সিইসির দুঃসাহসঃ বিএনপির সাহস by ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা ৯ ফেব্রুয়ারি রংপুরে আরডিএস মিলনায়তনে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন’ শীর্ষক এক কর্মশালায় বলেন, আসন্ন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে না। বিডিআর নিয়োগ করা হলেও তা হবে খুব কমসংখ্যক। ওই নির্বাচনে পুলিশই নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। তিনি আরও বলেন, ভোটাররা এখন সচেতন।
কালো টাকার মালিকরা যতই টাকা ছিটাক, ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দেন। এ দেশের সচেতন সাধারণ নাগরিকরা বিস্ময়ের সঙ্গে সিইসি মহোদয়ের এ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য শোনার পর মনে করেন, ঘরপোড়া গরু সিঁদুর রাঙ্গা মেঘ দেখলে যেমন ভয় পায়। ড. হুদার এ বক্তব্য শোনার পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তেমনিভাবে ভীত ও সতর্ক হয়ে তীব্রভাবে এ বক্তব্যের বিরোধিতা করবে। কিন্তু সিইসি মহোদয়ের আলোচ্য বক্তব্য প্রদানের পর মাসাধিক কাল অপেক্ষা করেও বিএনপির পক্ষ থেকে সিইসি মহোদয়ের এ বক্তব্যের ওপর কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে না শুনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বিস্মিত হন। কেন অনেকের মনে হয় যে সিইসি মহোদয়ের আলোচ্য বক্তব্য শুনে বিএনপি ভয় পাবে, সে সম্পর্কে এ নিবন্ধে আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলে নেয়া ভালো।
সেনা সমর্থিত জরুরি সরকারের পরিকল্পনায় অবিশ্বাস্য হারে ভোট পড়া নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দিন বদলের সরকার পরিচালনা শুরু করে। প্রধান বিরোধী দল এ নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ বিবেচনা করলেও নির্বাচনী রায় মেনে নিয়ে প্রথম থেকেই মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও সংসদ অধিবেশনে যোগদান করে। সেনাবাহিনী পরিচালিত জরুরি শাসন থেকে পরিত্রাণ নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনে উত্তরণের স্বার্থে বিএনপি চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে শুরু থেকেই দিন বদলের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে মহাজোট সরকারকে সহায়তার নীতি গ্রহণ করে। সে কারণে প্রথম বছর সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন কর্মসূচি না দিলেও সরকার বিরোধী দলের প্রতি কোনো রকম উদারতা প্রদর্শন না করে যুগপত্ সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে উদ্যোগী হয়। এ প্রক্রিয়ায় সংসদের বাইরে সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলা-মামলা, দাপট-দখল এবং আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি সরকারের পরোক্ষ প্রশ্রয় পেলেও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, সিট-বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও অন্যান্য অপরাধের প্রতি সরকার নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস ও অপরাধের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করে। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নিহত হলে সরকারকে যতটা তত্পর মনে হয়, একই মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হলে সরকার অভূতপূর্ব কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে শিবিরের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে। এর ফলে একেক ধরনের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসের প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একেক মাত্রায় সক্রিয় হতে দেখা যায়। সরকারের এহেন দ্বিমুখী নীতির ফলে শিক্ষাঙ্গনসহ সমাজের সর্বস্তরে সন্ত্রাস হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। অন্যদিকে দিন বদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসে নাম বদলকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ সরকার যে সাধারণ মানুষকে অনেকটা বিরক্ত করেনি, এমনটা বলা যায় না। যে দল নির্বাচনের আগে ভোটারদের ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, সে দল পরে সরকারি দলের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেটবাজদের অবৈধ মুনাফালাভের কারসাজির কাছে আত্মসমর্পণ করায় সাধারণ নাগরিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় সরকারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
এহেন এক অরাজক পরিস্থিতিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর যানজট-লোডশেডিংয়ের চাপে অতিষ্ঠ ঢাকা মহানগরীর সম্মানিত ও সচেতন ভোটাররা সরকারি দলের প্রার্থীকে কতটা সমর্থন দেবেন সে বিষয়টি সন্দেহ করার মতো। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটিই হবে এ সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের প্রথম পরীক্ষা। একদিকে সরকারি দল এ নির্বাচনে ভালো করে দেখাতে চাইবে যে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এখনও তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী দলও এ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলকে পরাস্ত করে প্রমাণ করতে চাইবে যে এ সরকারের প্রতি জনসমর্থন হ্রাস পেয়েছে। সেজন্য আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনে সরকারি ও বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হবেন, এ দেশে আগামী দিনের রাজনীতিতে তারা অনেকটা এগিয়ে যাবেন। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের এই প্রথম পরীক্ষায় কোনো রকম দুর্নীতি-কারচুপি যাতে না হয় সেজন্য সবারই সতর্ক হওয়া উচিত। নির্বাচনটি যেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালিত হয়, সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হওযা জরুরি।
এরকম এক গুরুত্বপূর্ণ সময় ডিসিসি নির্বাচনের আয়োজক নির্বাচন কমিশনের প্রধান সিইসি মহোদয় ঘোষণা দিলেন, আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হবে না। পুলিশই ওই নির্বাচনে নিরাপত্তা বিধান করবে। সিইসি মহোদয় এ ঘোষণা দিলেন এমনই এক সময়ে যখন দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে, মহাজোট সরকারের প্রথম ১১ মাসে ১৫ হাজার ১২৬টি রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং এসব সহিংসতায় নিহত হয়েছে ২৩৯ জন। সিইসি মহোদয় সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার আলোচ্য ঘোষণা দিলেন এমনই এক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, যে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হবে অত্যন্ত তীব্র এবং যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জয়ী হতে যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সিইসি মহোদয় এমন এক নির্বাচনে সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত দিলেন, যে নির্বাচনের নির্বাচনী এলাকা আকৃতিতে খুবই বড় এবং সন্ত্রাস-দুর্নীতির প্রসঙ্গ বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি নির্বাচনী এলাকা। এ সিদ্ধান্ত দেয়া হলো এমনই সময়, যখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের প্রতিযোগিতার তীব্রতায় গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদের ভেতরে সম্মানিত সংসদ সদস্যরা অভাবী মানুষের স্বার্থ উপেক্ষা করে মরহুম নেতাদের লাশের অস্তিত্ব নিয়ে পারস্পরিক আক্রমণের তীব্রতায় গণতন্ত্রের চর্চাকে বিপদাপন্ন করে তুলেছেন।
যেসব দেশপ্রেমিক নাগরিক শান্তিপূর্ণ ডিসিসি নির্বাচন দেখতে চান তারা ওই নির্বাচনে সিইসি মহোদয়ের সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত শুনে কিছুটা অবাক হয়েছেন। তারা বলেন, সন্ত্রাসের লীলাভূমি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের এরকম একটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা সুুনিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার না করার তো প্রশ্নই আসে না, বরং এ ধরনের নির্বাচনে অনেক আগে থেকেই অধিকসংখ্যক সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে সেনাবাহিনী ব্যবহার করার নামে এ বাহিনী যেন আবার নির্দেশিত বা পরিকল্পিত ভূমিকা পালন না করে সে ব্যাপারটিও সুনিশ্চিত করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দেশের নাগরিকদের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর প্রতি যে পরিমাণ বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে, সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রযেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, যে দেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অন্য দেশের নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হয়, তাদের নিজের দেশের নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব না দেয়া যথার্থ হবে না। তাছাড়া এমনিতেই কিছু উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তার অপরিণামদর্শী ভুল সিদ্ধান্তে ১১ জানুযারি-পরবর্তী ২ বছরে পরোক্ষ সেনা শাসন চালিয়ে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ন করেছে, আগামীতে সেনাবাহিনীকেই কল্যাণমূলক কাজ করে দেশবাসীর মনে আবার সে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজেই ডিসিসি নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সামনে এ নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ ও নিরাপদভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে দায়িত্ব পালনের সুযোগ এলে সে কাজ করার মধ্য দিয়ে সেনাবহিনী তার হৃত ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করার সুযোগ পাবে। সিইসি মহোদয়ের কি উচিত হবে সেনাবাহিনীকে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা? তাছাড়া যে পুলিশ বাহিনীর ওপর সাধারণ নাগরিকদের আস্থা কম, তিনি সেরকম পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে এতবড় একটি ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী এলাকার নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দিতে যাবেন কেন? তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা মানেই কিন্তু নিরাপদ নির্বাচনের গ্যারান্টি নয়। স্মর্তব্য, নবম সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর একটি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি অনেক অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। সিইসি মহোদয় তার আলোচ্য বক্তব্যে দারুণ অভাবের এ দেশে কালো টাকার মালিকরা টাকা ছিটিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেন না, এমন কথাও মানুষকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন। যেখানে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটার উদ্বুদ্ধকরণ বা প্রশিক্ষণের কোনো কাজ করা হয় না, সেখানে সিইসি মহোদয় কী করে আশা করেন যে ঢাকার অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র বস্তিবাসী ভোটাররা টাকায় প্রভাবিত হবেন না? তিনি যদি কালো টাকার ব্যবহার রোধের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত দিতেন তাহলে তা শ্রুতিশোভন হতো। কিন্তু তা না করে পরিবর্তে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দরিদ্র ভোটাররা তো উদ্বুদ্ধ হবেনই না, পরিবর্তে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অর্থের ব্যবহারে উত্সাহিত হবেন।
সিইসি মহোদয় যা বলবেন তাকে বেদবাক্য বলে বিশ্বাস করা যথার্থ হবে কি? নবম সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় এই সিইিসর বিতর্কিত ভূমিকা পালন বিএনপির ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। এই সিইসি ওই সময় জরুরি অবস্থার মধ্যে স্থানীয সরকার নির্বাচন করতে রাজি হয়েছিলেন। সিইসি মহোদয় সুশীল সমাজের যেসব সদস্যের নির্বাচন বিষয়ে পারদর্শিতা আছে, সারা দেশের এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে নির্বাচনী আইন সংস্কার প্রাসঙ্গিক আলোচনার নামে ঢাকায় বসবাসকারী কতিপয় এনজিও সংযোগধারী পছন্দকৃত সুশীল সমাজ সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এই সিইসি মহোদয়ই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র নামে বিএনপির ভাঙনে মদদ দিয়ে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মূল বিএনপিকে কোণঠাসা করতে মধ্যরাতের ষড়যন্ত্রের ফ্যাক্টরিতে জন্ম নেয়া তথাকথিত সংস্কারবাদী বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে পরে আবার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ২০০৭ সালে সমগ্র জাতি যখন ছিল দ্রুত নির্বাচন প্রত্যাশী, এই সিইসি মহোদয়ই তখন নির্বাচনের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির মতো নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভুত একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজে জড়িত হয়ে অসাংবিধানিক সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারকে দুই বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন। রাজনীতিবিদদের নির্বাচন কমিশনের ‘প্রধান ক্লায়েন্ট’ হিসেবে ব্যখ্যাকারী সিইসি মহোদয় ২০০৮ সালে ভোটার তালিকা তৈরি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর কোনো রাজনীতিবিদকে দাওয়াত না দিয়ে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করেছিলেন। এ দেশে বেশ কয়েকটি ভালো নির্বাচনের উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এই সিইসি মহোদয়ই নবম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ডিসিদের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতো নির্বাচন করার ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে সুশীল সমাজে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে যখন অব্যাহতভাবে সন্ত্রাস বাড়ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে পারস্পরিক আক্রমণ ও অবিশ্বাস, এরকম সময়ে সিইসি মহোদয় পুলিশ বাহিনী দিয়ে ডিসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন কেন, সে ব্যাখ্যা এখনও সষ্ট নয়। তিনি কি হঠাত্ পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্বে কোনো অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ্য করেছেন? নবম সংসদ নির্বাচনোত্তর মহাজোট সরকারের শাসনামলে যখন পুলিশ বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব তীব্র হয়ে উঠেছে, সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র যখন পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি, পোস্টিং, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা যখন অসহায় হয়ে পড়ছেন, যার ফলে পুলিশ প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে (দেখুন, যুগান্তর ৩১-১-০৯), একটি বিশেষ জেলার পুলিশ কর্মকর্তারা যখন গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে, তখন পুলিশ প্রশাসন এককভাবে ডিসিসি নির্বাচনে বর্তমান সিইসির অধীনে নির্বাচনী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করা কতটা যুক্তিযুক্ত? এরকম সঙ্কটময় সময়ে ডিসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিইসির ব্যক্ত আশাবাদ সঠিক হবে কিনা সে বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য রাজনীতি বিশ্লেষকদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ ফর্মুলার নব উদ্ভাবক সিইসি মহোদয়ের তীব্র প্রতিযোগিতার আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানে সেনাবাহিনী ব্যবহার না করে শুধু পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করাকে মেনে নিলে বিএনপির জন্য এটা হতে পারে এক আত্মঘাতী দুঃসাহসের পরিচয় দেয়া। বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতৃত্ব যদি সিইসির এমন সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেন, তবে তা দুর্নীতিমুক্ত ও নিরপেক্ষ ডিসিসি নির্বাচন প্রত্যাশী নাগরিকদের যুগপত্ হতাশ ও অবাক করবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@yahoo.com
সেনা সমর্থিত জরুরি সরকারের পরিকল্পনায় অবিশ্বাস্য হারে ভোট পড়া নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দিন বদলের সরকার পরিচালনা শুরু করে। প্রধান বিরোধী দল এ নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ বিবেচনা করলেও নির্বাচনী রায় মেনে নিয়ে প্রথম থেকেই মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও সংসদ অধিবেশনে যোগদান করে। সেনাবাহিনী পরিচালিত জরুরি শাসন থেকে পরিত্রাণ নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনে উত্তরণের স্বার্থে বিএনপি চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে শুরু থেকেই দিন বদলের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে মহাজোট সরকারকে সহায়তার নীতি গ্রহণ করে। সে কারণে প্রথম বছর সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন কর্মসূচি না দিলেও সরকার বিরোধী দলের প্রতি কোনো রকম উদারতা প্রদর্শন না করে যুগপত্ সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে উদ্যোগী হয়। এ প্রক্রিয়ায় সংসদের বাইরে সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলা-মামলা, দাপট-দখল এবং আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি সরকারের পরোক্ষ প্রশ্রয় পেলেও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, সিট-বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও অন্যান্য অপরাধের প্রতি সরকার নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস ও অপরাধের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করে। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নিহত হলে সরকারকে যতটা তত্পর মনে হয়, একই মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হলে সরকার অভূতপূর্ব কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে শিবিরের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে। এর ফলে একেক ধরনের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসের প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একেক মাত্রায় সক্রিয় হতে দেখা যায়। সরকারের এহেন দ্বিমুখী নীতির ফলে শিক্ষাঙ্গনসহ সমাজের সর্বস্তরে সন্ত্রাস হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। অন্যদিকে দিন বদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসে নাম বদলকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ সরকার যে সাধারণ মানুষকে অনেকটা বিরক্ত করেনি, এমনটা বলা যায় না। যে দল নির্বাচনের আগে ভোটারদের ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, সে দল পরে সরকারি দলের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেটবাজদের অবৈধ মুনাফালাভের কারসাজির কাছে আত্মসমর্পণ করায় সাধারণ নাগরিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় সরকারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
এহেন এক অরাজক পরিস্থিতিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর যানজট-লোডশেডিংয়ের চাপে অতিষ্ঠ ঢাকা মহানগরীর সম্মানিত ও সচেতন ভোটাররা সরকারি দলের প্রার্থীকে কতটা সমর্থন দেবেন সে বিষয়টি সন্দেহ করার মতো। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটিই হবে এ সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের প্রথম পরীক্ষা। একদিকে সরকারি দল এ নির্বাচনে ভালো করে দেখাতে চাইবে যে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এখনও তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী দলও এ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলকে পরাস্ত করে প্রমাণ করতে চাইবে যে এ সরকারের প্রতি জনসমর্থন হ্রাস পেয়েছে। সেজন্য আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনে সরকারি ও বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হবেন, এ দেশে আগামী দিনের রাজনীতিতে তারা অনেকটা এগিয়ে যাবেন। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের এই প্রথম পরীক্ষায় কোনো রকম দুর্নীতি-কারচুপি যাতে না হয় সেজন্য সবারই সতর্ক হওয়া উচিত। নির্বাচনটি যেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালিত হয়, সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হওযা জরুরি।
এরকম এক গুরুত্বপূর্ণ সময় ডিসিসি নির্বাচনের আয়োজক নির্বাচন কমিশনের প্রধান সিইসি মহোদয় ঘোষণা দিলেন, আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হবে না। পুলিশই ওই নির্বাচনে নিরাপত্তা বিধান করবে। সিইসি মহোদয় এ ঘোষণা দিলেন এমনই এক সময়ে যখন দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে, মহাজোট সরকারের প্রথম ১১ মাসে ১৫ হাজার ১২৬টি রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে এবং এসব সহিংসতায় নিহত হয়েছে ২৩৯ জন। সিইসি মহোদয় সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার আলোচ্য ঘোষণা দিলেন এমনই এক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, যে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হবে অত্যন্ত তীব্র এবং যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জয়ী হতে যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সিইসি মহোদয় এমন এক নির্বাচনে সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত দিলেন, যে নির্বাচনের নির্বাচনী এলাকা আকৃতিতে খুবই বড় এবং সন্ত্রাস-দুর্নীতির প্রসঙ্গ বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি নির্বাচনী এলাকা। এ সিদ্ধান্ত দেয়া হলো এমনই সময়, যখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের প্রতিযোগিতার তীব্রতায় গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদের ভেতরে সম্মানিত সংসদ সদস্যরা অভাবী মানুষের স্বার্থ উপেক্ষা করে মরহুম নেতাদের লাশের অস্তিত্ব নিয়ে পারস্পরিক আক্রমণের তীব্রতায় গণতন্ত্রের চর্চাকে বিপদাপন্ন করে তুলেছেন।
যেসব দেশপ্রেমিক নাগরিক শান্তিপূর্ণ ডিসিসি নির্বাচন দেখতে চান তারা ওই নির্বাচনে সিইসি মহোদয়ের সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত শুনে কিছুটা অবাক হয়েছেন। তারা বলেন, সন্ত্রাসের লীলাভূমি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের এরকম একটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা সুুনিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার না করার তো প্রশ্নই আসে না, বরং এ ধরনের নির্বাচনে অনেক আগে থেকেই অধিকসংখ্যক সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে সেনাবাহিনী ব্যবহার করার নামে এ বাহিনী যেন আবার নির্দেশিত বা পরিকল্পিত ভূমিকা পালন না করে সে ব্যাপারটিও সুনিশ্চিত করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দেশের নাগরিকদের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর প্রতি যে পরিমাণ বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে, সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রযেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, যে দেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অন্য দেশের নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে প্রশংসিত হয়, তাদের নিজের দেশের নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব না দেয়া যথার্থ হবে না। তাছাড়া এমনিতেই কিছু উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তার অপরিণামদর্শী ভুল সিদ্ধান্তে ১১ জানুযারি-পরবর্তী ২ বছরে পরোক্ষ সেনা শাসন চালিয়ে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ন করেছে, আগামীতে সেনাবাহিনীকেই কল্যাণমূলক কাজ করে দেশবাসীর মনে আবার সে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজেই ডিসিসি নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সামনে এ নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ ও নিরাপদভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে দায়িত্ব পালনের সুযোগ এলে সে কাজ করার মধ্য দিয়ে সেনাবহিনী তার হৃত ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করার সুযোগ পাবে। সিইসি মহোদয়ের কি উচিত হবে সেনাবাহিনীকে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা? তাছাড়া যে পুলিশ বাহিনীর ওপর সাধারণ নাগরিকদের আস্থা কম, তিনি সেরকম পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে এতবড় একটি ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী এলাকার নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দিতে যাবেন কেন? তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা মানেই কিন্তু নিরাপদ নির্বাচনের গ্যারান্টি নয়। স্মর্তব্য, নবম সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর একটি গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি অনেক অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। সিইসি মহোদয় তার আলোচ্য বক্তব্যে দারুণ অভাবের এ দেশে কালো টাকার মালিকরা টাকা ছিটিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেন না, এমন কথাও মানুষকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন। যেখানে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটার উদ্বুদ্ধকরণ বা প্রশিক্ষণের কোনো কাজ করা হয় না, সেখানে সিইসি মহোদয় কী করে আশা করেন যে ঢাকার অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র বস্তিবাসী ভোটাররা টাকায় প্রভাবিত হবেন না? তিনি যদি কালো টাকার ব্যবহার রোধের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত দিতেন তাহলে তা শ্রুতিশোভন হতো। কিন্তু তা না করে পরিবর্তে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দরিদ্র ভোটাররা তো উদ্বুদ্ধ হবেনই না, পরিবর্তে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অর্থের ব্যবহারে উত্সাহিত হবেন।
সিইসি মহোদয় যা বলবেন তাকে বেদবাক্য বলে বিশ্বাস করা যথার্থ হবে কি? নবম সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় এই সিইিসর বিতর্কিত ভূমিকা পালন বিএনপির ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। এই সিইসি ওই সময় জরুরি অবস্থার মধ্যে স্থানীয সরকার নির্বাচন করতে রাজি হয়েছিলেন। সিইসি মহোদয় সুশীল সমাজের যেসব সদস্যের নির্বাচন বিষয়ে পারদর্শিতা আছে, সারা দেশের এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে নির্বাচনী আইন সংস্কার প্রাসঙ্গিক আলোচনার নামে ঢাকায় বসবাসকারী কতিপয় এনজিও সংযোগধারী পছন্দকৃত সুশীল সমাজ সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এই সিইসি মহোদয়ই ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র নামে বিএনপির ভাঙনে মদদ দিয়ে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মূল বিএনপিকে কোণঠাসা করতে মধ্যরাতের ষড়যন্ত্রের ফ্যাক্টরিতে জন্ম নেয়া তথাকথিত সংস্কারবাদী বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে পরে আবার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ২০০৭ সালে সমগ্র জাতি যখন ছিল দ্রুত নির্বাচন প্রত্যাশী, এই সিইসি মহোদয়ই তখন নির্বাচনের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির মতো নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভুত একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজে জড়িত হয়ে অসাংবিধানিক সেনা-সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারকে দুই বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন। রাজনীতিবিদদের নির্বাচন কমিশনের ‘প্রধান ক্লায়েন্ট’ হিসেবে ব্যখ্যাকারী সিইসি মহোদয় ২০০৮ সালে ভোটার তালিকা তৈরি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর কোনো রাজনীতিবিদকে দাওয়াত না দিয়ে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করেছিলেন। এ দেশে বেশ কয়েকটি ভালো নির্বাচনের উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও এই সিইসি মহোদয়ই নবম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ডিসিদের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতো নির্বাচন করার ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে সুশীল সমাজে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে যখন অব্যাহতভাবে সন্ত্রাস বাড়ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে পারস্পরিক আক্রমণ ও অবিশ্বাস, এরকম সময়ে সিইসি মহোদয় পুলিশ বাহিনী দিয়ে ডিসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন কেন, সে ব্যাখ্যা এখনও সষ্ট নয়। তিনি কি হঠাত্ পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্বে কোনো অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ্য করেছেন? নবম সংসদ নির্বাচনোত্তর মহাজোট সরকারের শাসনামলে যখন পুলিশ বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব তীব্র হয়ে উঠেছে, সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র যখন পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি, পোস্টিং, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা যখন অসহায় হয়ে পড়ছেন, যার ফলে পুলিশ প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে (দেখুন, যুগান্তর ৩১-১-০৯), একটি বিশেষ জেলার পুলিশ কর্মকর্তারা যখন গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে, তখন পুলিশ প্রশাসন এককভাবে ডিসিসি নির্বাচনে বর্তমান সিইসির অধীনে নির্বাচনী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করা কতটা যুক্তিযুক্ত? এরকম সঙ্কটময় সময়ে ডিসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিইসির ব্যক্ত আশাবাদ সঠিক হবে কিনা সে বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য রাজনীতি বিশ্লেষকদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ ফর্মুলার নব উদ্ভাবক সিইসি মহোদয়ের তীব্র প্রতিযোগিতার আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানে সেনাবাহিনী ব্যবহার না করে শুধু পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করাকে মেনে নিলে বিএনপির জন্য এটা হতে পারে এক আত্মঘাতী দুঃসাহসের পরিচয় দেয়া। বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতৃত্ব যদি সিইসির এমন সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেন, তবে তা দুর্নীতিমুক্ত ও নিরপেক্ষ ডিসিসি নির্বাচন প্রত্যাশী নাগরিকদের যুগপত্ হতাশ ও অবাক করবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@yahoo.com
No comments