ব্যাক্তির কাছেই ডুবল পদ্মা সেতু
একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করতে গিয়েই ডুবল দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অথচ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী আড়াই বছর আগে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হতো না, এমন মতই প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
তাদের মতে, ব্যক্তিস্বার্থই পদ্মা সেতুর সর্বনাশ করেছে। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সব স্বার্থের বাইরে গিয়ে সরকারের প্রথম বছরে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে পারলে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হতো না। আবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের পর সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিলেও দাতা গোষ্ঠীর বলার কিছুই থাকত না। কিন্তু কোনো পদক্ষপ না নেওয়ায় তৈরি হয়েছে আজকের এই সংকট।
বিশেষজ্ঞরা জানান, গত তিন দিনে দফায় দফায় বৈঠক করেও দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সমঝোতা না হওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণের আশা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি না করার পক্ষে দুদক অবস্থান নিলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তাদের আলোচনা ভেঙে যায়। পরে শুধু সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। কিন্তু আবুল হোসেনকে আসামি না করার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। আবুল হোসেনের পক্ষে দুদকের অবস্থান পরিবর্তন না হওয়ায় নাখোশ হয়েই বুধবার ফিরে যান প্যানেলের সদস্যরা। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়ল। এর আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সেতু প্রকল্পের ১২০ কোটি ডলার ঋণের অর্থ বাংলাদেশ পাবে না বলে জানিয়ে দেন ঢাকার বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন। তিনি বলেন, দুদককে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সেতুকে বাস্তবে পরিণত করার বিষয়টি এখন দুদকের হাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন আবুল হোসেনের স্বার্থের কাছেই ডুবল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। মোট ২৯১ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণ ছাড়াও এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে।
যেভাবে সংকট তৈরি হয় : আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনের আগে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৫.২ ধারায় পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সরকার গঠনের চার বছরের মাথায় এসে অনেক টানাপড়েন শেষে সরকারের একজন মন্ত্রীর স্বার্থের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প। এর আগে এ সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ৩০ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে সেতু নির্মাণের বেশির ভাগ অর্থের জোগানদাতা বিশ্বব্যাংক। এর আগে তারা সরকারকে চারটি শর্ত পূরণের আহ্বান জানায়। সরকার এ ব্যাপারে প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়। এ সময় মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকও সই করে সরকার। পরে যোগাযোগমন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে এবং অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে ছুটিতে পাঠিয়ে শর্ত মেনে সরকার পুনরর্থায়নের অনুরোধ জানালে ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসে বিশ্বব্যাংক। এ সময় তারা আরও চারটি শর্ত দেয়। এর মধ্যে দুর্নীতি অনুসন্ধানে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঢাকা সফর করে অর্থ উপদেষ্টা মসিউর ও সৈয়দ আবুলসহ আরও কজনকে ফের জিজ্ঞাসাবাদের পরামর্শ দেয়। কারণ মসিউর রহমান পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর ছিলেন। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দলটি কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী তদন্তকাজ করতে দুদককে পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি তদন্ত শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অনুরোধ জানায়। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া মাত্র অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেয় তারা।
সেই ডায়রির পাতায় : পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে_এমন অভিযোগ ওঠার পর সর্বপ্রথম কানাডীয় পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্তকালে কানাডা পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয় থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজকর্ম-সংক্রান্ত একটি গোপন ডায়েরি জব্দ করে। ওই ডায়েরিতে ঘুষের টাকা দাবি-সংক্রান্ত একটি তালিকা পাওয়া যায়। ওই তালিকায় প্রথমেই লেখা হয়, 'দাবি অনুযায়ী তাদের কিছু দিতে হবে।' পরে সিরিয়াল অনুযায়ী কজনের নাম লেখা হয়। কানাডীয় নাগরিক রমেশ সাহার ডায়েরিতে দুর্নীতির তালিকায় প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয় তিন ব্যক্তির নাম। তারা হচ্ছেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এরপর সম্পূর্ণরূপে লেখা হয় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও নিঙ্ন চৌধুরীর নাম। প্রথমে কানাডীয় পুলিশ তদন্তের কিছু তথ্য-উপাত্তসহ নামের তালিকাটি বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক ওই তালিকা দুদকে পাঠিয়ে দেয়। এ তালিকার বাইরেও একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পায় কমিশন। তালিকায় উল্লেখ থাকা ব্যক্তিদেরসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করছে কমিশন।
আলোর দেখা পায় দুদক : পদ্মা সেতুর দুর্নীতি অনুসন্ধান বিষয়ে সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা এত দিন অন্ধকারে ছিলাম, আলোর দেখা পেয়েছি।' এ ছাড়া তাদের তদন্ত কর্মকর্তারা এরই মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িতদের শনাক্ত করতে পেরেছেন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তিনি যিনিই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদক সূত্র জানায়, কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ সাহার ডায়েরিতে লিখে রাখা ঘুষের তালিকায় যে পাঁচজনের নাম পাওয়া গেছে, সে তালিকা অনুযায়ী তদন্ত শেষে মামলা দায়েরের সুপারিশসহ প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কর্মকর্তারা কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া মাত্র এর সারসংক্ষেপ বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে পাঠানো হবে। আর এর পরই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা হবে মামলা।অভিযোগ এসএনসি-লাভালিনকে নিয়ে : ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয় পরামর্শকরা। মূল সেতু, সংযোগ সড়কসহ পাঁচটি প্যাকেজে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন ঠিকাদাররা দরপত্রে অংশ নেয়। কিন্তু যাচাই-প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠলে বিশ্বব্যাংক অনুমোদন আটকে দেয়। অথচ সেতু নির্মাণের নামে ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। আর এই অনিয়মের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের তদারকি ও ব্যবস্থাপনা-পরামর্শক নিয়োগেও গুরুতর অভিযোগ ওঠে। যাচাই-বাছাই না করে তদারকি পরামর্শক হিসেবে কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের অনুমতির জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এই নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। আর এ অভিযোগ ওঠে মন্ত্রী আবুল হোসেনের প্রতি। বিশ্বব্যাংক অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে নামে। গত বছরের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান 'সৈয়দ আবুল হোসেন কোম্পানি' সংক্ষেপে সাকো ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে শীর্ষ ব্যক্তিরা ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কমিশন চেয়েছে। এর পরই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ পড়ে অনিশ্চয়তার মুখে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সরকার আবুল হোসেনকে আসামি করা নিয়ে গোঁয়ার্তুমি অব্যাহত রাখায় পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। পাশাপাশি সরকার যে বড় বড় দুর্নীতিবাজকে আড়াল করতে চায় তা বিশ্বের কাছে প্রমাণিত হচ্ছে। সরকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে তার ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তায় ধস নেমে আসবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের নজরদারিতে সরকার আগেই রাজি হয়েছে। এখন শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে কাজ করতে হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে এখন আর দরকষাকষির সুযোগ নেই। আবুল হোসেনকে আসামি করলে সরকার রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক ফল পাবে। সরকার বলতে পারবে, দুর্নীতিবাজ যত বড়ই হোক না কেন আমরা ছাড় দিই না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
যেভাবে সংকট তৈরি হয় : আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনের আগে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৫.২ ধারায় পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সরকার গঠনের চার বছরের মাথায় এসে অনেক টানাপড়েন শেষে সরকারের একজন মন্ত্রীর স্বার্থের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প। এর আগে এ সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ৩০ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে সেতু নির্মাণের বেশির ভাগ অর্থের জোগানদাতা বিশ্বব্যাংক। এর আগে তারা সরকারকে চারটি শর্ত পূরণের আহ্বান জানায়। সরকার এ ব্যাপারে প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়। এ সময় মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকও সই করে সরকার। পরে যোগাযোগমন্ত্রীকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে এবং অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে ছুটিতে পাঠিয়ে শর্ত মেনে সরকার পুনরর্থায়নের অনুরোধ জানালে ২০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসে বিশ্বব্যাংক। এ সময় তারা আরও চারটি শর্ত দেয়। এর মধ্যে দুর্নীতি অনুসন্ধানে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঢাকা সফর করে অর্থ উপদেষ্টা মসিউর ও সৈয়দ আবুলসহ আরও কজনকে ফের জিজ্ঞাসাবাদের পরামর্শ দেয়। কারণ মসিউর রহমান পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর ছিলেন। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দলটি কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী তদন্তকাজ করতে দুদককে পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি তদন্ত শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যেই বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অনুরোধ জানায়। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া মাত্র অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেয় তারা।
সেই ডায়রির পাতায় : পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে_এমন অভিযোগ ওঠার পর সর্বপ্রথম কানাডীয় পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্তকালে কানাডা পুলিশ এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয় থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজকর্ম-সংক্রান্ত একটি গোপন ডায়েরি জব্দ করে। ওই ডায়েরিতে ঘুষের টাকা দাবি-সংক্রান্ত একটি তালিকা পাওয়া যায়। ওই তালিকায় প্রথমেই লেখা হয়, 'দাবি অনুযায়ী তাদের কিছু দিতে হবে।' পরে সিরিয়াল অনুযায়ী কজনের নাম লেখা হয়। কানাডীয় নাগরিক রমেশ সাহার ডায়েরিতে দুর্নীতির তালিকায় প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয় তিন ব্যক্তির নাম। তারা হচ্ছেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এরপর সম্পূর্ণরূপে লেখা হয় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও নিঙ্ন চৌধুরীর নাম। প্রথমে কানাডীয় পুলিশ তদন্তের কিছু তথ্য-উপাত্তসহ নামের তালিকাটি বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক ওই তালিকা দুদকে পাঠিয়ে দেয়। এ তালিকার বাইরেও একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পায় কমিশন। তালিকায় উল্লেখ থাকা ব্যক্তিদেরসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করছে কমিশন।
আলোর দেখা পায় দুদক : পদ্মা সেতুর দুর্নীতি অনুসন্ধান বিষয়ে সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা এত দিন অন্ধকারে ছিলাম, আলোর দেখা পেয়েছি।' এ ছাড়া তাদের তদন্ত কর্মকর্তারা এরই মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িতদের শনাক্ত করতে পেরেছেন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তিনি যিনিই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদক সূত্র জানায়, কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ সাহার ডায়েরিতে লিখে রাখা ঘুষের তালিকায় যে পাঁচজনের নাম পাওয়া গেছে, সে তালিকা অনুযায়ী তদন্ত শেষে মামলা দায়েরের সুপারিশসহ প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কর্মকর্তারা কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়া মাত্র এর সারসংক্ষেপ বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে পাঠানো হবে। আর এর পরই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা হবে মামলা।অভিযোগ এসএনসি-লাভালিনকে নিয়ে : ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয় পরামর্শকরা। মূল সেতু, সংযোগ সড়কসহ পাঁচটি প্যাকেজে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন ঠিকাদাররা দরপত্রে অংশ নেয়। কিন্তু যাচাই-প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠলে বিশ্বব্যাংক অনুমোদন আটকে দেয়। অথচ সেতু নির্মাণের নামে ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। আর এই অনিয়মের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের তদারকি ও ব্যবস্থাপনা-পরামর্শক নিয়োগেও গুরুতর অভিযোগ ওঠে। যাচাই-বাছাই না করে তদারকি পরামর্শক হিসেবে কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের অনুমতির জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এই নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। আর এ অভিযোগ ওঠে মন্ত্রী আবুল হোসেনের প্রতি। বিশ্বব্যাংক অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে নামে। গত বছরের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান 'সৈয়দ আবুল হোসেন কোম্পানি' সংক্ষেপে সাকো ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে শীর্ষ ব্যক্তিরা ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কমিশন চেয়েছে। এর পরই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ পড়ে অনিশ্চয়তার মুখে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সরকার আবুল হোসেনকে আসামি করা নিয়ে গোঁয়ার্তুমি অব্যাহত রাখায় পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। পাশাপাশি সরকার যে বড় বড় দুর্নীতিবাজকে আড়াল করতে চায় তা বিশ্বের কাছে প্রমাণিত হচ্ছে। সরকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে তার ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তায় ধস নেমে আসবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের নজরদারিতে সরকার আগেই রাজি হয়েছে। এখন শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে কাজ করতে হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে এখন আর দরকষাকষির সুযোগ নেই। আবুল হোসেনকে আসামি করলে সরকার রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক ফল পাবে। সরকার বলতে পারবে, দুর্নীতিবাজ যত বড়ই হোক না কেন আমরা ছাড় দিই না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
No comments