শ্রদ্ধাঞ্জলি- আমার হাতেম দাদু by ডা. মানস কুমার গোস্বামী
লোকটিকে আমি ছেলেবেলায় দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের আগে কিছুদিন। তখন উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের সূত্রাপুরের বাড়িটায় কখনো আসতেন। এই বাড়িটা তখন বামপন্থী বিপ্লবীদের একটা মিলনক্ষেত্র ছিল। এই বাড়িতে থাকতেন জিতেন ঘোষ, জ্ঞান চক্রবর্তী। আসতেন অনিল মুখার্জি, মণি সিংহ প্রমুখ বিপ্লবীরা।
আর আসতেন তরুণ ছাত্রনেতারা। এঁদেরই একজন হলেন হাতেম আলী খান। যুদ্ধের পরও কয়েক বছর তিনি আসতেন একটা সাদা পাজামা, খদ্দরের খাকি পাঞ্জাবি আর কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে। শুকনো গাল, গোঁফে ভরা মুখ—তখন আমার শিশুমনে তাঁকে সুকুমার রায়ের গোঁফ চুরির ওই বড় বাবুর ছবিটার মতো মনে হতো। কথা বলতেন খাঁটি টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলের ভাষায়। চলাফেরায় অতি সাধারণ শান্ত সৌম্য, ধীর লয়ে নিচু গলায় বাবার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলতেন। আমার কাছে অতি সাধারণ নগণ্য বলে মনে হতো তাঁকে। বিশেষত, জিতেন ঘোষের লম্বা দোহারা ফরসা চেহারা, পুরু লেন্সের চশমা, একমাথা টাক আর গমগমে গলার স্বরের কাছে তাঁকে বড়ই দুর্বল মনে হতো। হাতেম আলী খান—আমার হাতেম দাদু। এই সাধারণ একটা লোক কতখানি অসাধারণ ছিলেন, তা পরে জেনে বুঝেছি। তিনি আমার মনে একান্ত একটা জায়গা করে নিয়েছেন।
ইংরেজি ১৯০৪ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি (১০ অগ্রহায়ণ) জন্ম টাঙ্গাইল মহকুমার হেমনগর ইউনিয়নের বেলুয়া গ্রামে। জমিদারবাড়ির ছোট ছেলে হাতেম আলী খানের শরীরে জমিদার-রক্ত থাকলেও মনে তাঁর জন্ম নিয়েছিল গ্রামের শোষিত রায়ত কৃষক প্রজাকুলের জন্য অপার ভালোবাসা। এ থেকেই বালক বয়সেই ভিড়ে যান স্বদেশি বিপ্লবীদের সংগঠনগুলোর একটি অনুশীলন পার্টির দিকে। তারপর ১৯২০-এ কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে একদিন হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মিছিলে ‘বন্দে মাতরম’ ‘ব্রিটিশ কুকুর ভারত ছাড়’ ধ্বনির স্রোতে মিলেমিশে হূদয়ের উত্তাল সমুদ্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ঢেউ জেগে উঠেছিল, তা ক্রমে শত সহস্র হয়ে জীবনসাগরে আলোড়িত হতে থাকে। হাতেম আলী খান ক্রমে পরিণত হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ বিপ্লবী রূপে। নিজেকে শুদ্ধ করে, মুক্ত করে, নিঃস্ব করে আত্মনিয়োগ করেন মানবসেবায়। তিনি বুঝেছিলেন, গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অর্থ হবে শুধুই ব্রিটিশ থেকে দেশি শোষকের হাতে ক্ষমতার হাতবদল মাত্র। তাই তাঁর ভেতরে জেগে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী প্রতিহিংসার পাশাপাশি দেশি সামন্ত রাজা প্রভুবিরোধী বিদ্রোহের আগুন। নিজের ঘর থেকে শুরু হয়ে নিজ গ্রামের আশপাশের জমিদারবিরোধী বিদ্রোহ, কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি হয়ে কৃষক সমিতি গঠনের মাধ্যমে সেই আগুন এসে লাগে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের গায়ে। জীবনের এই দীর্ঘ বন্ধুর পথপরিক্রমায় তিনি নিয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের ব্রত। অনেক স্কুল-মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করেছেন, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টগিরি করেছেন, নিজে অভুক্ত থেকে খাবার জুগিয়েছেন নিরন্নদের মুখে; আক্ষরিক এবং বাস্তবিক অর্থেই, শুধু ভাবার্থে নয়। আর তাঁর এই আন্দোলনমুখর কর্মময় জীবনে জমিদারের পাইক-বরকন্দাজের অত্যাচার থেকে শুরু করে জেলজীবনে অসংখ্যবার অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অত্যাচারে প্রায় অচল হয়ে যাওয়া শরীরে অসহ্য ব্যথায় কাতরাতে আমিও তাঁকে দেখেছি অনেক দিন।
আমার মা অক্ষরজ্ঞানহীন খুবই সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। এ রকম একজন মানুষের হূদয়ে কীভাবে এই বিপ্লবীদের কর্মময় জীবন শ্রদ্ধার ভালোবাসার আসন পেয়েছিল, আমার ভাবতে অবাক লাগে। ঘরে একটু ভালো রান্না হলেই মা সবার আগে জিতেন দাদু, হাতেম দাদুর জন্য পাঠিয়ে দিতেন। তাঁদের প্রতি ছিল মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা।
আমার মায়ের বাবা হেমনগর জমিদারের সভাপণ্ডিত ছিলেন। আর সেই সুবাদে হাতেম দাদুর প্রতি আমার মায়ের একটা আলাদা নাড়ির টানও ছিল। মনে আছে, হাতেম দাদু এলে মা ডেকে এনে আমাদের ওপরতলার ঘরে চাটাই পেতে খেতে দিতেন। তন্ময় হয়ে তাঁর জীবনের কাহিনি শুনতেন। শুনতেন জেলজীবনে তাঁর ওপর নারকীয় অত্যাচারের কাহিনি। আর রান্নার অবসরে চুলার সামনে বসে বসে একাই সেই অত্যাচারের গল্পগুলো আওড়াতেন। হাতেম দাদু সম্পর্কে আমার জ্ঞান মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্প থেকেই। আর সে থেকেই লোকটার প্রতি আমার শিশুমনে একধরনের ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেয়।
১৯৭৭-এর দিকে তিনি যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়, আমার বড় বোনকে তাঁর বিছানার পাশে অপার স্নেহে হাত ধরে বসে থাকতে দেখেছি। ওই বছরই ২৪ অক্টোবর চলে গেলেন। ২৫ অক্টোবরের সংবাদে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পড়ে আমার বড় দিদির কান্নার দৃশ্যটা আমি কখনো ভুলব না।
হাতেম দাদুর সঙ্গে আমার কোনো দিন একটি কথাও হয়নি, তবু তাঁর কাছাকাছি বসার একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম। আমার বড় দুর্ভাগ্য, তাঁর সঙ্গে আলাপ করার বয়স হয়ে ওঠার আগেই তিনি চলে গেলেন। তবু আমি তাঁর উপস্থিতি আমার ভেতরে অনুক্ষণ অনুভব করি এবং গর্ববোধ করি যে হাতেম দাদুকে আমি সামনাসামনি দেখেছি। যখন অত্যাচার-অনাচার শোষকের বিষছোবল সীমানা ছাড়ায়, তখন ঈশ্বরের দূত হয়েই আসেন মহামানবেরা—এ কথা ছেলেবেলায় পড়েছি। আমার শৈশবজীবনে হাতেম দাদুকে সেই রকম দেবদূতের মতোই মনে হতো। এখনো তা মনে করি।
আজ ৭ ডিসেম্বর, হাতেম দাদুর জন্মদিন। একজন বড় মানুষকে এই দিনে স্মরণ করতে পারছি বলে নিজের কাছেই ভালো লাগছে।
ডা. মানস কুমার গোস্বামী
ইংরেজি ১৯০৪ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি (১০ অগ্রহায়ণ) জন্ম টাঙ্গাইল মহকুমার হেমনগর ইউনিয়নের বেলুয়া গ্রামে। জমিদারবাড়ির ছোট ছেলে হাতেম আলী খানের শরীরে জমিদার-রক্ত থাকলেও মনে তাঁর জন্ম নিয়েছিল গ্রামের শোষিত রায়ত কৃষক প্রজাকুলের জন্য অপার ভালোবাসা। এ থেকেই বালক বয়সেই ভিড়ে যান স্বদেশি বিপ্লবীদের সংগঠনগুলোর একটি অনুশীলন পার্টির দিকে। তারপর ১৯২০-এ কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে একদিন হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মিছিলে ‘বন্দে মাতরম’ ‘ব্রিটিশ কুকুর ভারত ছাড়’ ধ্বনির স্রোতে মিলেমিশে হূদয়ের উত্তাল সমুদ্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ঢেউ জেগে উঠেছিল, তা ক্রমে শত সহস্র হয়ে জীবনসাগরে আলোড়িত হতে থাকে। হাতেম আলী খান ক্রমে পরিণত হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ বিপ্লবী রূপে। নিজেকে শুদ্ধ করে, মুক্ত করে, নিঃস্ব করে আত্মনিয়োগ করেন মানবসেবায়। তিনি বুঝেছিলেন, গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অর্থ হবে শুধুই ব্রিটিশ থেকে দেশি শোষকের হাতে ক্ষমতার হাতবদল মাত্র। তাই তাঁর ভেতরে জেগে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী প্রতিহিংসার পাশাপাশি দেশি সামন্ত রাজা প্রভুবিরোধী বিদ্রোহের আগুন। নিজের ঘর থেকে শুরু হয়ে নিজ গ্রামের আশপাশের জমিদারবিরোধী বিদ্রোহ, কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি হয়ে কৃষক সমিতি গঠনের মাধ্যমে সেই আগুন এসে লাগে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের গায়ে। জীবনের এই দীর্ঘ বন্ধুর পথপরিক্রমায় তিনি নিয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের ব্রত। অনেক স্কুল-মাদ্রাসায় অধ্যাপনা করেছেন, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টগিরি করেছেন, নিজে অভুক্ত থেকে খাবার জুগিয়েছেন নিরন্নদের মুখে; আক্ষরিক এবং বাস্তবিক অর্থেই, শুধু ভাবার্থে নয়। আর তাঁর এই আন্দোলনমুখর কর্মময় জীবনে জমিদারের পাইক-বরকন্দাজের অত্যাচার থেকে শুরু করে জেলজীবনে অসংখ্যবার অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অত্যাচারে প্রায় অচল হয়ে যাওয়া শরীরে অসহ্য ব্যথায় কাতরাতে আমিও তাঁকে দেখেছি অনেক দিন।
আমার মা অক্ষরজ্ঞানহীন খুবই সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। এ রকম একজন মানুষের হূদয়ে কীভাবে এই বিপ্লবীদের কর্মময় জীবন শ্রদ্ধার ভালোবাসার আসন পেয়েছিল, আমার ভাবতে অবাক লাগে। ঘরে একটু ভালো রান্না হলেই মা সবার আগে জিতেন দাদু, হাতেম দাদুর জন্য পাঠিয়ে দিতেন। তাঁদের প্রতি ছিল মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা।
আমার মায়ের বাবা হেমনগর জমিদারের সভাপণ্ডিত ছিলেন। আর সেই সুবাদে হাতেম দাদুর প্রতি আমার মায়ের একটা আলাদা নাড়ির টানও ছিল। মনে আছে, হাতেম দাদু এলে মা ডেকে এনে আমাদের ওপরতলার ঘরে চাটাই পেতে খেতে দিতেন। তন্ময় হয়ে তাঁর জীবনের কাহিনি শুনতেন। শুনতেন জেলজীবনে তাঁর ওপর নারকীয় অত্যাচারের কাহিনি। আর রান্নার অবসরে চুলার সামনে বসে বসে একাই সেই অত্যাচারের গল্পগুলো আওড়াতেন। হাতেম দাদু সম্পর্কে আমার জ্ঞান মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্প থেকেই। আর সে থেকেই লোকটার প্রতি আমার শিশুমনে একধরনের ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেয়।
১৯৭৭-এর দিকে তিনি যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়, আমার বড় বোনকে তাঁর বিছানার পাশে অপার স্নেহে হাত ধরে বসে থাকতে দেখেছি। ওই বছরই ২৪ অক্টোবর চলে গেলেন। ২৫ অক্টোবরের সংবাদে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পড়ে আমার বড় দিদির কান্নার দৃশ্যটা আমি কখনো ভুলব না।
হাতেম দাদুর সঙ্গে আমার কোনো দিন একটি কথাও হয়নি, তবু তাঁর কাছাকাছি বসার একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম। আমার বড় দুর্ভাগ্য, তাঁর সঙ্গে আলাপ করার বয়স হয়ে ওঠার আগেই তিনি চলে গেলেন। তবু আমি তাঁর উপস্থিতি আমার ভেতরে অনুক্ষণ অনুভব করি এবং গর্ববোধ করি যে হাতেম দাদুকে আমি সামনাসামনি দেখেছি। যখন অত্যাচার-অনাচার শোষকের বিষছোবল সীমানা ছাড়ায়, তখন ঈশ্বরের দূত হয়েই আসেন মহামানবেরা—এ কথা ছেলেবেলায় পড়েছি। আমার শৈশবজীবনে হাতেম দাদুকে সেই রকম দেবদূতের মতোই মনে হতো। এখনো তা মনে করি।
আজ ৭ ডিসেম্বর, হাতেম দাদুর জন্মদিন। একজন বড় মানুষকে এই দিনে স্মরণ করতে পারছি বলে নিজের কাছেই ভালো লাগছে।
ডা. মানস কুমার গোস্বামী
No comments