সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি তো শুরু হয়ে গেছে by আবদুল মান্নান
ঈদের বন্ধে ঢাকার বাইরে গিয়ে মনে হলো কোন কোন এলাকায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে, যদিও নির্বাচনের এখনও এক বছরের বেশি সময় বাকি। চট্টগ্রামের একটি আসন হতে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান বলে ঘোষণা করেছেন।
কল্যাণ পার্টি বিগত সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ৩৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জামানত খুইয়েছিল। এবার যদি ১৮ দলের কাঁদে চড়ে দু’একটা আসন পাওয়া যায় ক্ষতি কি? রাজনীতি পাগল বাঙালি রাজনীতি করার সুযোগ পেলেই তা আর হাতছাড়া করতে চান না। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায় রমজানের সময় ইফতারের আর ঈদের সময় ঈদ মোবারকের রাজনীতি। ইফতারের রাজনীতি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। ইফতার রমজানের পবিত্রতম মুহূর্ত। এই মুহূর্তটাকে সামনে নিয়ে ইবাদত বন্দেগী করার কথা। তা সব সময় দেখা যায় না। জামায়াত এই বছর সারা দেশে নাকি চার হাজার ইফতার সমাবেশ করেছে এবং সেখানে তাদের যে সব নেতা বর্তমানে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছে তাদের মুক্তি দাবি করেছে। এমন একটি মাহফিলে বেগম জিয়াও শামিল হয়েছিলেন। সেখানেও তিনি জামায়াতের মোনাজাতে শামিল হয়ে বর্তমান ‘জালেম’ সরকারের পতন কামনা করেছেন এবং আমিন আমিন করে একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযম আর নিজামীর মুক্তি দাবি করেছেন। সেই মাহফিলে আবার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। বিএনপি প্রধান তাদের দলীয় ইফতার আয়োজনে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ইফতার আয়োজনে রাজনীতি বিষয়ে কিছু না বললেও দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য দোয়া করেছেন। তারা আবার একে অন্যের ইফতারে অংশগ্রহণ করা হতে বিরত থেকেছেন।
রমজানের শেষে আসে ঈদ। এ সময় অনেকেই বাড়ি ফেরেন। শুধু ঢাকা ছেড়েছিলেন সত্তর লাখ মানুষ। এই সুযোগে অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বাড়ি যান এবং নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অনেকে নিজ এলাকায় রঙিন পোস্টার লাগিয়ে এলাকার মানুষকে ঈদ মোবারক জানিয়েছেন। এটি হচ্ছে রাজনীতির ঈদ মোবারক। কারণ সামনে সংসদ নির্বাচন। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আর একটি রমজান ও ঈদ পাওয়া যাবে, তবে তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি হবে এখন তা বলা মুশকিল। আলামত যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সামনের দিনগুলো তেমন একটা শান্তিপূর্ণভাবে যাবে না। ইতোমধ্যে বিএনপি ঘোষণা করেছে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে থাকবে। আগামী বছর নাগাদ জামায়াতের যেসব নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বর্তমানে বিচারের কাঠগড়ায় আছেন তাদের কয়েকজনের রায় ঘোষিত হতে পারে। বলাবাহুল্য, এই বিচার ব্যবস্থাকে বানচাল করার জন্য জামায়াত ইতোমধ্যে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এই বাবদ তারা তাদের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উৎস হতে কয়েক কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে এবং তা দু’হাতে খরচ করছে। তাদের সঙ্গে আছে বিএনপির দলীয় এবং সাংগঠনিক শক্তি। এই ঈদে তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল সমাবেশ ও গণসংযোগ করেছে, পোস্টার লাগিয়েছে আর তাদের নেতাদের মুক্তি দাবি করেছে। এবার তারা সঙ্গে পেয়েছে তাদের নতুন দোসর হিযবুত তাহরীর। উভয়ের লক্ষ্য অভিন্ন। বর্তমান মহাজোট সরকারকে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত করা, দেশকে আবার জঙ্গীবাদের দিকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশকে পুনরায় ধর্মীয় মৌলবাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে তোলার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা। এই ক্ষেত্রেও তাদের সঙ্গে আছে বিএনপি। বুঝতে হবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে লড়তে হবে সর্ব প্রকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে যেটি এককভাবে তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে অনেকের সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছি। এই বিষয়ে তাদের মতামত মিশ্র। তবে সকলে একমত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের যে বিশাল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তা এখন অনেকাংশে ক্ষয় হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দল সরকারে থাকে তারা কদাচিৎ তাদের পক্ষে জনগণের সার্বিক সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হয়। সাধারণত বিরোধী দল জনগণের সামনে নিজেদের সরকারী দলের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা ঘটেছে বলা যাবে না। বর্তমান সরকারবিরোধী প্রধান মোর্চা বিএনপি-জামায়াত জোট এর আগে দু’দফায় দশ বছর দেশ শাসন করেছে। এই দশ বছরে তারা দেশকে সুশাসন উপহার দিতে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে। এই সময় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সে সময় হাওয়া ভবনের বদৌলতে দুর্নীতি একটি সূক্ষ্ম শিল্পে পরিণত হয়েছিল। এই সব কিছুকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে চারদলীয় জোট সরকার তাদের ২০০১-২০০৬ এর শাসনকালকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। সুতরাং দেশের মানুষ এই ব্যাপারেও অনেকটা নিশ্চিত আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারের বিকল্প হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার হতে পারে না। তারা ক্ষমতায় এলে আবার দেশ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে এবং এবার যদি তারা ক্ষমতায় ফিরে আসে দেশে ২০০১ সালের চাইতেও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং অনেক মানুষের প্রাণহানিও হতে পারে, দেশত্যাগ করতে পারে কয়েক লাখ মানুষ। ঠিক এমনটি ঘটেছিল ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তীকালে। তা হলে অন্য বিকল্পটা কি? এ প্রসঙ্গে দু’একটি প্রভাবশালী দেশের মাঝারি পর্র্যায়ের কূটনৈতিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারা এই প্রশ্নের কোন সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেছেন তারা তাদের ভাষায় তৃতীয় কোন রাজনৈতিক শক্তিকে সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতী। তারা অবশ্য এও মনে করেন বর্তমান অবস্থায় এই শক্তি যে উঠে দাঁড়াতে পারবে তা তারা মনে করছেন না। তাদের আরেকটি মূল্যবান পর্যবেক্ষণ হচ্ছেÑযদি কোন কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা নেত্রী এই তৃতীয় শক্তির সঙ্গে গাঁটচড়া বাঁধতে পারে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ হতেও কিছু মনোনয়ন বঞ্চিত গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী এই শক্তির সঙ্গে ভিড়তে পারে। তখন সার্বিক সমীকরণ কিছুটা হলেও পাল্টে যেতে পারে। তবে এই কূটনৈতিক কর্মকর্তারা এও বলেছেন, তারা কোন অবস্থায় বাংলাদেশ আবার জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হোক তা দেখতে চান না। তারা এও স্বীকার করেন, বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে তারা বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার দেখতে চান। তাদের মতে, তৃতীয় শক্তির (সেটি সামরিক শক্তি নয়) অবর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শক্তি হচ্ছে মন্দের ভাল। তবে মন্দের ভালকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে হলে তাদের হৃত অবস্থানের কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান যে ২০০৮-এর জায়গায় নেই তা স্বয়ং দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন।
যে সব সাধারণ মানুষের সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে তাদের অনেকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খবর আছে। কেন খবর আছে তা জানতে চাইলে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের বেশ কিছু অভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দলীয় নেতাকর্মীর লাগামহীন দুর্বৃত্তপনা অন্যতম। এছাড়াও আছে দলীয় কোন্দল, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং তাদের জনবিচ্ছিন্নতা। দলে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যিনি দলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, মন্ত্রিসভার সদস্যও কিন্তু নিজ এলাকার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। মাঝেমধ্যে এলাকায় যান, স্থানীয় সার্কিট হাউসে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করেন, দু’চারজন স্থানীয় টাউট বাটপাড়ের সঙ্গে আলাপ করেন, তারপর ঢাকায় ফিরে যান। ওই এলাকার মানুষের প্রশ্ন, এমন মানুষকে কেন পুনরায় নির্বাচন করতে হবে? এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দলে এবং সরকারে অজস্র আছেন। সামনের বার এসব ব্যক্তি যে আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে উঠবে তা বলাবাহুল্য। অনেকে শেয়ারবাজারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এই বিষয়ে সরকারের কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি, তবে নির্বাচনে তার একটা মন্দ প্রভাব অবশ্যই পড়বে। আলাপকালে অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি বর্তমান সরকারের অনেক বড় বড় অর্জন সম্পর্কে তাদের কিছু জানা আছে কিনা? না তেমন একটা নেই। কেন নেই? তার প্রধান কারণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সব সময় প্রচারে প্রচ- দুর্বল ও ব্যর্থ। দলটি সরকারে গেলেও তাদের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে না। এই অবস্থাটি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল থেকে হয়ে আসছে। ঠিক তার উল্টো চিত্র হচ্ছে বিএনপিতে। প্রতিদিন টিভি খুললেই দেখা যাবে তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখরা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে জনগণের সামনে হাজারো বিষয় উপস্থাপন করছেন যার জবাবে বস্তুনিষ্ঠভাবে কিছু বলার জন্য আওয়ামী লীগের কাউকে তেমন একটা পাওয়া যায় না। আর মধ্যরাতের টিভি টকশোগুলো তো দীর্ঘদিন ধরে শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের যে ক’টি দুর্বল মন্ত্রণালয় আছে তার অন্যতম হচ্ছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এর ফলে যেটি হয়েছে বর্তমানে দেশের সব মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সরকার হতে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। সম্ভবত তথ্য মন্ত্রণালয় এই সত্যটা উপলব্ধি করতে অক্ষম যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী।
১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পিছনে অনেক কারণ ছিল, যার মধ্যে মিডিয়ার ভূমিকা অন্যতম। একটি উদাহরণ দেই। বর্তমানে দেশের পত্রপত্রিকা বা টিভি খুললেই প্রথমে যে সংবাদটি পাঠক বা দর্শকের সামনে আসে তা হচ্ছে ড. ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ক। ভাল হোক আর মন্দ হোক এই বিষয়ে সরকারের একটি অবস্থান আছে। এ যাবত সরকারের অবস্থানটি কি তা ঠা-া মাথায় সরকারের পক্ষ হতে কখনও কাউকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে দেখা যায় না। অর্থমন্ত্রী এই প্রসঙ্গে যা বলেন তা হিতে বিপরীত হয়, কারণ তিনি সব সময় রাগান্বিত ও উত্তেজিত থাকেন। এটি তো অস্বীকার করার কোন কারণ নেই শহুরে শিক্ষিত মানুষের মাঝে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে এবং এই শিক্ষিত মানুষগুলো বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে মতামত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অথচ এই বিষয়টি ইতোমধ্যে বিএনপি লুফে নিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে আগামীতে ক্ষমতায় এলে তারা ড. ইউনূসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবে। তার বিপরীতে সরকারী দলের একজনকেও পাওয়া যায় না এটি বলতে যে, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের নেত্রী অথবা অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কী ভাষায় ড. ইউনূসকে অপমান করতেন। সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি করলে ড. ইউনূস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, দিনটি একটি কালো দিন এবং তিনি এও প্রত্যাশা করেছেন আগামীতে সরকার পরিবর্তন হলে (বিএনপি ক্ষমতায় এলে?) সব কিছু আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। আগেও বলেছি, আবারও বলি, সরকারের গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে সব পদক্ষেপেই এক ধরনের আনাড়িপনা ছিল (ড. ইউনূসের বেলায়ও তা সত্য) এবং অযথা এর পিছনে শক্তি ক্ষয় করেছে। পুরো বিষয়টা নিয়ে যিনি বা যারা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তারা হয়তো সরকারকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছেন যা তারা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন না।
এই যে সরকারের বিরোধী শক্তি আগামী নির্বাচনের জন্য এত আগ হতে (এটিই যথার্র্থ) প্রস্তুতি শুরু করেছে তার বিপরীতে সরকারী দলের নেতা-নেত্রীরা কি করছেন? দৃশ্যমান কিছুই না। বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে অন্তর্দলীয় কোন্দল আছে তা দলকে ভরাডুবির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে অনেকের ধারণা। দ্রুত এর একটি সুরাহা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। চট্টগ্রামে বিবদমান পক্ষগুলো একসঙ্গে হওয়ার একটা দুর্বল চেষ্টা করেছে। দুর্বল এই কারণেই বলছি জাতীয় শোক দিবস পালন ছাড়া সাংগঠনিকভাবে তারা আর একসঙ্গে হতে পারেনি। ২১ আগস্ট উপলক্ষে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাড়া অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাকে সভায় দেখা যায়নি। এটি কোন্দল দূরীভূত হওয়ার লক্ষণ নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ শহরে আওয়ামী লীগ একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেÑযার ফলে বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী শোচনীয়ভাবে একজন অখ্যাত সাবেক ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে পরাজিত হয়েছেন। অথচ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে এখনও আওয়ামী লীগ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। এমন অবস্থা প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায়।
আওয়ামী লীগ হয়তো বুঝতে পারছে না যে, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেও তাদের অনেক নেতাকর্মী ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। কৌশল হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে ভাল। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগও যদি অবিলম্বে তাদের প্রস্তুতি শুরু না করে তাহলে তা হবে চরম বোকামি। ১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পিছনে ছিল তাদের এক ধরনের গাছাড়া ভাব। যেখানে বিএনপির ৩০০ আসনে দেয়ার মতো প্রার্থী ছিল না, সেখানে তাদের সরকার গঠন ছিল এক বড় ধরনের চমক লাগানো ঘটনা। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না চাইলে এখন থেকেই সংগঠনটিকে শক্তিশালী করে প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া উচিত। এর ব্যত্যয় ঘটলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক।
রমজানের শেষে আসে ঈদ। এ সময় অনেকেই বাড়ি ফেরেন। শুধু ঢাকা ছেড়েছিলেন সত্তর লাখ মানুষ। এই সুযোগে অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বাড়ি যান এবং নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অনেকে নিজ এলাকায় রঙিন পোস্টার লাগিয়ে এলাকার মানুষকে ঈদ মোবারক জানিয়েছেন। এটি হচ্ছে রাজনীতির ঈদ মোবারক। কারণ সামনে সংসদ নির্বাচন। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আর একটি রমজান ও ঈদ পাওয়া যাবে, তবে তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি হবে এখন তা বলা মুশকিল। আলামত যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সামনের দিনগুলো তেমন একটা শান্তিপূর্ণভাবে যাবে না। ইতোমধ্যে বিএনপি ঘোষণা করেছে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে থাকবে। আগামী বছর নাগাদ জামায়াতের যেসব নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বর্তমানে বিচারের কাঠগড়ায় আছেন তাদের কয়েকজনের রায় ঘোষিত হতে পারে। বলাবাহুল্য, এই বিচার ব্যবস্থাকে বানচাল করার জন্য জামায়াত ইতোমধ্যে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এই বাবদ তারা তাদের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উৎস হতে কয়েক কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে এবং তা দু’হাতে খরচ করছে। তাদের সঙ্গে আছে বিএনপির দলীয় এবং সাংগঠনিক শক্তি। এই ঈদে তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল সমাবেশ ও গণসংযোগ করেছে, পোস্টার লাগিয়েছে আর তাদের নেতাদের মুক্তি দাবি করেছে। এবার তারা সঙ্গে পেয়েছে তাদের নতুন দোসর হিযবুত তাহরীর। উভয়ের লক্ষ্য অভিন্ন। বর্তমান মহাজোট সরকারকে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত করা, দেশকে আবার জঙ্গীবাদের দিকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশকে পুনরায় ধর্মীয় মৌলবাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে তোলার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা। এই ক্ষেত্রেও তাদের সঙ্গে আছে বিএনপি। বুঝতে হবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে লড়তে হবে সর্ব প্রকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে যেটি এককভাবে তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে অনেকের সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছি। এই বিষয়ে তাদের মতামত মিশ্র। তবে সকলে একমত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের যে বিশাল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তা এখন অনেকাংশে ক্ষয় হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দল সরকারে থাকে তারা কদাচিৎ তাদের পক্ষে জনগণের সার্বিক সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হয়। সাধারণত বিরোধী দল জনগণের সামনে নিজেদের সরকারী দলের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা ঘটেছে বলা যাবে না। বর্তমান সরকারবিরোধী প্রধান মোর্চা বিএনপি-জামায়াত জোট এর আগে দু’দফায় দশ বছর দেশ শাসন করেছে। এই দশ বছরে তারা দেশকে সুশাসন উপহার দিতে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে। এই সময় বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সে সময় হাওয়া ভবনের বদৌলতে দুর্নীতি একটি সূক্ষ্ম শিল্পে পরিণত হয়েছিল। এই সব কিছুকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে চারদলীয় জোট সরকার তাদের ২০০১-২০০৬ এর শাসনকালকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। সুতরাং দেশের মানুষ এই ব্যাপারেও অনেকটা নিশ্চিত আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারের বিকল্প হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার হতে পারে না। তারা ক্ষমতায় এলে আবার দেশ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে এবং এবার যদি তারা ক্ষমতায় ফিরে আসে দেশে ২০০১ সালের চাইতেও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং অনেক মানুষের প্রাণহানিও হতে পারে, দেশত্যাগ করতে পারে কয়েক লাখ মানুষ। ঠিক এমনটি ঘটেছিল ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তীকালে। তা হলে অন্য বিকল্পটা কি? এ প্রসঙ্গে দু’একটি প্রভাবশালী দেশের মাঝারি পর্র্যায়ের কূটনৈতিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারা এই প্রশ্নের কোন সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেছেন তারা তাদের ভাষায় তৃতীয় কোন রাজনৈতিক শক্তিকে সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতী। তারা অবশ্য এও মনে করেন বর্তমান অবস্থায় এই শক্তি যে উঠে দাঁড়াতে পারবে তা তারা মনে করছেন না। তাদের আরেকটি মূল্যবান পর্যবেক্ষণ হচ্ছেÑযদি কোন কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা নেত্রী এই তৃতীয় শক্তির সঙ্গে গাঁটচড়া বাঁধতে পারে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ হতেও কিছু মনোনয়ন বঞ্চিত গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী এই শক্তির সঙ্গে ভিড়তে পারে। তখন সার্বিক সমীকরণ কিছুটা হলেও পাল্টে যেতে পারে। তবে এই কূটনৈতিক কর্মকর্তারা এও বলেছেন, তারা কোন অবস্থায় বাংলাদেশ আবার জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হোক তা দেখতে চান না। তারা এও স্বীকার করেন, বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে তারা বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার দেখতে চান। তাদের মতে, তৃতীয় শক্তির (সেটি সামরিক শক্তি নয়) অবর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শক্তি হচ্ছে মন্দের ভাল। তবে মন্দের ভালকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে হলে তাদের হৃত অবস্থানের কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান যে ২০০৮-এর জায়গায় নেই তা স্বয়ং দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন।
যে সব সাধারণ মানুষের সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে তাদের অনেকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খবর আছে। কেন খবর আছে তা জানতে চাইলে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের বেশ কিছু অভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দলীয় নেতাকর্মীর লাগামহীন দুর্বৃত্তপনা অন্যতম। এছাড়াও আছে দলীয় কোন্দল, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং তাদের জনবিচ্ছিন্নতা। দলে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যিনি দলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, মন্ত্রিসভার সদস্যও কিন্তু নিজ এলাকার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। মাঝেমধ্যে এলাকায় যান, স্থানীয় সার্কিট হাউসে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করেন, দু’চারজন স্থানীয় টাউট বাটপাড়ের সঙ্গে আলাপ করেন, তারপর ঢাকায় ফিরে যান। ওই এলাকার মানুষের প্রশ্ন, এমন মানুষকে কেন পুনরায় নির্বাচন করতে হবে? এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দলে এবং সরকারে অজস্র আছেন। সামনের বার এসব ব্যক্তি যে আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে উঠবে তা বলাবাহুল্য। অনেকে শেয়ারবাজারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এই বিষয়ে সরকারের কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি, তবে নির্বাচনে তার একটা মন্দ প্রভাব অবশ্যই পড়বে। আলাপকালে অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি বর্তমান সরকারের অনেক বড় বড় অর্জন সম্পর্কে তাদের কিছু জানা আছে কিনা? না তেমন একটা নেই। কেন নেই? তার প্রধান কারণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সব সময় প্রচারে প্রচ- দুর্বল ও ব্যর্থ। দলটি সরকারে গেলেও তাদের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে না। এই অবস্থাটি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল থেকে হয়ে আসছে। ঠিক তার উল্টো চিত্র হচ্ছে বিএনপিতে। প্রতিদিন টিভি খুললেই দেখা যাবে তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখরা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে জনগণের সামনে হাজারো বিষয় উপস্থাপন করছেন যার জবাবে বস্তুনিষ্ঠভাবে কিছু বলার জন্য আওয়ামী লীগের কাউকে তেমন একটা পাওয়া যায় না। আর মধ্যরাতের টিভি টকশোগুলো তো দীর্ঘদিন ধরে শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের যে ক’টি দুর্বল মন্ত্রণালয় আছে তার অন্যতম হচ্ছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এর ফলে যেটি হয়েছে বর্তমানে দেশের সব মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সরকার হতে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। সম্ভবত তথ্য মন্ত্রণালয় এই সত্যটা উপলব্ধি করতে অক্ষম যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী।
১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পিছনে অনেক কারণ ছিল, যার মধ্যে মিডিয়ার ভূমিকা অন্যতম। একটি উদাহরণ দেই। বর্তমানে দেশের পত্রপত্রিকা বা টিভি খুললেই প্রথমে যে সংবাদটি পাঠক বা দর্শকের সামনে আসে তা হচ্ছে ড. ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ক। ভাল হোক আর মন্দ হোক এই বিষয়ে সরকারের একটি অবস্থান আছে। এ যাবত সরকারের অবস্থানটি কি তা ঠা-া মাথায় সরকারের পক্ষ হতে কখনও কাউকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে দেখা যায় না। অর্থমন্ত্রী এই প্রসঙ্গে যা বলেন তা হিতে বিপরীত হয়, কারণ তিনি সব সময় রাগান্বিত ও উত্তেজিত থাকেন। এটি তো অস্বীকার করার কোন কারণ নেই শহুরে শিক্ষিত মানুষের মাঝে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে এবং এই শিক্ষিত মানুষগুলো বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে মতামত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অথচ এই বিষয়টি ইতোমধ্যে বিএনপি লুফে নিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে আগামীতে ক্ষমতায় এলে তারা ড. ইউনূসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবে। তার বিপরীতে সরকারী দলের একজনকেও পাওয়া যায় না এটি বলতে যে, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের নেত্রী অথবা অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কী ভাষায় ড. ইউনূসকে অপমান করতেন। সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি করলে ড. ইউনূস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, দিনটি একটি কালো দিন এবং তিনি এও প্রত্যাশা করেছেন আগামীতে সরকার পরিবর্তন হলে (বিএনপি ক্ষমতায় এলে?) সব কিছু আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। আগেও বলেছি, আবারও বলি, সরকারের গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে সব পদক্ষেপেই এক ধরনের আনাড়িপনা ছিল (ড. ইউনূসের বেলায়ও তা সত্য) এবং অযথা এর পিছনে শক্তি ক্ষয় করেছে। পুরো বিষয়টা নিয়ে যিনি বা যারা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তারা হয়তো সরকারকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছেন যা তারা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন না।
এই যে সরকারের বিরোধী শক্তি আগামী নির্বাচনের জন্য এত আগ হতে (এটিই যথার্র্থ) প্রস্তুতি শুরু করেছে তার বিপরীতে সরকারী দলের নেতা-নেত্রীরা কি করছেন? দৃশ্যমান কিছুই না। বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে অন্তর্দলীয় কোন্দল আছে তা দলকে ভরাডুবির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে অনেকের ধারণা। দ্রুত এর একটি সুরাহা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। চট্টগ্রামে বিবদমান পক্ষগুলো একসঙ্গে হওয়ার একটা দুর্বল চেষ্টা করেছে। দুর্বল এই কারণেই বলছি জাতীয় শোক দিবস পালন ছাড়া সাংগঠনিকভাবে তারা আর একসঙ্গে হতে পারেনি। ২১ আগস্ট উপলক্ষে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাড়া অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাকে সভায় দেখা যায়নি। এটি কোন্দল দূরীভূত হওয়ার লক্ষণ নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ শহরে আওয়ামী লীগ একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেÑযার ফলে বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী শোচনীয়ভাবে একজন অখ্যাত সাবেক ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে পরাজিত হয়েছেন। অথচ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে এখনও আওয়ামী লীগ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। এমন অবস্থা প্রায় সব সাংগঠনিক জেলায়।
আওয়ামী লীগ হয়তো বুঝতে পারছে না যে, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেও তাদের অনেক নেতাকর্মী ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। কৌশল হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে ভাল। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগও যদি অবিলম্বে তাদের প্রস্তুতি শুরু না করে তাহলে তা হবে চরম বোকামি। ১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পিছনে ছিল তাদের এক ধরনের গাছাড়া ভাব। যেখানে বিএনপির ৩০০ আসনে দেয়ার মতো প্রার্থী ছিল না, সেখানে তাদের সরকার গঠন ছিল এক বড় ধরনের চমক লাগানো ঘটনা। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না চাইলে এখন থেকেই সংগঠনটিকে শক্তিশালী করে প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া উচিত। এর ব্যত্যয় ঘটলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক।
No comments