বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৯৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল মান্নান, বীর প্রতীক সাহসী এক প্রতিরোধযোদ্ধা আবদুল মান্নান ইপিআরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও ৯ উইংয়ের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) পঞ্চগড় কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে সেপাই হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২৫ মার্চের কয়েক দিন আগে তাঁকে চোপড়ামারী ক্যাম্পে বদলি করা হয়। এর অবস্থান ছিল বোদা উপজেলার বড়শশীতে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। সেখানে তাঁরা নয়জন ছিলেন—পাঁচজন বাঙালি আর চারজন পাকিস্তানি।
আবদুল মান্নানের একটা ব্যক্তিগত রেডিও ছিল। ২৫ মার্চ রাতে রেডিওর খবর শোনা নিয়ে পাকিস্তানি হাবিলদারের (মোঘল বাজ) সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার জন্য হাবিলদার তাঁকে রাতে বন্দী এবং পরদিন সকালে ক্যাম্পের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে।
এ সময় পাশের ডানাকাটা ক্যাম্পের মতিউর রহমান (নায়েব সুবেদার) তাঁদের ক্যাম্পে আসেন। তিনি বলেন, ‘দেশে যুদ্ধ লেগেছে। এখানকার পাকিস্তানিদের তোমরা শেষ করে দাও।’ এরপর তিনি ও আরেকজন (শরাফত) মিলে সুযোগ বুঝে তিনজন পাকিস্তানিকে গুলি করে হত্যা করেন। একজনকে এলাকার সাধারণ মানুষ মেরে ফেলে।
আবদুল মান্নান ২৯ মার্চ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে দিনাজপুরের ভাতগাঁও সেতুতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। সেখানে তাঁরা টিকে থাকতে পারেননি। পরে তাঁরা কান্তা ফার্মে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
৮ এপ্রিল সকাল থেকে ইপিআর সেনা রহমান, গাড়িচালক সাত্তার ও তিনি কান্তা ফার্মের সামনে টিলার মধ্যে এক ব্যাংকারে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। সন্ধ্যার দিকে তাঁদের গুলি শেষ হয়ে যায়। এ সময় গুলি সংগ্রহের জন্য ব্যাংকার থেকে বের হলে তাঁর সহযোদ্ধা সাত্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে রহমান ও তিনি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আটক করে।
পাকিস্তানি সেনারা তখনই তাঁদের হত্যা না করে প্রথমে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাঠায়। ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে রংপুর উপশহরের এক পুকুরপাড়ে তাঁদের দুজনসহ অনেককে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে। এর আগে তাঁদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন।
আবদুল মান্নানের পিঠে ও হাতে গুলি লাগে। পিঠের গুলি বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এরপর তিনি মরার মতো পড়ে থাকেন। তাঁর সহযোদ্ধা রহমানসহ সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যান। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে রাতে তিনি কোনো রকমে পাশের পাইলছড়া গ্রামে যান।
ওই গ্রামের রুস্তম আলী নামের এক মাওলানা স্থানীয়ভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি তাঁকে গ্রামেই লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হননি। তাঁর ক্ষতস্থানে পচন ধরে। হাঁটাচলা করার মতো শক্তিও ছিল না তাঁর। দুই মাস পর গ্রামের লোকজন তাঁকে ভারতের তরঙ্গপুর ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁকে গাড়িতে করে তেঁতুলিয়ায় পাঠালে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা সবাই মনে করেছিলেন তিনি বেঁচে নেই।
সহযোদ্ধারা তাঁকে তেঁতুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর তাঁকে ভারতের কল্যাণী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বাগডোগরা সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে ভারতের লক্ষৌ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। এই হাসপাতালে থাকাবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে প্রতিরোধযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুুল মান্নানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫৪।
আবদুল মান্নান স্বাধীনতার পর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে ২০০৩ সালে নায়েক হিসেবে অবসর নেন। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদনগর গ্রামে। বর্তমানে স্থায়ীভাবে বাস করেন পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে। বাবার নাম মো. শফিউল্লাহ, মা ফয়েজুননেছা। স্ত্রী তনজিনা খাতুন। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: আবদুল মান্নান বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন প্রথম আলোর পঞ্চগড় প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
আবদুল মান্নানের একটা ব্যক্তিগত রেডিও ছিল। ২৫ মার্চ রাতে রেডিওর খবর শোনা নিয়ে পাকিস্তানি হাবিলদারের (মোঘল বাজ) সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার জন্য হাবিলদার তাঁকে রাতে বন্দী এবং পরদিন সকালে ক্যাম্পের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে।
এ সময় পাশের ডানাকাটা ক্যাম্পের মতিউর রহমান (নায়েব সুবেদার) তাঁদের ক্যাম্পে আসেন। তিনি বলেন, ‘দেশে যুদ্ধ লেগেছে। এখানকার পাকিস্তানিদের তোমরা শেষ করে দাও।’ এরপর তিনি ও আরেকজন (শরাফত) মিলে সুযোগ বুঝে তিনজন পাকিস্তানিকে গুলি করে হত্যা করেন। একজনকে এলাকার সাধারণ মানুষ মেরে ফেলে।
আবদুল মান্নান ২৯ মার্চ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে দিনাজপুরের ভাতগাঁও সেতুতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁদের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। সেখানে তাঁরা টিকে থাকতে পারেননি। পরে তাঁরা কান্তা ফার্মে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
৮ এপ্রিল সকাল থেকে ইপিআর সেনা রহমান, গাড়িচালক সাত্তার ও তিনি কান্তা ফার্মের সামনে টিলার মধ্যে এক ব্যাংকারে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। সন্ধ্যার দিকে তাঁদের গুলি শেষ হয়ে যায়। এ সময় গুলি সংগ্রহের জন্য ব্যাংকার থেকে বের হলে তাঁর সহযোদ্ধা সাত্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে রহমান ও তিনি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আটক করে।
পাকিস্তানি সেনারা তখনই তাঁদের হত্যা না করে প্রথমে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাঠায়। ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে রংপুর উপশহরের এক পুকুরপাড়ে তাঁদের দুজনসহ অনেককে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে। এর আগে তাঁদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন।
আবদুল মান্নানের পিঠে ও হাতে গুলি লাগে। পিঠের গুলি বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এরপর তিনি মরার মতো পড়ে থাকেন। তাঁর সহযোদ্ধা রহমানসহ সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যান। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে রাতে তিনি কোনো রকমে পাশের পাইলছড়া গ্রামে যান।
ওই গ্রামের রুস্তম আলী নামের এক মাওলানা স্থানীয়ভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি তাঁকে গ্রামেই লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হননি। তাঁর ক্ষতস্থানে পচন ধরে। হাঁটাচলা করার মতো শক্তিও ছিল না তাঁর। দুই মাস পর গ্রামের লোকজন তাঁকে ভারতের তরঙ্গপুর ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁকে গাড়িতে করে তেঁতুলিয়ায় পাঠালে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা সবাই মনে করেছিলেন তিনি বেঁচে নেই।
সহযোদ্ধারা তাঁকে তেঁতুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর তাঁকে ভারতের কল্যাণী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বাগডোগরা সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে ভারতের লক্ষৌ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। এই হাসপাতালে থাকাবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে প্রতিরোধযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুুল মান্নানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫৪।
আবদুল মান্নান স্বাধীনতার পর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে ২০০৩ সালে নায়েক হিসেবে অবসর নেন। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদনগর গ্রামে। বর্তমানে স্থায়ীভাবে বাস করেন পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে। বাবার নাম মো. শফিউল্লাহ, মা ফয়েজুননেছা। স্ত্রী তনজিনা খাতুন। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: আবদুল মান্নান বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন প্রথম আলোর পঞ্চগড় প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments