হেমিংওয়ের প্যারিস by ফারুক মঈনউদ্দীন
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আমেরিকার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। যৌবনে ছিলেন প্যারিসে। মিশেছেন সেখানকার কবি, সাহিত্যিকদের সঙ্গে। তাঁর ফরাসি-যাপনের বিবিধ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এ লেখায়
সেন্ট দানি মেট্রো স্টেশন থেকে আঁভালিদাতে ট্রেন বদল করে সেন্ট মিশেল স্টেশনে নামলে মনে পড়ে, এই প্লাস সেন্ট মিশেলের একটা ক্যাফেতে সব সময় যেতেন হেমিংওয়ে। তাঁর প্যারিসের স্মৃতিকথা আ মুভেবল ফিস্ট-এ সেই ক্যাফেটাকে তিনি উল্লেখ করেছেন আ গুড ক্যাফে অন দ্য প্লাস সেন্ট মিশেল বলে। সেই ক্যাফেটি আজ আর নেই বোধ হয়, ক্যাফেটার নামও উল্লেখ করেননি তিনি। হেমিংওয়ের ভাষায়, ‘ক্যাফেটা খুব আরামদায়ক, উষ্ণ ও পরিষ্কার।’ সেই ক্যাফেতে বসেই হেমিংওয়ে একটা গল্প শেষ করার পর লেখেন, ‘যেকোনো গল্প শেষ করার পর বরাবরই আমি সঙ্গম-পরবর্তী সময়ের মতো শূন্যতা বোধে যুগপৎ বিষণ্ন ও আনন্দিত হই।’
বইপত্র, ছবি, পোশাক, স্যুভেনিরের ঝকঝকে সব দোকান, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেতে ঠাসা বুলভার্ড সেন্ট মিশেলের এক পত্রিকার দোকানে গিয়ে শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি দোকানটার নাম বলতেই লোকটা নিজের ভাষায় হাতের ইশারায় ডান-বাম করে দেখিয়ে দিল, কোন দিকে যেতে হবে। আমরা রুয় দ্য লা উসাৎ-এর হালকা ভিড় ধরে এগিয়ে যাই। এই রাস্তায় রয়েছে হোটেল দু-ম-ব্লাঁ। ত্রিশের দশকে হেমিংওয়ে প্যারিসে এলে এই হোটেলেই উঠতেন। রুয় দে লা বুশের ধরে সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। উনিশ শ বিশ এবং ত্রিশের দশকে সিলভিয়া বিচ এই নামে যে দোকানটা চালাতেন, সেটি কিন্তু এই ঠিকানায় ছিল না। দোকানের মূল বড় সাইনবোর্ডটি অপেক্ষাকৃত নতুন, সেটিতে ঢুকলে চোখে পড়ে হরেক রকমের নানা আকারের ইংরেজি বইয়ের সমাহার, আর দশটা দোকানের মতো খুব একটা গুছিয়ে রাখা নয়। বরং যেন কোনো খানদানি পড়ুয়া মানুষের বড়সড় স্টাডি। আমি কাউন্টারের মেয়েটিকে বলতে চাইলাম যে হেমিংওয়ের আ মুভেবল ফিস্ট বইটাতে এই দোকানের উল্লেখ আছে বলে দোকানটা দেখতে এসেছি আমি। মেয়েটি খুব একটা পাত্তা দেয় না, কেবল বলল, ‘না, বইটি আমাদের এখানে নেই এখন।’ আমি বলি, আছে আমার কাছে বইটা। ওটা আমার নিজের ভাষায় অনুবাদ করার পর সে বই প্রকাশিতও হয়েছে। তখন মেয়েটা ‘ওহ রিয়্যালি!’ বলে তার সংযত পাশ্চাত্য বিস্ময়ের প্রকাশ দেখায়। তারপর বলে, ‘কোন ভাষায় অনুবাদ করলেন আপনি?’ আমি তার মসৃণ লালচে চুলের শোভা দেখায় মগ্ন থেকে বলি, ‘বাংলায়’। মেয়েটি, ‘দ্যাটস গ্রেট’ বলে আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তিন সপ্তাহের ক্রমাগত ভ্রমণের কারণে ডাকাতের মতো চেহারা হয়েছে আমার, আমাকে ও রকম একটা বইয়ের অনুবাদক ভাবতে বয়েই গেছে ওর। আমি দোকানটির এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে একটা দ্রুত জরিপ চালানোর চেষ্টা করি স্বল্পতম সময়ে। পরিচিত নামের মধ্যে চোখে পড়ে হ্যারল্ড রবিনসের স্টিলেটো, জন আপডাইকের কাপল্স্্, সালমান রুশদির স্মৃতিকথা জোসেফ আন্টন, উইলিয়াম বারোজের নেকেড লাঞ্চ।
বড় সাইনবোর্ডওয়ালা দোকানটার পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা অংশের ওপরও একই সাইনবোর্ড শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, তবে সেটি দেখতে অনেক পুরোনো এবং ছোট, দোকানের বহিরঙ্গেও প্রাচীনতার ছাপ স্পষ্ট। এমনকি ষোড়শ শতাব্দীর ভবনটার অমসৃণ পাথরের দেয়ালের ওপর লাগানো কাঠের বাটাম এবং ফ্রেমগুলো দেখলে বোঝা যায়, অন্য কোথাও থেকে ওগুলো খুলে এনে লাগানো হয়েছে এখানে। সাইনবোর্ডে নামের পাশে লেখা অ্যান্টিকোয়ারিয়ান বুকস, এই অংশটি পুরোনো দুষ্প্রাপ্য বইয়ের জন্য। তবে দুটোর সাইনবোর্ডের ওপরই শেক্সপিয়ারের ছবি লাগানো।
দোকানের সামনে চওড়া চত্বরের ওপর একটা বইয়ের শেলফ, সেখানেও বহু পুরোনো বই সাজানো। সামনে ছোট একটা গাছের নিচে গোল করে বাঁধানো বেদি, সেটি ঘিরে দু-একজন বয়স্ক বেকার মানুষ অলস ভঙ্গিতে বসা। ঢোকার মুখে দরজার পাশে দু-একটা চেয়ার আর টেবিলও আছে। একটা চেয়ারে বসে কী একটা বই তন্ময় হয়ে পড়ছিল দোকানটির প্রাচীনত্বের সঙ্গে বেমানান সোনালি চুলের ঝকঝকে এক তরুণী। দোকানটার সামনের প্রশস্ত অঙ্গন উঁচু বাড়িটার স্নিগ্ধ ছায়ায় আচ্ছন্ন, এখানে একটা কফির মগ হাতে বসে থেকে বই ঘেঁটে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আমি সেই অংশটিতে ঢুকতে চাইলে ভেতর থেকে লালচে দাড়িওয়ালা এক ছোটখাটো তরুণ নড়বড়ে ফ্রেমের কাচের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে ‘ক্লোজড’ লেখা একটা কাগজের বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। আমি কাচের বাইরে থেকে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ছোকরাটির অনুমতির তোয়াক্কা না করে ভেতরে ঢুকে পড়ে বলি, ‘আমি বেশি সময় নেব না, কয়েক মিনিট কথা বলব তোমার সঙ্গে।’ তারপর আগের দোকানের মেয়েটিকে বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করি ওর কাছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চোখে পড়ে বইয়ের একটা স্তূপের ওপর আ মুভেবল ফিস্ট বইটা ডিসপ্লে করা আছে। তাই বলি, ‘তোমাদের কাছে বইটা আছে দেখছি, পাশের দোকানে নেই বলল, এটা তো এখনো দুষপ্রাপ্য হয়নি।’ ছেলেটির দাড়ির ফাঁকে ভদ্রতার হাসি দেখা যায়। জানতে চাই, এই দোকানটাই ছিল সম্ভবত হেমিংওয়ের চিঠিপত্র আসার জন্য ডাক ঠিকানা। ডেভিড নামের তরুণটি জানায়, ঠিক এটি নয়, সেই দোকান ছিল অন্য জায়গায়, যখন সিলভিয়া বিচ এটার মালকিন ছিলেন। আমি বলি, সে কথা আমার জানা আছে। তবে দোকানের এই অংশের সাইনবোর্ডটার বয়স এবং ত্যাড়া-বাঁকা চেহারা দেখে মনে হয়, এসব সিলভিয়া বিচের আদি দোকান থেকে এনে ফিট করা হয়েছে এখানে। ডেভিড জানায়, হতেও পারে, তবে ব্যাপারটা ওর ঠিক জানা নেই। তারপর বলল, ‘আপনি সিলভিয়া হুইটম্যানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। জর্জ হুইটম্যানের মেয়ে সিলভিয়াই এখন দোকানটার মালিক।’ দোকানটার ওপরের কোনো একটা অ্যাপার্টমেন্টে এখন সিলভিয়া থাকে, যেখানে থাকত ওর বাবাও।
শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি নামের বইয়ের এই যে দোকান, এটির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। দোকানটির আদি মালকিন ছিলেন সিলভিয়া বিচ, এখান থেকে ভাড়ায় বই ধার দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। ১৯১৯ সালে চালু হওয়া এই দোকানটিতে তখন নিয়মিত আনাগোনা করতেন এজরা পাউন্ড, জেমস জয়েস, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড, স্কট ফিটজেরাল্ড, গারট্রুড স্টাইন প্রমুখ লেখক। নব্য লেখক হেমিংওয়েও এখানে যাওয়া-আসা শুরু করেন সিলভিয়া বিচের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর। এটি ছিল প্যারিসে ইংরেজি ভাষাভাষী লেখক-শিল্পীদের মিলনক্ষেত্র। ইংরেজি ভাষার দুষপ্রাপ্য বইগুলো পাওয়া যেত এখানে, ছিল লেখকদের নিয়মিত আড্ডা। লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার যখন ইংল্যান্ড-আমেরিকায় নিষিদ্ধ, লন্ডন থেকে নিকটতম দূরত্বে এই দোকানে পাওয়া যেত বইটি। অশ্লীলতার অভিযোগে আমেরিকায় নিষিদ্ধ হওয়ার পর জেমস জয়েসের ইউলিসিস গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ করেন সিলভিয়া বিচ, ১৯২২ সালে। বইটির পরবর্তী প্যারিস সংস্করণগুলোও শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির নামেই প্রকাশিত হয়। জার্মানরা প্যারিস দখল করার পর ১৯৪১ সালে দোকানটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
হেমিংওয়ে খুব গরিবি হালে যখন প্যারিসে এসে লেখালেখি শুরু করেন, তখন এই বুক স্টোর থেকে ধার নিয়ে তিনি পড়েন তুর্গেনেভ, ডি এইচ লরেন্স, টলস্টয় ইত্যাদি। হেমিংওয়ে তাঁর আ মুভেবল ফিস্ট-এ লেখেন, ‘সেই দিনগুলোতে বই কেনার পয়সা ছিল না। আমি শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির রেন্টাল লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনতাম...আমি যখন প্রথমবার বইয়ের দোকানটিতে যাই, খুব লজ্জা পাচ্ছিল আমার, রেন্টাল লাইব্রেরিতে নাম লেখানোর মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না আমার কাছে।’
রুয় দে লা বুশের ৩৭ নম্বর বাড়ির নিচে যে শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিতে আমি যাই, সেটি অবশ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মার্কিন অভিবাসী জর্জ হুইটম্যান ১৯৫১ সালে, তখন এটির নাম ছিল লা মিস্ত্রাল। ১৯৬২ সালে সিলভিয়া বিচের মৃত্যু হলে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে হুইটম্যান দোকানটির নাম বদলে রাখেন শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, আর একমাত্র মেয়ের নাম রাখেন সিলভিয়া বিচ। তত দিনে অবশ্য হেমিংওয়ের মৃত্যু (১৯৬১) ঘটেছে। দোকানটির নামের গুণেই বোধ হয় এটিও প্যারিসের শিল্প-সাহিত্যসেবীদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে ওঠে। অ্যালেন গিনসবার্গসহ বিট প্রজন্মের কবি-লেখকেরা নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন এখানে। ২০১১ সালে হুইটম্যান মারা গেলে মেয়ে সিলভিয়া বিচ হুইটম্যানই এখন এটা চালান।
দোকানটা থেকে যখন আমরা বের হই, তখন মধ্যদিনের ছায়া হেলে পড়েছে খানিকটা। হেমিংওয়ে যে বাড়িটাতে থাকতেন, সেটি এখান থেকে খুব বেশি দূরে হওয়ার কথা নয়। কিছুদূর গিয়ে এক বইপত্র স্যুভেনিরের দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করি, রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ কীভাবে যেতে হবে, ওখানে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থাকতেন একসময়। ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন, বললেন, হ্যাঁ, চিনি জায়গাটা। আপনার কাছে প্যারিসের ম্যাপ আছে? নেই? আচ্ছা, এক কাজ করুন, এই যে রাস্তার নামটা লিখে দিচ্ছি, এটা উচ্চারণ করা হয়তো সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে, রুয় মন্তাঘঁ সেন্ট জেনেভ, এ রকম একটা নাম বললেন তিনি, তারপর দোকান থেকে বের হয়ে এসে আমাকে কীভাবে যেতে হবে সেটা বেশ যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন। আমি লিখে দেওয়া খটমট উচ্চারণের নামটা তাঁর কাছ থেকে শিখে নিয়ে রওনা হওয়ার পরমুহূর্তেই ভুলে যাই। আমার সঙ্গে আমার ছেলে সিয়াম, একসময় স্কুলজীবনে সে ফরাসি ভাষা নিয়েছিল, সেই জ্ঞান ঝালাই করে সে-ও লিখে দেওয়া নামটা পড়ার চেষ্টা করল, পারলও বোধ হয়। তবু নগদ ছয় ইউরো (অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছয় শ টাকা) দিয়ে প্রায় শামিয়ানার সাইজের একখানা ম্যাপ কিনি, যদিও পরে সেটির আর কোনো ব্যবহার হয়নি। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে ঢালু রাস্তা বেয়ে একসময় ৭৪ রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ-এর সামনে গিয়ে পৌঁছাতে হাঁপ ধরে যায়। পাঁচতলা সাদামাটা বাড়িটার মূল দরজার ওপর নম্বর লেখা ৭৪।
হেমিংওয়ে থাকতেন চারতলার ওপর। তাঁর ভাষায়, ‘রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ-এর বাসাটা দুই রুমের ফ্ল্যাট, গরম জলের ব্যবস্থা নেই, একটা অ্যান্টিসেপটিক ভান্ড ছাড়া লাগোয়া টয়লেটও নেই।’ তিনি অন্য জায়গায় লিখেছেন, ‘পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টগুলোর প্রতিতলায় সিঁড়ির পাশে পা না পিছলানোর জন্য জুতোর ছাঁচে বসানো দুটো পাদানিওয়ালা খাটা পায়খানার টাংকিগুলো রাতের বেলায় পাম্প দিয়ে সাফ করে ঘোড়ায় টানা ট্যাংক ওয়াগনে ভরা হতো। ...ট্যাংক ওয়াগনগুলো বাদামি আর জাফরান রং করা, চাঁদনি রাতে রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ-এ যখন কাজ করত ওগুলো, ঘোড়ায় টানা চাকাওয়ালা সিলিন্ডারগুলোকে ব্রাক-এর পেইন্টিংয়ের মতো মনে হতো।’ এখন নিশ্চয়ই সেসব সাবেকি ব্যবস্থা উঠে গেছে। ৭৪ নম্বরের ঠিক গায়ে লাগানো পাশের বাড়ির নিচতলায় একটা ক্যাফে, ওখানে লোকজন বিয়ারের মগ নিয়ে বসা।
বাড়িটায় সামনে থেকে একটা রাস্তা পেরিয়ে ডানে মোড় নিলেই রুয় দেসকার্ত, এটির ৩৯ নম্বর বাড়িটি একসময় ছিল হোটেল। লেখালেখি করার জন্য বাসার খুব কাছের এই হোটেলের ওপরতলার একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। এখন আর হোটেলটি নেই, তবে প্রায় সব বাড়ির নিচতলায় ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ ফুটপাত অবধি ছড়ানো। এই বাড়িটিতেই মারা গিয়েছিলেন ফরাসি কবি পল ভার্লেন। বাড়িটির নিচে একটা বোর্ডে ভার্লেনের কথা লেখা থাকলেও সেখানে হেমিংওয়ের অবস্থান সম্পর্কে কোনো কিছু দেখা গেল না। হেমিংওয়ে তাঁর এই ডেরাটির কথা লিখেছেন এভাবে, ‘শীতের হিম বৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ করে যেন শহরের সব বিষণ্নতা নেমে আসে, রাস্তার আর্দ্র অন্ধকার, ছোট ছোট দোকান, ভেষজ বিক্রেতা, স্টেশনারি আর খবরের কাগজের দোকান, দ্বিতীয় শ্রেণীর ধাত্রীর বন্ধ দরজা আর সেই হোটেল, যেখানে ভার্লেন মারা গিয়েছিলেন, যার সর্্বোচ্চ তলায় একটা ঘর নিয়ে লেখালেখি করি আমি—ছয় থেকে আট ধাপ উঁচু সবচেয়ে ওপরের তলাটা ছিল খুব ঠান্ডা...।’
এই রাস্তার কোথাও লা মুফতার্দ নামে একটা ক্যাফে আছে, হেমিংওয়ে এটিতেও বসতেন মাঝে মাঝে। পাথর বিছানো রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হেমিংওয়ের স্মৃতিচারণার কথা মনে পড়ে যায়, এই রাস্তার চরিত্র তো খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি, ওয়াইন শপ, ফলের দোকান, বার ক্যাফে, রেস্তোরাঁই দখল করে আছে বেশির ভাগ দোকান। কোনো গাড়িঘোড়া চলে না এই রাস্তায়, তাই পায়ে হাঁটা মানুষের ইতস্তত ভিড়। হেমিংওয়ের বর্ণনায়ও প্লাস কনত্রাসকার্পের চেহারা ছিল এমনই। সেই সব বর্ণনা স্মরণে রেখে রুয় দেসকার্তের একটা ছোট চৌরাস্তায় লা মুফতার্দ নামের ক্যাফেটা খুঁজে পেয়ে আমার সব শ্রান্তি মিলিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকে কাউন্টারের মেয়েটিকে বলি, এটিই তাহলে লা মুফতার্দ? মেয়েটি বলে, হ্যাঁ, এটাই লা মুফতার্দ। মেয়েটির পেছনে তাকভর্তি হরেক রকমের পানীয়ের বোতল থরে থরে সাজানো। বেতের চেয়ার, ছাদে ঝোলানো বিশেষ ধরনের বাতি দিয়ে সাজানো ক্যাফেটাতে বিশের দশক যেন থমকে আছে। ফাউন্টেন থেকে ড্রাফট বিয়ার ঢালতে ঢালতে মেয়েটি মিষ্টি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি ভেতরে বসতে চান? নাকি বাইরে? ওর কাছে আর হেমিংওয়ের কথাটা বলি না, বুঝতে পারি বেচারি হয়তো হেমিংওয়ের নাম কখনোই শোনেনি।
fmainuddin@hotmail.com
বইপত্র, ছবি, পোশাক, স্যুভেনিরের ঝকঝকে সব দোকান, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেতে ঠাসা বুলভার্ড সেন্ট মিশেলের এক পত্রিকার দোকানে গিয়ে শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি দোকানটার নাম বলতেই লোকটা নিজের ভাষায় হাতের ইশারায় ডান-বাম করে দেখিয়ে দিল, কোন দিকে যেতে হবে। আমরা রুয় দ্য লা উসাৎ-এর হালকা ভিড় ধরে এগিয়ে যাই। এই রাস্তায় রয়েছে হোটেল দু-ম-ব্লাঁ। ত্রিশের দশকে হেমিংওয়ে প্যারিসে এলে এই হোটেলেই উঠতেন। রুয় দে লা বুশের ধরে সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। উনিশ শ বিশ এবং ত্রিশের দশকে সিলভিয়া বিচ এই নামে যে দোকানটা চালাতেন, সেটি কিন্তু এই ঠিকানায় ছিল না। দোকানের মূল বড় সাইনবোর্ডটি অপেক্ষাকৃত নতুন, সেটিতে ঢুকলে চোখে পড়ে হরেক রকমের নানা আকারের ইংরেজি বইয়ের সমাহার, আর দশটা দোকানের মতো খুব একটা গুছিয়ে রাখা নয়। বরং যেন কোনো খানদানি পড়ুয়া মানুষের বড়সড় স্টাডি। আমি কাউন্টারের মেয়েটিকে বলতে চাইলাম যে হেমিংওয়ের আ মুভেবল ফিস্ট বইটাতে এই দোকানের উল্লেখ আছে বলে দোকানটা দেখতে এসেছি আমি। মেয়েটি খুব একটা পাত্তা দেয় না, কেবল বলল, ‘না, বইটি আমাদের এখানে নেই এখন।’ আমি বলি, আছে আমার কাছে বইটা। ওটা আমার নিজের ভাষায় অনুবাদ করার পর সে বই প্রকাশিতও হয়েছে। তখন মেয়েটা ‘ওহ রিয়্যালি!’ বলে তার সংযত পাশ্চাত্য বিস্ময়ের প্রকাশ দেখায়। তারপর বলে, ‘কোন ভাষায় অনুবাদ করলেন আপনি?’ আমি তার মসৃণ লালচে চুলের শোভা দেখায় মগ্ন থেকে বলি, ‘বাংলায়’। মেয়েটি, ‘দ্যাটস গ্রেট’ বলে আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তিন সপ্তাহের ক্রমাগত ভ্রমণের কারণে ডাকাতের মতো চেহারা হয়েছে আমার, আমাকে ও রকম একটা বইয়ের অনুবাদক ভাবতে বয়েই গেছে ওর। আমি দোকানটির এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে একটা দ্রুত জরিপ চালানোর চেষ্টা করি স্বল্পতম সময়ে। পরিচিত নামের মধ্যে চোখে পড়ে হ্যারল্ড রবিনসের স্টিলেটো, জন আপডাইকের কাপল্স্্, সালমান রুশদির স্মৃতিকথা জোসেফ আন্টন, উইলিয়াম বারোজের নেকেড লাঞ্চ।
বড় সাইনবোর্ডওয়ালা দোকানটার পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা অংশের ওপরও একই সাইনবোর্ড শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, তবে সেটি দেখতে অনেক পুরোনো এবং ছোট, দোকানের বহিরঙ্গেও প্রাচীনতার ছাপ স্পষ্ট। এমনকি ষোড়শ শতাব্দীর ভবনটার অমসৃণ পাথরের দেয়ালের ওপর লাগানো কাঠের বাটাম এবং ফ্রেমগুলো দেখলে বোঝা যায়, অন্য কোথাও থেকে ওগুলো খুলে এনে লাগানো হয়েছে এখানে। সাইনবোর্ডে নামের পাশে লেখা অ্যান্টিকোয়ারিয়ান বুকস, এই অংশটি পুরোনো দুষ্প্রাপ্য বইয়ের জন্য। তবে দুটোর সাইনবোর্ডের ওপরই শেক্সপিয়ারের ছবি লাগানো।
দোকানের সামনে চওড়া চত্বরের ওপর একটা বইয়ের শেলফ, সেখানেও বহু পুরোনো বই সাজানো। সামনে ছোট একটা গাছের নিচে গোল করে বাঁধানো বেদি, সেটি ঘিরে দু-একজন বয়স্ক বেকার মানুষ অলস ভঙ্গিতে বসা। ঢোকার মুখে দরজার পাশে দু-একটা চেয়ার আর টেবিলও আছে। একটা চেয়ারে বসে কী একটা বই তন্ময় হয়ে পড়ছিল দোকানটির প্রাচীনত্বের সঙ্গে বেমানান সোনালি চুলের ঝকঝকে এক তরুণী। দোকানটার সামনের প্রশস্ত অঙ্গন উঁচু বাড়িটার স্নিগ্ধ ছায়ায় আচ্ছন্ন, এখানে একটা কফির মগ হাতে বসে থেকে বই ঘেঁটে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আমি সেই অংশটিতে ঢুকতে চাইলে ভেতর থেকে লালচে দাড়িওয়ালা এক ছোটখাটো তরুণ নড়বড়ে ফ্রেমের কাচের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে ‘ক্লোজড’ লেখা একটা কাগজের বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। আমি কাচের বাইরে থেকে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে ছোকরাটির অনুমতির তোয়াক্কা না করে ভেতরে ঢুকে পড়ে বলি, ‘আমি বেশি সময় নেব না, কয়েক মিনিট কথা বলব তোমার সঙ্গে।’ তারপর আগের দোকানের মেয়েটিকে বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করি ওর কাছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চোখে পড়ে বইয়ের একটা স্তূপের ওপর আ মুভেবল ফিস্ট বইটা ডিসপ্লে করা আছে। তাই বলি, ‘তোমাদের কাছে বইটা আছে দেখছি, পাশের দোকানে নেই বলল, এটা তো এখনো দুষপ্রাপ্য হয়নি।’ ছেলেটির দাড়ির ফাঁকে ভদ্রতার হাসি দেখা যায়। জানতে চাই, এই দোকানটাই ছিল সম্ভবত হেমিংওয়ের চিঠিপত্র আসার জন্য ডাক ঠিকানা। ডেভিড নামের তরুণটি জানায়, ঠিক এটি নয়, সেই দোকান ছিল অন্য জায়গায়, যখন সিলভিয়া বিচ এটার মালকিন ছিলেন। আমি বলি, সে কথা আমার জানা আছে। তবে দোকানের এই অংশের সাইনবোর্ডটার বয়স এবং ত্যাড়া-বাঁকা চেহারা দেখে মনে হয়, এসব সিলভিয়া বিচের আদি দোকান থেকে এনে ফিট করা হয়েছে এখানে। ডেভিড জানায়, হতেও পারে, তবে ব্যাপারটা ওর ঠিক জানা নেই। তারপর বলল, ‘আপনি সিলভিয়া হুইটম্যানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। জর্জ হুইটম্যানের মেয়ে সিলভিয়াই এখন দোকানটার মালিক।’ দোকানটার ওপরের কোনো একটা অ্যাপার্টমেন্টে এখন সিলভিয়া থাকে, যেখানে থাকত ওর বাবাও।
শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি নামের বইয়ের এই যে দোকান, এটির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। দোকানটির আদি মালকিন ছিলেন সিলভিয়া বিচ, এখান থেকে ভাড়ায় বই ধার দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। ১৯১৯ সালে চালু হওয়া এই দোকানটিতে তখন নিয়মিত আনাগোনা করতেন এজরা পাউন্ড, জেমস জয়েস, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড, স্কট ফিটজেরাল্ড, গারট্রুড স্টাইন প্রমুখ লেখক। নব্য লেখক হেমিংওয়েও এখানে যাওয়া-আসা শুরু করেন সিলভিয়া বিচের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর। এটি ছিল প্যারিসে ইংরেজি ভাষাভাষী লেখক-শিল্পীদের মিলনক্ষেত্র। ইংরেজি ভাষার দুষপ্রাপ্য বইগুলো পাওয়া যেত এখানে, ছিল লেখকদের নিয়মিত আড্ডা। লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার যখন ইংল্যান্ড-আমেরিকায় নিষিদ্ধ, লন্ডন থেকে নিকটতম দূরত্বে এই দোকানে পাওয়া যেত বইটি। অশ্লীলতার অভিযোগে আমেরিকায় নিষিদ্ধ হওয়ার পর জেমস জয়েসের ইউলিসিস গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ করেন সিলভিয়া বিচ, ১৯২২ সালে। বইটির পরবর্তী প্যারিস সংস্করণগুলোও শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির নামেই প্রকাশিত হয়। জার্মানরা প্যারিস দখল করার পর ১৯৪১ সালে দোকানটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
হেমিংওয়ে খুব গরিবি হালে যখন প্যারিসে এসে লেখালেখি শুরু করেন, তখন এই বুক স্টোর থেকে ধার নিয়ে তিনি পড়েন তুর্গেনেভ, ডি এইচ লরেন্স, টলস্টয় ইত্যাদি। হেমিংওয়ে তাঁর আ মুভেবল ফিস্ট-এ লেখেন, ‘সেই দিনগুলোতে বই কেনার পয়সা ছিল না। আমি শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির রেন্টাল লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনতাম...আমি যখন প্রথমবার বইয়ের দোকানটিতে যাই, খুব লজ্জা পাচ্ছিল আমার, রেন্টাল লাইব্রেরিতে নাম লেখানোর মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না আমার কাছে।’
রুয় দে লা বুশের ৩৭ নম্বর বাড়ির নিচে যে শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিতে আমি যাই, সেটি অবশ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মার্কিন অভিবাসী জর্জ হুইটম্যান ১৯৫১ সালে, তখন এটির নাম ছিল লা মিস্ত্রাল। ১৯৬২ সালে সিলভিয়া বিচের মৃত্যু হলে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে হুইটম্যান দোকানটির নাম বদলে রাখেন শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, আর একমাত্র মেয়ের নাম রাখেন সিলভিয়া বিচ। তত দিনে অবশ্য হেমিংওয়ের মৃত্যু (১৯৬১) ঘটেছে। দোকানটির নামের গুণেই বোধ হয় এটিও প্যারিসের শিল্প-সাহিত্যসেবীদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে ওঠে। অ্যালেন গিনসবার্গসহ বিট প্রজন্মের কবি-লেখকেরা নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন এখানে। ২০১১ সালে হুইটম্যান মারা গেলে মেয়ে সিলভিয়া বিচ হুইটম্যানই এখন এটা চালান।
দোকানটা থেকে যখন আমরা বের হই, তখন মধ্যদিনের ছায়া হেলে পড়েছে খানিকটা। হেমিংওয়ে যে বাড়িটাতে থাকতেন, সেটি এখান থেকে খুব বেশি দূরে হওয়ার কথা নয়। কিছুদূর গিয়ে এক বইপত্র স্যুভেনিরের দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করি, রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ কীভাবে যেতে হবে, ওখানে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থাকতেন একসময়। ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন, বললেন, হ্যাঁ, চিনি জায়গাটা। আপনার কাছে প্যারিসের ম্যাপ আছে? নেই? আচ্ছা, এক কাজ করুন, এই যে রাস্তার নামটা লিখে দিচ্ছি, এটা উচ্চারণ করা হয়তো সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে, রুয় মন্তাঘঁ সেন্ট জেনেভ, এ রকম একটা নাম বললেন তিনি, তারপর দোকান থেকে বের হয়ে এসে আমাকে কীভাবে যেতে হবে সেটা বেশ যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন। আমি লিখে দেওয়া খটমট উচ্চারণের নামটা তাঁর কাছ থেকে শিখে নিয়ে রওনা হওয়ার পরমুহূর্তেই ভুলে যাই। আমার সঙ্গে আমার ছেলে সিয়াম, একসময় স্কুলজীবনে সে ফরাসি ভাষা নিয়েছিল, সেই জ্ঞান ঝালাই করে সে-ও লিখে দেওয়া নামটা পড়ার চেষ্টা করল, পারলও বোধ হয়। তবু নগদ ছয় ইউরো (অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছয় শ টাকা) দিয়ে প্রায় শামিয়ানার সাইজের একখানা ম্যাপ কিনি, যদিও পরে সেটির আর কোনো ব্যবহার হয়নি। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে ঢালু রাস্তা বেয়ে একসময় ৭৪ রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ-এর সামনে গিয়ে পৌঁছাতে হাঁপ ধরে যায়। পাঁচতলা সাদামাটা বাড়িটার মূল দরজার ওপর নম্বর লেখা ৭৪।
হেমিংওয়ে থাকতেন চারতলার ওপর। তাঁর ভাষায়, ‘রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ-এর বাসাটা দুই রুমের ফ্ল্যাট, গরম জলের ব্যবস্থা নেই, একটা অ্যান্টিসেপটিক ভান্ড ছাড়া লাগোয়া টয়লেটও নেই।’ তিনি অন্য জায়গায় লিখেছেন, ‘পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টগুলোর প্রতিতলায় সিঁড়ির পাশে পা না পিছলানোর জন্য জুতোর ছাঁচে বসানো দুটো পাদানিওয়ালা খাটা পায়খানার টাংকিগুলো রাতের বেলায় পাম্প দিয়ে সাফ করে ঘোড়ায় টানা ট্যাংক ওয়াগনে ভরা হতো। ...ট্যাংক ওয়াগনগুলো বাদামি আর জাফরান রং করা, চাঁদনি রাতে রুয় দু কার্দিনাল লেময়ঁ-এ যখন কাজ করত ওগুলো, ঘোড়ায় টানা চাকাওয়ালা সিলিন্ডারগুলোকে ব্রাক-এর পেইন্টিংয়ের মতো মনে হতো।’ এখন নিশ্চয়ই সেসব সাবেকি ব্যবস্থা উঠে গেছে। ৭৪ নম্বরের ঠিক গায়ে লাগানো পাশের বাড়ির নিচতলায় একটা ক্যাফে, ওখানে লোকজন বিয়ারের মগ নিয়ে বসা।
বাড়িটায় সামনে থেকে একটা রাস্তা পেরিয়ে ডানে মোড় নিলেই রুয় দেসকার্ত, এটির ৩৯ নম্বর বাড়িটি একসময় ছিল হোটেল। লেখালেখি করার জন্য বাসার খুব কাছের এই হোটেলের ওপরতলার একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। এখন আর হোটেলটি নেই, তবে প্রায় সব বাড়ির নিচতলায় ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ ফুটপাত অবধি ছড়ানো। এই বাড়িটিতেই মারা গিয়েছিলেন ফরাসি কবি পল ভার্লেন। বাড়িটির নিচে একটা বোর্ডে ভার্লেনের কথা লেখা থাকলেও সেখানে হেমিংওয়ের অবস্থান সম্পর্কে কোনো কিছু দেখা গেল না। হেমিংওয়ে তাঁর এই ডেরাটির কথা লিখেছেন এভাবে, ‘শীতের হিম বৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ করে যেন শহরের সব বিষণ্নতা নেমে আসে, রাস্তার আর্দ্র অন্ধকার, ছোট ছোট দোকান, ভেষজ বিক্রেতা, স্টেশনারি আর খবরের কাগজের দোকান, দ্বিতীয় শ্রেণীর ধাত্রীর বন্ধ দরজা আর সেই হোটেল, যেখানে ভার্লেন মারা গিয়েছিলেন, যার সর্্বোচ্চ তলায় একটা ঘর নিয়ে লেখালেখি করি আমি—ছয় থেকে আট ধাপ উঁচু সবচেয়ে ওপরের তলাটা ছিল খুব ঠান্ডা...।’
এই রাস্তার কোথাও লা মুফতার্দ নামে একটা ক্যাফে আছে, হেমিংওয়ে এটিতেও বসতেন মাঝে মাঝে। পাথর বিছানো রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হেমিংওয়ের স্মৃতিচারণার কথা মনে পড়ে যায়, এই রাস্তার চরিত্র তো খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি, ওয়াইন শপ, ফলের দোকান, বার ক্যাফে, রেস্তোরাঁই দখল করে আছে বেশির ভাগ দোকান। কোনো গাড়িঘোড়া চলে না এই রাস্তায়, তাই পায়ে হাঁটা মানুষের ইতস্তত ভিড়। হেমিংওয়ের বর্ণনায়ও প্লাস কনত্রাসকার্পের চেহারা ছিল এমনই। সেই সব বর্ণনা স্মরণে রেখে রুয় দেসকার্তের একটা ছোট চৌরাস্তায় লা মুফতার্দ নামের ক্যাফেটা খুঁজে পেয়ে আমার সব শ্রান্তি মিলিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকে কাউন্টারের মেয়েটিকে বলি, এটিই তাহলে লা মুফতার্দ? মেয়েটি বলে, হ্যাঁ, এটাই লা মুফতার্দ। মেয়েটির পেছনে তাকভর্তি হরেক রকমের পানীয়ের বোতল থরে থরে সাজানো। বেতের চেয়ার, ছাদে ঝোলানো বিশেষ ধরনের বাতি দিয়ে সাজানো ক্যাফেটাতে বিশের দশক যেন থমকে আছে। ফাউন্টেন থেকে ড্রাফট বিয়ার ঢালতে ঢালতে মেয়েটি মিষ্টি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি ভেতরে বসতে চান? নাকি বাইরে? ওর কাছে আর হেমিংওয়ের কথাটা বলি না, বুঝতে পারি বেচারি হয়তো হেমিংওয়ের নাম কখনোই শোনেনি।
fmainuddin@hotmail.com
No comments