বিদায় কে জি ভাই by মনজুর আহমদ
চলে গেলেন কে জি মুস্তাফা। বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা খন্দকার গোলাম মুস্তাফা। এই সুদূর নিউইয়র্ক থেকে তাকে জানাই আমার শেষ অভিবাদন। শেষ সংগ্রামী সালাম। কে জি ভাই আমার কাছে বরাবরই সংগ্রামের প্রতীক। আমার অবচেতন মনে তার যে ভাবমূর্তি চির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, তা এক লড়াকু সৈনিকের।
আমার কাছে কে জি ভাই মানেই মেহনতি সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের লড়াই। এই পরিচয়েই আমি কে জি ভাইকে প্রথম চিনেছিলাম। স্কুল জীবন শেষ করে তখন সবে কলেজে পা রাখতে চলেছি, তখনই দারুণভাবে ঝুঁকে পড়েছি সাংবাদিকতার প্রতি। প্রত্যন্ত মফস্বল শহর ঝিনাইদহের দুঃখ-দুর্দশার খবর যখন ‘সংবাদ’ আর ‘ইত্তেফাক’-এ লিখে পাঠাতে শুরু করি, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। কিছুদিন পর ‘সংবাদ’ থেকে ঝিনাইদহ সংবাদদাতা হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলাম। কে জি ভাই তখন সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক। তখনই, সালটা হবে সম্ভবত ১৯৫৮, আমি কে জি ভাইকে প্রথম দেখি। দেখি মানে একেবারেই চোখের দেখা। ঢাকায় গিয়ে সংবাদ অফিসে রাতে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর তাকে পেয়েছিলাম। আমার পরিচয় দিয়েছিলাম। পরামর্শ চেয়েছিলাম সংবাদদাতা হিসেবে আমার করণীয় সম্পর্কে। সেই ব্যস্ত মুহূর্তেও তিনি কিছুক্ষণ আমার পাশে বসে আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু তখনও না। কে জি ভাইয়ের পরিচয় আমার কাছে পুরোপুরি উঠে এলো আরও পরে, যখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাংবাদিক বেতন বোর্ড রোয়েদাদ আন্দোলনে। অবহেলিত সাংবাদিক সমাজের ন্যায্য বেতন-ভাতা আদায়ের লড়াইয়ে। তখনকার সাংবাদিক ইউনিয়গুলোর সারা পাকিস্তান ভিত্তিক ফেডারেল সংগঠন পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের (পিএফইউজে) তিনি তখন ছিলেন সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক। সেই মফস্বল শহরে বসে সংবাদপত্রে পড়ছিলাম তার কথা। দেখলাম, প্রথম বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি সাজ্জাদ আহমদ জানের পাশে দাঁড়ানো তার ছবি।
১৯৬১-তে আমি যখন পুরোপুরি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দিই, সংবাদের সাব-এডিটর হিসেবে নিযুক্তি পাই; তখন কে জি ভাইকে সেখানে পাইনি। কে জি ভাই তখন কারাবন্দি। একষট্টির মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পুলিশ হানা দিয়ে একদিনে তিন বামপন্থী সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করে। কে জি মুস্তাফা, আনোয়ার জাহিদ এবং আলাউদ্দিন আল আজাদ।
দেড় বছর কিংবা আরও কিছু বেশি সময় কারাভোগের পর কে জি ভাই যখন বেরিয়ে এলেন, তখন তিনি রীতিমত পকস্ফকেশ। মুক্তি পেয়েই তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে। পিএফইউজে’র দায়িত্ব শেষে তিনি ফিরে আসেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইপিইউজে) নেতৃত্বে। সাধারণ সদস্যদের সরাসরি ভোটে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ইপিইউজে’র প্রথম নির্বাচনে কে জি ভাই বিপুল ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তার সমর্থক প্যানেলের প্রার্থীরা অন্য প্রায় সব ক’টি পদে জয়লাভ করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যোগদানের প্রথম থেকেই আমি ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়ে ওঠি। সাধারণ সদস্যদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত ইপিইউজে’র প্রথম নির্বাচনে কে জি ভাইয়ের প্যানেল থেকে আমিও সদস্য পদে নির্বাচিত হই। আর এভাবেই ইউনিয়ন ও পরে প্রেসক্লাবের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই কেজি ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা দিনে দিনে গাঢ় হয়ে ওঠে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকের সময়টা ছিল বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়নের দাবিতে সাংবাদিকদের আন্দোলনে মুখর। বেতন বোর্ড রোয়েদাদ আদায়ের চেয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে তা বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে অনেক বেশি কঠিন। আর্থিক অসঙ্গতির অজুহাতে অনেক পত্রিকা মালিকই এই রোয়েদাদ বাস্তবায়নে অপারগতা প্রকাশ করেন। কে জি ভাইয়ের জন্য সে ছিল এক ব্যস্ত সময়। যেখানেই, যে পত্রিকাতেই আন্দোলন বা অশান্তি, সেখানেই ছুটে গেছেন কে জি ভাই। বাস্তবিক অর্থেই সে সময় সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং কে জি মুস্তাফা হয়ে উঠেছিলেন সমার্থক। সাংবাদিকদের আন্দোলনে সাহসী ও সফল নেতৃত্ব তাকে করে তুলেছিল সাংবাদিক সমাজের কিংবদন্তির নেতা।
কে জি ভাইয়ের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্কও আমার গড়ে উঠেছিল। তার স্ত্রী অধ্যাপিকা সাবেরা মুস্তাফা ছিলেন একজন খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী। আমার স্ত্রী রেখা আহমেদ তার সঙ্গে তিনটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এটা সেই ১৯৬৮ সালের কথা। তিনটি নাটকেরই নির্দেশনায় ছিলেন প্রয়াত লায়লা সামাদ।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কে জি মুস্তাফাকে লেবাননে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্তি দেন। সে নিযুক্তি কে জি ভাই গ্রহণ করেন। কিন্তু আমি এবং আমার মতো আরও দুই-একজন তার এই সরকারি দায়িত্বে যাওয়াকে মেনে নিতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছিল, সাংবাদিক কে জি মুস্তাফা হারিয়ে যাচ্ছে। সে কথা আমি তাকে খোলাখুলি বলেও ছিলাম। বলেছিলাম, আপনি এই স্বাধীন বাংলাদেশে নতুনভাবে গড়ে তুলবেন সাংবাদিক সমাজকে। তাদের অধিকার ও মর্যাদা সুমন্নত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। এর বদলে সরকারি চাকরি নিয়ে পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এটা কি আপনার জন্য বেশি গৌরবজনক? কে জি ভাই আমার মন্তব্যে খুশি হননি। একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, এ কাজটা এখন তোমরা করো। তোমরা আছ কী জন্য? মনে আছে, প্রেসক্লাব চত্বরে আয়োজিত তার বিদায় সংবর্ধনায় সেদিনের তরুণ সাংবাদিক এনএম হারুণ তার বক্তৃতায় কে জি ভাইয়ের এই নিযুক্তি সম্পর্কে এ ধরনেরই একটি মন্তব্য করেছিলেন। কে জি ভাই তার বক্তব্যে হারুণের নাম নিয়ে তার মন্তব্যের জবাব দিয়েছিলেন।
কে জি ভাই রাষ্ট্রদূত হয়ে লেবাননে চলে গেলেন। বেশ একটা লম্বা সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেন তিনি। তার সঙ্গে আবার আমার কথা হয় ১৯৭৯ সালের জুলাইতে, বাগদাদে। লেবানন থেকে তিনি বদলি হয়ে এসেছিলেন বাগদাদে। এরই মধ্যে দেশে ঘটে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু নিহত হন। ক্ষমতায় আসে নতুন নেতৃত্ব। এর কিছুদিন পরই কে জি মুস্তাফাকে অব্যাহতি দেয়া হয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব থেকে। অব্যাহতি লাভের পর তিনি বাগদাদেই রয়ে যান সরকারি প্রকাশনা একটি সংবাদপত্রে কাজ নিয়ে। বাগদাদে গিয়েই তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইরাকের বিপ্লববার্ষিকী উপলক্ষে সেবার বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম আমি আর ফাজলে রশিদ। আরও ৯০টি দেশের সাংবাদিককে এ উপলক্ষে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই বিপ্লববার্ষিকীতেই ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হাসান আল বকর পদত্যাগ করে সাদ্দাম হোসেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
কে জি ভাই আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে। নিয়ে গিয়েছিলেন ইরাকে কর্মরত বাংলাদেশীরা যে এলাকায় বসবাস করেন সেখানে। নিয়ে গিয়েছিলেন বাগদাদের দর্শনীয় স্থানগুলোতে। মনে হয়েছিল, একজন বড় ভাইয়ের মতো স্নেহে-আদরে তিনি তার দেশের এই দুই ছোট ভাইকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। কে জি ভাই শেষ অব্দি দেশে ফিরে এলেন আশির দশকের মাঝামাঝিতে। সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলেন ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন কাগজে। কিছু লেখালেখিও করলেন পত্র-পত্রিকায়।
১৩ মার্চ ভোরে কে জি ভাই চিরবিদায় নিলেন। দশ বছর আগে আমেরিকায় চলে আসার আগে তাকে অসুস্থ দেখে এসেছিলাম। প্রেসক্লাবে তিনিই একদিন বলেছিলেন তার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির কথা। তাকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না, ভেতরে ভেতরে কতটা ভেঙেছেন তিনি, শরীর কতটা ভেঙে পড়েছে তার।
চলে গেলেন তিনি। সমাপ্তি ঘটল এক সংগ্রামী জীবনের। এত দূর থেকে তার জন্য আর কিছু করার নেই জানি। শুধু জানাতে পারি শেষ সংগ্রামী সালাম।
কিন্তু তখনও না। কে জি ভাইয়ের পরিচয় আমার কাছে পুরোপুরি উঠে এলো আরও পরে, যখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাংবাদিক বেতন বোর্ড রোয়েদাদ আন্দোলনে। অবহেলিত সাংবাদিক সমাজের ন্যায্য বেতন-ভাতা আদায়ের লড়াইয়ে। তখনকার সাংবাদিক ইউনিয়গুলোর সারা পাকিস্তান ভিত্তিক ফেডারেল সংগঠন পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের (পিএফইউজে) তিনি তখন ছিলেন সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক। সেই মফস্বল শহরে বসে সংবাদপত্রে পড়ছিলাম তার কথা। দেখলাম, প্রথম বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি সাজ্জাদ আহমদ জানের পাশে দাঁড়ানো তার ছবি।
১৯৬১-তে আমি যখন পুরোপুরি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দিই, সংবাদের সাব-এডিটর হিসেবে নিযুক্তি পাই; তখন কে জি ভাইকে সেখানে পাইনি। কে জি ভাই তখন কারাবন্দি। একষট্টির মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পুলিশ হানা দিয়ে একদিনে তিন বামপন্থী সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করে। কে জি মুস্তাফা, আনোয়ার জাহিদ এবং আলাউদ্দিন আল আজাদ।
দেড় বছর কিংবা আরও কিছু বেশি সময় কারাভোগের পর কে জি ভাই যখন বেরিয়ে এলেন, তখন তিনি রীতিমত পকস্ফকেশ। মুক্তি পেয়েই তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে। পিএফইউজে’র দায়িত্ব শেষে তিনি ফিরে আসেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইপিইউজে) নেতৃত্বে। সাধারণ সদস্যদের সরাসরি ভোটে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ইপিইউজে’র প্রথম নির্বাচনে কে জি ভাই বিপুল ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তার সমর্থক প্যানেলের প্রার্থীরা অন্য প্রায় সব ক’টি পদে জয়লাভ করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যোগদানের প্রথম থেকেই আমি ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়ে ওঠি। সাধারণ সদস্যদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত ইপিইউজে’র প্রথম নির্বাচনে কে জি ভাইয়ের প্যানেল থেকে আমিও সদস্য পদে নির্বাচিত হই। আর এভাবেই ইউনিয়ন ও পরে প্রেসক্লাবের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই কেজি ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা দিনে দিনে গাঢ় হয়ে ওঠে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকের সময়টা ছিল বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়নের দাবিতে সাংবাদিকদের আন্দোলনে মুখর। বেতন বোর্ড রোয়েদাদ আদায়ের চেয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে তা বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে অনেক বেশি কঠিন। আর্থিক অসঙ্গতির অজুহাতে অনেক পত্রিকা মালিকই এই রোয়েদাদ বাস্তবায়নে অপারগতা প্রকাশ করেন। কে জি ভাইয়ের জন্য সে ছিল এক ব্যস্ত সময়। যেখানেই, যে পত্রিকাতেই আন্দোলন বা অশান্তি, সেখানেই ছুটে গেছেন কে জি ভাই। বাস্তবিক অর্থেই সে সময় সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং কে জি মুস্তাফা হয়ে উঠেছিলেন সমার্থক। সাংবাদিকদের আন্দোলনে সাহসী ও সফল নেতৃত্ব তাকে করে তুলেছিল সাংবাদিক সমাজের কিংবদন্তির নেতা।
কে জি ভাইয়ের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্কও আমার গড়ে উঠেছিল। তার স্ত্রী অধ্যাপিকা সাবেরা মুস্তাফা ছিলেন একজন খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী। আমার স্ত্রী রেখা আহমেদ তার সঙ্গে তিনটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এটা সেই ১৯৬৮ সালের কথা। তিনটি নাটকেরই নির্দেশনায় ছিলেন প্রয়াত লায়লা সামাদ।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কে জি মুস্তাফাকে লেবাননে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্তি দেন। সে নিযুক্তি কে জি ভাই গ্রহণ করেন। কিন্তু আমি এবং আমার মতো আরও দুই-একজন তার এই সরকারি দায়িত্বে যাওয়াকে মেনে নিতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছিল, সাংবাদিক কে জি মুস্তাফা হারিয়ে যাচ্ছে। সে কথা আমি তাকে খোলাখুলি বলেও ছিলাম। বলেছিলাম, আপনি এই স্বাধীন বাংলাদেশে নতুনভাবে গড়ে তুলবেন সাংবাদিক সমাজকে। তাদের অধিকার ও মর্যাদা সুমন্নত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। এর বদলে সরকারি চাকরি নিয়ে পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এটা কি আপনার জন্য বেশি গৌরবজনক? কে জি ভাই আমার মন্তব্যে খুশি হননি। একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, এ কাজটা এখন তোমরা করো। তোমরা আছ কী জন্য? মনে আছে, প্রেসক্লাব চত্বরে আয়োজিত তার বিদায় সংবর্ধনায় সেদিনের তরুণ সাংবাদিক এনএম হারুণ তার বক্তৃতায় কে জি ভাইয়ের এই নিযুক্তি সম্পর্কে এ ধরনেরই একটি মন্তব্য করেছিলেন। কে জি ভাই তার বক্তব্যে হারুণের নাম নিয়ে তার মন্তব্যের জবাব দিয়েছিলেন।
কে জি ভাই রাষ্ট্রদূত হয়ে লেবাননে চলে গেলেন। বেশ একটা লম্বা সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেন তিনি। তার সঙ্গে আবার আমার কথা হয় ১৯৭৯ সালের জুলাইতে, বাগদাদে। লেবানন থেকে তিনি বদলি হয়ে এসেছিলেন বাগদাদে। এরই মধ্যে দেশে ঘটে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু নিহত হন। ক্ষমতায় আসে নতুন নেতৃত্ব। এর কিছুদিন পরই কে জি মুস্তাফাকে অব্যাহতি দেয়া হয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব থেকে। অব্যাহতি লাভের পর তিনি বাগদাদেই রয়ে যান সরকারি প্রকাশনা একটি সংবাদপত্রে কাজ নিয়ে। বাগদাদে গিয়েই তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইরাকের বিপ্লববার্ষিকী উপলক্ষে সেবার বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম আমি আর ফাজলে রশিদ। আরও ৯০টি দেশের সাংবাদিককে এ উপলক্ষে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই বিপ্লববার্ষিকীতেই ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হাসান আল বকর পদত্যাগ করে সাদ্দাম হোসেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
কে জি ভাই আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে। নিয়ে গিয়েছিলেন ইরাকে কর্মরত বাংলাদেশীরা যে এলাকায় বসবাস করেন সেখানে। নিয়ে গিয়েছিলেন বাগদাদের দর্শনীয় স্থানগুলোতে। মনে হয়েছিল, একজন বড় ভাইয়ের মতো স্নেহে-আদরে তিনি তার দেশের এই দুই ছোট ভাইকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। কে জি ভাই শেষ অব্দি দেশে ফিরে এলেন আশির দশকের মাঝামাঝিতে। সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলেন ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন কাগজে। কিছু লেখালেখিও করলেন পত্র-পত্রিকায়।
১৩ মার্চ ভোরে কে জি ভাই চিরবিদায় নিলেন। দশ বছর আগে আমেরিকায় চলে আসার আগে তাকে অসুস্থ দেখে এসেছিলাম। প্রেসক্লাবে তিনিই একদিন বলেছিলেন তার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির কথা। তাকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না, ভেতরে ভেতরে কতটা ভেঙেছেন তিনি, শরীর কতটা ভেঙে পড়েছে তার।
চলে গেলেন তিনি। সমাপ্তি ঘটল এক সংগ্রামী জীবনের। এত দূর থেকে তার জন্য আর কিছু করার নেই জানি। শুধু জানাতে পারি শেষ সংগ্রামী সালাম।
No comments