বেড়েই চলেছে অপরাধ by আশরাফুল হক রাজীব
দেশে অপরাধের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ চিত্র পাওয়া গেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই গত অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে। সে অনুযায়ী ওই সময়ে রাজনৈতিক গোলযোগ, শ্রমিক অসন্তোষসহ প্রায় সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতির হার ছিল ঊর্ধ্বমুখী।
বেড়েছে এসিড নিক্ষেপের ঘটনাও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসেছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার তথ্য। এরপর গত প্রায় ছয় মাসে অপরাধের গতি কমা দূরের কথা, বরং অনেকাংশেই বেড়েছে। এ সময়ের অপরাধচিত্রের পরিসংখ্যান আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করা হবে চলতি মাস শেষে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ছয় মাসে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। সর্বশেষ বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে ছাত্রলীগকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত অক্টোবরে কক্সবাজারের রামুতে ঘটেছে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে আগুন লাগানোর মতো সহিংস ঘটনা। এরপর নভেম্বরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত হলে ওই ঘটনার জের ধরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। এদিকে গত অর্থবছরে রাজনৈতিক গোলযোগ ও শিল্পাঞ্চলে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষ অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত বাঁধা বলেই অপরাধ বেড়েছে।
স্বরাষ্ট্র্রসচিব সি কিউ কে মোস্তাক আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা খুব বেশি নয়। সারা দেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশে অপরাধ কমই হয়। তার পরও আমরা তৎপর রয়েছি।'
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবেদন না দেখে মন্তব্য করা যাবে না। তার পরও আমার যতটুকু মনে পড়ে, তাতে প্রায় সব অপরাধের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী ছিল না।'
অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ বিভাগের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ২০১১-১২ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে গত মাসে মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও ওই প্রতিবেদনেই দেশে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ১০৯। ২০১১-১২ অর্থবছরে সেটা বেড়ে ১২০-এ দাঁড়িয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সারা দেশে খুন হয়েছে তিন হাজার ৮৯৯ জন। গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০১১-১২ সালে খুনের সংখ্যা চার হাজার ১৩৫। একই সময়ে ধর্ষণের সংখ্যাও বেড়েছে ৩২৫। অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৪৬৬ থেকে বেড়ে ৪৮৬টি হয়েছে। কয়েক বছর ধরে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে এলেও গত অর্থবছরে তা বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ৮৫টি হলেও গত অর্থবছরে তা তিনটি বেড়েছে। একই সময় ডাকাতির ঘটনাও বেড়েছে ১২টি। তবে এই সময় রাহাজানি ও বিস্ফোরকসংক্রান্ত অপরাধ কমেছে। আগের বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে মোট অপরাধ বেড়েছে ৪৯২টি। একই সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১০-১১ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ছিল পাঁচ। গত অর্থবছরে তা ১৯ জন বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ জনে। একই সময় কারাবন্দির সংখ্যা বেড়েছে দুই হাজার ৯০৪।
কয়েক বছর ধরেই ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে ধর্ষণ বেড়েছে ৩৭৫টি; যার ধারাবাহিকতা রয়েছে ২০১১-১২ অর্থবছরেও। ২০০৯-১০ থেকে ধারাবাহিকভাবে অগ্নিসংযোগ ও রাহাজানি বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে নারী নির্যাতন বেড়েছিল চার হাজার ২৮৬টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সব অপরাধ নির্মূল করা যাবে না। তবে কমানো যাবে। চুরি, ডাকাতি, খুন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ আইনের প্রয়োগ নেই। রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। সন্ত্রাসীদের খুঁটির জোর সাধারণ মানুষের তুলনায় বহুগুণ বেশি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়। তিনি বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমি দোষ দিচ্ছি না। কারণ তাদের হাত বাঁধা। অপরাধ বাড়ার আরো একটি কারণ হলো, আমরা মূল অপরাধীকে ধরি না। আমরা কোনো দিনই গডফাদারদের ধরতে পারিনি। ধরি বাহকদের। গডফাদাররা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পান।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব বেশি ছিল না। তার পরও কয়েকটি ক্ষেত্রে অপরাধ বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক গোলযোগকে দায়ী করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে যদি গত বছর অপরাধ বেড়ে থাকে তাহলে এ বছর সেই সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। সরকারের মেয়াদের শেষ বছর হওয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি রাজপথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য জামায়াত সহিংস আচরণ করছে। এ ছাড়া দাবির মিছিল নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন মাঠ গরম করে রেখেছে। তাদেরকে সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এই সুযোগে সাধারণ অপরাধ দমনে পুলিশ সময় দিতে পারছে না। আর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ বলতে পোশাক খাতেই গোলযোগ বেশি ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, অপরাধ বেড়ে যাওয়ার জন্য শুধু রাজনৈতিক ও শ্রমিক অসন্তোষই দায়ী নয়। এর বাইরে কিছু সামাজিক কারণও রয়েছে। যদি রাজনৈতিক কারণই হবে তাহলে সামনের দিনগুলোতে এটা আরো বেড়ে যেতে পারে। এসিড নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে যাওয়া উদ্বেগজনক। অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধীকে ধরে থানায় নেওয়ার পর তদবির করে ছাড়িয়ে আনার সংস্কৃতি বন্ধ করতে পারলে অপরাধ অর্ধেক কমে যাবে। সব বাহিনীকে তাদের মতো কাজ করতে দিতে হবে।
দুটি সংস্থার প্রতিবেদন : এদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের গত পাঁচ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২০টি। এর মধ্যে গুলিতে নিহত, পিটিয়ে হত্যা, নির্যাতনে মৃত্যু ও ক্রসফায়ারও রয়েছে। একই সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩০৩টি। যৌতুক নিয়ে সহিংসতা হয়েছে ২৯৬টি। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬৯ জন এবং আহত হয়েছেন ছয় হাজার ৪৩৩ জন। এ সময় এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন। গুপ্তহত্যা, অপহরণ ও ক্রসফায়ার বেড়ে যাওয়ার ঘটনা উঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে।
অধিকারের গত ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শিল্প পুলিশ পোশাক মালিকদের পক্ষে কাজ করে। শ্রমিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও দমিয়ে রাখার জন্য শিল্প পুলিশ গঠন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত থাকায় অধিকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি মনে করে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধের জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা সহিংসতা বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে এসে সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুপারিশ করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এর জন্য সরকারের ব্যাপক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়টিও তাদের সুপারিশে রয়েছে। সব থানায় নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে নারী অপরাধী ও ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গত সেপ্টেম্বর মাসের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গুপ্তহত্যা, অপহরণ, ক্রসফায়ার নিত্যদিনের ঘটনা। তার মধ্যে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মানুষের তালিকা। কাউকে কাউকে ব্যস্ত রাজপথ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অপহরণকারীদের বাহন ছিল কালো কাচে ঢাকা মাইক্রেবাস। এ গাড়িগুলো কোথা থেকে আসে, কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। মাসের পর মাস যায়, নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে পথে পথে ঘোরেন স্বজনরা। কারো কারো লাশ মিললেও গুপ্ত হত্যার কোনো সুরাহা হয় না। ধরা পড়ে না খুনি। এর মধ্যে রহস্যময় গাড়ির আনাগোনাও চলতে থাকে।
স্বরাষ্ট্র্রসচিব সি কিউ কে মোস্তাক আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা খুব বেশি নয়। সারা দেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশে অপরাধ কমই হয়। তার পরও আমরা তৎপর রয়েছি।'
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবেদন না দেখে মন্তব্য করা যাবে না। তার পরও আমার যতটুকু মনে পড়ে, তাতে প্রায় সব অপরাধের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী ছিল না।'
অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ বিভাগের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ২০১১-১২ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে গত মাসে মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হলেও ওই প্রতিবেদনেই দেশে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ১০৯। ২০১১-১২ অর্থবছরে সেটা বেড়ে ১২০-এ দাঁড়িয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সারা দেশে খুন হয়েছে তিন হাজার ৮৯৯ জন। গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০১১-১২ সালে খুনের সংখ্যা চার হাজার ১৩৫। একই সময়ে ধর্ষণের সংখ্যাও বেড়েছে ৩২৫। অগ্নিসংযোগের ঘটনা ৪৬৬ থেকে বেড়ে ৪৮৬টি হয়েছে। কয়েক বছর ধরে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমে এলেও গত অর্থবছরে তা বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ৮৫টি হলেও গত অর্থবছরে তা তিনটি বেড়েছে। একই সময় ডাকাতির ঘটনাও বেড়েছে ১২টি। তবে এই সময় রাহাজানি ও বিস্ফোরকসংক্রান্ত অপরাধ কমেছে। আগের বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে মোট অপরাধ বেড়েছে ৪৯২টি। একই সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১০-১১ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ছিল পাঁচ। গত অর্থবছরে তা ১৯ জন বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ জনে। একই সময় কারাবন্দির সংখ্যা বেড়েছে দুই হাজার ৯০৪।
কয়েক বছর ধরেই ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে ধর্ষণ বেড়েছে ৩৭৫টি; যার ধারাবাহিকতা রয়েছে ২০১১-১২ অর্থবছরেও। ২০০৯-১০ থেকে ধারাবাহিকভাবে অগ্নিসংযোগ ও রাহাজানি বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে নারী নির্যাতন বেড়েছিল চার হাজার ২৮৬টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, সব অপরাধ নির্মূল করা যাবে না। তবে কমানো যাবে। চুরি, ডাকাতি, খুন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ আইনের প্রয়োগ নেই। রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। সন্ত্রাসীদের খুঁটির জোর সাধারণ মানুষের তুলনায় বহুগুণ বেশি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়। তিনি বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমি দোষ দিচ্ছি না। কারণ তাদের হাত বাঁধা। অপরাধ বাড়ার আরো একটি কারণ হলো, আমরা মূল অপরাধীকে ধরি না। আমরা কোনো দিনই গডফাদারদের ধরতে পারিনি। ধরি বাহকদের। গডফাদাররা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পান।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব বেশি ছিল না। তার পরও কয়েকটি ক্ষেত্রে অপরাধ বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক গোলযোগকে দায়ী করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে যদি গত বছর অপরাধ বেড়ে থাকে তাহলে এ বছর সেই সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। সরকারের মেয়াদের শেষ বছর হওয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি রাজপথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য জামায়াত সহিংস আচরণ করছে। এ ছাড়া দাবির মিছিল নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন মাঠ গরম করে রেখেছে। তাদেরকে সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এই সুযোগে সাধারণ অপরাধ দমনে পুলিশ সময় দিতে পারছে না। আর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ বলতে পোশাক খাতেই গোলযোগ বেশি ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, অপরাধ বেড়ে যাওয়ার জন্য শুধু রাজনৈতিক ও শ্রমিক অসন্তোষই দায়ী নয়। এর বাইরে কিছু সামাজিক কারণও রয়েছে। যদি রাজনৈতিক কারণই হবে তাহলে সামনের দিনগুলোতে এটা আরো বেড়ে যেতে পারে। এসিড নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে যাওয়া উদ্বেগজনক। অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধীকে ধরে থানায় নেওয়ার পর তদবির করে ছাড়িয়ে আনার সংস্কৃতি বন্ধ করতে পারলে অপরাধ অর্ধেক কমে যাবে। সব বাহিনীকে তাদের মতো কাজ করতে দিতে হবে।
দুটি সংস্থার প্রতিবেদন : এদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের গত পাঁচ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২০টি। এর মধ্যে গুলিতে নিহত, পিটিয়ে হত্যা, নির্যাতনে মৃত্যু ও ক্রসফায়ারও রয়েছে। একই সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩০৩টি। যৌতুক নিয়ে সহিংসতা হয়েছে ২৯৬টি। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬৯ জন এবং আহত হয়েছেন ছয় হাজার ৪৩৩ জন। এ সময় এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন। গুপ্তহত্যা, অপহরণ ও ক্রসফায়ার বেড়ে যাওয়ার ঘটনা উঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে।
অধিকারের গত ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শিল্প পুলিশ পোশাক মালিকদের পক্ষে কাজ করে। শ্রমিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও দমিয়ে রাখার জন্য শিল্প পুলিশ গঠন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত থাকায় অধিকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি মনে করে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধের জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা সহিংসতা বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে এসে সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুপারিশ করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এর জন্য সরকারের ব্যাপক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়টিও তাদের সুপারিশে রয়েছে। সব থানায় নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে নারী অপরাধী ও ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গত সেপ্টেম্বর মাসের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গুপ্তহত্যা, অপহরণ, ক্রসফায়ার নিত্যদিনের ঘটনা। তার মধ্যে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মানুষের তালিকা। কাউকে কাউকে ব্যস্ত রাজপথ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অপহরণকারীদের বাহন ছিল কালো কাচে ঢাকা মাইক্রেবাস। এ গাড়িগুলো কোথা থেকে আসে, কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। মাসের পর মাস যায়, নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে পথে পথে ঘোরেন স্বজনরা। কারো কারো লাশ মিললেও গুপ্ত হত্যার কোনো সুরাহা হয় না। ধরা পড়ে না খুনি। এর মধ্যে রহস্যময় গাড়ির আনাগোনাও চলতে থাকে।
No comments