বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৬০৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম সাহসী ও দক্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে টাঙ্গাইলে গঠিত হয় একটি সশস্ত্র বাহিনী। আবদুল কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন।
এর নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, এনায়েত করিম প্রমুখ। প্রাথমিক পর্যায়ে টাঙ্গাইলে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করেন।
টাঙ্গাইলের পতন হলে প্রতিরোধযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরে তাঁরা টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকা সখীপুরে সমবেত হন। এখানে শুরু হয় এ বাহিনীর পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া। পাশাপাশি চলে রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ। তখন আবদুল কাদের সিদ্দিকী বাহিনীর সামরিক প্রধান এবং আনোয়ার-উল-আলম শহীদ বেসামরিক প্রধান নিযুক্ত হন। সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নূরুন্নবী ও হামিদুল হক। পরবর্তীকালে এ বাহিনীরই নাম হয় ‘কাদেরিয়া বাহিনী’।
মুক্তিযুদ্ধকালে আবদুল কাদের সিদ্দিকী অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য সরাসরি যুদ্ধ ও অ্যাম্বুশ করেন। এর মধ্যে ধলাপাড়ার অ্যাম্বুশ অন্যতম।
ধলাপাড়া টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার অন্তর্গত। ১৬ আগস্ট আবদুল কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়ার কাছাকাছি একটি স্থানে ছিলেন। তিনি খবর পান, তাঁদের তিনটি উপদল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘেরাও করেছে। তাঁদের সাহায্য করার জন্য তিনি সেখানে রওনা হন। এদিকে অবরুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা তখন পিছে হটছিল।
আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মাত্র ১০ জন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানিরা যে পথ দিয়ে পিছু হটছিল, সে পথে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় ছিল অনেক। এটা তাঁকে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বিচলিত করেনি। কারণ, তাঁরা বেশির ভাগ ছিলেন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। কাদের সিদ্দিকী সহযোদ্ধাদের বলে রেখেছিলেন, শত্রু যত কাছেই আসুক, তিনি সংকেত বা গুলি করার আগে কেউ যেন গুলি না করেন।
ঠিক একটা ২০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের অ্যাম্বুশে প্রবেশ করে। তারা বেশ নিশ্চিন্ত মনেই আসছিল। চল্লিশ গজের মধ্যে আসামাত্র কাদের সিদ্দিকী এলএমজি দিয়ে প্রথম গুলি শুরু করেন। একই সময় তাঁর সহযোদ্ধাদের অস্ত্রও গর্জে ওঠে। নিমেষে সামনের কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকি সেনারা প্রতিরোধ তো দূরের কথা, জীবন বাঁচানোর জন্য দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে।
এ দৃশ্য কাদের সিদ্দিকীকে উত্তেজিত করে। তিনি শোয়া অবস্থা থেকে উঠে পড়েন। দাঁড়িয়ে এলএমজি দিয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। তাঁর সহযোদ্ধারাও উঠে দাঁড়িয়ে গুলি শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা গুলি করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে থাকে।
এ সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলি ছুটে আসে আবদুল কাদের সিদ্দিকীর দিকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন তিনি। তার পরও তিনি দমে যাননি। আহত অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধ শেষে সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়। সেদিন তাঁদের হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৪০ জন হতাহত হয়।
আবদুল কাদের সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। সামরিক প্রশিক্ষণও তাঁর ছিল। স্কুলে পড়াকালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেনাবাহিনীতে কিছুদিন চাকরি করেন। ১৯৬৭ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার শিক্ষাজীবনে ফিরে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৮।
আবদুল কাদের সিদ্দিকী ১৯৭৫ সালে টাঙ্গাইলের গভর্নর নিযুক্ত হন। একই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তিনি ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে যান। ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি। তিনি দলটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামে। তবে স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম আবদুল আলী সিদ্দিকী, মা লতিফা সিদ্দিকী। স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকী। তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময়, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.