মুক্তি ও স্বাধীনতা-সব কণ্ঠই আমলে নিতে হবে by আমেনা মহসিন
সোনার বাংলার জন্য চার দশক আগে আমরা লড়েছি তা এখনও অর্জিত হয়নি। এখনও আমরা মুক্তির সন্ধান করছি। পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে থেকে প্রশ্ন করেছি : স্বাধীনতা ও মুক্তি, তুমি কোথায়? এখন একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য আমাদের একই জিজ্ঞাসা।
এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে কেবল রাষ্ট্রই এবং এজন্য ছোট ও বড় যেখানে যে কণ্ঠস্বর রয়েছে তা আমলে নিতেই হবে
১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বরে ঢাকা বিমানবন্দরের স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই বিমানের জানালা দিয়ে দেশের মাটির দিকে তাকিয়ে আমি স্বগতোক্তি করেছি; 'অবশেষে স্বদেশের মাটিতে এলাম, অবশেষে আমার মুক্ত!' আমরা সবাই ছিলাম অশ্রুসিক্ত।
দু'বছর হয়েছে বাংলাদেশের শত্রুমুক্তির। কিন্তু আমাকে এ সময়টি পরিবারের সদস্যসহ কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানের দুটি বন্দিশিবিরে। এর একটি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোহাটে, অন্যটি পাঞ্জাবের মান্ডিবাহাউদ্দিনে। আমার মতো সেদিন বিমানের যেসব যাত্রী ছিলেন তাদেরও একই অনুভূতি হয়েছিল, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমার কৈশোর জীবন তখন। হাসি-আনন্দে মুক্তজীবনে কাটানোর সময় তখন। কিন্তু বন্দিশিবির ছিল বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারে ঘেরা। দেশে ফিরে আমার প্রথমেই মনে হলো, এখন আর কেউ পথ আটকাবে না সঙ্গিন উঁচিয়ে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তার জন্য পদে পদে জবাবদিহিতা করতে হবে না। আমি নিজে যা ভাবি সেটা বলতে পারব। কেউ কিছু বললে সেটা শুনতে পারব নির্ভয়ে। আমার কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার বিষয়টি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করে। এর কিছুদিন পরেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দিশিবিরে। তখন থেকে আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। আমার মতো আরও অনেক ছাত্রছাত্রীর জন্যও একই সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমার জন্য তখন এক কঠিন সময়। সেই বয়সেই 'আমরা' এবং 'ওরা' শব্দের অর্থ আমাদের যুঝতে হয়। বাবা-মা বলে দেন, ছোটরা যেন সর্বদা মুখ বন্ধ রাখি। তাদের চোখে-মুখে যে আতঙ্ক সেটাও লক্ষ্য করি। আমাদের স্বাভাবিক জীবন বলতে কিছু ছিল না। সর্বক্ষণ যে নজরদারিতে রয়েছি, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হতো না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে যেসব বাঙালি সামরিক অফিসার ছিল তাদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়া কিংবা বাংলাদেশে ফিরে আসা_ যে কোনো পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আমার বাবাসহ বেশিরভাগ বাঙালি অফিসার বাংলাদেশের পক্ষে বলেন। এরপর এক বিকেলে আমাদের শিয়ালকোট থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কোহাট শিবিরে। তারপর মান্ডিবাহাউদ্দিনে। সেখানের জীবন উৎকণ্ঠায় ভরা। বয়স্করা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি আলোচনা করতেন। আমরা ছোটরা দিন গুনতাম মুক্তির। আমি মাঝে মধ্যে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মনে হতো, ওখানে কোনো শিকল নেই, বাধা নেই। আমাদের দেখতে হয়েছে, মায়েরা তাদের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে দিচ্ছেন। কারণ, পাকিস্তান সরকার যে ভাতা দিত তা দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকাও কঠিন ছিল। আমাদের জন্য ভরসা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ বেতারের ওভারসিজ অনুষ্ঠান। এতে আমরা পেতাম 'দেশের' খবর, যেখানে ফেরার জন্য আমাদের ছিল ব্যাকুলতা। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বজনদের পাঠানো চিঠি মাঝে মধ্যে হাতে পেঁৗছত। এভাবেই আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতাম। দেশটি মনে হতো একান্তই আমার, অথচ এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার তেমন সুযোগ আমার ঘটেনি।
ক্যাম্পে আমরা নিজেদের বাংলাদেশ জগৎ গড়ে তুলতে কত কিছুই না করতাম। বাংলা বছরের সূচনা দিন পহেলা বৈশাখ এবং রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তীতে আয়োজন করা হতো অনুষ্ঠানের। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরায় সচেতন প্রয়াস চালাতেন।
প্রকৃতপক্ষে 'পাকিস্তানে যুদ্ধবন্দি' অবস্থাতেই আমার কেটেছে কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমি তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি এমন একটি স্থানে ফিরে আসার যেখানে ভয়ভীতি থাকবে না, কাঁটাতারের বেড়া এবং 'আমরা' ও 'ওরা' থাকবে না।
ফিরে এলাম আমার স্বপ্নের সোনার বাংলায়। কিন্তু হোঁচট খেতে হলো 'বাঙালি' ও 'আটকেপড়া অবস্থা থেকে ফিরে আসা বাঙালি' শুনে। এটা ছিল রাজনীতির অঙ্গনের ভাষা, কিন্তু এক ধরনের বিভেদ তাতে প্রকাশ পেত। বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক। আমরা শুনতে পাই যে অনেক সামরিক অফিসার তাদের সঙ্গে 'পাকিস্তানি মানসিকতাও' নিয়ে এসেছেন, যার পরিণতি ১৯৭৫ সালের গণতান্ত্রিক ধারার মৃত্যু।
আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি পড়াশোনায়। রাজনীতি ছিল পাঠ্য বিষয়। সেখানেও দেখতে পাই অনেক বিবাদ-বিভেদ এবং 'আমরা' ও 'ওরা'। শৈশবে ভাবতাম তারকাঁটাহীন চারপাশের কথা। এখন দেখছি ধর্মীয়, নৃতাত্তি্বক, জেন্ডার ও শ্রেণীগত বিভাজন। রাষ্ট্রের সামরিকায়ন হয়েছে, উগ্রতাও বেড়েছে। বাংলাদেশে ৪৫টিরও বেশি নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর বসবাস। বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে তাদের স্থান কোথায়? তাদের রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। সেসব কি হারিয়ে যেতে দেব? আমাদের ভাষার লড়াই ছিল আধিপত্যের বিরুদ্ধে। আমরা সেই ছয় দশকেরও বেশি আগে সচেতনভাবে চেয়েছি সব ভাষার সমান অধিকার। এ আন্দোলন চরিত্রের দিক থেকে ছিল সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক। এখন আমাদের নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে এ চরিত্র কি ধরে রাখতে পারছি? আমাদের দেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার জন্য। পাকিস্তানিরা জনগণের রায় মানতে চায়নি, বরং চাপিয়ে দিয়েছিল গণহত্যা। আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে স্থান পেয়েছে গণতন্ত্র। এমন একটি দেশে নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি বঞ্চিত থাকতে পারে না। এখন তারা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করছে। সংবিধান এখন রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম নিয়েও এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে। বাহাত্তরের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা সামরিক শাসনামলে বাদ দেওয়া হয়েছিল। অথচ পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন হয়েছিল তার প্রেরণা ছিল সেক্যুলার ধারণা। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় বাঙালিদের মুসলিম বাঙালি ও হিন্দু বাঙালিতে ভাগ করে ফেলা হলো। আর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকরাও পরিণত হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে। সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রান্ত অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের মতো এখানেও আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে ধরছে কিছু লোক। তাদের ব্যানার হচ্ছে খতমে নবুওয়ত আন্দোলন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে তারা ক্রমাগত হিংসা ছড়িয়ে চলেছে।
বিভাজন বন্ধ দুয়ার কেবল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের দুয়ার পর্যন্তই থেমে থাকেনি। নারীদের জন্যও তা মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। চারপাশের বৈরী পরিবেশ অনেক নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে। সমাজে এমন অনেক নৈতিক বিধিনিষেধ গড়ে তোলা হচ্ছে যার মূল লক্ষ্য কেবল নারীকেই বেড়াজালে বেঁধে ফেলা। ধর্মের নামে ফতোয়ার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কিন্তু অনেক নারী এর নির্মম শিকার হচ্ছে। সংবাদপত্রে কিছু খবর প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি খবর থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
এমন পরিস্থিতিতেই মুক্তির সন্ধান চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এক সময়ে অশান্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রতিবাদ ছিল চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি-বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাও প্রতিবাদমুখর। মুক্তির জন্য নারী সমাজের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তাও আমরা লক্ষ্য করছি। তারা কখনও কখনও মুখোমুখি হয় ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠীর।
রাজধানী ঢাকা ও শহরতলিতে পোশাক শিল্পের কর্মীরা বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে মাঝে মধ্যেই আন্দোলনে নামে। তাদের বেশিরভাগ নারী। শিল্প পুলিশ গঠন করে তাদের প্রতিবাদ থামিয়ে রাখা যাবে না। এ ধরনের দমননীতি শুভ পরিণতি ডেকে আনতে পারে না। বরং সমাজে বাড়াতে পারে অস্থিরতা। কেন এ সমস্যা তার কারণ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের গভীরে ব্যাধি অনেক। ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে তা প্রভাব ফেলছে। দেশকে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্তৃত্বপরায়ণ। এ কারণেই বলতে হয় যে সোনার বাংলার জন্য চার দশক আগে আমরা লড়েছি তা এখনও অর্জিত হয়নি। এখনও আমরা মুক্তির সন্ধান করছি। পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে থেকে প্রশ্ন করেছি : স্বাধীনতা ও মুক্তি, তুমি কোথায়? এখন একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য আমাদের একই জিজ্ঞাসা। এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে কেবল রাষ্ট্রই এবং এজন্য ছোট ও বড় যেখানে যে কণ্ঠস্বর রয়েছে তা আমলে নিতেই হবে।
আমেনা মহসিন : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বরে ঢাকা বিমানবন্দরের স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই বিমানের জানালা দিয়ে দেশের মাটির দিকে তাকিয়ে আমি স্বগতোক্তি করেছি; 'অবশেষে স্বদেশের মাটিতে এলাম, অবশেষে আমার মুক্ত!' আমরা সবাই ছিলাম অশ্রুসিক্ত।
দু'বছর হয়েছে বাংলাদেশের শত্রুমুক্তির। কিন্তু আমাকে এ সময়টি পরিবারের সদস্যসহ কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানের দুটি বন্দিশিবিরে। এর একটি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোহাটে, অন্যটি পাঞ্জাবের মান্ডিবাহাউদ্দিনে। আমার মতো সেদিন বিমানের যেসব যাত্রী ছিলেন তাদেরও একই অনুভূতি হয়েছিল, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমার কৈশোর জীবন তখন। হাসি-আনন্দে মুক্তজীবনে কাটানোর সময় তখন। কিন্তু বন্দিশিবির ছিল বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারে ঘেরা। দেশে ফিরে আমার প্রথমেই মনে হলো, এখন আর কেউ পথ আটকাবে না সঙ্গিন উঁচিয়ে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তার জন্য পদে পদে জবাবদিহিতা করতে হবে না। আমি নিজে যা ভাবি সেটা বলতে পারব। কেউ কিছু বললে সেটা শুনতে পারব নির্ভয়ে। আমার কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার বিষয়টি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করে। এর কিছুদিন পরেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দিশিবিরে। তখন থেকে আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। আমার মতো আরও অনেক ছাত্রছাত্রীর জন্যও একই সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমার জন্য তখন এক কঠিন সময়। সেই বয়সেই 'আমরা' এবং 'ওরা' শব্দের অর্থ আমাদের যুঝতে হয়। বাবা-মা বলে দেন, ছোটরা যেন সর্বদা মুখ বন্ধ রাখি। তাদের চোখে-মুখে যে আতঙ্ক সেটাও লক্ষ্য করি। আমাদের স্বাভাবিক জীবন বলতে কিছু ছিল না। সর্বক্ষণ যে নজরদারিতে রয়েছি, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হতো না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে যেসব বাঙালি সামরিক অফিসার ছিল তাদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়া কিংবা বাংলাদেশে ফিরে আসা_ যে কোনো পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আমার বাবাসহ বেশিরভাগ বাঙালি অফিসার বাংলাদেশের পক্ষে বলেন। এরপর এক বিকেলে আমাদের শিয়ালকোট থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কোহাট শিবিরে। তারপর মান্ডিবাহাউদ্দিনে। সেখানের জীবন উৎকণ্ঠায় ভরা। বয়স্করা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি আলোচনা করতেন। আমরা ছোটরা দিন গুনতাম মুক্তির। আমি মাঝে মধ্যে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মনে হতো, ওখানে কোনো শিকল নেই, বাধা নেই। আমাদের দেখতে হয়েছে, মায়েরা তাদের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে দিচ্ছেন। কারণ, পাকিস্তান সরকার যে ভাতা দিত তা দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকাও কঠিন ছিল। আমাদের জন্য ভরসা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ বেতারের ওভারসিজ অনুষ্ঠান। এতে আমরা পেতাম 'দেশের' খবর, যেখানে ফেরার জন্য আমাদের ছিল ব্যাকুলতা। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বজনদের পাঠানো চিঠি মাঝে মধ্যে হাতে পেঁৗছত। এভাবেই আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতাম। দেশটি মনে হতো একান্তই আমার, অথচ এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার তেমন সুযোগ আমার ঘটেনি।
ক্যাম্পে আমরা নিজেদের বাংলাদেশ জগৎ গড়ে তুলতে কত কিছুই না করতাম। বাংলা বছরের সূচনা দিন পহেলা বৈশাখ এবং রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তীতে আয়োজন করা হতো অনুষ্ঠানের। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরায় সচেতন প্রয়াস চালাতেন।
প্রকৃতপক্ষে 'পাকিস্তানে যুদ্ধবন্দি' অবস্থাতেই আমার কেটেছে কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমি তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি এমন একটি স্থানে ফিরে আসার যেখানে ভয়ভীতি থাকবে না, কাঁটাতারের বেড়া এবং 'আমরা' ও 'ওরা' থাকবে না।
ফিরে এলাম আমার স্বপ্নের সোনার বাংলায়। কিন্তু হোঁচট খেতে হলো 'বাঙালি' ও 'আটকেপড়া অবস্থা থেকে ফিরে আসা বাঙালি' শুনে। এটা ছিল রাজনীতির অঙ্গনের ভাষা, কিন্তু এক ধরনের বিভেদ তাতে প্রকাশ পেত। বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক। আমরা শুনতে পাই যে অনেক সামরিক অফিসার তাদের সঙ্গে 'পাকিস্তানি মানসিকতাও' নিয়ে এসেছেন, যার পরিণতি ১৯৭৫ সালের গণতান্ত্রিক ধারার মৃত্যু।
আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি পড়াশোনায়। রাজনীতি ছিল পাঠ্য বিষয়। সেখানেও দেখতে পাই অনেক বিবাদ-বিভেদ এবং 'আমরা' ও 'ওরা'। শৈশবে ভাবতাম তারকাঁটাহীন চারপাশের কথা। এখন দেখছি ধর্মীয়, নৃতাত্তি্বক, জেন্ডার ও শ্রেণীগত বিভাজন। রাষ্ট্রের সামরিকায়ন হয়েছে, উগ্রতাও বেড়েছে। বাংলাদেশে ৪৫টিরও বেশি নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর বসবাস। বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে তাদের স্থান কোথায়? তাদের রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। সেসব কি হারিয়ে যেতে দেব? আমাদের ভাষার লড়াই ছিল আধিপত্যের বিরুদ্ধে। আমরা সেই ছয় দশকেরও বেশি আগে সচেতনভাবে চেয়েছি সব ভাষার সমান অধিকার। এ আন্দোলন চরিত্রের দিক থেকে ছিল সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক। এখন আমাদের নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে এ চরিত্র কি ধরে রাখতে পারছি? আমাদের দেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার জন্য। পাকিস্তানিরা জনগণের রায় মানতে চায়নি, বরং চাপিয়ে দিয়েছিল গণহত্যা। আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে স্থান পেয়েছে গণতন্ত্র। এমন একটি দেশে নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি বঞ্চিত থাকতে পারে না। এখন তারা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করছে। সংবিধান এখন রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম নিয়েও এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে। বাহাত্তরের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা সামরিক শাসনামলে বাদ দেওয়া হয়েছিল। অথচ পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন হয়েছিল তার প্রেরণা ছিল সেক্যুলার ধারণা। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় বাঙালিদের মুসলিম বাঙালি ও হিন্দু বাঙালিতে ভাগ করে ফেলা হলো। আর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকরাও পরিণত হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে। সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রান্ত অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের মতো এখানেও আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে ধরছে কিছু লোক। তাদের ব্যানার হচ্ছে খতমে নবুওয়ত আন্দোলন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে তারা ক্রমাগত হিংসা ছড়িয়ে চলেছে।
বিভাজন বন্ধ দুয়ার কেবল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের দুয়ার পর্যন্তই থেমে থাকেনি। নারীদের জন্যও তা মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। চারপাশের বৈরী পরিবেশ অনেক নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে। সমাজে এমন অনেক নৈতিক বিধিনিষেধ গড়ে তোলা হচ্ছে যার মূল লক্ষ্য কেবল নারীকেই বেড়াজালে বেঁধে ফেলা। ধর্মের নামে ফতোয়ার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। কিন্তু অনেক নারী এর নির্মম শিকার হচ্ছে। সংবাদপত্রে কিছু খবর প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি খবর থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
এমন পরিস্থিতিতেই মুক্তির সন্ধান চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এক সময়ে অশান্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রতিবাদ ছিল চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি-বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাও প্রতিবাদমুখর। মুক্তির জন্য নারী সমাজের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তাও আমরা লক্ষ্য করছি। তারা কখনও কখনও মুখোমুখি হয় ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠীর।
রাজধানী ঢাকা ও শহরতলিতে পোশাক শিল্পের কর্মীরা বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে মাঝে মধ্যেই আন্দোলনে নামে। তাদের বেশিরভাগ নারী। শিল্প পুলিশ গঠন করে তাদের প্রতিবাদ থামিয়ে রাখা যাবে না। এ ধরনের দমননীতি শুভ পরিণতি ডেকে আনতে পারে না। বরং সমাজে বাড়াতে পারে অস্থিরতা। কেন এ সমস্যা তার কারণ খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের গভীরে ব্যাধি অনেক। ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে তা প্রভাব ফেলছে। দেশকে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্তৃত্বপরায়ণ। এ কারণেই বলতে হয় যে সোনার বাংলার জন্য চার দশক আগে আমরা লড়েছি তা এখনও অর্জিত হয়নি। এখনও আমরা মুক্তির সন্ধান করছি। পাকিস্তানের বন্দিশিবিরে থেকে প্রশ্ন করেছি : স্বাধীনতা ও মুক্তি, তুমি কোথায়? এখন একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য আমাদের একই জিজ্ঞাসা। এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে কেবল রাষ্ট্রই এবং এজন্য ছোট ও বড় যেখানে যে কণ্ঠস্বর রয়েছে তা আমলে নিতেই হবে।
আমেনা মহসিন : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments