বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৮৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম রণকৌশলী এক যোদ্ধা ১৯৭১ সালে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মহকুমা পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) ছিলেন।
মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি আশপাশের মহকুমায় কর্মরত কয়েকজন বাঙালি বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তাকে আলোচনার জন্য ঝিনাইদহে আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ঝিনাইদহে যান। ২১ থেকে ২৩ মার্চ তাঁরা আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত নেন, যদি সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত হয়, তবে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করলে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ তাঁর নির্দেশে স্থানীয় পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করেন। এরপর তিনি চুয়াডাঙ্গায় যান। সেখানে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও (ব্যারিস্টার) আমীর-উল ইসলামকে তিনি ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম, তখন মেহেরপুরের এসডিও) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চ্যাংখালী চেকপোস্টে নিয়ে যান।
১ এপ্রিল ভোরে যশোর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঝিনাইদহে রওনা হয়। পথিমধ্যে বিষয়খালীতে ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাধা দেন। তখন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে যায়। এ যুদ্ধে মাহবুব উদ্দিন সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এ যুদ্ধে বিজয়ের পরও নেতৃত্বের অভাবে মুক্তিযোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। কারণ তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত সামরিক কর্মকর্তা ছিল না। এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তাঁর বাহিনীতে মাহবুব উদ্দিনসহ কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তাঁদের সরাসরি ক্যাপ্টেন র্যাং কে কমিশন দিয়ে ব্যাজ পরিয়ে দেন।
এভাবে ঝিনাইদহ মহকুমা এলাকায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড পুনরায় সংগঠিত হয়। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে ঝিনাইদহ মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। এপ্রিল মাসের শেষে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ক্রমে সাংগঠনিক রূপ পায়। সেক্টর গঠিত হয়। তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন একটি সাব-সেক্টরে অধিনায়কের দায়িত্ব পান।
সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা এলাকায় ছিলেন। ২৮-২৯ মে সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে তাঁর দলকে নেতৃত্ব দেন। সরাসরি যুদ্ধও করেন। তিনি ও তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধারা অসাধারণ রণকৌশল প্রদর্শন করেন। যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার কাকডাঙ্গা-বেলেডাঙ্গা-সোনাবাড়িয়ায় কয়েক দিন ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের একটি ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় যুদ্ধ। মূল আক্রমণকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শফিকউল্লাহ (বীর প্রতীক, পরে কর্নেল)। তাঁরা বিরামহীনভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে নিজ নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে দুই দলের মুক্তিযোদ্ধারাই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। মাহবুব উদ্দিনের রণকৌশল ও বিচক্ষণতায় মুক্তিযোদ্ধারা চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পান। এ যুদ্ধে তিনি আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৮।
মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বর্তমানে ব্যবসায়ী এবং ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার সদর উপজেলার আমানতগঞ্জে। তাঁর বাবার নাম আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, মা জেবুননেছা বেগম। স্ত্রী নূপুর আহমেদ। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করলে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ তাঁর নির্দেশে স্থানীয় পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করেন। এরপর তিনি চুয়াডাঙ্গায় যান। সেখানে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও (ব্যারিস্টার) আমীর-উল ইসলামকে তিনি ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম, তখন মেহেরপুরের এসডিও) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চ্যাংখালী চেকপোস্টে নিয়ে যান।
১ এপ্রিল ভোরে যশোর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঝিনাইদহে রওনা হয়। পথিমধ্যে বিষয়খালীতে ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাধা দেন। তখন সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা পিছু হটে যায়। এ যুদ্ধে মাহবুব উদ্দিন সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এ যুদ্ধে বিজয়ের পরও নেতৃত্বের অভাবে মুক্তিযোদ্ধারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। কারণ তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত সামরিক কর্মকর্তা ছিল না। এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তাঁর বাহিনীতে মাহবুব উদ্দিনসহ কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তাঁদের সরাসরি ক্যাপ্টেন র্যাং কে কমিশন দিয়ে ব্যাজ পরিয়ে দেন।
এভাবে ঝিনাইদহ মহকুমা এলাকায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড পুনরায় সংগঠিত হয়। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে ঝিনাইদহ মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। এপ্রিল মাসের শেষে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ক্রমে সাংগঠনিক রূপ পায়। সেক্টর গঠিত হয়। তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন একটি সাব-সেক্টরে অধিনায়কের দায়িত্ব পান।
সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা এলাকায় ছিলেন। ২৮-২৯ মে সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে তাঁর দলকে নেতৃত্ব দেন। সরাসরি যুদ্ধও করেন। তিনি ও তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধারা অসাধারণ রণকৌশল প্রদর্শন করেন। যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার কাকডাঙ্গা-বেলেডাঙ্গা-সোনাবাড়িয়ায় কয়েক দিন ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের একটি ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় যুদ্ধ। মূল আক্রমণকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শফিকউল্লাহ (বীর প্রতীক, পরে কর্নেল)। তাঁরা বিরামহীনভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে নিজ নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে দুই দলের মুক্তিযোদ্ধারাই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। মাহবুব উদ্দিনের রণকৌশল ও বিচক্ষণতায় মুক্তিযোদ্ধারা চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পান। এ যুদ্ধে তিনি আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৮।
মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বর্তমানে ব্যবসায়ী এবং ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার সদর উপজেলার আমানতগঞ্জে। তাঁর বাবার নাম আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, মা জেবুননেছা বেগম। স্ত্রী নূপুর আহমেদ। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments