চারদিক- আরোগ্যকুঞ্জ by আকমল হোসেন
উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যের জন্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান মোটামুটি অনেকের কাছেই পরিচিত। অনেকেই হয়তো অচেনা-অজানা গাছপালা, লতাগুল্মসহ নানা রকম বন্য প্রাণী দেখতে এই উদ্যান ঘুরে গেছেন (যদিও অপরিকল্পিত আচরণের জন্য এই উদ্যানে এখন উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য দুটোই হুমকিতে।
ফলে তাঁরা কতটা দেখতে পেয়েছেন, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ)। তবে উদ্ভিদ বা প্রাণী—এই দুটোর বৈচিত্র্য বিপন্ন হলেও পাকা সড়কের দুই পাশে গাছপালার ঘন ঝোপের স্থানটি যে এখনো কাছে টানার মতো, তা যাঁরা ঘুরে গেছেন, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন। (যদিও এ প্রশ্ন এখন উঠছে এবং ওঠাই হয়তো যৌক্তিক। এ রকম উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যের উদ্যানের ভেতর দিয়ে ট্রেনলাইন ও পাকা সড়ক নির্মাণ কতটুকু পরিবেশবান্ধব, যা বন্য প্রাণীর নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেছে ও গাছ চুরির পথকে সহজ করেছে)।
এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকারই একটু পূর্বদিকে অগ্রসর হলে আরও একটি উদ্যান চোখে পড়ে। এই উদ্যান নিয়ে কারও কৌতূহল তৈরি হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। এই উদ্যানে এমন সব বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের নাম আছে, যেগুলো দেখা তো দূরে থাক, হয়তো অনেকে নামই কখনো শোনেননি। এই উদ্যানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি একটি দেশজ ঔষধি বৃক্ষের ভেষজ বাগান। ভেষজ বাগানটিতে টাঙানো সাইনবোর্ড বাগানের আত্মপরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় এক দশক আগে এই বাগান তৈরি হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, একসময় দেশের গ্রামীণ ঝোপঝাড় ও বনজঙ্গলে হেলাফেলায় বিভিন্ন জাতের ঔষধি বৃক্ষ জন্মলাভ করেছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বনজঙ্গল উজাড়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অসচেতনতার কারণে অনেক ঔষধি বৃক্ষ হারিয়ে গেছে। অনেক জাতের গাছ বিলুপ্তির পথে। এই অবস্থায় দেশজ ঔষধি বৃক্ষ সংগ্রহের লক্ষ্যেই বাগানটির জন্ম। সাইনবোর্ডে বাগানটির বৃত্তান্ত লেখা আছে (যদিও অনেকেরই প্রশ্ন, যে তালিকা আছে। তা এখন বাস্তবে কতটুকু রয়েছে)।
মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের পাশে বন বিভাগ ২০০১-০২ অর্থবছরে ২০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলে গুল্ম ও ঔষধি বৃক্ষের ভেষজ বাগান আরোগ্যকুঞ্জ। বন বিভাগ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে এখানে ৬৩টি প্রজাতির গাছ ও গুল্মলতা রোপণ করে। এর মধ্যে আছে: অশোক, অর্জুন, আমলকী, কাঞ্জলভাদী/ কামেলা, কর্পূর, কুরচি, কাউ, গাব, চালতা, চালমুগরা, ছাতিয়ান, জয়ত্রী, তেঁতুল, পলাশ, বর্তা, নিম, মহুয়া, যজ্ঞডুমুর, রক্তচন্দন, রিঠা, শিমুল, শ্বেতচন্দন, সোনালু, সিভিট/ সিভিটা, হরীতকী, হিজল, খয়ের, কাঁঠাল, ইউক্যালিপটাস, বট, গামার, আমসহ ৩৮ প্রজাতির বৃক্ষ; বাসক, আকন্দ, পাথরকুচি, ভেরেণ্ডা, ঘৃতকুমারী, ওলটকমল, তুলসী, ফণিমনসাসহ ১২ প্রজাতির গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ এবং ঈশ্বরমূল, কালোমেঘ, গন্ধভাদুলি, গোলমরিচ, থানকুনি, পুদিনা, শতমূলী, সর্পগন্ধা, হাড়মোড়, কুমারিকাসহ ১৩ প্রজাতির লতাজাতীয় গাছ। কিন্তু এই বাগান তৈরির পর আরোগ্যকুঞ্জের সঠিক পরিচর্যা কতটকু হয়েছে বা হচ্ছে—এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন আছে। দেখা গেল, বাগানের চার পাশ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। অবাধে সেখানে লোকজন প্রবেশ করছে। অনেক স্থানীয়-অস্থানীয় কবিরাজ দুর্লভ জাতের গাছ কেটে নিয়ে গেছে, কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে। দীর্ঘদিন পরিচর্যা না থাকায় ঝোপজঙ্গলের কারণে কোনটা ঔষধিগাছ আর কোনটা আগাছা আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। অযত্ন-অবহেলায় অনেক গাছ ও লতাগুল্ম আরোগ্যকুঞ্জ থেকে হারিয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে জানালেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আসা পর্যটকেরা প্রায়ই ভেষজ ঔষধি বৃক্ষ দেখতে আরোগ্যকুঞ্জে আসেন। কিন্তু কোনটা কোন প্রজাতির গাছ, তা চেনার কোনো সুযোগ পান না। প্রজাতি অনুযায়ী, গাছের কোনো পরিচয় লেখা নেই। এ ছাড়া পর্যটকেরা অবাধে প্রবেশ করেও লতাগুল্মের ক্ষতিসাধন করছে। তাদের পদতলে অনেক গাছ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিককর্মী সালেহ এলাহী কুটি বললেন, ‘আমি ঔষধি অনেক গাছের মধ্যে অন্তত নিমগাছটা চিনি। কিন্তু আরোগ্যকুঞ্জে অনেকক্ষণ খুঁজেও নিমগাছ পাইনি।’
বন বিভাগের (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) মৌলভীবাজার রেঞ্জের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাগান তৈরির প্রথম এক বছর আরোগ্যকুঞ্জের পরিচর্যা ছিল (যা আমাদের দেশে কোনো কিছু শুরুর সময় হয়ে থাকে)। এরপর আর বাজেট না থাকায় পরিচর্যা বন্ধ। অনেকটা অরক্ষিত-অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় আছে বাগানটি। কী পরিমাণ ও কত প্রজাতির গাছ আছে, তা গুনে দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক নেই। তাই বর্তমানে গাছের সংখ্যা বলা কঠিন। সঠিক পরিচর্যার অভাবে গাছ বেশি বড় হচ্ছে না। এখানে অনেক দুর্লভ প্রজাতির ভেষজ বৃক্ষ আছে। সংরক্ষণ করা গেলে এখানকার দুর্লভ প্রজাতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের ধারণা, খাতাপত্রে আরোগ্যকুঞ্জের ঔষধি বৃক্ষ ও গুল্মলতার প্রজাতি ও যে পরিসংখ্যান আছে, বাস্তবের সঙ্গে তা মিলবে না।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বললেন, ‘এখানে লতাগুল্ম ও ঔষধি বৃক্ষ আছে। তবে কিছু কিছু লতাগুল্ম নেই। হয়তো কিছু গাছও নেই। তীব্র জনবলসংকটের কারণে পরিচর্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। যেখানে কাজ বেড়েছে, লোকবল বাড়ার কথা। কিন্তু সেখানে লোকবল কমছে।’ এখন আরোগ্যকুঞ্জের নিজেরই আরোগ্য দরকার হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকারই একটু পূর্বদিকে অগ্রসর হলে আরও একটি উদ্যান চোখে পড়ে। এই উদ্যান নিয়ে কারও কৌতূহল তৈরি হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। এই উদ্যানে এমন সব বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের নাম আছে, যেগুলো দেখা তো দূরে থাক, হয়তো অনেকে নামই কখনো শোনেননি। এই উদ্যানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি একটি দেশজ ঔষধি বৃক্ষের ভেষজ বাগান। ভেষজ বাগানটিতে টাঙানো সাইনবোর্ড বাগানের আত্মপরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় এক দশক আগে এই বাগান তৈরি হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, একসময় দেশের গ্রামীণ ঝোপঝাড় ও বনজঙ্গলে হেলাফেলায় বিভিন্ন জাতের ঔষধি বৃক্ষ জন্মলাভ করেছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বনজঙ্গল উজাড়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অসচেতনতার কারণে অনেক ঔষধি বৃক্ষ হারিয়ে গেছে। অনেক জাতের গাছ বিলুপ্তির পথে। এই অবস্থায় দেশজ ঔষধি বৃক্ষ সংগ্রহের লক্ষ্যেই বাগানটির জন্ম। সাইনবোর্ডে বাগানটির বৃত্তান্ত লেখা আছে (যদিও অনেকেরই প্রশ্ন, যে তালিকা আছে। তা এখন বাস্তবে কতটুকু রয়েছে)।
মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের পাশে বন বিভাগ ২০০১-০২ অর্থবছরে ২০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলে গুল্ম ও ঔষধি বৃক্ষের ভেষজ বাগান আরোগ্যকুঞ্জ। বন বিভাগ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে এখানে ৬৩টি প্রজাতির গাছ ও গুল্মলতা রোপণ করে। এর মধ্যে আছে: অশোক, অর্জুন, আমলকী, কাঞ্জলভাদী/ কামেলা, কর্পূর, কুরচি, কাউ, গাব, চালতা, চালমুগরা, ছাতিয়ান, জয়ত্রী, তেঁতুল, পলাশ, বর্তা, নিম, মহুয়া, যজ্ঞডুমুর, রক্তচন্দন, রিঠা, শিমুল, শ্বেতচন্দন, সোনালু, সিভিট/ সিভিটা, হরীতকী, হিজল, খয়ের, কাঁঠাল, ইউক্যালিপটাস, বট, গামার, আমসহ ৩৮ প্রজাতির বৃক্ষ; বাসক, আকন্দ, পাথরকুচি, ভেরেণ্ডা, ঘৃতকুমারী, ওলটকমল, তুলসী, ফণিমনসাসহ ১২ প্রজাতির গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ এবং ঈশ্বরমূল, কালোমেঘ, গন্ধভাদুলি, গোলমরিচ, থানকুনি, পুদিনা, শতমূলী, সর্পগন্ধা, হাড়মোড়, কুমারিকাসহ ১৩ প্রজাতির লতাজাতীয় গাছ। কিন্তু এই বাগান তৈরির পর আরোগ্যকুঞ্জের সঠিক পরিচর্যা কতটকু হয়েছে বা হচ্ছে—এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন আছে। দেখা গেল, বাগানের চার পাশ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। অবাধে সেখানে লোকজন প্রবেশ করছে। অনেক স্থানীয়-অস্থানীয় কবিরাজ দুর্লভ জাতের গাছ কেটে নিয়ে গেছে, কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে। দীর্ঘদিন পরিচর্যা না থাকায় ঝোপজঙ্গলের কারণে কোনটা ঔষধিগাছ আর কোনটা আগাছা আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। অযত্ন-অবহেলায় অনেক গাছ ও লতাগুল্ম আরোগ্যকুঞ্জ থেকে হারিয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে জানালেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আসা পর্যটকেরা প্রায়ই ভেষজ ঔষধি বৃক্ষ দেখতে আরোগ্যকুঞ্জে আসেন। কিন্তু কোনটা কোন প্রজাতির গাছ, তা চেনার কোনো সুযোগ পান না। প্রজাতি অনুযায়ী, গাছের কোনো পরিচয় লেখা নেই। এ ছাড়া পর্যটকেরা অবাধে প্রবেশ করেও লতাগুল্মের ক্ষতিসাধন করছে। তাদের পদতলে অনেক গাছ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিককর্মী সালেহ এলাহী কুটি বললেন, ‘আমি ঔষধি অনেক গাছের মধ্যে অন্তত নিমগাছটা চিনি। কিন্তু আরোগ্যকুঞ্জে অনেকক্ষণ খুঁজেও নিমগাছ পাইনি।’
বন বিভাগের (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) মৌলভীবাজার রেঞ্জের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাগান তৈরির প্রথম এক বছর আরোগ্যকুঞ্জের পরিচর্যা ছিল (যা আমাদের দেশে কোনো কিছু শুরুর সময় হয়ে থাকে)। এরপর আর বাজেট না থাকায় পরিচর্যা বন্ধ। অনেকটা অরক্ষিত-অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় আছে বাগানটি। কী পরিমাণ ও কত প্রজাতির গাছ আছে, তা গুনে দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক নেই। তাই বর্তমানে গাছের সংখ্যা বলা কঠিন। সঠিক পরিচর্যার অভাবে গাছ বেশি বড় হচ্ছে না। এখানে অনেক দুর্লভ প্রজাতির ভেষজ বৃক্ষ আছে। সংরক্ষণ করা গেলে এখানকার দুর্লভ প্রজাতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের ধারণা, খাতাপত্রে আরোগ্যকুঞ্জের ঔষধি বৃক্ষ ও গুল্মলতার প্রজাতি ও যে পরিসংখ্যান আছে, বাস্তবের সঙ্গে তা মিলবে না।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বললেন, ‘এখানে লতাগুল্ম ও ঔষধি বৃক্ষ আছে। তবে কিছু কিছু লতাগুল্ম নেই। হয়তো কিছু গাছও নেই। তীব্র জনবলসংকটের কারণে পরিচর্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। যেখানে কাজ বেড়েছে, লোকবল বাড়ার কথা। কিন্তু সেখানে লোকবল কমছে।’ এখন আরোগ্যকুঞ্জের নিজেরই আরোগ্য দরকার হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
No comments