বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কেউ কেউ জ্বলবে!!! by মাসুদা ভাট্টি

বাংলাদেশ ভাল করছে। শত বাধা, শত বিঘ্ন পেরিয়ে বাংলাদেশ এগুচ্ছে লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ভাষ্য থেকে আমরা সেই প্রমাণই পাই। পত্রিকাটির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বাংলাদেশ এমন এক সম্ভাবনার দেশ, যে দেশটি খুব দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতি নিয়ে অতি অল্প সময়েই পশ্চিমের বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বর্তমানে যে পথে দেশটির অর্থনীতি ধাবমান তাতে এই অগ্রগতি অর্জনে বাংলাদেশের খুব বেশি সময় আর লাগবে না, আর মাত্র ৩০ বছর। যে কোন দেশের বা জাতি-ইতিহাসের জন্য ৩০ বছর খুব কম সময়, দেখতে দেখতে সে সময় চলে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের যে পথ পাড়ি দিতে হবে, সে পথ তো মসৃণ নয় বরং সে পথের সবচেয়ে বড় বাধা আমরা নিজেরাই, তাই নয় কি?
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মতো যে সমস্ত দেশ এক সময় অনুল্লেখযোগ্য তালিকায় ছিল সেসব দেশের এই দ্রুত অগ্রসরমানতার প্রথম কারণ হচ্ছে, এরা অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে এবং মূল্যস্ফীতি রোধ, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে আধুনিক হয়ে উঠছে। অথচ এক সময় এদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো। বিশেষ করে বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনাতে এই বিশেষণটি হামেশাই ব্যবহার করা হয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের বরাত দিয়ে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হলেও তিনি নিজে আরেকজনের বরাতে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সে কালো ইতিহাস থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আরও আগেই হয়ত বেরুনো যেত কিন্তু সে পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশের ঘাড়ে চেপেবসা দু’দু’বারের সামরিক শাসন এবং এই অপশাসনের ফলে সৃষ্ট দেশব্যাপী অরাজকতা, অশান্তি আর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার অভাব। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক শাসনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা গেলে, রাজনৈতিক রক্তপাত না হলে বাংলাদেশ সম্পর্কে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হতো আরো দশ বছর আগে। নব্বইয়ের দশকেই আমরা পেতাম বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে। এটা খুব সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব যে, সামরিক শাসনামলে ও রাজনৈতিক শাসনের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ সব সূচকেই অন্তত ২০ বছর পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু আগেই বলেছি, এখনও এ পথ নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন নয়।
শুরু থেকেই বাংলাদেশের যে বৈশিষ্ট্যটি দেশে-বিদেশে আলোচিত ছিল তা হলো, এই দেশের মানুষ মুক্তিকামী। ১৯৭১ বাঙালীকে এভাবেই পরিচিত করেছিল বিশ্বের কাছে। রাজনৈতিক সচেতনতার দিকটিও এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। যে কারণে এদেশে স্বৈরাচার বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। রক্তপাতের ভেতর দিয়ে হলেও মানুষ বেরিয়ে এসেছে স্বৈরশাসন থেকে। গণতন্ত্রের প্রতি স্বাভাবিক প্রীতি না থাকলে এটা সম্ভবপর ছিল না। অসম্ভবের সঙ্গে লড়ার যে অদম্য শক্তি তা এ দেশের মানুষের স্বভাবজাত, প্রতিবছর খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর যে শক্তি বাঙালী দেখিয়েছে তা অভূতপূর্ব। একই সঙ্গে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কিংবা আধুনিক হওয়ারও উদাহরণ আমরা দিতে পারি। নইলে গ্রামের সবচে বয়স্ক ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে একেবারে নবীন বালকটি পর্যন্ত যেভাবে মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও প্রযুক্তিকে এভাবে ব্যবহার করার নজির খুব কমই রয়েছে। এদেশের এই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতাকে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকই ‘মোবাইল রেভুল্যুশন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করে তার থেকে বিবিধ উপযোগিতা আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বেশ উল্লেখযোগ্য আলোচনায় উঠে এসেছে। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ডিজিটাল বাংলাদেশের জোয়ার জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশও ‘ডিজিটাল’ শব্দটিকে বেছে নিয়ে প্রযুক্তিকে দেশের আপামর মানুষের কাছে সহজলভ্য করার ঘোষণা দিয়েছিল। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে পাইওনিয়র। বর্তমান সরকারের চার বছর অতিক্রম হতে যাচ্ছে, এখানে দাঁড়িয়ে আমরা যদি দেশের প্রযুক্তিগত উন্নতির দিকে চোখ রাখি তাহলে এই সরকারের পরম শত্রুও একথা স্বীকার করবেন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ কিছুটা হলেও কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে। দেশের প্রায় চার হাজার ইউনিয়নে ই-তথ্য কেন্দ্র স্থাপন ও তার ব্যবহারের কথাই যদি ধরি তাহলেও মানুষকে অন্তত তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করার কাজটি এরই মধ্যে সম্ভব হয়েছে। আর এক্ষেত্রে যে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান করা গেছে তাতে অনেকেরই বিস্ময় জাগবে।
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সুশাসন ও জবাবদিহিতা। যে সকল রাষ্ট্র এই দু’টি বিষয় নিশ্চিত করতে পেরেছে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশে এই দু’টি বিষয়ই খুব দুর্বল। কিন্তু দুর্বলতার নিক্তিকে যদি আমরা শুরু থেকে এ পর্যন্ত সময় দিয়ে মাপি তাহলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ এগিয়েছে। ৪১ বছর একটি দেশের জন্য খুব বেশি বয়স নয়। বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে নবীন দেশগুলোর অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই অনেক চড়াইউতরাই পেরুতে হয়েছে এই দেশটিকে স্থিতু হতে। যার ভেতর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফেরার বিষয়টি অন্যতম। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সুশাসন ও জবাবদিহিতাকে যদি যোগ করি তাহলে এই সূচকেও বাংলাদেশ এগিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ এখনও এখানে নিশ্চিত নয় এবং রাষ্ট্রের সেবামূলক (কাস্টমার সার্ভিস) প্রতিষ্ঠান থেকে জনগণের দূরত্ব এখনও অনেক সে কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু এগুলো মূল সমস্যার শেষের দিককার কথা, একেবারে প্রথমদিকে যে কথাটি আলোচিত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, তা হলো, বাংলাদেশের কিছু সর্বজনীন সমস্যা রয়েছে, যার সমাধানে সকলের ঐকমত্যে পৌঁছনোটা আশু জরুরী। যার মধ্যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক করা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোনমতেই স্বাভাবিক রীতি নয়), অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতা দখল করতে না দেয়া এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে সুসংহত করা। এগুলো নিশ্চিত করা গেলেই রাষ্ট্র কাঠামো একটি সুসংহত ভিতের ওপর দাঁড়াবে, যেখান থেকে সুশাসন বলি আর জবাবদিহিতা বলি, সবই নিশ্চিত করতে কোন বেগ পেতে হবে না। আর তার জন্য আমাদের নিজেদেরই সবার আগে ঠিক করতে হবে।
একটা উদাহরণ দিয়েই আজকের লেখার সমাপ্তিতে পৌঁছে যাব। বাংলাদেশে এক সময় সিভিল সোসাইটি আন্দোলন ছিল খুব শক্তিশালী। বিশেষ করে পাকিস্তানী শাসনব্যবস্থার বিপরীতে এই শক্তিশালী সুশীল সমাজ আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনকে বেগময় করেছিল। এ কারণে একাত্তরে এই সিভিল সোসাইটিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল প্রাণ দিয়েই। কিন্তু বাংলাদেশে ক্রমশ এই আন্দোলন থিতিয়ে পড়ে। এবং আজকে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ আজ যেন একটি ‘গালি’তে পরিণত হয়েছে। মানুষের সঙ্গে এই সমাজের দূরত্বই এই পরিণতির জন্য দায়ী। সাধারণ মানুষ যা চায় তা আমাদের সুশীল সমাজ আন্দাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে আজকে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এ রকম যে, মানুষ বলছে বাংলাদেশে আসলে রাজনৈতিক দল তিনটি ১. আওয়ামী লীগ, ২. বিএনপি এবং ৩. সুশীল সমাজ কাম দাতাগোষ্ঠী কাম সেনাসমর্থিত অগণতান্ত্রিক শক্তি কাম বিরাজনীতিকরণ গোষ্ঠী কাম প্রাপ্তিযোগে রাজনৈতিক চরিত্রবদলকারী বুদ্ধি-ব্যবসায়ী কাম আরো কিছু। আমার মনে হয়, আজকের রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা ও দায়িত্বহীনতার কারণ মূলত একটি শক্তিশালী সুশীল আন্দোলনের অনুপস্থিতি। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা কেন বিঘিœত হয়েছে তা নিয়ে আমাদের গবেষণা চলতে পারে কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনৈক্য আর অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের যে বিশাল অর্জন বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তির হাতেই হয়েছে তা এই বিশাল বিচ্ছিন্ন সুশীল সমাজের স্বীকৃতি পায় না বা পেলেও তা হয় খ-িত ও পক্ষপাতদুষ্ট। আর সে কারণেই দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশ এখনও আলোচনা-সমালোচনার বড় টার্গেট হয়ে যায়, যেখানে মূল সত্য থেকে যায় নিভৃতে। নইলে ১/১১-র মতো অগণতান্ত্রিক শাসন কি করে বিশ্বের বড় বড় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী দেশগুলোর সমর্থন লাভ করে? কি করে বাংলাদেশে ৯ বছরের জন্য একটি অনির্বাচিত সরকারের শাসন-ধারণা বিদেশে কল্কে পায়? আমার মনে হয়, বাংলাদেশের এই শক্তিশালী সুশীল গোষ্ঠীটি যদি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত হতো তাহলে এদেশের উন্নয়ন সূচক আরো বৃদ্ধি পেত এবং ৩০ বছর নয়, তারও আগে বাংলাদেশ পশ্চিমকে ছাড়াত। কেবলমাত্র সমালোচনার জন্য সমালোচনা বা উদ্দেশ্যময় সমালোচনা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে যে কত বড় বাধা তা আমরা সকলেই কমবেশি বুঝতে পারার কথা।
ফিরে যাই, পুরনো কথায়। বাংলাদেশের কিছু স্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের মধ্যে এই দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আজ প্রবাসী এবং সেখান থেকে পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি প্রধান উপকরণ। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ে এদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যাকে যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা যায় তাহলে জনসংখ্যা বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে পারে; বাংলাদেশকে গবেষণা করলেই এই সত্য প্রতীয়মান হবে। তাই বলে বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যা প্রশিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম, একথা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। বরং, এখনও এই জনসংখ্যার বিশাল অংশটি শিক্ষাবঞ্চিত, অদক্ষ এবং বেকার। এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলার আগে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। ইউরোপ কিংবা আমেরিকাসহ পশ্চিমের অনেক দেশেই আজ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিম্নগামীই শুধু নয়, নেতিবাচকও। অচিরেই দেশগুলো পড়তে যাচ্ছে বিশাল এক ফাঁপড়ে, যেখানে কার্যক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠী হয়ে উঠবে অবসরভোগী বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর তুলনায় স্বল্প। এই স্বল্পতা সেখানে সৃষ্টি করছে কিংবা করবে ভারসাম্যহীনতা। আর এই ভারসাম্যহীনতার ভেতরেই ঢুকে পড়তে সক্ষম হবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জনসংখ্যার প্রশিক্ষিত ও দক্ষ অংশটি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমরা এখনও সে রকম কোন বড় উদ্যোগ নিতে পারিনি। বরং আমরা এখনও নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। আমাদের নিয়ে উন্নত বিশ্বে গবেষণা হচ্ছে, গবেষণার ইতিবাচক ফলও বেরিয়ে আসছে কিন্তু আমরা তো জানি আমাদের অবস্থান কোথায়?

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর, সোমবার, ২০১২।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ।
masuda.bhatti@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.