দানব by শেখ আবদুল হাকিম
জানেন এটা আগুন নিয়ে খেলা, কিন্তু নিজের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই। দুঃসাহস দেখিয়ে রিসেপশনিস্ট মেয়েটার বাঁকবহুল কাঠামোয় প্রকাশ্যে চোখ বুলাচ্ছেন মিথুন, হাসছেন দাঁত বের করা নীরব হাসি, নির্লজ্জ দৃষ্টি বারবার লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছে ওর শার্টের ভেতর কুমড়ো আকৃতির জোড়া উত্থানের দিকে।
‘এই যে, আপনারা,’ রিসেপশনিস্ট বলল, যদি ওর খারাপ লেগেও থাকে চেহারায় সেটা ফুটতে না দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে রেখেছে। ‘মিস্টার আর মিসেস তো?’ অ্যাপয়েন্টমেন্টের তালিকায় কালো নখ টানছে।
‘হ্যাঁ,’ বললেন মিথুন, ‘আমি মিথুন কাজি...’ কল্পনায় ওকে বিছানার ওপর অনবরত মোচড় খেতে দেখছেন, বিবস্ত্র ও ঘর্মাক্ত, তিনি সেখানে প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ব্যাজে লেখা নামটা পড়লেন, সোনালি রঙের ওপর এম্বুস করা কালো হরফ—তৃষ্ণা। একটা ঢোঁক গিললেন তিনি।
‘আচ্ছা, আপনারা চলে এসেছেন...মিস্টার মিথুন কাজি, আর মিসেস মিথিলা কাজি?’
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই জোর করে একটু হাসলেন।
হাতের ক্লিপবোর্ডে একটা টোকা মারল তৃষ্ণা। ‘ডাক্তার সোহেলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট? দুপুর দেড়টায়?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন মিথিলা, একপাশে একটু সরে গিয়ে স্বামীর দৃষ্টিপথে স্পষ্ট বাধা সৃষ্টি করলেন।
‘দারুণ,’ হাত তুলে জানালার পাশে চামড়া মোড়া সোফা দেখাল তৃষ্ণা। ‘আপনাদের একটু বসতে হবে। সময় হলে ডাকব আমি।’ ওর হাসিতে মুক্তো ঝরল, দাঁতগুলো একদম নিখুঁত।
এরপর অস্বস্তিকর নীরবতা। সোফায় বসার পরও তৃষ্ণার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না মিথুন, গায়ে রোদ নিয়ে বসেছেন শুধু ওকে ভালো করে দেখতে পাওয়ার জন্য। তবে, যেমনটি আশা করেছিলেন সে রকম কিছু ঘটতে দেখছেন না—তরুণী তৃষ্ণা ভুলেও তাঁর দিকে তাকাচ্ছে না।
বসার ভঙ্গি বারবার বদলাচ্ছেন মিথুন। একসময় তাঁর চোখ পড়ল দেয়ালে বসানো টিভির পর্দায়। আওয়াজ কমানো হলেও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে; কোথাও আগুন লেগেছে, অকুস্থল থেকে গলা ফাটিয়ে রিপোর্ট করছে এক মেয়ে। কোথায় আগুন লাগল, কেউ মারা গেল কি না, এসব প্রশ্ন মিথুনের মাথাতেই এল না, মেয়েটার ওড়না গলায় উঠে গেছে দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো তাঁর, বুক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না। রায় দিয়ে দিলেন, এই মেয়ে মিথিলার চেয়েও সুন্দর, এর আবেদনও বেশি, কাজেই এর সঙ্গে তো পাপ করা যায়ই।
‘তুমি ছায়ায় সরে বসো, গায়ে রোদ লাগছে,’ বললেন মিথিলা। ‘নতুন শার্টটা শুধু শুধু ঘামে ভেজাচ্ছ।’
মিথুন কিছু বললেন না, কিছু করলেনও না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালেন।
টিভিতে খবর বদলে গেল। এখন দেখানো হচ্ছে দেশজুড়ে যে লোককে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ, তার সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন। শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে গোলগাল চেহারা পর্দাজুড়ে। ওটা ফটো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া খুনি, চোখ দুটো ভাসা ভাসা, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কী যেন দেখছে। সেদিকে তাকিয়ে গলার মাদুলি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলেন মিথিলা।
‘সকালে তোমার নিজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, ভুলে যাওনি তো?’ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করলেন মিথুন। ‘না, মিলা, ভুলিনি।’ নানা মানসিক সমস্যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে হয়, পরস্পরকে মনে করিয়ে দেওয়াটাও প্রায় একটা রোগের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এই সময় মিথিলা শুনতে পেলেন টিভির রিপোর্টার বলছে: ‘... এই লোক চরম বিপজ্জনক,’ চোখ তুলে পর্দার দিকে তাকালেন তিনি। লোকটাকে, অর্থাৎ খুনি আব্বাসকে দেখাচ্ছে। ‘ও আল্লাহ, মিথুন!’ আঁতকে উঠলেন তিনি, মনে পড়ে গেল এই লোকের অপরাধের তালিকা, যে তালিকা মিডিয়া প্রতিদিন প্রচার করছে: নটা খুন, পাঁচটা খুনের চেষ্টা, বারোটা ধর্ষণ এবং গ্রেপ্তার হয়েছিল মাত্র একবার। জেল থেকে পালানোসহ আরও অনেক ছোটখাটো অভিযোগ আছে। ‘ও আল্লাহ, ওই লোক...’
‘এই,’ বললেন মিথুন, নরম হচ্ছেন, স্ত্রীর হাত ধরে চাপ দিলেন একটু।
‘না, মানে, আমার কথা হলো, এ রকম একটা লোককে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কীভাবে পালাতে দিল?’
স্ত্রীকে অভয় দেওয়ার সময় পেলেন না মিথুন।
‘মিস্টার এবং মিসেস কাজি,’ অ্যাড্রেস সিস্টেম থেকে তৃষ্ণার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘আপনারা দয়া করে তিন নম্বর প্যাসেজ ধরে বাইশ নম্বর কামরায় চলে আসুন। ডাক্তার সোহেল এখন আপনাদের সময় দেবেন।’
বাইশ নম্বর কামরার বাতাস একদম বরফ। ডেস্কের পেছনে বড়সড় লেদার চেয়ারে বসে আছেন প্রকাণ্ডদেহী ডাক্তার সোহেল। আশিতলায় রয়েছেন তাঁরা, ডাক্তারের পেছনে কাচ, নিচে বহুদূর বিস্মৃত কক্সবাজার শহর, কংক্রিটের জঙ্গল বললেই হয়, বিশাল সব দালানের পাশ ঘেঁষে উড়ালপথ ধরে ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। বহুদূরে রোদে চিকচিক করছে সাগর।
‘ধন্যবাদ,’ বললেন ডাক্তার সোহেল, চশমাটা নেড়েচেড়ে ঠিকমতো বসিয়ে নিলেন চোখে। হাত তুলে চেয়ার দেখালেন ওঁদের। ‘প্লিজ।’
‘ধন্যবাদ।’
‘আমি জানি আপনারা কী ভাবছেন। এত তাড়াতাড়ি আবার কেন ডাকলাম আপনাদের, তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন মিথুন, স্ত্রীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ‘একটু চিন্তাও হচ্ছে।’
‘আমি বকবক করতে পারি না, মিস্টার মিথুন, মিসেস মিথিলা, কাজেই সরাসরি কাজের কথায় আসছি।’ হাত দুটো দিয়ে একটা ব্রিজ বানালেন ডাক্তার সোহেল। ‘কাল আমি ল্যাব থেকে একটা খবর পেলাম। কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে, আপনাদের বাচ্চাকে নিয়ে সেটা বেশ গুরুতর জটিলতাই বলব আমি, তাই ভাবলাম শুরুতেই জানিয়ে রাখি আপনাদের।’
‘কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মিথিলা, ঝট করে সামনে ঝুঁকলেন। ‘কী ধরনের জটিলতা?’
‘উম্...মনে হচ্ছে এ রকম একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে...’ থেমে গেলেন ডাক্তার, কৌশলী হওয়ার উপায় খুঁজছেন। ‘আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি তা হলো, আপনাদের বাচ্চা স্পেসিফিকেশন অনুসারে সবকিছু পাবে না...’
‘আচ্ছা,’ বললেন মিথুন, ভ্রুজোড়া কপালে উঠে গেছে। শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন তিনি, খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। ‘প্লিজ। ডাক্তার সাহেব।’ চোখ দুটো সরু করলেন, গলার আওয়াজ নিজের অজান্তেই কর্কশ। ‘এর মানে বা তাৎপর্য কী?’
‘গত সপ্তায় আপনার ভ্রূণের স্ক্যান করা হয়,’ লুকোচুরি বাদ দিয়ে আসল কথায় আসছেন ডাক্তার, ‘সেই সঙ্গে ওই একই পর্যায়ের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখা গেছে দুটোর মধ্যে তারতম্য রয়েছে, যেটা আমরা স্রেফ আশা করিনি।’
‘ও।’ নিজেকে ধরে রাখার জন্য প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করছেন মিথুন, কাগজের চেয়েও সাদা দেখাচ্ছে তাঁর মুখ। আবার সেই একই প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘এর মানে বা তাৎপর্য যদি একটু বুঝিয়ে বলেন, প্লিজ?’
‘শুনুন, আপনাদের অনাগত সন্তানের জেনেটিক মেকআপে আমরা প্রচুর পরিমাণে এমএওএ-টু পেয়েছি...আমার আর আপনাদের কাছে এমটু।’
‘তারপর?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন মিথুন। ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, ডাক্তার সাহেব, এখানটায় বাংলায় বলুন!’
‘এই এমটু মিন অক্সিডেইজ, এই নামেই এটা পরিচিত, একটা এনজাইম, যেটা ব্রেইনের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার ভাঙে, যেমন পাইনফ্রিন, ডোপামিন, এ রকম আরও অনেক। ওটা নিষ্ক্রিয় করে ওগুলোকে, আর এই ট্র্যান্সমিটারগুলোই শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করে মেজাজ, আক্রমণাত্মক প্রবণতা, ফুর্তি ইত্যাদি।’
কথাগুলো হজম করতে কিছুটা সময় নিলেন মিথুন। ‘ঠিক আছে,’ কোনো রকমে বলতে পারলেন। ‘তাহলে, আমাকে ধরে নিতে হচ্ছে এটা ভালো খবর নয়?’
এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন ডাক্তার।
‘ঠিক আছে, ডাক্তার সাহেব। আপনি এখন তাহলে ব্যাখ্যা করে বলবেন আমাদের বাচ্চাকে এটা ঠিক কীভাবে বিপদে ফেলবে?’
‘বাচ্চাকে বিপদে ফেলবে? না না না! ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো...’
ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে মিথিলা আবার বললেন, ‘আমি বলতে চাইছি, আমরা যা করতে বলেছিলাম, তাও কি আপনি করেননি?’ তাঁর গলা থেকে আওয়াজ বেরোতে চাইছে না, যেকোনো মুহূর্তে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই, মিসেস কাজি, আপনারা যা যা চেয়েছেন সব আমরা করেছি।’
‘তাহলে এসব ছাই ঘটল কীভাবে?’
চশমাটা আবার নাকের গোড়ায় তুলে আঁট করে বসালেন ডাক্তার। ‘সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের একগাদা চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই আমাদের এই উৎকট সমস্যায় পড়তে হয়েছে, মিস্টার কাজি। আপনি চেয়েছেন আপনার মধ্যে যেকোনো বিষয়ে সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ার যে প্রবণতা আছে, সেটা যেন ওর ভেতর থেকে বাদ দেওয়া হয়, আমরা সেটা বাদ দিয়েছি। কিন্তু আমরা আপনাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছি আসক্তি, যেকোনো আসক্তি, হোক সেটা সেক্স, অ্যালকোহল, ড্রাগ...এমনকি ভায়োলেন্স পর্যন্ত প্রভাবিত হয় অসংখ্য জিনের দ্বারা, অসংখ্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা এখানে নাহয় নাই বললাম। এটা খুবই জটিল একটা প্রক্রিয়া, একজনেরটা আরেকজনের মতো নয় এবং এখানে কোনো রকম গ্যারান্টি নেই। একটা জিনের অলটারনেটিভ ফর্মকে বলে অ্যালিল, এই কেসে আমরা ডিআরডিটু জিনে যে ডোপামিন রিসেপটর আছে তার অ্যালিল নিষ্ক্রিয় করে দিই, যে জিন আমরা জানি আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, মিস্টার মিথুন, এই জিনই দায়ী কিছু...’ ইতস্তত করছেন ডাক্তার, সঠিক শব্দটা খুঁজছেন, ‘...দায়ী আপনাদের ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার জন্য, সম্প্রতি আপনাদের দাম্পত্য জীবনে যেগুলো অশান্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল।’ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন।
‘তো?’ কাঁধ ঝাঁকালেন মিথুন। ‘আপনি এখনো প্রশ্নটার উত্তর দেননি। ঠিক কী ঘটেছে যে সব এ রকম এলোমেলো হয়ে গেল?’
‘আপনি কি আমাকে বলতে দেবেন, প্লিজ? আপনি আরও চেয়েছিলেন, আমরা যেন আপনার স্ত্রীর ওসিডি প্রবণতা বাচ্চার মধ্যে না রাখি। কাজেই, হিউম্যান সেরোটোনিন ট্রান্সপোর্টার জিনের সমস্ত চিহ্ন আমরা সরিয়ে নিয়েছি, কাজটা যথেষ্ট সহজই ছিল, কিন্তু সেটা সৃষ্টি করল আরেক প্রস্থ আড়ষ্ট বাস্তবতা। শেষ পর্যন্ত সেসব আমরা এড়াতে পারলাম, কিন্তু তার পরও আপনার শিশুর বুদ্ধিশক্তি আর স্মৃতিশক্তি বাড়াতে হলো আমাদের, সেই সঙ্গে গড় আকারের চেয়ে বড় দেখে একটা সেরিবেলাম কর্টেক্সের ব্যবস্থা করতে হলো। এগুলোর সবই আমরা করেছি আপনারা চেয়েছিলেন বলে, মিস্টার মিথুন।’
‘সে জন্য আমরা পেমেন্টও করেছি।’
‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করলেন ডাক্তার, এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করলেন চোখ দুটো। ‘কিন্তু আপনাদের আমরা বলেছি, সংখ্যায় এত বেশি অনুরোধ এর আগে কখনো কেউ করেনি। শেষ পর্যন্ত আপনাদের আমরা পুরোপুরি সচেতন করেছি স্পেসিফিকেশনে আরও বেশি কিছু দাবি করা হলে কম্পোজিশন কী রকম আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার পরও, আপনারা দুজনেই, চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন।’
‘এক মিনিট থামুন, আগে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হতে দিন,’ বললেন মিথুন। ‘আমরা আপনাদের বিশ লাখ টাকা দিয়েছি, সেটা আপনারা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন, আর তার বিনিময়ে এখানে আপনি ঠান্ডা ঘরে বসে আমাকে বলছেন আমাদের বাচ্চার রক্তে না মগজে তারতম্য ঘটেছে? আমার স্ত্রীর ভেতর আপনারা কী উদ্ভট জিনিস বড় করছেন শুনি?’ সামনের দিকে ঝুঁকলেন তিনি, গলার আওয়াজ খাদে নামালেন। ‘আপনি, ডাক্তার, নিজের উপকার করবেন ভালো একজন উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। যদি ভেবে থাকেন আমরা আপনাকে ছেড়ে দেব...’
‘ওহ্, শুধু ভালো নয়, দেশের সেরা উকিল ঠিক করা আছে আমাদের, মিস্টার মিথুন।’ জোর করে একটু হাসলেন ডাক্তার সোহেল। ‘আমার কাছে আরও তথ্য আছে, ওগুলো নিয়েও আমি আলোচনা করতে চাই।’
রাগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন মিথুন।
‘তো আগে যা বলছিলাম আরকি, নিজেদের জেনেটিক মেকআপে এত বেশি মাত্রায় এমটু থাকলে কেউই কোনো রকমের সহমর্মিতা অনুভব করবে না, কিংবা তাদের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি বলে কিছু থাকবে না। তারা শুধু জানবে রাগ করতে। হতাশায় ডুবতে। আর জানবে কাকে কীভাবে আঘাত করা যায়।’
সোফায় স্থির হয়ে বসতে পারছেন না মিথুন।
‘জন্মাবার পর শিশুটিকে আমরা চরম আক্রমণাত্মক একটা প্রাণী হিসেবে পাব। প্যারানয়আ...মানসিক বৈকল্যের শিকার, মাঝেমধ্যে চরম ভুল ধারণার শিকার। শিশুটি মাত্রা ছাড়ানো বিষণ্নতায় ভুগবে, আকস্মিক খেপামি দেখা দেবে আচরণে, যত দিন যাবে ততই তার মধ্যে দয়ামায়ার অভাব প্রচণ্ড হয়ে উঠবে। এ ধরনের কেসে আমরা, ডাক্তাররা, যে ভবিষ্যদ্বাণী করি তাতে বলা হয়েছে—প্রচুর আশঙ্কা আছে সাবজেক্ট পরিণতবয়স্ক হওয়ার আগেই খুনি হয়ে উঠতে পারে, সম্ভবত কৈশোরে পা দেওয়ারও আগে।’
প্রবল হতাশায় আহত জন্তুর মতো একটা আওয়াজ বেরোল মিথিলার গলা থেকে।
সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন মিথুন। ‘ডাক্তার সাহেব, আসলে এটা কি এক ধরনের কৌতুক? বিশ লাখ টাকায় এই জিনিস? একবার শুধু তাকিয়ে দেখুন আমার স্ত্রীর কী অবস্থা করেছেন আপনি।’
ডাক্তারের হাত ব্রিজটা ভেঙে দিল, ভ্রুজোড়া তৈরি করল গভীর গিরিখাদ। ‘মিস্টার মিথুন, আমি...’
‘আমার উচিত এক ঘুষিতে আপনাকে আগামী সপ্তায় পাঠিয়ে দেওয়া!’
‘না, মিথুন, প্লিজ।’ স্বামীর হাত খামচে ধরলেন মিথিলা। ‘প্লিজ, তুমি শান্ত হও। এভাবে আমরা কোনো সাহায্যই পাব না।’ নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য একটু সময় নিলেন, তারপর সোফা ছেড়ে সিধে হলেন, ডাক্তারের চোখের দিকে তাকালেন, এখনো আড়ষ্ট হয়ে আছেন। ‘দু-দুঃখিত, ডাক্তার সাহেব। কী যেন বলছিলেন আপনি?’
‘আপনাদের দুজনকেই বলছি। এটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা চুপ থাকবেন। এখন আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা বোঝার চেষ্টা করবেন।’
নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকিয়ে আছেন মিথুন, ডাক্তারের নাটকীয়তা তিনি ভালো চোখে দেখছেন না, তবে কিছু বললেন না।
‘আমাদের ওপর নির্দেশ আছে আমরা যেসব ভ্রূণ ডেভলপ করছি, তার মধ্যে এমটু থাকলে সরকারকে তা জানাতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে আমাদের লাইসেন্স থাকা বা না থাকা। আজ বিশ বছর হয়ে গেল এই ফ্যাসিলিটিতে ডেভলপ করা কোনো সিনথেসাইজড শিশুকে রক্তপ্রবাহে এত বেশি মাত্রায় এমটু নিয়ে গেটের বাইরে বেরোবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার আগে, ওটাই শেষবার, প্রায় হুবহু এই কেসটার মতো পরিস্থিতিতে, এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তার পরিণতি শুনবেন?’ চোখ তুলে তাকালেন ডাক্তার সোহেল। ‘আমার ধারণা, ইতিমধ্যে টিভিতে আপনারা আজকের খবর শুনেছেন।’
মিথুন আর মিথিলার মুখ ঝুলে পড়ল। ব্যাপারটা অনুধাবন করতে খুব বেশি সময় লাগল না।
‘আপনি খুনি আব্বাসের কথা বলছেন?’ গলায় একটা আর্তনাদকে আটকে দিলেন মিথিলা।
‘সর্বশেষ সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সে, একজন সিরিয়াল খুনি, সাজাটা দেওয়া হয়েছিল দশ বছর আগে, নটা মেয়েকে খুন করার অপরাধে।’
‘আল্লাহ...অসম্ভব!’ ধাম করে ডেস্কে ঘুষি মারলেন মিথুন। ‘আমাদের বিরুদ্ধে এ রকম একটা অন্যায় আপনি কীভাবে করতে পারলেন?’
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, ডাক্তার বলে যাচ্ছেন, ‘আজ কয়েক যুগ হয়ে গেল আমরা আমাদের প্রক্রিয়া থেকে এমটু মুছে ফেলার চেষ্টা করছি—এটা আমাদের কয়েক শ কোটি টাকার রিসার্চ প্রজেক্ট।’ খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, গলার আওয়াজ যেন দূর থেকে ভেসে আসছে। ‘কিছু হয়নি। দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি একটা না একটা পথ ঠিকই পেয়ে যায়। যতভাবে যত রকম চেষ্টাই আমরা করি না কেন।’
‘কিন্তু নিশ্চয়ই নিয়ম-টিয়মের মধ্যেও ব্যতিক্রম বলে কিছু থাকে,’ মিনতির সুরে বললেন মিথিলা। ‘মানে, এমটু-র কথা বলছি। থাকে না, ডাক্তার সাহেব?’
মৃদু হাসির রেখা ফুটল ডাক্তারের ঠোঁটে, তবে তাঁর সুর দৃঢ়ই থাকল। ‘আমি দুঃখিত, মিসেস মিথিলা। গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে শতকরা নব্বই পার্সেন্টেরও বেশি হিংস্র অপরাধীর জেনেটিক মেকআপে এমটু পাওয়া গেছে। সে জন্যই সরকার বাধ্য হয়ে একটা গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। হিংস্রতা বা নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো নিরসনপদ্ধতি আবিষ্কার করেছি আমরা!’
মিথিলার দুগাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে।
‘তাহলে,’ মিথুন বললেন, গলার আওয়াজ এখন হেরে যাওয়া মানুষের মতো নিচু, ‘কী সেই গাইডলাইন, যেটার কথা বলছেন আপনি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। ‘অন্তত বাছাই করার একটা সুযোগ আপনাদের আছে। এক, বাচ্চার কথা ভুলে যান, এখানেই এই চ্যাপ্টার শেষ হয়ে যাক। দুই, ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’
‘কিন্তু এই সুযোগ পাওয়ার জন্য আমাদের দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে!’
ডাক্তার এখন আর মিথুনকে গ্রাহ্য করছেন না, আবেদন করার জন্য বেছে নিয়েছেন মিথিলাকে। ‘কথাটা গোপনীয়, আমি আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি, মিসেস মিথিলা। ইতি টানুন, আর তা না হলে জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষ আপনার বাচ্চাকে নিয়ে চলে যাবে। আইন মেনে চলতে আমরা বাধ্য, কাজেই এই ফ্যাসিলিটিতে এমটু নিয়ে কোনো বাচ্চা জন্ম নিলে আমাকে তা রিপোর্ট করতে হবে। এর ওপর নির্ভর করবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার লাইসেন্স থাকবে কি থাকবে না।’
‘আর আমরা যদি বিদেশে গিয়ে নিই ওকে? ইন্দোনেশিয়ার কোনো একটা দ্বীপে চলে গেলাম, আপনাদের নাগালের বাইরে? তখন আপনারা কিছু জানতে পারবেন না, কাউকে কিছু বলারও থাকবে না।’
‘সেটা আপনারা করতে পারেন,’ বিষণ্ন চেহারা নিয়ে মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার। ‘তবে আমি সব সময় সন্দেহ করব। আর, তা ছাড়া, রাতে আপনারা ঘুমোবেন কীভাবে—এটা জেনে যে দুনিয়ায় আপনারা কী ধরনের আতঙ্ক নিয়ে এসেছেন? এই আতঙ্ক ভবিষ্যতের সব কজন ভুক্তভোগীকে গ্রাস করবে, ধ্বংস করবে তাদের পরিবারকে—নিরীহ সব পরিবার, ঠিক আপনাদের মতো?’
‘কিন্তু এতটা নিশ্চিত আপনি কীভাবে হচ্ছেন যে...’
‘শুনুন! কান খুলে শুনুন! আপনাদের বাচ্চা বড় হবে একটা খুনি হিসেবে, মাথায় অত্যন্ত উঁচুমানের বুদ্ধি থাকবে তার, একের পর এক রোমহর্ষক অপরাধ না করে তার কোনো উপায় থাকবে না—ঠিক আব্বাসের মতো।’ সরাসরি মিথিলার দিকে তাকালেন। ‘নিজের ভেতরে যেটাকে আপনি বড় করছেন, সেটা সব রকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে আক্ষরিক অর্থে একটা দানব ছাড়া আর কিছু নয়!’
মিথিলার মাসকারা লেপ্টে গেছে। তাঁর নিচের ঠোঁট কাঁপছে।
যেন অসুস্থকর কোনো ধরনের সংকেত পেয়ে ব্যাপারটা শুরু হলো: খুনি আব্বাসের শিশুসুলভ গোলগাল চেহারা ফুটল চেম্বারের দেয়ালে বসানো টিভি পর্দায়, মিউট করে রাখা মনিটরে খবরটা আবার পড়া হচ্ছে।
মুঠোর ভেতর মাদুলিটা শক্ত করে ধরলেন মিথিলা, খুনি আব্বাসের চোখে তাকানোর শক্তি সঞ্চয় করছেন। চোখা দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, তার মুখের সামনে দিয়ে তারই খুন করা মেয়েদের ফটোগুলো সরে যাচ্ছে, ওদের পিছু নিয়ে এল যাদের সে ধর্ষণ করেছে তাদের ফটো—প্রতিবেদক বলছে, ‘এদের শুধু ধর্ষণই করা হয়নি, ধর্ষণের পর কয়েকজনকে খুনও করা হয়েছে...তারপর নিজ বাড়ির বাগানে প্রতিটি লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, সেও আজ বহু বছর আগের ঘটনা...’
‘সিদ্ধান্ত আপনাদের, মিসেস মিথিলা। কতটুকু চাপ আপনাদের সহ্য করতে হচ্ছে, আমরা জানি। কিন্তু...বুঝতেই তো পারছেন।’
শক্ত মুঠোর ভেতর মাদুলি, নিঃসঙ্গ একফোঁটা চোখের পানি পড়ল তাঁর পেটে। তারপর, শুরুটা ধীরে, মিথিলা কাঁদতে শুরু করলেন।
‘হ্যাঁ,’ বললেন মিথুন, ‘আমি মিথুন কাজি...’ কল্পনায় ওকে বিছানার ওপর অনবরত মোচড় খেতে দেখছেন, বিবস্ত্র ও ঘর্মাক্ত, তিনি সেখানে প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ব্যাজে লেখা নামটা পড়লেন, সোনালি রঙের ওপর এম্বুস করা কালো হরফ—তৃষ্ণা। একটা ঢোঁক গিললেন তিনি।
‘আচ্ছা, আপনারা চলে এসেছেন...মিস্টার মিথুন কাজি, আর মিসেস মিথিলা কাজি?’
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই জোর করে একটু হাসলেন।
হাতের ক্লিপবোর্ডে একটা টোকা মারল তৃষ্ণা। ‘ডাক্তার সোহেলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট? দুপুর দেড়টায়?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন মিথিলা, একপাশে একটু সরে গিয়ে স্বামীর দৃষ্টিপথে স্পষ্ট বাধা সৃষ্টি করলেন।
‘দারুণ,’ হাত তুলে জানালার পাশে চামড়া মোড়া সোফা দেখাল তৃষ্ণা। ‘আপনাদের একটু বসতে হবে। সময় হলে ডাকব আমি।’ ওর হাসিতে মুক্তো ঝরল, দাঁতগুলো একদম নিখুঁত।
এরপর অস্বস্তিকর নীরবতা। সোফায় বসার পরও তৃষ্ণার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না মিথুন, গায়ে রোদ নিয়ে বসেছেন শুধু ওকে ভালো করে দেখতে পাওয়ার জন্য। তবে, যেমনটি আশা করেছিলেন সে রকম কিছু ঘটতে দেখছেন না—তরুণী তৃষ্ণা ভুলেও তাঁর দিকে তাকাচ্ছে না।
বসার ভঙ্গি বারবার বদলাচ্ছেন মিথুন। একসময় তাঁর চোখ পড়ল দেয়ালে বসানো টিভির পর্দায়। আওয়াজ কমানো হলেও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে; কোথাও আগুন লেগেছে, অকুস্থল থেকে গলা ফাটিয়ে রিপোর্ট করছে এক মেয়ে। কোথায় আগুন লাগল, কেউ মারা গেল কি না, এসব প্রশ্ন মিথুনের মাথাতেই এল না, মেয়েটার ওড়না গলায় উঠে গেছে দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো তাঁর, বুক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না। রায় দিয়ে দিলেন, এই মেয়ে মিথিলার চেয়েও সুন্দর, এর আবেদনও বেশি, কাজেই এর সঙ্গে তো পাপ করা যায়ই।
‘তুমি ছায়ায় সরে বসো, গায়ে রোদ লাগছে,’ বললেন মিথিলা। ‘নতুন শার্টটা শুধু শুধু ঘামে ভেজাচ্ছ।’
মিথুন কিছু বললেন না, কিছু করলেনও না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালেন।
টিভিতে খবর বদলে গেল। এখন দেখানো হচ্ছে দেশজুড়ে যে লোককে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ, তার সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন। শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে গোলগাল চেহারা পর্দাজুড়ে। ওটা ফটো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া খুনি, চোখ দুটো ভাসা ভাসা, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কী যেন দেখছে। সেদিকে তাকিয়ে গলার মাদুলি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলেন মিথিলা।
‘সকালে তোমার নিজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, ভুলে যাওনি তো?’ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করলেন মিথুন। ‘না, মিলা, ভুলিনি।’ নানা মানসিক সমস্যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে হয়, পরস্পরকে মনে করিয়ে দেওয়াটাও প্রায় একটা রোগের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এই সময় মিথিলা শুনতে পেলেন টিভির রিপোর্টার বলছে: ‘... এই লোক চরম বিপজ্জনক,’ চোখ তুলে পর্দার দিকে তাকালেন তিনি। লোকটাকে, অর্থাৎ খুনি আব্বাসকে দেখাচ্ছে। ‘ও আল্লাহ, মিথুন!’ আঁতকে উঠলেন তিনি, মনে পড়ে গেল এই লোকের অপরাধের তালিকা, যে তালিকা মিডিয়া প্রতিদিন প্রচার করছে: নটা খুন, পাঁচটা খুনের চেষ্টা, বারোটা ধর্ষণ এবং গ্রেপ্তার হয়েছিল মাত্র একবার। জেল থেকে পালানোসহ আরও অনেক ছোটখাটো অভিযোগ আছে। ‘ও আল্লাহ, ওই লোক...’
‘এই,’ বললেন মিথুন, নরম হচ্ছেন, স্ত্রীর হাত ধরে চাপ দিলেন একটু।
‘না, মানে, আমার কথা হলো, এ রকম একটা লোককে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কীভাবে পালাতে দিল?’
স্ত্রীকে অভয় দেওয়ার সময় পেলেন না মিথুন।
‘মিস্টার এবং মিসেস কাজি,’ অ্যাড্রেস সিস্টেম থেকে তৃষ্ণার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘আপনারা দয়া করে তিন নম্বর প্যাসেজ ধরে বাইশ নম্বর কামরায় চলে আসুন। ডাক্তার সোহেল এখন আপনাদের সময় দেবেন।’
বাইশ নম্বর কামরার বাতাস একদম বরফ। ডেস্কের পেছনে বড়সড় লেদার চেয়ারে বসে আছেন প্রকাণ্ডদেহী ডাক্তার সোহেল। আশিতলায় রয়েছেন তাঁরা, ডাক্তারের পেছনে কাচ, নিচে বহুদূর বিস্মৃত কক্সবাজার শহর, কংক্রিটের জঙ্গল বললেই হয়, বিশাল সব দালানের পাশ ঘেঁষে উড়ালপথ ধরে ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। বহুদূরে রোদে চিকচিক করছে সাগর।
‘ধন্যবাদ,’ বললেন ডাক্তার সোহেল, চশমাটা নেড়েচেড়ে ঠিকমতো বসিয়ে নিলেন চোখে। হাত তুলে চেয়ার দেখালেন ওঁদের। ‘প্লিজ।’
‘ধন্যবাদ।’
‘আমি জানি আপনারা কী ভাবছেন। এত তাড়াতাড়ি আবার কেন ডাকলাম আপনাদের, তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন মিথুন, স্ত্রীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ‘একটু চিন্তাও হচ্ছে।’
‘আমি বকবক করতে পারি না, মিস্টার মিথুন, মিসেস মিথিলা, কাজেই সরাসরি কাজের কথায় আসছি।’ হাত দুটো দিয়ে একটা ব্রিজ বানালেন ডাক্তার সোহেল। ‘কাল আমি ল্যাব থেকে একটা খবর পেলাম। কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে, আপনাদের বাচ্চাকে নিয়ে সেটা বেশ গুরুতর জটিলতাই বলব আমি, তাই ভাবলাম শুরুতেই জানিয়ে রাখি আপনাদের।’
‘কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মিথিলা, ঝট করে সামনে ঝুঁকলেন। ‘কী ধরনের জটিলতা?’
‘উম্...মনে হচ্ছে এ রকম একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে...’ থেমে গেলেন ডাক্তার, কৌশলী হওয়ার উপায় খুঁজছেন। ‘আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি তা হলো, আপনাদের বাচ্চা স্পেসিফিকেশন অনুসারে সবকিছু পাবে না...’
‘আচ্ছা,’ বললেন মিথুন, ভ্রুজোড়া কপালে উঠে গেছে। শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন তিনি, খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। ‘প্লিজ। ডাক্তার সাহেব।’ চোখ দুটো সরু করলেন, গলার আওয়াজ নিজের অজান্তেই কর্কশ। ‘এর মানে বা তাৎপর্য কী?’
‘গত সপ্তায় আপনার ভ্রূণের স্ক্যান করা হয়,’ লুকোচুরি বাদ দিয়ে আসল কথায় আসছেন ডাক্তার, ‘সেই সঙ্গে ওই একই পর্যায়ের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখা গেছে দুটোর মধ্যে তারতম্য রয়েছে, যেটা আমরা স্রেফ আশা করিনি।’
‘ও।’ নিজেকে ধরে রাখার জন্য প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করছেন মিথুন, কাগজের চেয়েও সাদা দেখাচ্ছে তাঁর মুখ। আবার সেই একই প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘এর মানে বা তাৎপর্য যদি একটু বুঝিয়ে বলেন, প্লিজ?’
‘শুনুন, আপনাদের অনাগত সন্তানের জেনেটিক মেকআপে আমরা প্রচুর পরিমাণে এমএওএ-টু পেয়েছি...আমার আর আপনাদের কাছে এমটু।’
‘তারপর?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন মিথুন। ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, ডাক্তার সাহেব, এখানটায় বাংলায় বলুন!’
‘এই এমটু মিন অক্সিডেইজ, এই নামেই এটা পরিচিত, একটা এনজাইম, যেটা ব্রেইনের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার ভাঙে, যেমন পাইনফ্রিন, ডোপামিন, এ রকম আরও অনেক। ওটা নিষ্ক্রিয় করে ওগুলোকে, আর এই ট্র্যান্সমিটারগুলোই শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করে মেজাজ, আক্রমণাত্মক প্রবণতা, ফুর্তি ইত্যাদি।’
কথাগুলো হজম করতে কিছুটা সময় নিলেন মিথুন। ‘ঠিক আছে,’ কোনো রকমে বলতে পারলেন। ‘তাহলে, আমাকে ধরে নিতে হচ্ছে এটা ভালো খবর নয়?’
এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন ডাক্তার।
‘ঠিক আছে, ডাক্তার সাহেব। আপনি এখন তাহলে ব্যাখ্যা করে বলবেন আমাদের বাচ্চাকে এটা ঠিক কীভাবে বিপদে ফেলবে?’
‘বাচ্চাকে বিপদে ফেলবে? না না না! ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো...’
ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে মিথিলা আবার বললেন, ‘আমি বলতে চাইছি, আমরা যা করতে বলেছিলাম, তাও কি আপনি করেননি?’ তাঁর গলা থেকে আওয়াজ বেরোতে চাইছে না, যেকোনো মুহূর্তে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই, মিসেস কাজি, আপনারা যা যা চেয়েছেন সব আমরা করেছি।’
‘তাহলে এসব ছাই ঘটল কীভাবে?’
চশমাটা আবার নাকের গোড়ায় তুলে আঁট করে বসালেন ডাক্তার। ‘সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের একগাদা চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই আমাদের এই উৎকট সমস্যায় পড়তে হয়েছে, মিস্টার কাজি। আপনি চেয়েছেন আপনার মধ্যে যেকোনো বিষয়ে সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ার যে প্রবণতা আছে, সেটা যেন ওর ভেতর থেকে বাদ দেওয়া হয়, আমরা সেটা বাদ দিয়েছি। কিন্তু আমরা আপনাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছি আসক্তি, যেকোনো আসক্তি, হোক সেটা সেক্স, অ্যালকোহল, ড্রাগ...এমনকি ভায়োলেন্স পর্যন্ত প্রভাবিত হয় অসংখ্য জিনের দ্বারা, অসংখ্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা এখানে নাহয় নাই বললাম। এটা খুবই জটিল একটা প্রক্রিয়া, একজনেরটা আরেকজনের মতো নয় এবং এখানে কোনো রকম গ্যারান্টি নেই। একটা জিনের অলটারনেটিভ ফর্মকে বলে অ্যালিল, এই কেসে আমরা ডিআরডিটু জিনে যে ডোপামিন রিসেপটর আছে তার অ্যালিল নিষ্ক্রিয় করে দিই, যে জিন আমরা জানি আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, মিস্টার মিথুন, এই জিনই দায়ী কিছু...’ ইতস্তত করছেন ডাক্তার, সঠিক শব্দটা খুঁজছেন, ‘...দায়ী আপনাদের ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার জন্য, সম্প্রতি আপনাদের দাম্পত্য জীবনে যেগুলো অশান্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল।’ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন।
‘তো?’ কাঁধ ঝাঁকালেন মিথুন। ‘আপনি এখনো প্রশ্নটার উত্তর দেননি। ঠিক কী ঘটেছে যে সব এ রকম এলোমেলো হয়ে গেল?’
‘আপনি কি আমাকে বলতে দেবেন, প্লিজ? আপনি আরও চেয়েছিলেন, আমরা যেন আপনার স্ত্রীর ওসিডি প্রবণতা বাচ্চার মধ্যে না রাখি। কাজেই, হিউম্যান সেরোটোনিন ট্রান্সপোর্টার জিনের সমস্ত চিহ্ন আমরা সরিয়ে নিয়েছি, কাজটা যথেষ্ট সহজই ছিল, কিন্তু সেটা সৃষ্টি করল আরেক প্রস্থ আড়ষ্ট বাস্তবতা। শেষ পর্যন্ত সেসব আমরা এড়াতে পারলাম, কিন্তু তার পরও আপনার শিশুর বুদ্ধিশক্তি আর স্মৃতিশক্তি বাড়াতে হলো আমাদের, সেই সঙ্গে গড় আকারের চেয়ে বড় দেখে একটা সেরিবেলাম কর্টেক্সের ব্যবস্থা করতে হলো। এগুলোর সবই আমরা করেছি আপনারা চেয়েছিলেন বলে, মিস্টার মিথুন।’
‘সে জন্য আমরা পেমেন্টও করেছি।’
‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করলেন ডাক্তার, এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করলেন চোখ দুটো। ‘কিন্তু আপনাদের আমরা বলেছি, সংখ্যায় এত বেশি অনুরোধ এর আগে কখনো কেউ করেনি। শেষ পর্যন্ত আপনাদের আমরা পুরোপুরি সচেতন করেছি স্পেসিফিকেশনে আরও বেশি কিছু দাবি করা হলে কম্পোজিশন কী রকম আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার পরও, আপনারা দুজনেই, চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন।’
‘এক মিনিট থামুন, আগে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হতে দিন,’ বললেন মিথুন। ‘আমরা আপনাদের বিশ লাখ টাকা দিয়েছি, সেটা আপনারা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন, আর তার বিনিময়ে এখানে আপনি ঠান্ডা ঘরে বসে আমাকে বলছেন আমাদের বাচ্চার রক্তে না মগজে তারতম্য ঘটেছে? আমার স্ত্রীর ভেতর আপনারা কী উদ্ভট জিনিস বড় করছেন শুনি?’ সামনের দিকে ঝুঁকলেন তিনি, গলার আওয়াজ খাদে নামালেন। ‘আপনি, ডাক্তার, নিজের উপকার করবেন ভালো একজন উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। যদি ভেবে থাকেন আমরা আপনাকে ছেড়ে দেব...’
‘ওহ্, শুধু ভালো নয়, দেশের সেরা উকিল ঠিক করা আছে আমাদের, মিস্টার মিথুন।’ জোর করে একটু হাসলেন ডাক্তার সোহেল। ‘আমার কাছে আরও তথ্য আছে, ওগুলো নিয়েও আমি আলোচনা করতে চাই।’
রাগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন মিথুন।
‘তো আগে যা বলছিলাম আরকি, নিজেদের জেনেটিক মেকআপে এত বেশি মাত্রায় এমটু থাকলে কেউই কোনো রকমের সহমর্মিতা অনুভব করবে না, কিংবা তাদের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি বলে কিছু থাকবে না। তারা শুধু জানবে রাগ করতে। হতাশায় ডুবতে। আর জানবে কাকে কীভাবে আঘাত করা যায়।’
সোফায় স্থির হয়ে বসতে পারছেন না মিথুন।
‘জন্মাবার পর শিশুটিকে আমরা চরম আক্রমণাত্মক একটা প্রাণী হিসেবে পাব। প্যারানয়আ...মানসিক বৈকল্যের শিকার, মাঝেমধ্যে চরম ভুল ধারণার শিকার। শিশুটি মাত্রা ছাড়ানো বিষণ্নতায় ভুগবে, আকস্মিক খেপামি দেখা দেবে আচরণে, যত দিন যাবে ততই তার মধ্যে দয়ামায়ার অভাব প্রচণ্ড হয়ে উঠবে। এ ধরনের কেসে আমরা, ডাক্তাররা, যে ভবিষ্যদ্বাণী করি তাতে বলা হয়েছে—প্রচুর আশঙ্কা আছে সাবজেক্ট পরিণতবয়স্ক হওয়ার আগেই খুনি হয়ে উঠতে পারে, সম্ভবত কৈশোরে পা দেওয়ারও আগে।’
প্রবল হতাশায় আহত জন্তুর মতো একটা আওয়াজ বেরোল মিথিলার গলা থেকে।
সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন মিথুন। ‘ডাক্তার সাহেব, আসলে এটা কি এক ধরনের কৌতুক? বিশ লাখ টাকায় এই জিনিস? একবার শুধু তাকিয়ে দেখুন আমার স্ত্রীর কী অবস্থা করেছেন আপনি।’
ডাক্তারের হাত ব্রিজটা ভেঙে দিল, ভ্রুজোড়া তৈরি করল গভীর গিরিখাদ। ‘মিস্টার মিথুন, আমি...’
‘আমার উচিত এক ঘুষিতে আপনাকে আগামী সপ্তায় পাঠিয়ে দেওয়া!’
‘না, মিথুন, প্লিজ।’ স্বামীর হাত খামচে ধরলেন মিথিলা। ‘প্লিজ, তুমি শান্ত হও। এভাবে আমরা কোনো সাহায্যই পাব না।’ নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য একটু সময় নিলেন, তারপর সোফা ছেড়ে সিধে হলেন, ডাক্তারের চোখের দিকে তাকালেন, এখনো আড়ষ্ট হয়ে আছেন। ‘দু-দুঃখিত, ডাক্তার সাহেব। কী যেন বলছিলেন আপনি?’
‘আপনাদের দুজনকেই বলছি। এটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা চুপ থাকবেন। এখন আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা বোঝার চেষ্টা করবেন।’
নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকিয়ে আছেন মিথুন, ডাক্তারের নাটকীয়তা তিনি ভালো চোখে দেখছেন না, তবে কিছু বললেন না।
‘আমাদের ওপর নির্দেশ আছে আমরা যেসব ভ্রূণ ডেভলপ করছি, তার মধ্যে এমটু থাকলে সরকারকে তা জানাতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে আমাদের লাইসেন্স থাকা বা না থাকা। আজ বিশ বছর হয়ে গেল এই ফ্যাসিলিটিতে ডেভলপ করা কোনো সিনথেসাইজড শিশুকে রক্তপ্রবাহে এত বেশি মাত্রায় এমটু নিয়ে গেটের বাইরে বেরোবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার আগে, ওটাই শেষবার, প্রায় হুবহু এই কেসটার মতো পরিস্থিতিতে, এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তার পরিণতি শুনবেন?’ চোখ তুলে তাকালেন ডাক্তার সোহেল। ‘আমার ধারণা, ইতিমধ্যে টিভিতে আপনারা আজকের খবর শুনেছেন।’
মিথুন আর মিথিলার মুখ ঝুলে পড়ল। ব্যাপারটা অনুধাবন করতে খুব বেশি সময় লাগল না।
‘আপনি খুনি আব্বাসের কথা বলছেন?’ গলায় একটা আর্তনাদকে আটকে দিলেন মিথিলা।
‘সর্বশেষ সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সে, একজন সিরিয়াল খুনি, সাজাটা দেওয়া হয়েছিল দশ বছর আগে, নটা মেয়েকে খুন করার অপরাধে।’
‘আল্লাহ...অসম্ভব!’ ধাম করে ডেস্কে ঘুষি মারলেন মিথুন। ‘আমাদের বিরুদ্ধে এ রকম একটা অন্যায় আপনি কীভাবে করতে পারলেন?’
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, ডাক্তার বলে যাচ্ছেন, ‘আজ কয়েক যুগ হয়ে গেল আমরা আমাদের প্রক্রিয়া থেকে এমটু মুছে ফেলার চেষ্টা করছি—এটা আমাদের কয়েক শ কোটি টাকার রিসার্চ প্রজেক্ট।’ খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, গলার আওয়াজ যেন দূর থেকে ভেসে আসছে। ‘কিছু হয়নি। দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি একটা না একটা পথ ঠিকই পেয়ে যায়। যতভাবে যত রকম চেষ্টাই আমরা করি না কেন।’
‘কিন্তু নিশ্চয়ই নিয়ম-টিয়মের মধ্যেও ব্যতিক্রম বলে কিছু থাকে,’ মিনতির সুরে বললেন মিথিলা। ‘মানে, এমটু-র কথা বলছি। থাকে না, ডাক্তার সাহেব?’
মৃদু হাসির রেখা ফুটল ডাক্তারের ঠোঁটে, তবে তাঁর সুর দৃঢ়ই থাকল। ‘আমি দুঃখিত, মিসেস মিথিলা। গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে শতকরা নব্বই পার্সেন্টেরও বেশি হিংস্র অপরাধীর জেনেটিক মেকআপে এমটু পাওয়া গেছে। সে জন্যই সরকার বাধ্য হয়ে একটা গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। হিংস্রতা বা নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো নিরসনপদ্ধতি আবিষ্কার করেছি আমরা!’
মিথিলার দুগাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে।
‘তাহলে,’ মিথুন বললেন, গলার আওয়াজ এখন হেরে যাওয়া মানুষের মতো নিচু, ‘কী সেই গাইডলাইন, যেটার কথা বলছেন আপনি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। ‘অন্তত বাছাই করার একটা সুযোগ আপনাদের আছে। এক, বাচ্চার কথা ভুলে যান, এখানেই এই চ্যাপ্টার শেষ হয়ে যাক। দুই, ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’
‘কিন্তু এই সুযোগ পাওয়ার জন্য আমাদের দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে!’
ডাক্তার এখন আর মিথুনকে গ্রাহ্য করছেন না, আবেদন করার জন্য বেছে নিয়েছেন মিথিলাকে। ‘কথাটা গোপনীয়, আমি আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি, মিসেস মিথিলা। ইতি টানুন, আর তা না হলে জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষ আপনার বাচ্চাকে নিয়ে চলে যাবে। আইন মেনে চলতে আমরা বাধ্য, কাজেই এই ফ্যাসিলিটিতে এমটু নিয়ে কোনো বাচ্চা জন্ম নিলে আমাকে তা রিপোর্ট করতে হবে। এর ওপর নির্ভর করবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার লাইসেন্স থাকবে কি থাকবে না।’
‘আর আমরা যদি বিদেশে গিয়ে নিই ওকে? ইন্দোনেশিয়ার কোনো একটা দ্বীপে চলে গেলাম, আপনাদের নাগালের বাইরে? তখন আপনারা কিছু জানতে পারবেন না, কাউকে কিছু বলারও থাকবে না।’
‘সেটা আপনারা করতে পারেন,’ বিষণ্ন চেহারা নিয়ে মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার। ‘তবে আমি সব সময় সন্দেহ করব। আর, তা ছাড়া, রাতে আপনারা ঘুমোবেন কীভাবে—এটা জেনে যে দুনিয়ায় আপনারা কী ধরনের আতঙ্ক নিয়ে এসেছেন? এই আতঙ্ক ভবিষ্যতের সব কজন ভুক্তভোগীকে গ্রাস করবে, ধ্বংস করবে তাদের পরিবারকে—নিরীহ সব পরিবার, ঠিক আপনাদের মতো?’
‘কিন্তু এতটা নিশ্চিত আপনি কীভাবে হচ্ছেন যে...’
‘শুনুন! কান খুলে শুনুন! আপনাদের বাচ্চা বড় হবে একটা খুনি হিসেবে, মাথায় অত্যন্ত উঁচুমানের বুদ্ধি থাকবে তার, একের পর এক রোমহর্ষক অপরাধ না করে তার কোনো উপায় থাকবে না—ঠিক আব্বাসের মতো।’ সরাসরি মিথিলার দিকে তাকালেন। ‘নিজের ভেতরে যেটাকে আপনি বড় করছেন, সেটা সব রকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে আক্ষরিক অর্থে একটা দানব ছাড়া আর কিছু নয়!’
মিথিলার মাসকারা লেপ্টে গেছে। তাঁর নিচের ঠোঁট কাঁপছে।
যেন অসুস্থকর কোনো ধরনের সংকেত পেয়ে ব্যাপারটা শুরু হলো: খুনি আব্বাসের শিশুসুলভ গোলগাল চেহারা ফুটল চেম্বারের দেয়ালে বসানো টিভি পর্দায়, মিউট করে রাখা মনিটরে খবরটা আবার পড়া হচ্ছে।
মুঠোর ভেতর মাদুলিটা শক্ত করে ধরলেন মিথিলা, খুনি আব্বাসের চোখে তাকানোর শক্তি সঞ্চয় করছেন। চোখা দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, তার মুখের সামনে দিয়ে তারই খুন করা মেয়েদের ফটোগুলো সরে যাচ্ছে, ওদের পিছু নিয়ে এল যাদের সে ধর্ষণ করেছে তাদের ফটো—প্রতিবেদক বলছে, ‘এদের শুধু ধর্ষণই করা হয়নি, ধর্ষণের পর কয়েকজনকে খুনও করা হয়েছে...তারপর নিজ বাড়ির বাগানে প্রতিটি লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, সেও আজ বহু বছর আগের ঘটনা...’
‘সিদ্ধান্ত আপনাদের, মিসেস মিথিলা। কতটুকু চাপ আপনাদের সহ্য করতে হচ্ছে, আমরা জানি। কিন্তু...বুঝতেই তো পারছেন।’
শক্ত মুঠোর ভেতর মাদুলি, নিঃসঙ্গ একফোঁটা চোখের পানি পড়ল তাঁর পেটে। তারপর, শুরুটা ধীরে, মিথিলা কাঁদতে শুরু করলেন।
No comments