যাপিত রস- একদিন লিফটে by আলিম আল রাজি
এই শপিং মলটাতে লিফট কখনো খালি পাওয়া যায় না। আজ ব্যতিক্রম ঘটল। লিফটের দরজা খোলার পর দেখি, ভেতরে কেউ নেই। আমি লিফটে ঢুকে পাঁচতলার বাটন চাপলাম। দরজা বন্ধ হচ্ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে এক মেয়ে দৌড়ে এসে দরজায় হাত দিল। দরজা আবার খুলে গেল। লিফটে ঢুকে পাঁচতলার বাটন চাপতে যাচ্ছিল মেয়েটি।
আমি আগেই দিয়ে রেখেছি দেখে আর টিপ দিল না। বুঝলাম সেও পাঁচতলায় যাচ্ছে। লিফট উঠছে। লিফটে শুধু আমি আর ওই মেয়ে। আমি কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। এটা নতুন কিছু নয়। লিফটে কোনো মেয়ের সঙ্গে একা থাকলে এ রকম আমার প্রায়ই হয়।
তিনতলায় এসে লিফট থামল। হুড়মুড় করে চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে লিফটে ঢুকে পড়ল। যাক! ভালোই হয়েছে। এখন বেশ কয়েকজন আছি লিফটে। অস্বস্তিকর অনুভূতিটা আর হবে না। লিফট আবার থামল চারতলায়। লিফটের এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে।
পাবলিক বাসের মতো ঘন ঘন স্টেশন ধরে যায়। চারতলা থেকে আরও পাঁচ-ছয়জন উঠলেন। লিফট চলতে শুরু করল আবার। আমি আর ওই মেয়ে লিফটের একেবারে ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে আছি। এত মানুষ টপকে পাঁচতলায় নামাটা কঠিন হবে। কিন্তু এ কী! লিফট দেখি পাঁচতলায় থামলই না! ব্যাপার কী?
সামনে দাঁড়ানো কোনো পাবলিক নিশ্চয়ই পাঁচতলার বাটনে আবার টিপ দিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছে। ভালো করে ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই লিফট উঠে গেল সোজা ১১ তলায়। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকালাম। সেও আমার মতো বিরক্ত। লিফট ১১ তলা থেকে আবার নামতে শুরু করল। আবার সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি। লিফটে আমি আর ওই মেয়ে। অস্বস্তি কাটানোর জন্য কথা বলার বিকল্প নেই। আমি জানতাম, সে পাঁচতলায় নামবে। তার পরও সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনিও তো পাঁচতলায় নামবেন। তাই না?’
হ্যাঁ! আপনিও তো! ঠিক?
আমি জবাব দিতে যাচ্ছিলাম। এর আগেই দেখি লিফট এসে নেমে গেছে দ্বিতীয় তলায়। এতক্ষণ কেউই খেয়াল করিনি যে আমরা পাঁচতলার বাটনে আবার চাপ দিইনি। মেয়েটি এবার বেশ বিরক্ত হলো বুঝলাম। একটু কঠিন স্বরে আমাকে বলল, ‘আরে!
আপনি সামনে ছিলেন আমার, একবার খেয়ালও করলেন না?’
আগেই ছিলাম অস্বস্তিতে। মেয়েটির কথা শুনে আরও চুপসে গেলাম। আমি এবার সামনে গিয়ে ভালোভাবে পাঁচতলার বাটনটা চেপে এলাম। লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেল। সেখান থেকে আমাদের সঙ্গে পাঁচ-ছয়জন যাত্রী যোগ দিলেন। লিফট আবার উঠতে শুরু করল। এবার ঠিকঠাকমতোই পাঁচতলায় লিফট থামল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আসুন, এবার নামা যাক।’
কিন্তু মেয়েটি দেখি নড়ে না! সে ওড়না ধরে টানাটানি করছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, লিফটের টেলিফোনের সুইচের সঙ্গে তার ওড়না আটকে গেছে। আমি ব্যাপারটা খেয়াল করেছি, দেখি মেয়েটি যথেষ্ট বিব্রত হয়েছে মনে হলো। ওড়না খুলতে সাহায্য করা ঠিক হবে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই লিফট আবার চলতে শুরু করল। মেয়েটি শেষমেশ নিজেই ওড়না খুলতে পারল। লিফট ততক্ষণে ১১ তলায় পৌঁছে গেছে। আমি কিছুটা হতাশ গলায় বললাম, ‘চলুন, হেঁটেই নেমে যাই!’
মেয়েটি মনে হয় হাঁটতেই রাজি। সে নামার জন্য সামনে আসছিল। হঠাৎ একঝাঁক ছেলে এসে লিফটে ঢুকে গেল। ১১ তলায় একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটি আছে। বোঝা যাচ্ছিল এরা এই ইউনিভার্সিটিরই ছাত্র। যা-ই হোক, এদের ধাক্কায় আমি আর মেয়েটি আবার লিফটের কোনায় পৌঁছে গেলাম। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় বললাম, ‘দেখুন দেখি কী অবস্থা!’
মেয়েটি আস্তে করে বলল, ‘হু, দেখতেই তো পাচ্ছি।’
লিফট থামল সাততলায়। যে ছেলেগুলো উঠেছিল, তারা সাততলায়ই নেমে গেল। লিফটের দরজা বন্ধ হচ্ছিল। অর্ধেক বন্ধ হওয়ার পরে ঘটাং করে একটা শব্দ হয়ে লিফট শান্ত হলো। লিফটের ভেতরের লাইট-ফ্যান দুটিই বন্ধ হয়ে গেল।
‘খাইছে! কারেন্ট চলে গেছে!’
আমার কথা শুনে মেয়েটি বলল, ‘এখন কী হবে? আজকের দিনটাই কুফা হয়েছে!’ আমি মেয়েটির কথা শুনে মিইয়ে গেলাম। সে কি পরোক্ষভাবে আমাকে কুফা বলল? বুঝতে পারছি না।
আমি আস্তে করে বললাম, কারেন্ট এলে হেঁটেই নেমে যাব এবার।’
আচ্ছা! আস্তে করে মেয়েটির কণ্ঠ শোনা গেল। আমি প্রথমবারের মতো খেয়াল করলাম, মেয়েটির গলার স্বর অসম্ভব মিষ্টি। এই শপিং মলের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা দেখি খুব খারাপ! বিদ্যুৎ আসতে লাগল পাঁচ মিনিট। আগের কথামতো আমরা লিফট থেকে নামতে যাচ্ছিলাম। যেই দরজার কাছে পৌঁছালাম, লিফট তখনই ঘটাং করে উঠল। এবার ঘটাং শব্দ করে লিফট থেমে থাকল না। হুড়মুড় করে নিচে নামতে শুরু করল।
আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম, ‘খাইছে! লিফট মনে হয় ছিঁড়ে গেছে!’
আমার কথা শুনতে পেল মেয়েটি। সে দ্বিগুণ আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘সর্বনাশ! এখন কী হবে?’ শক্ত হয়ে বসে থাকুন কিছু একটা ধরে। মেয়েটি কিছু ধরার জায়গা পেল না। সে শক্ত করে আমার হাত ধরে রইল। আমি আশঙ্কা করছিলাম, একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে লিফট আছাড় খাবে। সঙ্গে আমাদেরও খবর হয়ে যাবে। কিন্তু লিফট এর আগেই থেমে গেল। দরজা তখন খোলাই ছিল। আমরা প্রায় লাফ দিয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে এলাম। শপিং মলের কোথা থেকে আট-দশজন লোক এসে হাজির হলো। করপোরেট গলায় একজন বলল, ‘স্যার! আমরা আন্তরিক দুঃখিত!’
আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে এখনো আমার হাত ধরে আছে।
No comments