পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে by রাহীদ এজাজ
সুশাসন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর দূরত্ব বাড়ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর সঙ্গে এ দূরত্ব আরও বেড়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী, তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের প্রশ্নে সরকারের অবস্থানও পশ্চিমা উন্নয়ন-সহযোগীদের অসন্তুষ্ট করছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপে উদ্বেগ জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছিলেন। গত রোববার এ বিষয়ে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ঢাকায় কর্মরত একাধিক ইইউ দেশের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগে সরকারের নিযুক্ত চেয়ারম্যানকে বেশি ক্ষমতা দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের কাছে ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে ইইউর দুই প্রভাবশালী সদস্য জার্মানি ও ফ্রান্স।
সম্প্রতি লন্ডন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় ফেরার পর জনসমক্ষে দেওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার বক্তব্যে সরকার অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে টিকফা চুক্তি, শ্রমিকনেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তাঁর বক্তব্য-বিবৃতিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের পাশাপাশি সম্প্রতি ঢাকা সফরের সময় জার্মান প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ গণতন্ত্র ও সুশাসনে অগ্রগতির ওপর গুরুত্ব দেন। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্র ও সুশাসনে অগ্রগতির পাশাপাশি সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত দেশগুলো। কিন্তু এ বিষয়গুলোতে তেমন অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করছে তারা। বরং গ্রামীণ ব্যাংকের পাশাপাশি আদিবাসী ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে সরকারের অবস্থান উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছে নেতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উদ্বেগ জানিয়ে জার্মানি ও ফ্রান্সের চিঠি: গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন এমডি নিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে সরকারের নিযুক্ত চেয়ারম্যানের। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জার্মানি ও ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। ১৪ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ই-মেইল করে ইইউর প্রভাবশালী দুই দেশের ঢাকার দূতাবাস যৌথভাবে তাদের সরকারের অবস্থান জানায়।
জানতে চাইলে ইউরোপের এক কূটনীতিক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান, উদ্যোগটি এ দুই দেশের হলেও এতে সমর্থন আছে সংস্থার অন্য সদস্যদের। সরকারকে দেওয়া চিঠিতে দেশ দুটি বলেছে, গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ তাদের বিচলিত করেছে। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাই ব্যাংকের মূল অংশীদারদের ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখা জরুরি।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিনসেন্ট ফ্লোরিয়ানি প্যারিসে এক বিবৃতিতে বলেছেন, এমডি নিয়োগে সরকারের নিযুক্ত গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্তে ফ্রান্স উদ্বিগ্ন। গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাটা জরুরি।
গ্রামীণ ব্যাংক ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের মনোভাব: সম্প্রতি লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যান্ড্রু মিশেল। আলোচনায় উঠে আসে গ্রামীণ ব্যাংক এবং মিয়ানমারের জাতিগত সংঘাত থেকে প্রাণে বাঁচা রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ। মিশেল গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেন। বৈশ্বিক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যবিষয়ক আলোচনায় যোগ দিতে ১২ আগস্ট তিন দিনের সফরে লন্ডন যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোহিঙ্গার বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এম জিয়াউদ্দিনকে চিঠি লেখেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট এ চিঠিটি পাঠানো হয়। গিবসন লিখেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে ইইউর অনুসৃত নীতি অনুসরণ করে যুক্তরাজ্য। অর্থাৎ মানবিক সাহায্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের সমর্থন রয়েছে। এ কাজে সহায়তার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করে যুক্তরাজ্য।
এনজিও কার্যক্রম প্রসঙ্গে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ: রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার নামে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সরকার সম্প্রতি সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল (এমএসএফ), অ্যাকশন কন্ত লা ফেইম এবং মুসলিম এইড ইউকে নামের তিনটি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ ওই তিন এনজিওর নিবন্ধনের মেয়াদ প্রায় দুই বছর আগে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তবে নিয়মানুযায়ী নিবন্ধনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করার কথা থাকলেও এ রীতি ওই তিন এনজিও অনুসরণ করেনি।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ভিনসেন্ট ফ্লোরিয়ানি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তিন এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার নিন্দা জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তিন এনজিওর কার্যক্রম বন্ধে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তাঁর দেশের পক্ষে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
No comments