সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি by ফখরুল ইসলাম
সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের অনুরোধ জানিয়ে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। ব্যাংকটির একাধিক শাখায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনিয়মের বিবরণ দিয়ে গতকাল সোমবার একটি প্রতিবেদন-সংবলিত চিঠি দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সোনালী ব্যাংকে সংঘটিত অনিয়মগুলোর প্রকৃতি অত্যন্ত গুরুতর। ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার অনেক স্তর থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি কারও নজরে আসেনি, তা কোনোক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে বা সম্মতিতে জালিয়াতির মাধ্যমে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর এ ঘটনা সমগ্র ব্যাংক খাতের ওপরই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। শিথিল তদারকির ব্যবস্থা, দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ত্রুটিপূর্ণ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার কারণে এ ধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হতে পেরেছে বলে আতিউর রহমান চিঠিতে বলেন।
প্রতিবেদনে অর্থ আত্মসাৎ ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা (বর্তমানে রূপসী বাংলা) থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করেছে দুই হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
হলমার্ক গ্রুপের অনিয়মের প্রকৃতিগুলোও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হচ্ছে: ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে হলমার্ক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে স্থানীয় ঋণপত্র (এলসি) খোলা, অভ্যন্তরীণ বিল কেনা, ভুয়া রপ্তানি বিল কেনা, পিসি-সুবিধা দেওয়া, স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এলসি খুলে অ্যাকোমোডেশন বিল সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, শুধু ভাউচারের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের অনুকূলে অর্থ দেওয়া এবং স্বীকৃত বিল মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তার অর্থ পরিশোধ না করে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করা।
রূপসী বাংলা শাখার পাশাপাশি গুলশান এবং আগারগাঁও শাখায়ও একই ধরনের জালিয়াতি ও ক্ষমতাবহির্ভূত চর্চার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন ও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন, সোনালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের প্রতিবেদন এবং একটি বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই আত্মসাতের ঘটনা উঠে এসেছে বলে অর্থমন্ত্রীকে জানান গভর্নর।
চিঠিতে গভর্নর বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের সংঘবিধি অনুযায়ী, যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের। তাই সংঘটিত সব অনিয়মের সামগ্রিক দায়দায়িত্ব ব্যাংকের পর্ষদের ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি। দেশের বৃহত্তম এই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।’
প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়, ২০১০ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসে যে শেরাটন শাখা থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণসুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়ন বিভাগের প্রতিবেদনেও তখন গুরুতর অনিয়ম চিহ্নিত হয়। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একই বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়, ঋণ আদায় করে তা সীমার মধ্যে আনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সীমাতিরিক্ত ঋণ না দেওয়ার বিষয়ে সোনালী ব্যাংক সতর্ক থাকবে। কিন্তু সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও শেরাটন শাখাসহ কয়েকটি শাখা বিপুল অঙ্কের জালিয়াতি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতা-সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করা আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। সে অনুযায়ী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করবে ব্যাংকের পর্ষদ এবং তা যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি না, তা-ও তদারক করবে। পর্ষদ এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা, বহিঃনিরীক্ষা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের সুপারিশ পর্যালোচনা করবে। ঋণ ও বিনিয়োগের সন্তোষজনক গুণগত মান অর্জনের জন্য অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ওপর পরিচালনা পর্ষদ সতর্ক নজর রাখবে।
প্রতিবেদনমতে, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ এসব দায়িত্ব পালন না করায় এই হলমার্ক গ্রুপের নামে ২০১০ সালের সীমাতিরিক্ত ঋণ ২০১২ সালে বহুগুণ বেড়ে দুই হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। প্রতিবেদনে গভর্নর বলেন, ‘বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, অনিয়মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনে উল্টো তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর পদোন্নতিও দেওয়া হয়। প্রতিটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির মাধ্যমে পর্ষদে উপস্থাপিত হওয়ার বিধান রয়েছে।’
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিন বছরের জন্য সোনালী ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ গঠন করা হয়, যার মেয়াদ দুই সপ্তাহ পরে শেষ হচ্ছে। পর্ষদের চেয়ারম্যান সোনালী ব্যাংকেরই সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের উপদেষ্টা কাজী বাহারুল ইসলাম। পরিচালকেরা হলেন: আওয়ামী লীগের নেতা সুভাষ সিংহ রায়, কক্সবাজারের ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের নেতা সাইমুম সরওয়ার, দৈনিক সংবাদ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাশেম হুমায়ুন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সত্যেন্দ্র চন্দ্র ভক্ত, সবুজ কানন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা, এ এস এম নাইম এফসিএ, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সহসভাপতি কে এম জামান রোমেল, আনোয়ার শহীদ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শহীদুল্লাহ মিয়া।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটি দেওয়ার পর গতকাল দুপুরে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে সচিবালয়ে যান সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী। বৈঠকের কথা স্বীকার করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী তাঁকে আসতে বলেছিলেন। কাজী বাহারুল ইসলাম বলেন, পর্ষদ কিছুই জানত না। পর্ষদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে বরং সোনালী ব্যাংকে আগের চেয়ে খেলাপি ঋণ কমেছে। প্রতিবেদন তৈরি করে সোনালী ব্যাংকে আতঙ্ক ছড়ানো ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তো ব্যাংক খাতে বিরূপ প্রভাবের জন্য সোনালী ব্যাংককে দায়ী করেছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই তো চলে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কথায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো এ রকম বলবেই।’
গত জুনে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন প্রদীপ কুমার দত্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই উল্লেখ করে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘হলমার্কের ব্যাপারে পরিচালনা পর্ষদের খুব বেশি দোষ নেই, দোষ আসলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। পর্ষদকে যদি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো অবহিত করত, তাহলে অনেক কিছুই রোধ করা যেত।’
প্রদীপ কুমার দত্ত এ-ও মনে করেন, শুধু সোনালী নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। তাঁর মতে, ধরলে সবাইকেই ধরা উচিত।
সূত্র জানায়, সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীকে বলা হয়েছে যে এ ধরনের চিঠি লেখার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। তবে সাবেক একাধিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬(৬) ধারা অনুযায়ী এ ধরনের প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিতে পারে। ওই ধারায় বলা আছে, ‘চেয়ারম্যান, পরিচালক, প্রধান নির্বাহীর আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নিকট কোনো প্রতিবেদন পেশ করিলে সরকার উহা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করিবে।’ সাবেক ব্যাংকাররা আরও জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৪৫ ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক জনস্বার্থে বা আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কার্যকলাপ প্রতিরোধে যেকোনো নির্দেশ দিতে পারবে।
উল্লেখ্য, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবীরসহ ৩১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে গত রোববার সোনালী ব্যাংকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
No comments