মানুষের শত্রুমিত্রঃ হুসেনের পিছে এ কোন তীরন্দাজ? by মাহমুদ শামসুল হক
১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে ইংরেজিতে লেখা একটি বড়সড় পুরনো বই দেখেছিলাম। বইটি এবং এর লেখকের নাম মনে নেই। এর দুটো পাতায় মোটা হলদে কাগজের তালি লাগানো ছিল। তালি তুলতে না পেরে আলোর বিপরীতে ধরেও আড়ালের ছবি দুটো দেখা যায়নি। তালিদাতার উচিত ছিল ছবির ক্যাপশনটিও তালির আওতায় নেয়া কিংবা কালি দিয়ে লেপটে দেয়া।
তাহলে অন্তত পাঠক একটি ঘিনঘিনে অনুভূতির হাত থেকে রেহাই পেতেন। ক্যাপশন পড়ে জানা গেল অদৃশ্য ছবি দুটো মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কল্পিত স্কেচ। পরবর্তী সময়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বইটি পাওয়া যায়নি। এ ধরনের অনেক চিত্রকর্মের খবর জেনেছি বইপুস্তক পড়ে। ১৯৩১ সালে কলকাতার সেন ব্রাদার্স নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। এতে মুদ্রিত হয়েছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি কাল্পনিক ছবি। পুস্তিকাটির স্বত্বাধিকারী ভোলানাথ সেন এবং তার দুই ছেলেকে হত্যা করেছিলেন লাহোরের আবদুল্লাহ ও আমীর আহমদ। হত্যার অপরাধে আদালত তাদের ফাঁসি দেন এবং পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করেন। এরপর ভারতবর্ষের কোথাও মহানবী (সা.)-এর কল্পিত ছবি আঁকার ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটেনি। এ ধরনের উস্কানিমূলক অপকর্মের সর্বশেষ সাড়া জাগানো ঘটনাটি ঘটে ডেনমার্কে। সেখানকার ‘জিল্যান্ডস পোস্টেন’ পত্রিকায় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বারোটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ পায় ২০০৫ সালে। তা নিয়ে স্বভাবতই মুসলিম বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়ে রেহাই পায়। অথচ এসব চিত্রকর, পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশক সবাই জানতেন হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর ছবি আঁকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই আবেগের অবমূল্যায়ন মানে সংঘাত—এ কথাও তারা জানতেন। এও জানতেন, এ ধরনের অপ্রয়াস রুখে দিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রেই প্রস্তুত থাকেন। সম্ভবত তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে মুসলমানদের বিশ্বাস কতটা মজবুত তা পরখ করতে চেয়েছেন।
এত সবের পরও এসব ছবির আঁকিয়ে ও প্রকাশকরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলেছিলেন; কিন্তু তা ধোপে টেকেনি এ জন্য যে, প্রকৃত শিল্পী অযাচিতভাবে কোনো সম্প্রদায়, গোত্র বা ব্যক্তির বিশ্বাসকে আহত করার জন্য উস্কানিমূলক কিছু রূপায়িত করেন না। কারণ অন্যদের মতো তিনিও জানেন, মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু সর্বত্রই শৃঙ্খলিত। ফ্রিডম আর লিবার্টি এক কথা নয়। অন্যকে অহেতুক বিপন্ন বিড়ম্বিত করে কোনো কাজই স্বাধীনতার সমার্থক নয়। এ অর্থে শিল্পী তার সব কল্পনাকেই মূর্ত করার অসীম অধিকার রাখেন না।
সম্প্রতি ভারতের বিশ্রুত চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেন হিন্দুদের আরাধ্য দেবীর নগ্ন চিত্র এঁকে বিশেষ বিশেষ মহলের রোষানলে পড়েছেন। তাকে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছে হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক একাধিক সংগঠন। কয়েকবার তার ওপর হামলাও চালানো হয়েছে। মেরে ফেলার হুমকি বহন করে অনেকটা অভিমান করেই হুসেন ভারত ছেড়ে কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে হুসেনের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলো বলছে, শিল্পীর তকমা পরে হুসেন হিন্দু দেবীদের নগ্ন ছবি এঁকে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। শিল্পীর স্বাধীনতার নামে একজন মুসলমান চিত্রকরের এ কাজ উস্কানিমূলক। ভারতীয় ঐতিহ্যে নগ্ন দেবদেবী বা নগ্নিকার রূপায়ণ সিদ্ধ হলেও হুসেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দেবী সরস্বতীকে বেছে নিয়েছেন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতিকে তুচ্ছ বিবেচনা করেছেন। কাজেই এ অপরাধে গুরুদণ্ড তার প্রাপ্য। অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি এবং রাজনীতিকরা মৌলবাদীদের এই ব্যাখ্যা আমলে নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ তো বটেই, গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শকেও বিনষ্ট করতে চাইছে। উদার হিন্দু পণ্ডিতরা বলছেন, দেবীদের মাতৃসত্তা প্রকৃতির মতোই নিরাবরণ। দেবী জননীসমা, ভক্তরা সবাই তার কাছে শিশুতুল্য। সে অর্থেই অনেক দেবী বিগ্রহ নগ্নরূপে প্রকাশিত। এদিক থেকে শিল্পী হুসেন নির্দোষ। তিনি ভারতীয় চারুশিল্পের ঐতিহ্যকেই ধারণ করেছেন তার আঁকা ছবিতে। হুসেনের শুভার্থী শিল্পীরা বলছেন, যে কোনো নগ্ন শিল্পকর্মের বিচার করার আগে ন্যুড ও ন্যাকেডের পার্থক্য বুঝতে হবে। অর্থাত্ নগ্ন (ঘঁফব) ও উলঙ্গ (ঘধশবফ) এক বিষয় নয়। হুসেন দেবীকে নগ্ন করে দেখেছেন, উলঙ্গ করে নয়। আসলে বিচার্য বিষয় হচ্ছে, সত্যিই হুসেন কোনো ধর্মনৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ কাজ করেছেন কিনা। হুসেনের বয়স এখন পঁচানব্বই। এ বয়সে এসে শিল্পের সঙ্গে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের সম্পর্ক তিনি রক্ষা করতে জানেন না এটা মেনে নেয়া কঠিন। এদিকে বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিশেষত সিপিআইএম একাধারে ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় হুসেনকে ভারতে ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন সরকারের কাছে। তাদের অনেকে গ্রিক, রোম, মিসর, ভারত এমনকি বাংলার প্রাচীন চারুকর্মের ঐতিহ্যের প্রসঙ্গও এনেছেন। তারা সবচেয়ে বড় করে দেখছেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শের বিষয়টিকে। সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এও বলেছেন অনেকে, হুসেনের আঁকা একটি চিত্রকর্মকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে কোনো সংগঠন বা সরকার ফায়দা লুটতে চাইলে তা হবে আত্মঘাতের শামিল।
বস্তুত, কয়েকটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া এখন সবাই চাইছেন ভারতের গৌরব তথা জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক হুসেন সরকারের তত্ত্বাবধানে নিরাপদে এবং নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা মুক্ত অবস্থায় ফিরে আসুক মাতৃভূমিতে। এই নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এত সবের পরও এসব ছবির আঁকিয়ে ও প্রকাশকরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলেছিলেন; কিন্তু তা ধোপে টেকেনি এ জন্য যে, প্রকৃত শিল্পী অযাচিতভাবে কোনো সম্প্রদায়, গোত্র বা ব্যক্তির বিশ্বাসকে আহত করার জন্য উস্কানিমূলক কিছু রূপায়িত করেন না। কারণ অন্যদের মতো তিনিও জানেন, মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু সর্বত্রই শৃঙ্খলিত। ফ্রিডম আর লিবার্টি এক কথা নয়। অন্যকে অহেতুক বিপন্ন বিড়ম্বিত করে কোনো কাজই স্বাধীনতার সমার্থক নয়। এ অর্থে শিল্পী তার সব কল্পনাকেই মূর্ত করার অসীম অধিকার রাখেন না।
সম্প্রতি ভারতের বিশ্রুত চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেন হিন্দুদের আরাধ্য দেবীর নগ্ন চিত্র এঁকে বিশেষ বিশেষ মহলের রোষানলে পড়েছেন। তাকে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছে হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক একাধিক সংগঠন। কয়েকবার তার ওপর হামলাও চালানো হয়েছে। মেরে ফেলার হুমকি বহন করে অনেকটা অভিমান করেই হুসেন ভারত ছেড়ে কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে হুসেনের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলো বলছে, শিল্পীর তকমা পরে হুসেন হিন্দু দেবীদের নগ্ন ছবি এঁকে হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। শিল্পীর স্বাধীনতার নামে একজন মুসলমান চিত্রকরের এ কাজ উস্কানিমূলক। ভারতীয় ঐতিহ্যে নগ্ন দেবদেবী বা নগ্নিকার রূপায়ণ সিদ্ধ হলেও হুসেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দেবী সরস্বতীকে বেছে নিয়েছেন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতিকে তুচ্ছ বিবেচনা করেছেন। কাজেই এ অপরাধে গুরুদণ্ড তার প্রাপ্য। অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি এবং রাজনীতিকরা মৌলবাদীদের এই ব্যাখ্যা আমলে নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ তো বটেই, গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শকেও বিনষ্ট করতে চাইছে। উদার হিন্দু পণ্ডিতরা বলছেন, দেবীদের মাতৃসত্তা প্রকৃতির মতোই নিরাবরণ। দেবী জননীসমা, ভক্তরা সবাই তার কাছে শিশুতুল্য। সে অর্থেই অনেক দেবী বিগ্রহ নগ্নরূপে প্রকাশিত। এদিক থেকে শিল্পী হুসেন নির্দোষ। তিনি ভারতীয় চারুশিল্পের ঐতিহ্যকেই ধারণ করেছেন তার আঁকা ছবিতে। হুসেনের শুভার্থী শিল্পীরা বলছেন, যে কোনো নগ্ন শিল্পকর্মের বিচার করার আগে ন্যুড ও ন্যাকেডের পার্থক্য বুঝতে হবে। অর্থাত্ নগ্ন (ঘঁফব) ও উলঙ্গ (ঘধশবফ) এক বিষয় নয়। হুসেন দেবীকে নগ্ন করে দেখেছেন, উলঙ্গ করে নয়। আসলে বিচার্য বিষয় হচ্ছে, সত্যিই হুসেন কোনো ধর্মনৈতিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ কাজ করেছেন কিনা। হুসেনের বয়স এখন পঁচানব্বই। এ বয়সে এসে শিল্পের সঙ্গে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের সম্পর্ক তিনি রক্ষা করতে জানেন না এটা মেনে নেয়া কঠিন। এদিকে বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিশেষত সিপিআইএম একাধারে ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভায় হুসেনকে ভারতে ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন সরকারের কাছে। তাদের অনেকে গ্রিক, রোম, মিসর, ভারত এমনকি বাংলার প্রাচীন চারুকর্মের ঐতিহ্যের প্রসঙ্গও এনেছেন। তারা সবচেয়ে বড় করে দেখছেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শের বিষয়টিকে। সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এও বলেছেন অনেকে, হুসেনের আঁকা একটি চিত্রকর্মকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে কোনো সংগঠন বা সরকার ফায়দা লুটতে চাইলে তা হবে আত্মঘাতের শামিল।
বস্তুত, কয়েকটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া এখন সবাই চাইছেন ভারতের গৌরব তথা জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক হুসেন সরকারের তত্ত্বাবধানে নিরাপদে এবং নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা মুক্ত অবস্থায় ফিরে আসুক মাতৃভূমিতে। এই নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
No comments