রণমহি বঙ্গমাতা- মহররমের চাঁদ উঠিলে... by সাইমন জাকারিয়া
অজানা ও অচেনা এক গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলাম। সহায়ক হিসেবে যাঁর সঙ্গে আগে দু-একবার ফোনে কথা হয়েছে, তিনিও আমার অচেনা। তাই মনে ছিল দ্বিধা, কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির, প্রতীক্ষা ছিল দৃঢ়, আমি যাবই যাব বাংলাদেশের আত্মসত্তার গভীরে।
বিকেলের রক্তলাল পশ্চিমাকাশের আলোর পর সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারের ভেতর সুলতানসীতে পৌঁছি। সরাসরি মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরাধিকার হিসেবে খ্যাত প্রখ্যাত সাধক-লেখক সৈয়দ হাসান ইমাম হোসাইনী চিশতির ‘দরবার-এ মোস্তফা’ নামের গৃহপ্রাঙ্গণে নামি। নামতেই অন্তর আলী নামক জনৈক ভক্ত এগিয়ে এসে বললেন, ‘মনে কিছু করবেন না, আমাদের এখানে এই মহররমের মাসজুড়ে আমরা কিছু নিয়ম মানি, এ সময় আমরা কেউ জুতা-স্যান্ডেল পরি না।’ এমন কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে পায়ের স্যান্ডেল খুলে ব্যাগে রেখে তাঁকে বলি, ‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি, আওলিয়া মিয়া সাবের সাথে দেখা করতে চাই।’ এ কথার পর অন্তর আলী আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভেতরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সেখানেই সাক্ষাৎ হলো সৈয়দ হাসান ইমাম হোসাইনী চিশতির সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘মহররমের এ সময় আমরা শোক পালন করি, এই দেখেন, আমার ঘরে এখন কোনো খাট-পালঙ্ক নেই, আমরা এ চাঁদে মাটির বিছানায় ঘুমাই, আপনাকে যে চেয়ারে বসতে দেব, তা-ও সম্ভব নয়। কারণ, আমরা মহররমে কোনো আসনে বসি না, মাটিতে বসি। তাই আপনাকে কোনো ধরনের আদর-আপ্যায়নও করতে পারব না। এ সময় আমরা রোজা রাখি, খালি পায়ে হাঁটি, মাটির বিছানায় শুই। এখানে থাকতে হলে আপনাকেও এসব পালন করতে হবে।’ তাঁর কথায় রাজি হয়ে বলি, ‘আমি আপনাদের সব নিয়মই মানব, পালন করব, আর আমাকে বাড়তি কোনো আদর-আপ্যায়নও করতে হবে না। আপনি শুধু অনুমতি দিন, আমি আপনার অঞ্চলে কয়েক দিন ঘুরে ঘুরে জারি-মর্সিয়া শুনব, এলাকার মানুষের সাথে কথা বলব, ছবি তুলব, প্রয়োজনে ভিডিও করব। এই সব আমার গবেষণার অংশ।’ তিনি রাজি হন এবং সুলতানসী হাবিলীর প্রধান খাদেম মহরম আলীকে বলে দেন, আমাকে যেন সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়।
আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতার দুয়ার খুলে যায়। সুলতানসী হাবিলীর মোকামের পাশেই ছোট একটি খোলা ঘরে খড় বিছিয়ে যেখানে খাদেম ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্তরা ধানের সোনালি খড় বিছিয়ে শুয়ে রাত যাপন করেন, সেখানেই আমার স্থান নির্ধারিত হয়। সেখানে বসে খাতা-কলম বের করে প্রধান খাদেম মহরম আলীর মুখ থেকে এই এলাকার মহররম উদ্যাপনের বৃত্তান্ত শুনি। জানতে পারি, সুলতানসী, শরিফপুর, চানপুর ও হাতির থান—এই চার গ্রামের তরিকতপন্থী আশেকে পাঞ্জাতন মহররমের চাঁদ ওঠার দিন সুলতানসী হাবিলীতে এসে ‘ইয়া নবি শান ওপর তোমারই সালাতু সালাম হে...’ বলে সালাম দেন। মূলত এই সালাম দেওয়ার পর থেকেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি জারি-মর্সিয়ার আসর শুরু হয়।
গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে জারি-মর্সিয়া পরিবেশনের একটি রীতি এই অঞ্চলে আছে। তা হলো, এক-একটি জারি-মর্সিয়ার দল ঢাক, ট্রামপেড, কাঁসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জারিগানের একজন বইমাস্টার দু-তিনজন হাদিসহ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যান এবং প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে জারি ও মর্সিয়া পরিবেশন করেন। একটি বাড়ির জারি-মর্সিয়া শেষ হলে সে বাড়ির পক্ষ থেকে জারি-মর্সিয়াকারী ভক্ত-শিল্পীদের শিরনি খেতে দেন, শিরনি শেষে জারি-মর্সিয়ার দল আবার ঢাক, ট্রামপেড ও কাঁসা বাজিয়ে অন্য বাড়িতে যায় এবং আগের মতোই জারি-মর্সিয়া পরিবেশন করে। মহররম মাসের চাঁদ দেখা দেওয়ার পর থেকে ৯ তারিখ রাত পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এমন জারি-মর্সিয়ার আসর চলে।
খাদেম মহরম আলী বলেন, তাঁদের অঞ্চলে প্রতি গ্রামে একাধিক পাঞ্জাতনের মোকাম রয়েছে এবং এই অঞ্চলে প্রায় ৪০টি গ্রামে পঞ্চাশের অধিক মোকাম রয়েছে। প্রায় প্রতিটি মোকাম থেকে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন তাজিয়া মিছিল এসে সুলতানসী হাবিলী মোকামে এসে জমায়েত হয়ে শোক মর্সিয়া করে। এই অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ গভীর ভক্তির সঙ্গে মহররম পালন করেন। এ সময় এখানকার মানুষ মাথায় টুপি পরেন না, এমনকি রোদ-বৃষ্টিতে ছাতাও ব্যবহার করেন না।
প্রাথমিকভাবে খাদেম মহরম আলীর মুখ থেকে এসব তথ্য জেনে নিয়ে রাত গভীর না হতেই গ্রামে গ্রামে জারি-মর্সিয়ার আসর পর্যবেক্ষণে নামি। প্রথমে দেখি, পূর্ব সুলতানসীর তমিজ মিয়ার বাড়ির উঠানে তরুণ বইমাস্টার মোহাম্মদ ফজলু মিয়া পরিচালিত জারি-মর্সিয়া। জারি-মর্সিয়ার আসর হবে বলে আগে থেকে উঠানের দুই দিকে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল। উঠানের ঠিক মাঝখানে সিমেন্টের বস্তা সেলাই করা আসনে বসে ও দাঁড়িয়ে ৫০-৬০ জন শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সম্মিলিতভাবে কয়েকটি জারি ও সেই সঙ্গে মর্সিয়া পরিবেশন করল। তারপর শিরনি খেয়ে ট্রামপেড, ঢাক ও কাঁসা বাজাতে বাজাতে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে গ্রামের ঝোপ-জঙ্গলের পাশ দিয়ে কখনো একপায়ে পথ, কখনো প্রশস্ত পথ মাড়িয়ে এই দলটি পৌঁছে গেল একই গ্রামের মধ্য সুলতানসীর রহিমুল্লাহ হাজির বাড়ি। আমরা সেখানেও এই দলের জারি-মর্সিয়া শুনলাম। এরপর আমি আরেকটি ভিন্ন দলের জারি-মর্সিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য সুলতানসী হাবিলী থেকে আমার সঙ্গে দেওয়া পথনির্দেশক রানা ও অন্তর ভাইকে বললাম। তাঁরা এবার আমাকে নিয়ে পশ্চিম সুলতানসীর আবদুল কাইয়ুমের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে বইমাস্টার মোহাম্মদ বজলুর নেতৃত্বে জারি-মর্সিয়া দেখে আমি ভিন্ন একটি গ্রামে এই পরিবেশনার ধরনটি পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠি।
এ পর্যায়ে হাতির থানের পথে রওনা দেওয়া। এই গ্রামের কুদ্দুস মিয়ার বাড়িতে হাদী শাহ মোহাম্মদ আবদুস শহীদের নেতৃত্বে জারি-মর্সিয়া দেখেও পিপাসা মেটে না। তাই শরিফপুর গ্রামের দিকে হাঁটতে থাকি। সে গ্রামে তখন কাচা মিয়ার বাড়িতে জারি-মর্সিয়া পরিবেশন করছিল হাদী মোহাম্মদ আকবর আলীর দল। এভাবে একই রাতে তিনটি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে ঘুরে জারি-মর্সিয়ার আসর দেখে দেখে রাতের শেষ প্রহরে এসে পৌঁছি। রোজা রাখতে হবে। তাই সেহিরর জন্য এবং কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজনে সুলতানসী হাবিলীর মোকামে ফিরে আসা।
পরদিন সকালে সুলতানসী গ্রামে সাত বছর ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া নতুন মোকামে যাই। জানতে পারি, শতাধিক বছরের পুরোনো এই মোকামটি প্রবর্তন করেছিলেন সৈয়দ আবদুল আওয়াল মুস্তর মিয়ার দাদা আবদুল হেলিম মিয়া। সম্প্রতি সৈয়দ আবদুল আওয়াল মুস্তর মিয়ার সন্তান আবু সালেহ মোহাম্মদ ইব্রাহিম জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শে তাঁর চার পুরুষের ঐতিহ্যবাহী সুলতানসী নতুন হাবিলীর মহররমের সব আয়োজন বন্ধ করে দিয়েছেন। এলাকাবাসীর মনে তা নিয়ে দারুণ অসন্তোষ, সে অসন্তোষের ভাব-বাচ্য এই মোকামের খাদেম নিধন মিয়ার চোখেমুখে প্রকাশ পেলেও তিনি হয়তো কোনো ভীতির কারণে মুখ খুলতে অপারগ। দুটি মোকাম দেখে কেন যেন মনে হলো, একই গ্রামের একটি মোকাম যেখানে মহররমের মাতমে সহস্র ভক্তের আহাজারিতে সমাচ্ছন্ন, সেখানে অন্য মোকামটি শোক প্রকাশে অপারগ হয়ে জনতার আবেগের সঙ্গে একাত্ম হতে না পেরে নিঃশব্দে গুমরে গুমরে কাঁদছে।
এরপর আমরা চানপুর গ্রামের পথে হাঁটি। এবার আমার সঙ্গী হয়ে ওঠেন খাদেম মহরম আলীর কনিষ্ঠ সহোদর মশাররফ। তাঁর সঙ্গে খালি পায়ে চানপুরের পথে যেতে যেতে প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। সে বর্ণনার এখানে সম্ভব নয়। মহররমের শোক-স্মৃতির স্মারক ঘোড়া তৈরির প্রস্তুতি দেখা, এক-একটি মর্সিয়া দলকে মর্সিয়া গাইতে গাইতে সুলতানসী হাবিলীর দিকে এগিয়ে যেতে দেখা এবং পবিত্র নারীদের জারি-মর্সিয়া দেখার অভিজ্ঞতাও ঘটে এই গ্রামে। সে আরেক প্রসঙ্গ। কেননা, এখানে এসেই জানতে পারি, নারীরা কখন পবিত্র হন আর কখনই বা তাঁরা জারি-মর্সিয়া গাইবার অধিকার রাখেন।
গভীরভাবে অবলোকন করলে বোঝা যায় যে সুলতানসী হাবিলীর মহররম পালনের কৃত্যাচার সত্যিকার অর্থে নিয়মতান্ত্রিক তথা ছকে বাঁধা একটি আয়োজন। যেমন এলাকার সবাই প্রায় জানেন, মহররমের ৯ তারিখ সকাল থেকে দুপুর অবধি বিভিন্ন গ্রামের জারি-মর্সিয়ার দল এসে সাব বাড়ির (কারবালা) প্রাঙ্গণে জারি-মর্সিয়া পরিবেশন করেন এবং মহররমের ১০ তারিখ তাজিয়া মিছিলসহ সুলতানসী হাবিলীর প্রধান মোকামে সালাম দিয়ে মহররমের ১০ দিনের শোক প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতার ইতি টানেন। কিন্তু শোকের বিভিন্ন ধরনের কৃত্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুরো মাসজুড়েই চলতে থাকে।
তাই কেউ যেন একাত্ম না হয়ে ওই এলাকার সাধারণ জনতার শোক প্রকাশের ভক্তিভাবের সঙ্গে খুব সহজে সেখানে যেতে না পারেন, এই ভেবে এখানে সুলতানসী গ্রামের জেলার নাম উল্লেখ করা হলো না, তবে অনুসন্ধানী গবেষকের জন্য এই লেখার মধ্যে এমন কিছু সূত্র বা ইঙ্গিত দেওয়া থাকল যার ভিত্তিতে গবেষক পথ খুঁজে নিতে পারবেন—এই আমার বিশ্বাস।
আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতার দুয়ার খুলে যায়। সুলতানসী হাবিলীর মোকামের পাশেই ছোট একটি খোলা ঘরে খড় বিছিয়ে যেখানে খাদেম ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্তরা ধানের সোনালি খড় বিছিয়ে শুয়ে রাত যাপন করেন, সেখানেই আমার স্থান নির্ধারিত হয়। সেখানে বসে খাতা-কলম বের করে প্রধান খাদেম মহরম আলীর মুখ থেকে এই এলাকার মহররম উদ্যাপনের বৃত্তান্ত শুনি। জানতে পারি, সুলতানসী, শরিফপুর, চানপুর ও হাতির থান—এই চার গ্রামের তরিকতপন্থী আশেকে পাঞ্জাতন মহররমের চাঁদ ওঠার দিন সুলতানসী হাবিলীতে এসে ‘ইয়া নবি শান ওপর তোমারই সালাতু সালাম হে...’ বলে সালাম দেন। মূলত এই সালাম দেওয়ার পর থেকেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি জারি-মর্সিয়ার আসর শুরু হয়।
গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে জারি-মর্সিয়া পরিবেশনের একটি রীতি এই অঞ্চলে আছে। তা হলো, এক-একটি জারি-মর্সিয়ার দল ঢাক, ট্রামপেড, কাঁসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জারিগানের একজন বইমাস্টার দু-তিনজন হাদিসহ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যান এবং প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে জারি ও মর্সিয়া পরিবেশন করেন। একটি বাড়ির জারি-মর্সিয়া শেষ হলে সে বাড়ির পক্ষ থেকে জারি-মর্সিয়াকারী ভক্ত-শিল্পীদের শিরনি খেতে দেন, শিরনি শেষে জারি-মর্সিয়ার দল আবার ঢাক, ট্রামপেড ও কাঁসা বাজিয়ে অন্য বাড়িতে যায় এবং আগের মতোই জারি-মর্সিয়া পরিবেশন করে। মহররম মাসের চাঁদ দেখা দেওয়ার পর থেকে ৯ তারিখ রাত পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এমন জারি-মর্সিয়ার আসর চলে।
খাদেম মহরম আলী বলেন, তাঁদের অঞ্চলে প্রতি গ্রামে একাধিক পাঞ্জাতনের মোকাম রয়েছে এবং এই অঞ্চলে প্রায় ৪০টি গ্রামে পঞ্চাশের অধিক মোকাম রয়েছে। প্রায় প্রতিটি মোকাম থেকে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন তাজিয়া মিছিল এসে সুলতানসী হাবিলী মোকামে এসে জমায়েত হয়ে শোক মর্সিয়া করে। এই অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ গভীর ভক্তির সঙ্গে মহররম পালন করেন। এ সময় এখানকার মানুষ মাথায় টুপি পরেন না, এমনকি রোদ-বৃষ্টিতে ছাতাও ব্যবহার করেন না।
প্রাথমিকভাবে খাদেম মহরম আলীর মুখ থেকে এসব তথ্য জেনে নিয়ে রাত গভীর না হতেই গ্রামে গ্রামে জারি-মর্সিয়ার আসর পর্যবেক্ষণে নামি। প্রথমে দেখি, পূর্ব সুলতানসীর তমিজ মিয়ার বাড়ির উঠানে তরুণ বইমাস্টার মোহাম্মদ ফজলু মিয়া পরিচালিত জারি-মর্সিয়া। জারি-মর্সিয়ার আসর হবে বলে আগে থেকে উঠানের দুই দিকে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল। উঠানের ঠিক মাঝখানে সিমেন্টের বস্তা সেলাই করা আসনে বসে ও দাঁড়িয়ে ৫০-৬০ জন শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সম্মিলিতভাবে কয়েকটি জারি ও সেই সঙ্গে মর্সিয়া পরিবেশন করল। তারপর শিরনি খেয়ে ট্রামপেড, ঢাক ও কাঁসা বাজাতে বাজাতে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে গ্রামের ঝোপ-জঙ্গলের পাশ দিয়ে কখনো একপায়ে পথ, কখনো প্রশস্ত পথ মাড়িয়ে এই দলটি পৌঁছে গেল একই গ্রামের মধ্য সুলতানসীর রহিমুল্লাহ হাজির বাড়ি। আমরা সেখানেও এই দলের জারি-মর্সিয়া শুনলাম। এরপর আমি আরেকটি ভিন্ন দলের জারি-মর্সিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য সুলতানসী হাবিলী থেকে আমার সঙ্গে দেওয়া পথনির্দেশক রানা ও অন্তর ভাইকে বললাম। তাঁরা এবার আমাকে নিয়ে পশ্চিম সুলতানসীর আবদুল কাইয়ুমের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে বইমাস্টার মোহাম্মদ বজলুর নেতৃত্বে জারি-মর্সিয়া দেখে আমি ভিন্ন একটি গ্রামে এই পরিবেশনার ধরনটি পর্যবেক্ষণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠি।
এ পর্যায়ে হাতির থানের পথে রওনা দেওয়া। এই গ্রামের কুদ্দুস মিয়ার বাড়িতে হাদী শাহ মোহাম্মদ আবদুস শহীদের নেতৃত্বে জারি-মর্সিয়া দেখেও পিপাসা মেটে না। তাই শরিফপুর গ্রামের দিকে হাঁটতে থাকি। সে গ্রামে তখন কাচা মিয়ার বাড়িতে জারি-মর্সিয়া পরিবেশন করছিল হাদী মোহাম্মদ আকবর আলীর দল। এভাবে একই রাতে তিনটি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে ঘুরে জারি-মর্সিয়ার আসর দেখে দেখে রাতের শেষ প্রহরে এসে পৌঁছি। রোজা রাখতে হবে। তাই সেহিরর জন্য এবং কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজনে সুলতানসী হাবিলীর মোকামে ফিরে আসা।
পরদিন সকালে সুলতানসী গ্রামে সাত বছর ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া নতুন মোকামে যাই। জানতে পারি, শতাধিক বছরের পুরোনো এই মোকামটি প্রবর্তন করেছিলেন সৈয়দ আবদুল আওয়াল মুস্তর মিয়ার দাদা আবদুল হেলিম মিয়া। সম্প্রতি সৈয়দ আবদুল আওয়াল মুস্তর মিয়ার সন্তান আবু সালেহ মোহাম্মদ ইব্রাহিম জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শে তাঁর চার পুরুষের ঐতিহ্যবাহী সুলতানসী নতুন হাবিলীর মহররমের সব আয়োজন বন্ধ করে দিয়েছেন। এলাকাবাসীর মনে তা নিয়ে দারুণ অসন্তোষ, সে অসন্তোষের ভাব-বাচ্য এই মোকামের খাদেম নিধন মিয়ার চোখেমুখে প্রকাশ পেলেও তিনি হয়তো কোনো ভীতির কারণে মুখ খুলতে অপারগ। দুটি মোকাম দেখে কেন যেন মনে হলো, একই গ্রামের একটি মোকাম যেখানে মহররমের মাতমে সহস্র ভক্তের আহাজারিতে সমাচ্ছন্ন, সেখানে অন্য মোকামটি শোক প্রকাশে অপারগ হয়ে জনতার আবেগের সঙ্গে একাত্ম হতে না পেরে নিঃশব্দে গুমরে গুমরে কাঁদছে।
এরপর আমরা চানপুর গ্রামের পথে হাঁটি। এবার আমার সঙ্গী হয়ে ওঠেন খাদেম মহরম আলীর কনিষ্ঠ সহোদর মশাররফ। তাঁর সঙ্গে খালি পায়ে চানপুরের পথে যেতে যেতে প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। সে বর্ণনার এখানে সম্ভব নয়। মহররমের শোক-স্মৃতির স্মারক ঘোড়া তৈরির প্রস্তুতি দেখা, এক-একটি মর্সিয়া দলকে মর্সিয়া গাইতে গাইতে সুলতানসী হাবিলীর দিকে এগিয়ে যেতে দেখা এবং পবিত্র নারীদের জারি-মর্সিয়া দেখার অভিজ্ঞতাও ঘটে এই গ্রামে। সে আরেক প্রসঙ্গ। কেননা, এখানে এসেই জানতে পারি, নারীরা কখন পবিত্র হন আর কখনই বা তাঁরা জারি-মর্সিয়া গাইবার অধিকার রাখেন।
গভীরভাবে অবলোকন করলে বোঝা যায় যে সুলতানসী হাবিলীর মহররম পালনের কৃত্যাচার সত্যিকার অর্থে নিয়মতান্ত্রিক তথা ছকে বাঁধা একটি আয়োজন। যেমন এলাকার সবাই প্রায় জানেন, মহররমের ৯ তারিখ সকাল থেকে দুপুর অবধি বিভিন্ন গ্রামের জারি-মর্সিয়ার দল এসে সাব বাড়ির (কারবালা) প্রাঙ্গণে জারি-মর্সিয়া পরিবেশন করেন এবং মহররমের ১০ তারিখ তাজিয়া মিছিলসহ সুলতানসী হাবিলীর প্রধান মোকামে সালাম দিয়ে মহররমের ১০ দিনের শোক প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতার ইতি টানেন। কিন্তু শোকের বিভিন্ন ধরনের কৃত্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুরো মাসজুড়েই চলতে থাকে।
তাই কেউ যেন একাত্ম না হয়ে ওই এলাকার সাধারণ জনতার শোক প্রকাশের ভক্তিভাবের সঙ্গে খুব সহজে সেখানে যেতে না পারেন, এই ভেবে এখানে সুলতানসী গ্রামের জেলার নাম উল্লেখ করা হলো না, তবে অনুসন্ধানী গবেষকের জন্য এই লেখার মধ্যে এমন কিছু সূত্র বা ইঙ্গিত দেওয়া থাকল যার ভিত্তিতে গবেষক পথ খুঁজে নিতে পারবেন—এই আমার বিশ্বাস।
No comments