গাভির খামারে সখিনার দিনবদল by আনোয়ার পারভেজ
নিতান্ত দরিদ্র একটি পরিবার। টাকার অভাবে ভালো একটি শাড়িও কেনা হয়নি কখনো। হঠাৎ একদিন স্বামী আবদুল মজিদের কাছে একটি গাভি কিনে আনার আবদার করেন সখিনা। একটি গাভি থেকে দুটি। দুটি থেকে চারটি। এভাবে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪টি গরুর মালিক এই দম্পতি।
গড়ে তুলেছেন বিশাল দুগ্ধ খামার।
সখিনা-মজিদ দম্পতির বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। তাঁদের অভাবের সংসার এখন সুখ আর প্রাচুর্যে ভরপুর। বলতে গেলে শূন্য হাতে শুরু করে আজ তাঁরা সাফল্যের শিখরে উঠেছেন। পরিশ্রম আর সংগ্রাম করে সখিনা শুধু নিজের সংসারেই স্বচ্ছলতা আনেননি, পাশাপাশি গ্রামের অন্যদেরও গাভি পালনে উৎসাহিত করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। কাবিলপুর থেকে খামার-বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে সোনাতলা উপজেলার আশপাশের গ্রামগুলোয়।
সখিনা বেগম সোনাতলার জীবনপুর গ্রামের আবদুল করিম শেখের মেয়ে। ১৯৮২ সালে একই উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের আবদুল মজিদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বল্পশিক্ষিত স্বামীর তখন আয়-রোজগার ছিল না। অভাবের কাছে হার মানেননি সখিনা। কিছু একটা করার সংকল্প নিয়ে বাবার দেওয়া সোনার বালা ৫০০ টাকায় বিক্রি করে এ অর্থ তুলে দেন স্বামীর হাতে। স্বামী শুরু করেন হাটে হাটে ধান কেনার ব্যবসা। কয়েক বছর পর সখিনাকে একটি গাভি কিনে দেন মজিদ। সেই একটি গাভিই তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। সখিনা গড়ে তুলেছেন দুগ্ধ খামার। ওই খামারের নাম ‘সখিনা ডেইরি খামার’। ২০০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
যেভাবে শুরু: বাইসাইকেলে চড়ে গ্রামের হাটবাজারে গিয়ে ধান ও চালের ব্যবসা করতেন মজিদ। সখিনা একদিন আবদার করলেন, ধান ভাঙার পর তুষ ও চালের কুঁড়া থেকে যায়। একটা গাভি থাকলে এসব খাওয়ানো যেত। মজিদ বলেন, ‘সখিনা বিয়ের পর কোনো কিছুরই আবদার করেনি। এত দিন পর একটা গাভি চেয়েছে। সালটা ১৯৯৮ হবে। পাশের নামাজখালী গ্রামে গিয়ে সুভাষ ঘোষ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকায় একটি বিদেশি গাভি কিনে বাড়িতে নিয়ে আসি। সেই যে শুরু, তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
দুগ্ধ খামারে একদিন: বগুড়া শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে কাবিলপুর গ্রাম। সখিনার পাকা বাড়ির পাশেই প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গাজুড়ে বিশাল দুগ্ধ খামার।
সখিনা জানান, দুধেল গাভির মধ্যে ২০টি ফ্রিজিয়ান, ২০টি শাহিওয়াল ও পাঁচটি জার্সি জাতের। ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি ৩০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। দুগ্ধ খামারে কোনো এঁড়ে বাছুর রাখেন না তিনি। দুধ দেওয়া শেষ হলেই তা বিক্রি করে দেন। যে গাভি দিয়ে খামার শুরু করেছিলেন, সেটিও রয়েছে খামারে। সখিনা-মজিদ দম্পতি গাভিটিকে আদর করে ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকেন। খামারের একপাশে বায়োগ্যাস প্লান্ট; অন্যপাশে কয়েক বিঘাজুড়ে লাগানো হয়েছে খামারের গাভির খাবারের জন্য নিপিয়ার ঘাস।
ভাগ্যবদলের উপাখ্যান: সখিনা বলেন, ‘আমাদের এক শতাংশ জমিও ছিল না। প্রথমে খামারের জন্য ৪০ শতাংশ জায়গা কিনেছি। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে খামারে তিনটি শেড দিয়েছি। শেডগুলোর মেঝেতে ইট বিছিয়েছি। পানি সরবরাহের জন্য বৈদ্যুতিক মোটর কিনেছি। প্রতিটি শেডে বৈদ্যুতিক পাখা লাগিয়েছি। খামারের আয় দিয়ে পাঁচ বিঘা আবাদি জমি কিনেছি। আরও পাঁচ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছি।’
সখিনা আরও জানান, খামারে এখন কোটি টাকার গরু রয়েছে। চালের ব্যবসায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার পুঁজি খাটছে। বড় ছেলে শাহাদত হোসেন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে মাস্টার্সে পড়ছেন। ছোট ছেলে আজাদ হোসেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে লেখাপড়া করছেন।
আয়-ব্যয়: খামারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখেন মজিদ। তিনি জানান, বর্তমানে ২৫টি গাভি দুধ দিচ্ছে। এসব গাভি থেকে দিনে গড়ে ৪০০ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। সেই হিসাবে প্রতিদিন দুধ বিক্রি থেকে আয় হয় ১৬ হাজার টাকা। খাদ্য আর শ্রমিকের মজুরি বাবদ খামারে প্রতিদিন ব্যয় প্রায় চার হাজার টাকা। দুধ দোহানোর পর খামারের শ্রমিকেরা তা উপজেলা সদরের ব্র্যাক ডেইরি ও প্রাণের সংগ্রহকেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন।
এলাকায় খামার-বিপ্লব: সখিনার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সোনাতলা উপজেলায় অনেকেই দুগ্ধ খামার করেছেন। কাবিলপুরের জাকির হোসেন, আবদুল হামিদ; রানীরপাড়ার পিন্টু মিয়া, শফিকুল ইসলাম; গড়চৈতন্যপুরের লতিফ খলিফা; সোনাতলা বন্দরের সোনা মিয়া, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকেই এখন সফল দুগ্ধখামারি। প্রতিদিনই লোকজন আসেন সখিনা-মজিদ দম্পতির কাছে খামার সম্পর্কে নানা পরামর্শ নিতে। এই দম্পতির পরামর্শ নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন ৬৫টি দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে।
অন্যরা যা বলেন: উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, সখিনা-মজিদ দম্পতি ডেইরি খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে এলাকার দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করছেন। তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবদলের পাশাপাশি অন্যদের খামার গড়ার পরামর্শ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছেন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আহসানুল তৈয়ব জাকির বলেন, ‘সখিনা-মজিদ দম্পতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁদের সংসারে একসময় খুব অভাব-অনটন ছিল। গাভির খামার তাঁদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।’
সখিনা-মজিদ দম্পতির বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। তাঁদের অভাবের সংসার এখন সুখ আর প্রাচুর্যে ভরপুর। বলতে গেলে শূন্য হাতে শুরু করে আজ তাঁরা সাফল্যের শিখরে উঠেছেন। পরিশ্রম আর সংগ্রাম করে সখিনা শুধু নিজের সংসারেই স্বচ্ছলতা আনেননি, পাশাপাশি গ্রামের অন্যদেরও গাভি পালনে উৎসাহিত করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। কাবিলপুর থেকে খামার-বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে সোনাতলা উপজেলার আশপাশের গ্রামগুলোয়।
সখিনা বেগম সোনাতলার জীবনপুর গ্রামের আবদুল করিম শেখের মেয়ে। ১৯৮২ সালে একই উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের আবদুল মজিদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বল্পশিক্ষিত স্বামীর তখন আয়-রোজগার ছিল না। অভাবের কাছে হার মানেননি সখিনা। কিছু একটা করার সংকল্প নিয়ে বাবার দেওয়া সোনার বালা ৫০০ টাকায় বিক্রি করে এ অর্থ তুলে দেন স্বামীর হাতে। স্বামী শুরু করেন হাটে হাটে ধান কেনার ব্যবসা। কয়েক বছর পর সখিনাকে একটি গাভি কিনে দেন মজিদ। সেই একটি গাভিই তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। সখিনা গড়ে তুলেছেন দুগ্ধ খামার। ওই খামারের নাম ‘সখিনা ডেইরি খামার’। ২০০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
যেভাবে শুরু: বাইসাইকেলে চড়ে গ্রামের হাটবাজারে গিয়ে ধান ও চালের ব্যবসা করতেন মজিদ। সখিনা একদিন আবদার করলেন, ধান ভাঙার পর তুষ ও চালের কুঁড়া থেকে যায়। একটা গাভি থাকলে এসব খাওয়ানো যেত। মজিদ বলেন, ‘সখিনা বিয়ের পর কোনো কিছুরই আবদার করেনি। এত দিন পর একটা গাভি চেয়েছে। সালটা ১৯৯৮ হবে। পাশের নামাজখালী গ্রামে গিয়ে সুভাষ ঘোষ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকায় একটি বিদেশি গাভি কিনে বাড়িতে নিয়ে আসি। সেই যে শুরু, তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
দুগ্ধ খামারে একদিন: বগুড়া শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে কাবিলপুর গ্রাম। সখিনার পাকা বাড়ির পাশেই প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গাজুড়ে বিশাল দুগ্ধ খামার।
সখিনা জানান, দুধেল গাভির মধ্যে ২০টি ফ্রিজিয়ান, ২০টি শাহিওয়াল ও পাঁচটি জার্সি জাতের। ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি ৩০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। দুগ্ধ খামারে কোনো এঁড়ে বাছুর রাখেন না তিনি। দুধ দেওয়া শেষ হলেই তা বিক্রি করে দেন। যে গাভি দিয়ে খামার শুরু করেছিলেন, সেটিও রয়েছে খামারে। সখিনা-মজিদ দম্পতি গাভিটিকে আদর করে ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকেন। খামারের একপাশে বায়োগ্যাস প্লান্ট; অন্যপাশে কয়েক বিঘাজুড়ে লাগানো হয়েছে খামারের গাভির খাবারের জন্য নিপিয়ার ঘাস।
ভাগ্যবদলের উপাখ্যান: সখিনা বলেন, ‘আমাদের এক শতাংশ জমিও ছিল না। প্রথমে খামারের জন্য ৪০ শতাংশ জায়গা কিনেছি। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে খামারে তিনটি শেড দিয়েছি। শেডগুলোর মেঝেতে ইট বিছিয়েছি। পানি সরবরাহের জন্য বৈদ্যুতিক মোটর কিনেছি। প্রতিটি শেডে বৈদ্যুতিক পাখা লাগিয়েছি। খামারের আয় দিয়ে পাঁচ বিঘা আবাদি জমি কিনেছি। আরও পাঁচ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছি।’
সখিনা আরও জানান, খামারে এখন কোটি টাকার গরু রয়েছে। চালের ব্যবসায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার পুঁজি খাটছে। বড় ছেলে শাহাদত হোসেন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে মাস্টার্সে পড়ছেন। ছোট ছেলে আজাদ হোসেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে লেখাপড়া করছেন।
আয়-ব্যয়: খামারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখেন মজিদ। তিনি জানান, বর্তমানে ২৫টি গাভি দুধ দিচ্ছে। এসব গাভি থেকে দিনে গড়ে ৪০০ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। সেই হিসাবে প্রতিদিন দুধ বিক্রি থেকে আয় হয় ১৬ হাজার টাকা। খাদ্য আর শ্রমিকের মজুরি বাবদ খামারে প্রতিদিন ব্যয় প্রায় চার হাজার টাকা। দুধ দোহানোর পর খামারের শ্রমিকেরা তা উপজেলা সদরের ব্র্যাক ডেইরি ও প্রাণের সংগ্রহকেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন।
এলাকায় খামার-বিপ্লব: সখিনার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সোনাতলা উপজেলায় অনেকেই দুগ্ধ খামার করেছেন। কাবিলপুরের জাকির হোসেন, আবদুল হামিদ; রানীরপাড়ার পিন্টু মিয়া, শফিকুল ইসলাম; গড়চৈতন্যপুরের লতিফ খলিফা; সোনাতলা বন্দরের সোনা মিয়া, সিরাজুল ইসলামসহ অনেকেই এখন সফল দুগ্ধখামারি। প্রতিদিনই লোকজন আসেন সখিনা-মজিদ দম্পতির কাছে খামার সম্পর্কে নানা পরামর্শ নিতে। এই দম্পতির পরামর্শ নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন ৬৫টি দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে।
অন্যরা যা বলেন: উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, সখিনা-মজিদ দম্পতি ডেইরি খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে এলাকার দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করছেন। তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবদলের পাশাপাশি অন্যদের খামার গড়ার পরামর্শ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছেন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আহসানুল তৈয়ব জাকির বলেন, ‘সখিনা-মজিদ দম্পতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁদের সংসারে একসময় খুব অভাব-অনটন ছিল। গাভির খামার তাঁদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।’
No comments