়া উপজেলার চাচই গ্রামে। ১৯৭১ সালে লোহাগড়া বাজারের বটতলায় রুটি বানিয়ে বিক্রি করতেন তিনি। নূর ইসলামের ভাষায়, 'নিজ হাতে বানানো রুটি আর গোস্তের ছালুন (তরকারি) খেতে আইসত নানা পেশার মানুষ। ব্যবসার অবস্থা তখন রমরমা। এরই মইধ্যে পাকিস্তানিরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালাতে শুরু করে। এক রাতে রাজাকাররা নিতে আসে আমারে। কিন্তু রাজাকারের খাতায় নাম লেখানোর ইচ্ছে ছিল না, তাই ওই রাইতেই বাড়ি থেকে পালাই। পরে কয়েকজনের সঙ্গে চইলে যাই ভারতে। সেখানে লে. মতিয়ার রহমানের সাহায্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসি। নাইমে পড়ি মুক্তিযুদ্ধে।'
দেশ স্বাধীন হলে নূর ইসলাম আবার ফিরে যান পুরনো পেশায়। ভাতের হোটেল দেন লোহাগড়া বাজারের বর্তমান পান হাটের পাশে। স্বাধীন দেশে ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু জমির দখল নিয়ে মামলা শুরু হয়। মামলায় জিতলেও জায়গাটি ধরে রাখতে পারেননি তিনি। প্রতিপক্ষের কুটচালে জায়গা থেকে বিতাড়িত হন। অভাবের সংসারে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। অভাবের তাড়নায় বিনা চিকিৎসায় প্রথম স্ত্রী আনোয়ারা বেগম মারা যান ১৯৯৪ সালে। বড় মেয়ে নাসিমাও মারা গেছেন। দুই ছেলে শহিদুল ইসলাম আর আমিনুল ইসলাম আলাদা থাকেন। তাঁরাও দিন এনে দিন খান। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হেনা বেগম আর ৮-৯ বছর বয়সী ছেলে রকিবুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর এখনকার সংসার। স্ত্রী কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। কাজ না থাকলে ভিক্ষাও করেন। স্ত্রীর রোজগার আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হিসেবে পাওয়া টাকায় চলে তাঁর সংসার।
যুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে নূর ইসলাম বলেন, 'নড়ালের ট্রেজারি লুট, কালনার যুদ্ধ, লোহাগড়া মুক্ত করার যুদ্ধ ও নড়াল মুক্ত করার যুদ্ধ করছি। মতিয়ার ভাই কতো (বলত)_মিয়া ভাই সাথের পোলাপানগুলোরে একটু দেইখে রাইখো। আমি সবাইরে দেইখে রাখতি পারিনি। কেউ গুলি খায়ে মরছে (শহীদ), কারও পাজর ফুটো হয়ে গেছে। গুলিতে আমার বুকের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। সেই চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি।'
সরেজমিন মাইটকুমড়া আশ্রয়ণ কেন্দ্রে গিয়ে নূর ইসলামের দৈন্যদশার চিত্র দেখা গেছে। ওই কেন্দ্রে তিনি যে ঘরে থাকেন, তাতে বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। আক্ষেপ নিয়েই তিনি বলেন, 'আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছি। বাংলা স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না বলে ওয়াদা করিছিলাম। স্বাধীন কইরেই ঘরে ফিরিছিলাম। কিন্তু সেই ঘর ধইরে রাখতি পারলাম না। ঘরে একখান চাল দিয়ার ক্ষেমতা নাই। তাই এহানে মাথা গুজিছি। এখন এহানে আছি। তাও কি থাহা যায়!' তবে ওই আশ্রয়ণ কেন্দ্রের অন্যরা নূর ইসলামাকে খুব ভালোবাসেন। ব্যারাকের সামনের দোকানদার রমজান বিশ্বাস বলেন, 'একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা সবাই তাঁকে দেখেশুনে রাখি। মাঝেমাঝে তাঁর যায়যায় দশা হয়।'
নূর ইসলাম তাঁর জীবনের গল্প বলেন এভাবে, 'ছাওয়াল দুডোরে স্কুলে পাঠালাম। লেহাপড়া শেষ করতে পারেনি। বউডার পেটে ব্যথা। ওষুধ কিনে দিতি পারিনি। পেটের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারে শেষে একদিন গলায় দড়ি নিয়ে মরল। ছাওয়াল দুডোও দূরে সরে গেল। শেষে আবার একডা বিয়া করলাম। এই বউও আমার লক্ষ্মী। যে কাজ কবেন, সে কাজ কইরে দেবে। বাসাবাড়িতে কাজ করে। সবাই তারে পাগলি কয়। আমি তো ঠিকমতো হাটতি পারি না। ভিক্ষে করতিও পারি না। তাই আমার পাগলিডা আমাগে খাওয়ায়ে বাঁচায়ে রাখিছে। ও যহন কিছু পারে না, খাতি দেবে কী দিয়ে। শেষে ভিক্ষে করে নিয়ে আইসে চুলোয় আগুন দেয়। এভাবে আমার দিন কাইটে যাচ্ছে।'
No comments