রদর্শনী- স্বাধীনতার মূল্য by আশীষ-উর-রহমান
ছবিগুলোর কোনো শিরোনাম নেই। তার প্রয়োজনও নেই। কারণ, সেই শিরোনাম তো চিরকালের জন্য অমোচনীয় হয়ে লেখা আছে বাঙালির হূদয়ে—‘১৯৭১’। ভারতের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী রঘু রায় ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন বাঙালির জীবনের চরমতম সংকট ও সংগ্রামে দৃপ্ত সেই উত্তাল দিনগুলোর দৃশ্য।
আজ শুক্রবার থেকে ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হচ্ছে এসব ছবির ১০ দিনব্যাপী প্রদর্শনী। ‘বাংলাদেশ: দ্য প্রাইস অব ফ্রিডম’ নামের এ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়। জাতীয় সংসদের স্পিকার মো. আবদুল হামিদ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। প্রদর্শনীতে ছবি ৫১টি। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোজ দুপুর ১২টা থেকে রাত আটটা অবধি খোলা থাকবে এ প্রদর্শনী।
রঘু রায়ের এ ছবিগুলো নিয়ে আগে ঢাকায় তো বটেই, অন্যত্রও কোনো প্রদর্শনী হয়নি। কারণটা হলো, নেগেটিভ হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এ নিয়ে গভীর খেদ ছিল তাঁর মনে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সে কথাই জানালেন তিনি। ১৯৭১ সালে দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকায় মুখ্য আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তখন স্টেটসম্যান-এ তাঁর তোলা মুক্তিযুদ্ধের যে ছবিগুলো ছাপা হয়েছিল, তা সংবাদচিত্রের গণ্ডি অতিক্রম করে মানবিক মূল্যবোধের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। পরে এ ছবিগুলোর জন্য তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
আশার কথা, হারিয়ে যাওয়া নেগেটিভগুলোর বেশ কিছু তিনি খুঁজে পেয়েছেন, যাতে ছবির মানগুলোও অক্ষুণ্ন রয়েছে। তার মধ্য থেকে নিজেই ৫১টি ছবি বাছাই করেছেন এ প্রদর্শনীর জন্য। বেঙ্গল গ্যালারি ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যৌথভাবে আয়োজন করছে এ প্রদর্শনী। সংবাদ সম্মেলনে আলোকচিত্রী রঘু রায়, আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক অংকন ব্যানার্জি এবং বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরী বক্তব্য দেন। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক সারোয়ার জাহান।
প্রদর্শনীর ছবিগুলোর দুটি অংশ আছে। যদিও দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো আলাদা করে ভাগ করা হয়নি, তবে দর্শক সহজেই দুটি পর্ব আলাদা করতে পারবে। প্রথমেই চোখে পড়বে বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হামলায় বিপর্যস্ত মানবতার দৃশ্য। কী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, কত গভীর বেদনার মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছিল সেদিন আমাদের। রঘু রায়কে বিচলিত করেছিল মানবতার সেই সমূহ বিপর্যয়। তিনি বলেন, ছবির কারিগরি দিকের বিষয়ে তেমন মনোযোগ দেননি। ততটা জ্ঞানও ছিল না তখন। বয়স মাত্র ২৮ বছর। লাখ লাখ উদ্বাস্তু, স্বজনহারা, সম্পদহারা, সম্ভ্রমহারা মানুষের বুকভাঙা বেদনা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মানুষের সেই বেদনাকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ক্যামেরায়। সে দৃশ্যগুলো আজ জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে।
প্রাণভয়ে অগণিত মানুষ দীর্ঘ সারি দিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। ভারতের আশ্রয়শিবিরগুলোতে তাদের জীবনযাপন। আশ্রয় নিয়েছে পাইপের মধ্যে। পথে পড়ে আছে অনাহারী শিশু। প্রথম পর্বে রয়েছে এ ধরনের ছবি। রঘু রায় ঘটনাকে ছাপিয়ে আবেগ-অনুভূতি, অভিব্যক্তিকে প্রধান করে তুলেছিলেন দৃশ্যগুলোতে। লাঞ্ছিত, সর্বহারা মানুষের চোখ, তাদের দৃষ্টি, তাদের মুখাবয়বে লেপ্টে থাকা বিভীষিকার ছাপ বাঙ্ময় হয়ে আছে একের পর এক ছবিতে। ওই মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে, তাদের চোখের নির্বাক দৃষ্টিই যেন শতকণ্ঠের উচ্চকিত স্বরে জানিয়ে দেয় কী নির্মমতার শিকার হয়েছে তারা। মুখে কাপড় চেপে উদ্গত কান্না আড়াল করতে চেয়েছেন এক বৃদ্ধা। কিন্তু চোখ তিনি আড়াল করবেন কেমন করে। তপ্ত অশ্রুতে ভরে আছে দুই নয়ন। ডুকরে কাঁদছে এক অনাথ শিশু। আর নাম না জানা সেই পোড় খাওয়া মানুষটি, জীবনসায়াহ্নে এসে সব হারিয়ে তিনিও কাঁদছেন ওই শিশুটির মতোই। এসব ছবির কি আদৌ কোনো শিরোনামের প্রয়োজন হয়!
বিপর্যস্ত মানবিকতার পাশাপাশি আছে বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের দৃশ্যও। গর্জে উঠেছিলেন দেশের বীর সন্তানেরা বিপর্যয়কে অতিক্রম করে। সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর রণাঙ্গনের বেশ কিছু ছবি রয়েছে প্রদর্শনীতে। রয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষরের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি। আর সবশেষে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। অগণিত মানুষের ঢল। আক্ষরিক অর্থেই বিপুল জনস্রোত ঠেলে এগিয়ে চলেছে তাঁর ছাদখোলা গাড়ি। এ বিজয়ের মাসে ৪১ বছর আগের দিনগুলোকে স্মৃতির অন্তরাল থেকে আবার সামনে এনে দেবে এ প্রদর্শনী।
রঘু রায়ের এ ছবিগুলো নিয়ে আগে ঢাকায় তো বটেই, অন্যত্রও কোনো প্রদর্শনী হয়নি। কারণটা হলো, নেগেটিভ হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এ নিয়ে গভীর খেদ ছিল তাঁর মনে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সে কথাই জানালেন তিনি। ১৯৭১ সালে দিল্লির স্টেটসম্যান পত্রিকায় মুখ্য আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তখন স্টেটসম্যান-এ তাঁর তোলা মুক্তিযুদ্ধের যে ছবিগুলো ছাপা হয়েছিল, তা সংবাদচিত্রের গণ্ডি অতিক্রম করে মানবিক মূল্যবোধের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। পরে এ ছবিগুলোর জন্য তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
আশার কথা, হারিয়ে যাওয়া নেগেটিভগুলোর বেশ কিছু তিনি খুঁজে পেয়েছেন, যাতে ছবির মানগুলোও অক্ষুণ্ন রয়েছে। তার মধ্য থেকে নিজেই ৫১টি ছবি বাছাই করেছেন এ প্রদর্শনীর জন্য। বেঙ্গল গ্যালারি ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যৌথভাবে আয়োজন করছে এ প্রদর্শনী। সংবাদ সম্মেলনে আলোকচিত্রী রঘু রায়, আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক অংকন ব্যানার্জি এবং বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরী বক্তব্য দেন। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক সারোয়ার জাহান।
প্রদর্শনীর ছবিগুলোর দুটি অংশ আছে। যদিও দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো আলাদা করে ভাগ করা হয়নি, তবে দর্শক সহজেই দুটি পর্ব আলাদা করতে পারবে। প্রথমেই চোখে পড়বে বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হামলায় বিপর্যস্ত মানবতার দৃশ্য। কী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, কত গভীর বেদনার মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছিল সেদিন আমাদের। রঘু রায়কে বিচলিত করেছিল মানবতার সেই সমূহ বিপর্যয়। তিনি বলেন, ছবির কারিগরি দিকের বিষয়ে তেমন মনোযোগ দেননি। ততটা জ্ঞানও ছিল না তখন। বয়স মাত্র ২৮ বছর। লাখ লাখ উদ্বাস্তু, স্বজনহারা, সম্পদহারা, সম্ভ্রমহারা মানুষের বুকভাঙা বেদনা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মানুষের সেই বেদনাকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ক্যামেরায়। সে দৃশ্যগুলো আজ জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে।
প্রাণভয়ে অগণিত মানুষ দীর্ঘ সারি দিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। ভারতের আশ্রয়শিবিরগুলোতে তাদের জীবনযাপন। আশ্রয় নিয়েছে পাইপের মধ্যে। পথে পড়ে আছে অনাহারী শিশু। প্রথম পর্বে রয়েছে এ ধরনের ছবি। রঘু রায় ঘটনাকে ছাপিয়ে আবেগ-অনুভূতি, অভিব্যক্তিকে প্রধান করে তুলেছিলেন দৃশ্যগুলোতে। লাঞ্ছিত, সর্বহারা মানুষের চোখ, তাদের দৃষ্টি, তাদের মুখাবয়বে লেপ্টে থাকা বিভীষিকার ছাপ বাঙ্ময় হয়ে আছে একের পর এক ছবিতে। ওই মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে, তাদের চোখের নির্বাক দৃষ্টিই যেন শতকণ্ঠের উচ্চকিত স্বরে জানিয়ে দেয় কী নির্মমতার শিকার হয়েছে তারা। মুখে কাপড় চেপে উদ্গত কান্না আড়াল করতে চেয়েছেন এক বৃদ্ধা। কিন্তু চোখ তিনি আড়াল করবেন কেমন করে। তপ্ত অশ্রুতে ভরে আছে দুই নয়ন। ডুকরে কাঁদছে এক অনাথ শিশু। আর নাম না জানা সেই পোড় খাওয়া মানুষটি, জীবনসায়াহ্নে এসে সব হারিয়ে তিনিও কাঁদছেন ওই শিশুটির মতোই। এসব ছবির কি আদৌ কোনো শিরোনামের প্রয়োজন হয়!
বিপর্যস্ত মানবিকতার পাশাপাশি আছে বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের দৃশ্যও। গর্জে উঠেছিলেন দেশের বীর সন্তানেরা বিপর্যয়কে অতিক্রম করে। সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর রণাঙ্গনের বেশ কিছু ছবি রয়েছে প্রদর্শনীতে। রয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষরের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি। আর সবশেষে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। অগণিত মানুষের ঢল। আক্ষরিক অর্থেই বিপুল জনস্রোত ঠেলে এগিয়ে চলেছে তাঁর ছাদখোলা গাড়ি। এ বিজয়ের মাসে ৪১ বছর আগের দিনগুলোকে স্মৃতির অন্তরাল থেকে আবার সামনে এনে দেবে এ প্রদর্শনী।
No comments