কৃষকের প্রতিবাদ—প্রতিবাদী কৃষক by মাহফুজ উল্লাহ
বাংলাদেশের এবং এক সময়কার বাংলার কৃষকের দুঃখ-বঞ্চনার কোনো শেষ নেই। এই বঞ্চনার কাহিনী অনেক দীর্ঘ। ইতিহাস বড় করুণ। কৃষক তার উত্পাদিত পণ্য দিয়ে সমাজ ও মানুষের জীবনকে সচল রাখলেও তার নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বরং কখনও কখনও সে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। সাত দশক আগে কৃষকের অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে রজনী পাম দত্ত তার ‘ইন্ডিয়া টুডে’ গ্রন্থে কৃষকের সাংবাত্সরিক অভাব-অনটনের কথা বলেছেন।
বলেছেন, উত্পাদিত পণ্যের দাম না পাওয়ার কথা এবং দুর্ভিক্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। এক সময় অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবনকে সোনার বাংলা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এমনকি পাকিস্তান বিরোধী লড়াইয়ে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এমন একটি স্লোগান জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল। আকবর আলী খান সোনার বাংলা : মিথ ও বাস্তব প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন, সোনার বাংলা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতবাদ অর্থনীতির প্রামাণ্য তত্ত্বের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ড. খান বলছেন, সোনার বাংলা তত্ত্ব মেনে নিয়ে স্বীকার করতে হবে ব্রিটিশ আমলে এ দেশে কখনও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি এবং কৃষিপ্রধান সমাজে মাঝে মাঝে অর্থনীতিতে যে ধরনের ওঠানামা দেখা দেয় তা ছিল অনুপস্থিত। তিনি বলেছেন, ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণের তত্ত্ব যদি তুলে ধরি তাহলে দেখা যাবে তার কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। ড. খান আরও বলেছেন, বাংলার ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা সীমিত ক্রয়ক্ষমতার কারণে খাদ্যাভাবের শিকার হতেন।
এই প্রসঙ্গের অবতারণা করার কারণ, বাংলাদেশের চাষীদের বঞ্চনার প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত আছে। তারা হয় উত্পাদিত ফসলের মূল্য পান না অথবা উত্পাদিত পণ্য সংরক্ষণের অভাবে তা নষ্ট করতে বাধ্য হন। ১১ মার্চ ২০১০ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ও সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষুব্ধ চাষীরা তাদের টমেটো সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এনে ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। উত্পাদিত পণ্যের মূল্য না পাওয়া অথবা সেই পণ্য অন্যত্র ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা প্রায় অভিন্ন। গত মে মাসে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুগ্ধ উত্পাদকরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে প্রচুর পরিমাণে দুধ রাইন নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন অথবা ফসলের মাঠে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। অভিযোগ একটাই, তা হচ্ছে উত্পাদিত পণ্যের মূল্য হ্রাস। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে ফরাসি কৃষকরা প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করে যা পেতেন এক বছর পরে সে মূল্য থেকে তা ৩০ ভাগ কমে যায়। ফ্রান্সে দুগ্ধ উত্পাদনকারী কৃষকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ এবং এদের রয়েছে প্রায় তিন হাজার ডেইরি। এই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে জার্মানির ছয় হাজার কৃষক দু’শ’ ট্রাক্টর এনে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। দুধ নিয়ে আমাদের দেশের কৃষকরা ও বিপাকে পড়েছিলেন। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অবৈধ সরকারের সময় এ দেশের কৃষকদের রাস্তায় দুধ ঢেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ছবি অনেকেই দেখেছেন। কৃষকরা প্রায়ই প্রতিবাদ করেন এবং তাদের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন হলেও বিষয়বস্তু থাকে অভিন্ন। বর্তমান বছরের জানুয়ারি মাসে আখের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত কৃষকরা ভারতের ব্যাঙ্গালোরের রাস্তায় নেমে এসেছিল। কৃষকদের ঠেকাতে জারি করতে হয়েছিল ১৪৪ ধারা।
আবার কিছুটা ভিন্ন ধরনের প্রতিবাদও আছে। কয়েক বছর আগে জমি নিয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা মেক্সিকোর রাস্তায় নগ্ন হয়ে মিছিল করেছিল। বাংলাদেশের কৃষকরা নগ্ন হয়ে মিছিল না করলেও স্বার্থরক্ষায় তারা প্রতিবাদ করে। বর্তমান সময়ে কৃষকদের প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে আলু নিয়ে। ইতোমধ্যে তারা রংপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কৃষকদের দাবি ছিল, তারা আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না এবং আলু সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা আছে তাতে তাদের উত্পাদিত পণ্যের দাম কমে যাবে। কৃষকদের বোকা বানানো হয়েছিল বলে বর্তমান বছরেও তারা প্রচুর আলু উত্পাদন করেছেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হিমাগার সঙ্কটের কারণে এ বছর ৭০ লাখ মেট্রিক টন আলু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। চলতি মৌসুমে ৪ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ মনে করে, উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭২ লাখ মেট্রিক টন ধরা হলেও বাম্পার ফলনের কারণে তা এক কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে আলু রাখার হিমাগারের সংখ্যা ৩৩০টি। আর এসব হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায় মাত্র ২৩ লাখ মেট্রিক টন আলু। পরিস্থিতি বুঝে হিমাগার মালিকরাও বস্তা রাখার ভাড়া ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭০ টাকা করেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বস্তার দাম। বিভিন্ন এলাকার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে কেজিপ্রতি আলু উত্পাদন খরচ ১০-১২ টাকা হলেও কৃষক তা ৪-৫ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তার সমস্যা একটাই—সংরক্ষণ।
অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও কৃষককে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। এসব শস্যের মধ্যে রয়েছে মুলা, শিম, টমেটো, বাঁধাকপি ও করলা। ঢাকা শহরের অধিবাসীরা যে দাম দিয়ে এসব সামগ্রী ক্রয় করেন তাতে তাদের এটা বোঝার অবকাশ থাকে না যে, মাঠপর্যায়ের চিত্রটা কত করুণ। এটা ধানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গত বছর দাম বেঁধে দিয়েও সরকার কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনি। কৃষকের ধান গেছে আড়তদারের কাছে।
এ বছর উত্পাদিত সবজি নিয়ে কৃষক চরম বিপদে পড়েছিল। একটি বাঁধাকপির উত্পাদন খরচ ৩-৪ টাকা হওয়ার পরেও কৃষককে বিক্রি করতে হয়েছে এক টাকায় অথবা ক্ষেত্রবিশেষে খাওয়াতে হয়েছে গরু-ছাগলকে। এবার কৃষক শিম বিক্রি করতে পেরেছে সর্বোচ্চ ১৫০-২০০ টাকা মণ দরে। অথচ প্রতিমণ শিম উত্পাদনে কৃষকের ব্যয় হয় ৫০০-৬০০ টাকা। একই অবস্থা টমেটোর ক্ষেত্রেও। কেজিপ্রতি উত্পাদন খরচ ৪-৫ টাকা হলেও কৃষককে তা পঞ্চাশ পয়সায় বিক্রি করতে হয়েছে। মুলার কথা না বলাই ভালো। কারণ, অনেক জায়গায় কৃষক সেটা বিনামূল্যে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। একই অবস্থা ঘটে কাঁঠালের মৌসুমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়। সেখানকার মানুষ কাঁঠাল নিয়ে এসে বিক্রির জন্য রাস্তার পাশে জড়ো করে, ১-২ টাকার বিনিময়ে প্রতিটি কাঁঠাল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর বিক্রি করতে না পারলে যেখানে জড়ো করেছে সেখানেই ফেলে রেখে দেয়। এ সবকিছুর অর্থ কৃষকের বাড়তি ঋণগ্রস্ততা এবং দৈন্যদশা। কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো সম্পর্কে জানেন না এমন নয়। কিন্তু তাদের দিক থেকে সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই। ‘অধিক ফসল ফলাও’—স্লোগান কৃষকের কাছে পৌঁছালেও সে তার উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে কিনা তা কেউ জানে না। জানে না বললে বোধ হয় ঠিক হবে না। শহর, বিশেষ করে রাজধানীর মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্যই কৃষককে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এই ক্ষতির কারণে দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও ভারতের হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার বিষয়টি নতুন কোনো ঘটনা নয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কৃষকরা সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে তাদের সমিতি বা ইউনিয়নের শক্তির কারণে। বাংলাদেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের দু’টি কৃষক সংগঠন থাকলেও এসব সংগঠনের সাহেবী কেতাদুরস্ত নেতৃত্ব কৃষকদের দুরবস্থার কথা জানেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এমনকি, এ দু’টি সংগঠনের সদস্য হিসেবে সত্যিকারের কৃষক আছেন কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। কৃষকদল অথবা কৃষকলীগ যেসব আলোচনা সভার আয়োজন করে সেখানে কৃষকের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। সেখানে উপস্থিতরা সবাই বনানী, গুলশান বা ধানমন্ডির কৃষক।
বাংলাদেশে কৃষক সংগঠনের চরিত্রগত বিকৃতির জন্যই কৃষকরা আজ বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমানের সংগঠনগুলো যে কৃষকের সত্যিকারের সংগঠন নয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৪ মার্চ ২০১০ কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জাতীয় সংসদে এ সমস্যাটি তুলে ধরেছেন। কিন্তু সমাধান কীভাবে হবে সে বিষয়ে কোনো পথ বাতলে দেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে সত্যিকারের কৃষকদের সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি। মওলানা ভাসানী এই সংগঠনের নেতৃত্বে থাকলেও কৃষকদের সংগঠিত করার কাজটি করতেন বামপন্থীরা। এ দেশের অনেক মানুষের স্মৃতিতে এখনও হাতে লাঠি ও লাল টুপি পরিহিত কৃষকদের মিছিল ও সমাবেশের কথা নিশ্চয়ই জাগরূক আছে। কৃষকদের এই সংগঠন তাদের আন্দোলনকে শতভাগ সাফল্য না দিতে পারলেও নিজেদের মধ্যে একটা সংহতি ও একতার বোধ জন্ম দিয়েছিল। আজকের কৃষকদের মতো তাদের বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদী হতে হতো না। প্রতিবাদ জানিয়ে স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের কৃষকদের প্রয়োজন নতুন সংগঠন—বড় দু’দলের লেজুড়বৃত্তি নয়। যুগ যুগ ধরে কৃষক তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রতিবাদ করে, এমনকি লড়াইও করে। কৃষকের প্রতিবাদী চরিত্র পৃথিবীব্যাপী অভিন্ন।
No comments