ধর্মভিত্তিক ও ধর্মহীন রাজনীতি by ফাহমিদ উর রহমান
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে দুনিয়াজুড়ে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে আছে মতানৈক্য। ধর্মভিত্তিক ও ধর্মহীন রাজনীতির স্বরূপ এবং সঙ্কট নিয়েও আছে মতান্তর। যে ইউরোপের সূত্রে আমরা সেকুলারিজমের ধারণা পেয়েছি তার ব্যাখ্যাতেও আছে স্থানকালপাত্রভেদে বহুমাত্রিকতা। একদল মনে করেন সেকুলারাইজেশনের ফলে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ধর্মহীন হয়ে উঠবে।
এর মানে হচ্ছে রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে ধর্মনির্বিশেষে সব নাগরিকের কল্যাণ। এই দলের মতানুসারে কোনো রকমের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনীতিকে হতে হবে পুরোপুরি ধর্মহীন। এ ধরনের রাজনীতি চর্চা এক সময় কমিউনিস্ট দেশগুলোতে দেখা গিয়েছিল। এসব দেশ তখন রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে নাস্তিকতাকে গ্রহণ করেছিল। রাষ্ট্রের ব্যাপারে ধর্মকে আদৌ বরদাশত করা হতো না।
রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণের কঠোর সমালোচক হচ্ছে কমিউনিস্টরা। কিন্তু প্রয়োজনে নানা রকম সুবিধা আদায়ের জন্য এরাও যে ধর্মের ব্যবহার থেকে পিছিয়ে থাকেন না তার নজিরও কিন্তু একেবারে কম নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করলে রুশ গির্জায় শুরু হয় রাশিয়াকে রক্ষার জন্য সমবেত প্রার্থনা। স্টালিন নাস্তিক হলেও এই প্রার্থনা অনুষ্ঠানকে প্রদান করেন বিশেষ অনুমোদন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন রুশ অর্থভক্স গির্জার শক্তিকে হিটলারবিরোধী লড়াইয়ে কাজে লাগাতে।
দক্ষিণ আমেরিকার খ্রিস্টান মিশনারি লিবারেশন থিওলজিস্টদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক মিত্রতার কথা অনেকেরই জানা আছে।
গত শতকের চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে ধর্মকে ভিত্তি করে যে পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে ওঠে তাকেও কিন্তু সমর্থন জানায় কমিউনিস্ট পার্টি। তখন তারা পাকিস্তান আন্দোলনকে শ্রেণী সংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করে। মূলত, তাদের লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলনকে ভর করে মুসলিম সমাজে কমিউনিজমের বিস্তার ঘটানো।
এখন শোনা যাচ্ছে ভারতের কমিউনিস্টরা তাদের মার্ক্সীয় ধর্মবিরোধিতা খারিজ করে ধর্মাচরণে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চাচ্ছেন। এ প্রক্রিয়া কিন্তু অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সেখানকার কমিউনিস্টরা মন্দিরে গিয়ে মূর্তিকে প্রণাম করেন, পূজামণ্ডপে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সবকিছুর মধ্যে রাজনৈতিক কলাকৌশল থাকলেও এটা যে মার্কসবাদ সম্মত নয় তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
সেকুলারিজমের আর একদল ব্যাখ্যাতা আছেন তারা মনে করেন এটা ঠিক ধর্মহীনতা নয়। এটা ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতায় অবিশ্বাসও নয়। এ ধরনের সেকুলার রাষ্ট্রে প্রত্যেকের নিজের পছন্দমত মত ও পথ পালন এবং প্রচার করার পূর্ণ অধিকার থাকবে ও প্রতিটি ধর্মের মঙ্গল এবং বাধাহীন বিকাশের সুযোগও থাকবে।
ভারতকে বলা হয়ে থাকে একটা সেকুলার রাষ্ট্র। ভারতের সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন : সেকুলার রাষ্ট্র মানে এমন কোনো রাষ্ট্র নয়, যেখানে মানুষে ধর্ম পরিত্যাগ করে। সেকুলার রাষ্ট্র মানে এমন এক রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্র সব ধর্মকে রক্ষা করে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট এক ধর্মের মূল্য অন্য কোনো ধর্মের পক্ষাবলম্বন করে না—বা কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে না।
ভারতের সংবিধানের সেকুলারিজম সংক্রান্ত ধারণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি হলো—যে কোনো ব্যক্তি অবাধে তার ধর্ম পালন, প্রচার ও প্রসার করার স্বাধীনতা পাবেন।
ভারতের সংবিধানে দেয়া সব ধর্মকে সমমর্যাদা দানের নীতি কিংবা নেহরুর সেকুলারিজমবিষয়ক ধ্যান-ধারণা কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করার কথা বলে না। এই কারণেই ভারতে হিন্দু মহাসভা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ, শিবসেনা, বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দল দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে চলেছে। এ ধরনের সেকুলার রাষ্ট্রে তাই ধর্মীয় রাজনীতিতে কোনো বাধা নেই। এই দুই ধরনের সেকুলারিজম এখন বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশে চোখে পড়ে। প্রথম জাতের সেকুলারিজম ধর্ম বস্তুটাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে ব্যক্তির ও সমাজের জীবনধারাকে অর্থ, কাম, উচ্চাশার পথে ধাবিত করতে চায়। এ যে ভোগবাদের নামান্তর তাতে সন্দেহ থাকে না। যে ব্যক্তি, যে সমাজ, যে রাষ্ট্র এ ধরনের সেকুলারিজমকে জীবনের সার কথা বলে গ্রহণ করতে চায় সে অনায়াসেই সমার্থক হয়ে উঠতে পারে দুর্নীতির, প্রতারণাজাত কার্যসিদ্ধির এবং সমবেত চরিত্র হননের।
ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নীটশে দরজা খুলে দিয়েছিলেন নাজী ফ্যাসিজমের। আর মার্কস খুলে রেখেছিলেন এমন এক কমিউনিজমের জন্য যা আসলে মার্কসবাদকে ছাপিয়ে গেছে। রুশ কমিউনিজম যে ধীরে ধীরে গোঁড়ামিতে ও ক্রুরতার ফ্যাসিজমের সমতুল্য হয়ে উঠেছিল, তা তো ইতিহাস।
এক সময় এই কমিউনিজম সংক্রমিত হয়েছিল আমাদের দেশেও। এর মধ্যে Fanaticism-এর বীজ ছিল। ‘কম্যুন’ কখনও মানবিক ‘কম্যুন’ হয়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ মানবিকতার ধর্ম না মেনে গোষ্ঠীর আদেশ মানতে হয়েছে তাদের। স্ট্যালিন যুগের কমিউনিস্টদের বাদ দিলেও কমিউনিজমের বাস্তব রূপটি অনেক মার্কসবাদী আত্মোত্সর্গী ব্যক্তিকে কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এদের মধ্যে এমএন রায় ও জর্জ অরওয়েল অন্যতম। এরা কমিউনিস্ট সমাজবাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। বিশেষ করে অরওয়েল তার Animal Firm এবং 1984 উপন্যাসে কমিউনিজমের চেহারা তুলে ধরেছেন অনন্যতার সঙ্গে। কমিউনিজম ধর্মের একটা বিকল্প প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু অচিরেই তার মহত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে Fanaticism-এ পরিণত হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
আর দ্বিতীয় জাতের সেকুলারিজম সতর্কতা অবলম্বন করে এগুতে চায়। তারা ধর্মকেও অস্বীকার করে না কিংবা সেকুলারিজমকেও ত্যাগ করে না। এরা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্রের তফােক খুব বড় করে দেখে না। এ ধরনের সেকুলারিজম চর্চাকে সুবিধাবাদ ছাড়া কি বলা যায়? জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারদের সেকুলারিজম তো আমরা দেখলাম। একই সঙ্গে মৌলবাদ-ভোগবাদ-শক্তিবাদের দানবকে তারা প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। পাশ্চাত্য জগতে রিফরমেশন, রেনেসাঁস, আধুনিক নগরের বিস্তার, শিল্প বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার ফলস্বরূপ এক সময় সেকুলারিজম শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেকুলারিজমের উদ্যোগী পুরুষরা সে সময় মানুষের উপর অলৌকিক বা অতি প্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এর ফলে সেখানকার জনমানসে ধর্মীয় ধারণাগুলো অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। রাষ্ট্রত্ত অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রসারের চেষ্টা করে। সমাজবিজ্ঞানীরা একে নেগোটিভলি রিলিজিয়াস বা ধর্মীয় বিষয়সমূহের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রূপে বিবেচনা করেন। তারপরেও বলতে হবে আদর্শ সেকুলার বা ধর্মহীন রাষ্ট্র আদপে পৃথিবীর কোথাও নেই বা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ, ধর্ম মানুষের অতি নিবিড় সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষকে নিয়েই সমাজ কিংবা রাষ্ট্র। মানুষের মন ধর্মনিরপেক্ষ না হলে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না।
অনেকে বলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানতে পারি না। ভুলতে পারি না ধর্ম সমাজের অঙ্গ। ধর্ম আমাদের দেশাত্ববোধের প্রান্ত ছুঁয়ে থাকে। ধর্মের নানা প্রকাশে দেশের মানুষের উদ্বেল হয়ে ওঠা কি মানুষ উড়িয়ে দিতে পারে? বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
বিলাত তথা ইউরোপ থেকে আমাদের দেশে এসেছে সেকুলারিজমের ধারণা। সেদিক দিয়ে বিলাতের ইতিহাসও হয়ে উঠেছে কিছুটা আমাদের ইতিহাস। সেই বিলাতের সমাজও পুরোপুরি ধর্মহীন নয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে চার্চের আছে নিকট সম্পর্ক। অ্যাংলিকান চার্চ হলো সেখানকার রাষ্ট্রধর্ম। ইউরোপে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে। এর বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে খ্রিস্টীয় গণতন্ত্রীরা (Christian Democrats)। এরা রোমান ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করে। কেতাবী সেকুলারিজমের সঙ্গে ফলিত সেকুলারিজমের তফাত্ অনেক। সুতরাং আমাদের দেশে যারা ধর্মহীন সেকুলারিজমের মাহাত্ম্যে বুঁদ হয়ে আছেন তাদের আগে বোঝা উচিত সেকুলারিজম কি বস্তু এবং স্থানকালপাত্র বিচারে তার যথার্থতা কতটুকু। আবার ইউরোপের সেকুলারিজমের বিকাশের ইতিহাস দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া বিভ্রান্তিকর ছাড়া কিছু নয়। এ দেশের সেকুলারিস্টদের একাংশ নানা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কারণে ভারতের প্রতি সংবেদনশীল। তারা মনে করেন ভারত হচ্ছে একটা আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসকে ধর্ম ছাড়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হচ্ছে কংগ্রেস। জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেস নেতারা দাবি করতেন এটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন—ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এই দল। মুখে যাই বলুন দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কংগ্রেস নেতারা আন্তরিকভাবে কেউই সেকুলার ছিলেন না। কংগ্রেসের সবচেয়ে ক্যারিসম্যাটিক নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ভারতীয় রাজনীতিতে তার চেয়ে সফলতার সঙ্গে আর কেউ ধর্মের মিশ্রণ ঘটাতে পারেননি। তিনিই রাজনীতির ময়দানে ‘হিন্দু সিম্বলকে’ আমদানি করেন। তপস্যা, আত্মিক শক্তি, শত্রুর ক্ষতি না করে হৃদয়ের পরিবর্তন, ধর্মবোধ সজ্ঞাত নৈতিকতা, অনশন, বিমূর্ত সত্য, রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়, রামধূন, পঙ্কস্নান (মহাত্মা গান্ধী তার আশ্রমে সর্বাঙ্গে মাটি মেখে রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা করতেন। তার বিশ্বাস ছিল এতে পুণ্য হয় এবং শরীর ভালো থাকে।) মৌনব্রত, গো দেবতা ইত্যাদি বিষয় গান্ধীর রাজনীতিকে ধর্মাশ্রয়ী ও হিন্দুঘেঁষা করে তোলে।
১৯১৫ সালে কলকাতায় ছাত্রদের এক সভায় তিনি ঘোষণা করেন : রাজনীতিকে ধর্মের থেকে পৃথক করা যায় না। পরবর্তীকালে তিনি বলেন, ধর্মের থেকে পৃথকীকৃত রাজনীতি হলো মৃত্যু ফাঁদ—কারণ তা আত্মাকে নিহত করে।
মহাত্মা গান্ধীর পথ ধরে কংগ্রেসের পরবর্তী নেতারাও ভারতের রাজনীতিকে হিন্দুয়ানী আদর্শে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন। এ ব্যাপারে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ এমনকি পণ্ডিত নেহরুও কম যাননি। শোনা যায় নেহরু ছিলেন ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। অথচ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বারবার বলেছেন, উপনিষদ হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ভিত্তি।
এই নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সংবিধানে ১৯৭৬ সালে সেকুলার শব্দটা সংযোজন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিত সেই তিনিও তীর্থস্থান আর হিন্দু ধর্মানুষ্ঠানে যোগদানের ব্যাপারে তার পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যান। ইন্দিরা নন্দন রাজীব গান্ধী বাবরী মসজিদের পাশে রামমন্দিরের শিলান্যাস করেন। এভাবে ভারতের সেকুলার রাজনৈতিক নেতারা প্রয়োজন পড়লেই ধর্ম ও ধর্মান্ধতার বন্দনা করেন। আর বিজেপির কথা বলাইবাহুল্য। এর রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম ভিত্তিই হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষ। বাবরী মসজিদ ধ্বংস। গুজরাট হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ভারতের সেকুলারিজমের আসল চেহারা উদোম করে দিয়েছে। বস্তুত, ভারতের রাজনৈতিক চরিত্রকে কখনোই পুরোপুরি সেকুলার বলা যায় না। কংগ্রেস হোক, বিজেপি হোক উভয়ের রাজনীতিই এক হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দ্বারাই পরিচালিত। যেসব ঐতিহাসিক কারণে এই উপমহাদেশের মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল সেকুলারিজমের আড়ালে কংগ্রেসের এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। এভাবে ধর্ম জড়িয়ে গেছে ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে। কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে দানা বেঁধেছে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলনের। জিন্নাহ সাহেবকে এক সময় বলা হতো Ambassador of Hindu-Muslim Unity. দীর্ঘদিন কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিই প্রধান কারণ। এসব কথা আজ ভারতের মুক্তমতি বুদ্ধিজীবী ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিকরা এতকাল পর স্বীকার করতে শুরু করেছেন। ফলে বাধ্য হয়েই জিন্নাহ সাহেবকে সেদিন ভারতবর্ষের মুসলমানদের আত্মরক্ষার সংগ্রামে নামতে হয়। কেন সেকুলার জিন্নাহকে মুসলিম জাতীয়তাবাদী জিন্নায় পরিণত হতে হলো তার বিশ্লেষণ ছাড়া আজকের বাংলাদেশের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। যারা এ দেশে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক বলে এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন, তারা আসলে ইতিহাসকেই উড়িয়ে দেন। তারা ইতিহাসের পরম্পরাকেই অস্বীকার করেন। আজকে যারা এ দেশে ইসলামনির্ভর রাজনীতিকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে সেকুলার ধর্মহীন রাজনীতির কথা বলছেন তাদের ভারতবর্ষের সমকালীন রাজনীতির ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
ইসলামকে সাম্প্রদায়িক মনে করা তথাকথিত ইউরোপীয় যুক্তিবাদী, সেকুলার চিন্তা-ভাবনার ফল বলেই মনে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপের মজ্জাগত শত শত বছরের ইসলামবিদ্বেষ। রিফরমেশন, রেনেসাঁর দরজা পার হয়ে আসার পরও পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এতটুকু পাল্টায়নি। কমিউনিজমের পতনের পর আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বের রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে ইসলামকে কেন্দ্র করে। তাদের পেয়ে বসেছে এক ইসলামভীতি। ইসলামকে অনবরত বর্বর, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ধর্ম হিসেবে প্রচার করা আজ পশ্চিমা বিশ্বের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে। কারণ, কাউকে সন্ত্রাসী না বানাতে পারলে তাকে হেনস্থা করা যাবে কি করে। ইসলামকে নিশানা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিজমের পতনের পর এটি একমাত্র সুগঠিত মতাদর্শ যা পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ইসলাম শুধু একটি পারলৌকিক ধর্মবিশ্বাস নয়, এর মধ্যে আছে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যাবতীয় পুঁজিবাদী শাসন-শোষণ আর কনজুমারিজমের অবসান চায়। এই কারণেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের এ দেশীয় তাঁবেদাররা ইসলামের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
আজ যে ইসলামভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার একটা কথা উঠেছে তা আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পরিকল্পনার অংশ। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাঁবেদাররা মুসলিম দুনিয়ায় একটা ইসলামভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকুক এটা চায় না। মুসলিম সমাজের আইডেনটিটি হচ্ছে ইসলাম। ইসলামই হচ্ছে মুসলিম সমাজের ঐক্য ও সংহতির বন্ধন। ওই বন্ধন কেটে ফেলা মানে মুসলিম সমাজের আত্মহত্যার শামিল। সাম্রাজ্যবাদ সেটাই মনেপ্রাণে চায় এবং সেটাকে কার্যকর করতে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে। ইসলাম কোনো ভূইফোঁড় ধর্ম নয়। ইসলাম এ দেশে এসেছিল এক বিপ্লবী আদর্শ নিয়ে। ইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা এ দেশের মানুষকে সহজে আকর্ষণ করেছিল। মানুষ এখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে এর মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়েই। ইসলাম একটা মানবতন্ত্রী ধর্ম। কারণ, কোরআন শরীফে মানুষকে পৃথিবীর খলিফা বলা হয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এর সমতাবাদী, গণতান্ত্রিক চেতনা, শোষণহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞান-মনস্কতা ইসলামকে একটা বিপ্লবী তাত্পর্য দিয়েছে। এ দেশে ইসলামকে নিয়ে যারা লেখালেখি করেছেন তার মধ্যে বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় একজন। তার Historical Role of Islam খুবই সুপঠিত একটা গ্রন্থ। ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন :
‘ইসলামের তরবারি আল্লাহর নামেই পরিচালিত হয় এবং তা কার্যত একটি নতুন সামাজিক শক্তির বিজয়ে ভূমিকা রাখে এবং একটা নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনধারাকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে সচেষ্ট থাকে। যা ঘটনাচক্রে অন্যসব ধর্ম ও বিশ্বাসের সমাধির
রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণের কঠোর সমালোচক হচ্ছে কমিউনিস্টরা। কিন্তু প্রয়োজনে নানা রকম সুবিধা আদায়ের জন্য এরাও যে ধর্মের ব্যবহার থেকে পিছিয়ে থাকেন না তার নজিরও কিন্তু একেবারে কম নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করলে রুশ গির্জায় শুরু হয় রাশিয়াকে রক্ষার জন্য সমবেত প্রার্থনা। স্টালিন নাস্তিক হলেও এই প্রার্থনা অনুষ্ঠানকে প্রদান করেন বিশেষ অনুমোদন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন রুশ অর্থভক্স গির্জার শক্তিকে হিটলারবিরোধী লড়াইয়ে কাজে লাগাতে।
দক্ষিণ আমেরিকার খ্রিস্টান মিশনারি লিবারেশন থিওলজিস্টদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক মিত্রতার কথা অনেকেরই জানা আছে।
গত শতকের চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে ধর্মকে ভিত্তি করে যে পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে ওঠে তাকেও কিন্তু সমর্থন জানায় কমিউনিস্ট পার্টি। তখন তারা পাকিস্তান আন্দোলনকে শ্রেণী সংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করে। মূলত, তাদের লক্ষ্য ছিল এই আন্দোলনকে ভর করে মুসলিম সমাজে কমিউনিজমের বিস্তার ঘটানো।
এখন শোনা যাচ্ছে ভারতের কমিউনিস্টরা তাদের মার্ক্সীয় ধর্মবিরোধিতা খারিজ করে ধর্মাচরণে নিজেদেরকে যুক্ত করতে চাচ্ছেন। এ প্রক্রিয়া কিন্তু অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সেখানকার কমিউনিস্টরা মন্দিরে গিয়ে মূর্তিকে প্রণাম করেন, পূজামণ্ডপে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সবকিছুর মধ্যে রাজনৈতিক কলাকৌশল থাকলেও এটা যে মার্কসবাদ সম্মত নয় তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
সেকুলারিজমের আর একদল ব্যাখ্যাতা আছেন তারা মনে করেন এটা ঠিক ধর্মহীনতা নয়। এটা ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতায় অবিশ্বাসও নয়। এ ধরনের সেকুলার রাষ্ট্রে প্রত্যেকের নিজের পছন্দমত মত ও পথ পালন এবং প্রচার করার পূর্ণ অধিকার থাকবে ও প্রতিটি ধর্মের মঙ্গল এবং বাধাহীন বিকাশের সুযোগও থাকবে।
ভারতকে বলা হয়ে থাকে একটা সেকুলার রাষ্ট্র। ভারতের সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন : সেকুলার রাষ্ট্র মানে এমন কোনো রাষ্ট্র নয়, যেখানে মানুষে ধর্ম পরিত্যাগ করে। সেকুলার রাষ্ট্র মানে এমন এক রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্র সব ধর্মকে রক্ষা করে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট এক ধর্মের মূল্য অন্য কোনো ধর্মের পক্ষাবলম্বন করে না—বা কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে না।
ভারতের সংবিধানের সেকুলারিজম সংক্রান্ত ধারণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি হলো—যে কোনো ব্যক্তি অবাধে তার ধর্ম পালন, প্রচার ও প্রসার করার স্বাধীনতা পাবেন।
ভারতের সংবিধানে দেয়া সব ধর্মকে সমমর্যাদা দানের নীতি কিংবা নেহরুর সেকুলারিজমবিষয়ক ধ্যান-ধারণা কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করার কথা বলে না। এই কারণেই ভারতে হিন্দু মহাসভা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ, শিবসেনা, বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দল দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে চলেছে। এ ধরনের সেকুলার রাষ্ট্রে তাই ধর্মীয় রাজনীতিতে কোনো বাধা নেই। এই দুই ধরনের সেকুলারিজম এখন বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশে চোখে পড়ে। প্রথম জাতের সেকুলারিজম ধর্ম বস্তুটাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে ব্যক্তির ও সমাজের জীবনধারাকে অর্থ, কাম, উচ্চাশার পথে ধাবিত করতে চায়। এ যে ভোগবাদের নামান্তর তাতে সন্দেহ থাকে না। যে ব্যক্তি, যে সমাজ, যে রাষ্ট্র এ ধরনের সেকুলারিজমকে জীবনের সার কথা বলে গ্রহণ করতে চায় সে অনায়াসেই সমার্থক হয়ে উঠতে পারে দুর্নীতির, প্রতারণাজাত কার্যসিদ্ধির এবং সমবেত চরিত্র হননের।
ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নীটশে দরজা খুলে দিয়েছিলেন নাজী ফ্যাসিজমের। আর মার্কস খুলে রেখেছিলেন এমন এক কমিউনিজমের জন্য যা আসলে মার্কসবাদকে ছাপিয়ে গেছে। রুশ কমিউনিজম যে ধীরে ধীরে গোঁড়ামিতে ও ক্রুরতার ফ্যাসিজমের সমতুল্য হয়ে উঠেছিল, তা তো ইতিহাস।
এক সময় এই কমিউনিজম সংক্রমিত হয়েছিল আমাদের দেশেও। এর মধ্যে Fanaticism-এর বীজ ছিল। ‘কম্যুন’ কখনও মানবিক ‘কম্যুন’ হয়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ মানবিকতার ধর্ম না মেনে গোষ্ঠীর আদেশ মানতে হয়েছে তাদের। স্ট্যালিন যুগের কমিউনিস্টদের বাদ দিলেও কমিউনিজমের বাস্তব রূপটি অনেক মার্কসবাদী আত্মোত্সর্গী ব্যক্তিকে কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এদের মধ্যে এমএন রায় ও জর্জ অরওয়েল অন্যতম। এরা কমিউনিস্ট সমাজবাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। বিশেষ করে অরওয়েল তার Animal Firm এবং 1984 উপন্যাসে কমিউনিজমের চেহারা তুলে ধরেছেন অনন্যতার সঙ্গে। কমিউনিজম ধর্মের একটা বিকল্প প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু অচিরেই তার মহত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে Fanaticism-এ পরিণত হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
আর দ্বিতীয় জাতের সেকুলারিজম সতর্কতা অবলম্বন করে এগুতে চায়। তারা ধর্মকেও অস্বীকার করে না কিংবা সেকুলারিজমকেও ত্যাগ করে না। এরা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্ম ও রাষ্ট্রের তফােক খুব বড় করে দেখে না। এ ধরনের সেকুলারিজম চর্চাকে সুবিধাবাদ ছাড়া কি বলা যায়? জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারদের সেকুলারিজম তো আমরা দেখলাম। একই সঙ্গে মৌলবাদ-ভোগবাদ-শক্তিবাদের দানবকে তারা প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। পাশ্চাত্য জগতে রিফরমেশন, রেনেসাঁস, আধুনিক নগরের বিস্তার, শিল্প বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার ফলস্বরূপ এক সময় সেকুলারিজম শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেকুলারিজমের উদ্যোগী পুরুষরা সে সময় মানুষের উপর অলৌকিক বা অতি প্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এর ফলে সেখানকার জনমানসে ধর্মীয় ধারণাগুলো অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। রাষ্ট্রত্ত অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রসারের চেষ্টা করে। সমাজবিজ্ঞানীরা একে নেগোটিভলি রিলিজিয়াস বা ধর্মীয় বিষয়সমূহের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রূপে বিবেচনা করেন। তারপরেও বলতে হবে আদর্শ সেকুলার বা ধর্মহীন রাষ্ট্র আদপে পৃথিবীর কোথাও নেই বা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ, ধর্ম মানুষের অতি নিবিড় সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষকে নিয়েই সমাজ কিংবা রাষ্ট্র। মানুষের মন ধর্মনিরপেক্ষ না হলে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না।
অনেকে বলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানতে পারি না। ভুলতে পারি না ধর্ম সমাজের অঙ্গ। ধর্ম আমাদের দেশাত্ববোধের প্রান্ত ছুঁয়ে থাকে। ধর্মের নানা প্রকাশে দেশের মানুষের উদ্বেল হয়ে ওঠা কি মানুষ উড়িয়ে দিতে পারে? বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
বিলাত তথা ইউরোপ থেকে আমাদের দেশে এসেছে সেকুলারিজমের ধারণা। সেদিক দিয়ে বিলাতের ইতিহাসও হয়ে উঠেছে কিছুটা আমাদের ইতিহাস। সেই বিলাতের সমাজও পুরোপুরি ধর্মহীন নয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে চার্চের আছে নিকট সম্পর্ক। অ্যাংলিকান চার্চ হলো সেখানকার রাষ্ট্রধর্ম। ইউরোপে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে। এর বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে খ্রিস্টীয় গণতন্ত্রীরা (Christian Democrats)। এরা রোমান ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করে। কেতাবী সেকুলারিজমের সঙ্গে ফলিত সেকুলারিজমের তফাত্ অনেক। সুতরাং আমাদের দেশে যারা ধর্মহীন সেকুলারিজমের মাহাত্ম্যে বুঁদ হয়ে আছেন তাদের আগে বোঝা উচিত সেকুলারিজম কি বস্তু এবং স্থানকালপাত্র বিচারে তার যথার্থতা কতটুকু। আবার ইউরোপের সেকুলারিজমের বিকাশের ইতিহাস দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া বিভ্রান্তিকর ছাড়া কিছু নয়। এ দেশের সেকুলারিস্টদের একাংশ নানা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কারণে ভারতের প্রতি সংবেদনশীল। তারা মনে করেন ভারত হচ্ছে একটা আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসকে ধর্ম ছাড়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হচ্ছে কংগ্রেস। জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেস নেতারা দাবি করতেন এটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন—ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এই দল। মুখে যাই বলুন দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কংগ্রেস নেতারা আন্তরিকভাবে কেউই সেকুলার ছিলেন না। কংগ্রেসের সবচেয়ে ক্যারিসম্যাটিক নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ভারতীয় রাজনীতিতে তার চেয়ে সফলতার সঙ্গে আর কেউ ধর্মের মিশ্রণ ঘটাতে পারেননি। তিনিই রাজনীতির ময়দানে ‘হিন্দু সিম্বলকে’ আমদানি করেন। তপস্যা, আত্মিক শক্তি, শত্রুর ক্ষতি না করে হৃদয়ের পরিবর্তন, ধর্মবোধ সজ্ঞাত নৈতিকতা, অনশন, বিমূর্ত সত্য, রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়, রামধূন, পঙ্কস্নান (মহাত্মা গান্ধী তার আশ্রমে সর্বাঙ্গে মাটি মেখে রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা করতেন। তার বিশ্বাস ছিল এতে পুণ্য হয় এবং শরীর ভালো থাকে।) মৌনব্রত, গো দেবতা ইত্যাদি বিষয় গান্ধীর রাজনীতিকে ধর্মাশ্রয়ী ও হিন্দুঘেঁষা করে তোলে।
১৯১৫ সালে কলকাতায় ছাত্রদের এক সভায় তিনি ঘোষণা করেন : রাজনীতিকে ধর্মের থেকে পৃথক করা যায় না। পরবর্তীকালে তিনি বলেন, ধর্মের থেকে পৃথকীকৃত রাজনীতি হলো মৃত্যু ফাঁদ—কারণ তা আত্মাকে নিহত করে।
মহাত্মা গান্ধীর পথ ধরে কংগ্রেসের পরবর্তী নেতারাও ভারতের রাজনীতিকে হিন্দুয়ানী আদর্শে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন। এ ব্যাপারে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ এমনকি পণ্ডিত নেহরুও কম যাননি। শোনা যায় নেহরু ছিলেন ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। অথচ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বারবার বলেছেন, উপনিষদ হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ভিত্তি।
এই নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সংবিধানে ১৯৭৬ সালে সেকুলার শব্দটা সংযোজন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিত সেই তিনিও তীর্থস্থান আর হিন্দু ধর্মানুষ্ঠানে যোগদানের ব্যাপারে তার পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যান। ইন্দিরা নন্দন রাজীব গান্ধী বাবরী মসজিদের পাশে রামমন্দিরের শিলান্যাস করেন। এভাবে ভারতের সেকুলার রাজনৈতিক নেতারা প্রয়োজন পড়লেই ধর্ম ও ধর্মান্ধতার বন্দনা করেন। আর বিজেপির কথা বলাইবাহুল্য। এর রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম ভিত্তিই হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষ। বাবরী মসজিদ ধ্বংস। গুজরাট হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ভারতের সেকুলারিজমের আসল চেহারা উদোম করে দিয়েছে। বস্তুত, ভারতের রাজনৈতিক চরিত্রকে কখনোই পুরোপুরি সেকুলার বলা যায় না। কংগ্রেস হোক, বিজেপি হোক উভয়ের রাজনীতিই এক হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দ্বারাই পরিচালিত। যেসব ঐতিহাসিক কারণে এই উপমহাদেশের মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল সেকুলারিজমের আড়ালে কংগ্রেসের এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। এভাবে ধর্ম জড়িয়ে গেছে ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে। কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে দানা বেঁধেছে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলনের। জিন্নাহ সাহেবকে এক সময় বলা হতো Ambassador of Hindu-Muslim Unity. দীর্ঘদিন কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার জন্য কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিই প্রধান কারণ। এসব কথা আজ ভারতের মুক্তমতি বুদ্ধিজীবী ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিকরা এতকাল পর স্বীকার করতে শুরু করেছেন। ফলে বাধ্য হয়েই জিন্নাহ সাহেবকে সেদিন ভারতবর্ষের মুসলমানদের আত্মরক্ষার সংগ্রামে নামতে হয়। কেন সেকুলার জিন্নাহকে মুসলিম জাতীয়তাবাদী জিন্নায় পরিণত হতে হলো তার বিশ্লেষণ ছাড়া আজকের বাংলাদেশের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। যারা এ দেশে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক বলে এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন, তারা আসলে ইতিহাসকেই উড়িয়ে দেন। তারা ইতিহাসের পরম্পরাকেই অস্বীকার করেন। আজকে যারা এ দেশে ইসলামনির্ভর রাজনীতিকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে সেকুলার ধর্মহীন রাজনীতির কথা বলছেন তাদের ভারতবর্ষের সমকালীন রাজনীতির ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
ইসলামকে সাম্প্রদায়িক মনে করা তথাকথিত ইউরোপীয় যুক্তিবাদী, সেকুলার চিন্তা-ভাবনার ফল বলেই মনে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপের মজ্জাগত শত শত বছরের ইসলামবিদ্বেষ। রিফরমেশন, রেনেসাঁর দরজা পার হয়ে আসার পরও পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এতটুকু পাল্টায়নি। কমিউনিজমের পতনের পর আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বের রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে ইসলামকে কেন্দ্র করে। তাদের পেয়ে বসেছে এক ইসলামভীতি। ইসলামকে অনবরত বর্বর, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ধর্ম হিসেবে প্রচার করা আজ পশ্চিমা বিশ্বের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে। কারণ, কাউকে সন্ত্রাসী না বানাতে পারলে তাকে হেনস্থা করা যাবে কি করে। ইসলামকে নিশানা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিজমের পতনের পর এটি একমাত্র সুগঠিত মতাদর্শ যা পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ইসলাম শুধু একটি পারলৌকিক ধর্মবিশ্বাস নয়, এর মধ্যে আছে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যাবতীয় পুঁজিবাদী শাসন-শোষণ আর কনজুমারিজমের অবসান চায়। এই কারণেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের এ দেশীয় তাঁবেদাররা ইসলামের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
আজ যে ইসলামভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার একটা কথা উঠেছে তা আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পরিকল্পনার অংশ। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাঁবেদাররা মুসলিম দুনিয়ায় একটা ইসলামভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকুক এটা চায় না। মুসলিম সমাজের আইডেনটিটি হচ্ছে ইসলাম। ইসলামই হচ্ছে মুসলিম সমাজের ঐক্য ও সংহতির বন্ধন। ওই বন্ধন কেটে ফেলা মানে মুসলিম সমাজের আত্মহত্যার শামিল। সাম্রাজ্যবাদ সেটাই মনেপ্রাণে চায় এবং সেটাকে কার্যকর করতে সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে। ইসলাম কোনো ভূইফোঁড় ধর্ম নয়। ইসলাম এ দেশে এসেছিল এক বিপ্লবী আদর্শ নিয়ে। ইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা এ দেশের মানুষকে সহজে আকর্ষণ করেছিল। মানুষ এখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে এর মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়েই। ইসলাম একটা মানবতন্ত্রী ধর্ম। কারণ, কোরআন শরীফে মানুষকে পৃথিবীর খলিফা বলা হয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এর সমতাবাদী, গণতান্ত্রিক চেতনা, শোষণহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞান-মনস্কতা ইসলামকে একটা বিপ্লবী তাত্পর্য দিয়েছে। এ দেশে ইসলামকে নিয়ে যারা লেখালেখি করেছেন তার মধ্যে বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় একজন। তার Historical Role of Islam খুবই সুপঠিত একটা গ্রন্থ। ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন :
‘ইসলামের তরবারি আল্লাহর নামেই পরিচালিত হয় এবং তা কার্যত একটি নতুন সামাজিক শক্তির বিজয়ে ভূমিকা রাখে এবং একটা নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনধারাকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে সচেষ্ট থাকে। যা ঘটনাচক্রে অন্যসব ধর্ম ও বিশ্বাসের সমাধির
No comments