পরিবেশ- নদী বাঁচাও মানুষ বাঁচাও by মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী
বাংলাদেশের ভৌগোলিক কাঠামোতে অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ নদ-নদী। সুপেয় পানির উৎস, শিল্প উৎপাদনের উৎস, ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎস, মৎস্য সম্পদের উৎস, চাষাবাদের উৎস, ভ্রমণের উৎস, যোগাযোগের উৎস—এককথায় জীবনধারণের সব উৎস নদী।
এই জনপদের সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের নিয়ামক নদী। নদ-নদী রক্ষা পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্যতম ম্যান্ডেট। নদীর ওপর অধিকার রয়েছে কৃষক, শ্রমিক, মৎস্যজীবী ও সৃষ্টিজগতের সবার। সেই অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ অনৈতিক ও অমানবিক। সিলেটের কুশিয়ারা নদী দখলদারদের তাৎক্ষণিক শাস্তি দিয়ে এবং উচ্ছেদ করে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ-অপরাধীদের সুবিচার নিশ্চিত করছে। জনগণের প্রত্যাশা, নদী দখলে জড়িত অপরাধীরা শাস্তি পাক। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং জনগণের স্বার্থে পরিবেশ সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করা আইনের শাসনের পূর্বশর্ত।
পরিবেশ অধিদপ্তর দক্ষতা ও সততার সঙ্গে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর দখল করা এক অংশ মুক্ত করেছে দখলদারদের দিয়েই। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এই নদী দখলের ওপর ৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ প্রকাশিত হলে পরিবেশ অধিদপ্তর অতি দ্রুত ঘটনা তদন্ত করে। নদীগর্ভে পিলার বসিয়ে দোতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণকারী তিন দখলদারকে ঢাকায় তলব করে নদীর প্রতিবেশ ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনের অপরাধে সাড়ে আট লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দখলদারদের ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয় নিজ খরচে ও উদ্যোগে দখল করা স্থান থেকে স্থাপনা ভেঙে নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। একই সঙ্গে নদী রক্ষায় দখলদারদের কঠিন শপথ করানো হয়। সরকারি নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জরিমানা দেওয়া এবং নিজ উদ্যোগে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার ঘটনা পরিবেশ সুশাসন ও সুবিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত। পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের একার নয়, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার। পরিবেশ অধিদপ্তর নির্লিপ্ত থাকে—এ অভিযোগের দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর দখলদারদের স্বপ্নে ছাই দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করেছে। কুশিয়ারা তীরের মানুষ জানল, বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন নামক একটি আইন আছে এবং এ আইনে শাস্তিও পেতে হয়। নদীকে ঘিরে মানুষের অনেক স্বপ্ন ও আশা।
আবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও এ কারণে যে, নদ-নদীগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদী দখলের প্রভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর শুধু ১৫০০ বর্গফুট অংশ দখল করায় প্রাথমিকভাবে হিসাব করে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ হলো: নদীর ৯ দশমিক ৮৭ লাখ লিটার পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাবে। প্রায় ছয় হাজার ছোট মাছের বিচরণ বন্ধ হয়ে যাবে। আশপাশের এলাকার শীতলীকরণব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধান উৎপাদন হ্রাস পাবে। ওই এলাকার আবহাওয়া উত্তপ্ত হবে, তাপমাত্রা বাড়বে। মাছের অভাবে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি পাখির আনাগোনা বন্ধ হবে। নদীর বিপরীত তীরে ভাঙন দেখা দেবে, উজানে পলিপাতন ত্বরান্বিত হবে। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হবে। নৌ-চলাচল পথ সংকুচিত হবে। সাত-আট হাজার লোক নদীর পানি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হবে। নদী রক্ষায় বাংলাদেশে অনেক আইন ও বিধি রয়েছে। সেগুলোর যথার্থ প্রয়োগেই পরিবেশের রক্ষাকবচ। আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ও অস্বচ্ছতা থাকলে পরিবেশ রক্ষা বাস্তবে কঠিন।
পরিবেশ অধিদপ্তর সরকারের সদিচ্ছায় আইনের দ্রুত প্রয়োগের মাধ্যমে দেশজুড়ে নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় নাগরিক সচেতনতা তৈরি করেছে। বিত্তশালী বা শক্তিশালী কারও কাছেই পরিবেশ অধিদপ্তর মাথা নত করেনি। অধিদপ্তরের অভিযানলব্ধ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিত, সচেতন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও নদীদূষণ ও ধ্বংসের কাজে জড়িত। আইন প্রয়োগের পথে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
শিল্পকারখানার অশোধিত বর্জ্যে নদীর প্রতিবেশ ধ্বংস করা, আবাসন প্রকল্পের নামে নদী ভরাট ও শিল্পায়নের নামে নদী দখলের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ঘটনা বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত হয়ে দেশের নদ-নদীর জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। আজ থেকে ৫০ বছর পরের চাহিদা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে নদ-নদীর পানি রক্ষা করতে হবে। একটা সময় আসবে যখন দেশজুড়ে জনপদ-নগরগুলোর বিপুল পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে নদীগুলো থেকে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনক মাত্রায় অনেক নিচে নেমে গেছে। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের মধ্যে নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি ও চেতনায় পুরোপুরি শুদ্ধতা না আসা পর্যন্ত নদ-নদী রক্ষার কার্যক্রম দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমাদের সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে নদীকে। নদীর ওপর আমাদের অত্যাচার কমাতে হবে এবং নির্ভরতা বাড়াতে হবে। লোভ-লালসা মুনাফার অদম্য বাসনা যেন নদীকে গ্রাস না করে। নদী ধ্বংসের অপরাধ দমনে পরিবেশ অধিদপ্তর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক কঠোর অবস্থানে। নদী রক্ষা নিয়ে অনেক গবেষণা, সেমিনার, কর্মশালা হয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে এককাতারে মাঠে নামার এনজিও, সিভিল সোসাইটিসহ সব সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তির।
আসুন, আমরা সমবেতভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশে নদী রক্ষায় সহযোদ্ধা হিসেবে দাঁড়াই। নদী রক্ষায় সবার অবস্থান হোক অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে।
মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী: পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর।
mmunirc@gmail.com
পরিবেশ অধিদপ্তর দক্ষতা ও সততার সঙ্গে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর দখল করা এক অংশ মুক্ত করেছে দখলদারদের দিয়েই। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এই নদী দখলের ওপর ৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ প্রকাশিত হলে পরিবেশ অধিদপ্তর অতি দ্রুত ঘটনা তদন্ত করে। নদীগর্ভে পিলার বসিয়ে দোতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণকারী তিন দখলদারকে ঢাকায় তলব করে নদীর প্রতিবেশ ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনের অপরাধে সাড়ে আট লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দখলদারদের ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয় নিজ খরচে ও উদ্যোগে দখল করা স্থান থেকে স্থাপনা ভেঙে নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। একই সঙ্গে নদী রক্ষায় দখলদারদের কঠিন শপথ করানো হয়। সরকারি নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জরিমানা দেওয়া এবং নিজ উদ্যোগে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার ঘটনা পরিবেশ সুশাসন ও সুবিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত। পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের একার নয়, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার। পরিবেশ অধিদপ্তর নির্লিপ্ত থাকে—এ অভিযোগের দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর দখলদারদের স্বপ্নে ছাই দিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করেছে। কুশিয়ারা তীরের মানুষ জানল, বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন নামক একটি আইন আছে এবং এ আইনে শাস্তিও পেতে হয়। নদীকে ঘিরে মানুষের অনেক স্বপ্ন ও আশা।
আবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও এ কারণে যে, নদ-নদীগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদী দখলের প্রভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর শুধু ১৫০০ বর্গফুট অংশ দখল করায় প্রাথমিকভাবে হিসাব করে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ হলো: নদীর ৯ দশমিক ৮৭ লাখ লিটার পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাবে। প্রায় ছয় হাজার ছোট মাছের বিচরণ বন্ধ হয়ে যাবে। আশপাশের এলাকার শীতলীকরণব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধান উৎপাদন হ্রাস পাবে। ওই এলাকার আবহাওয়া উত্তপ্ত হবে, তাপমাত্রা বাড়বে। মাছের অভাবে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি পাখির আনাগোনা বন্ধ হবে। নদীর বিপরীত তীরে ভাঙন দেখা দেবে, উজানে পলিপাতন ত্বরান্বিত হবে। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হবে। নৌ-চলাচল পথ সংকুচিত হবে। সাত-আট হাজার লোক নদীর পানি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হবে। নদী রক্ষায় বাংলাদেশে অনেক আইন ও বিধি রয়েছে। সেগুলোর যথার্থ প্রয়োগেই পরিবেশের রক্ষাকবচ। আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ও অস্বচ্ছতা থাকলে পরিবেশ রক্ষা বাস্তবে কঠিন।
পরিবেশ অধিদপ্তর সরকারের সদিচ্ছায় আইনের দ্রুত প্রয়োগের মাধ্যমে দেশজুড়ে নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় নাগরিক সচেতনতা তৈরি করেছে। বিত্তশালী বা শক্তিশালী কারও কাছেই পরিবেশ অধিদপ্তর মাথা নত করেনি। অধিদপ্তরের অভিযানলব্ধ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিত, সচেতন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও নদীদূষণ ও ধ্বংসের কাজে জড়িত। আইন প্রয়োগের পথে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
শিল্পকারখানার অশোধিত বর্জ্যে নদীর প্রতিবেশ ধ্বংস করা, আবাসন প্রকল্পের নামে নদী ভরাট ও শিল্পায়নের নামে নদী দখলের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ঘটনা বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত হয়ে দেশের নদ-নদীর জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। আজ থেকে ৫০ বছর পরের চাহিদা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে নদ-নদীর পানি রক্ষা করতে হবে। একটা সময় আসবে যখন দেশজুড়ে জনপদ-নগরগুলোর বিপুল পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে নদীগুলো থেকে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনক মাত্রায় অনেক নিচে নেমে গেছে। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের মধ্যে নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি ও চেতনায় পুরোপুরি শুদ্ধতা না আসা পর্যন্ত নদ-নদী রক্ষার কার্যক্রম দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমাদের সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে নদীকে। নদীর ওপর আমাদের অত্যাচার কমাতে হবে এবং নির্ভরতা বাড়াতে হবে। লোভ-লালসা মুনাফার অদম্য বাসনা যেন নদীকে গ্রাস না করে। নদী ধ্বংসের অপরাধ দমনে পরিবেশ অধিদপ্তর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক কঠোর অবস্থানে। নদী রক্ষা নিয়ে অনেক গবেষণা, সেমিনার, কর্মশালা হয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে এককাতারে মাঠে নামার এনজিও, সিভিল সোসাইটিসহ সব সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তির।
আসুন, আমরা সমবেতভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশে নদী রক্ষায় সহযোদ্ধা হিসেবে দাঁড়াই। নদী রক্ষায় সবার অবস্থান হোক অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে।
মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী: পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর।
mmunirc@gmail.com
No comments