আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন
(গতকালের পর) ৬. আলবদরের কাঠামো আলবদরের প্রত্যেকটি ইউনিটে তিনটি ভাগ ছিল। এগুলো হলো : ক) প্রতিরক্ষা খ) তথ্য গ) জনসংযোগ ক) প্রতিরক্ষা : প্রতিরক্ষার অর্থ সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। অর্থাৎ ‘দুশমনের’ খোঁজ-খবর, তার শক্তি সম্পর্কে জানা এবং তার যে কোন আক্রমণ ঠেকানো।
গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতি জেলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের নির্দেশ বা অনুমতিক্রমে আলবদররা তৎপরতা চালাত। অর্থাৎ পাকিদের অধস্তন ইউনিট হিসেবে কাজ করত।
খ) জনসংযোগ : এই বিভাগের কাজ ছিল কাউন্টার প্রপাগাণ্ডা। আলবদররা জানত। সাধারণ মানুষ আকাশবাণী, বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বা অন্যান্য বেতার শোনে। তাদের মতে এসব খবরাখবর দ্বারা মানুষ সাংঘাতিক রকমের বিদ্বেষের শিকার হয়েছিল। এসব খবরকে তারা মনে করত গুজব। কারণ তারা মনেপ্রাণে পাকিস্তানি রেডিওর খবর বিশ্বাস করত। সুতরাং, জনগণের ‘কল্যাণের’ জন্য ‘পাকিস্তানী খবর’ পৌঁছে দিত। পাকিস্তানের অখ-তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হতো। এজন্য নিয়মিত সভার আয়োজন ছিল অন্যতম কার্যক্রম। এছাড়া স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের নিরাপত্তা বিধান করাও এদের দায়িত্ব ছিল।
গ) তথ্য : ‘দুশমন’দের দেশদ্রোহী কার্যকলাপের খবর সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ ছিল এদের প্রধান দায়িত্ব। এই বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে আলবদররা তাদের ‘আক্রমণে’র বা তৎপরতার পরিকল্পনা তৈরি করত।
এছাড়া প্রতিটি জেলা আলবদর ইউনিটের ছিল একটি করে মেডিক্যাল ইউনিট, সংঘের যেসব সদস্য মেডিক্যালে পড়ত বা সংঘ/জামায়াত সমর্থক ডাক্তারদের দ্বারা এই ইউনিট গঠন করা হয়েছিল।
খালেদ আলবদরের একটি কাঠামো উপস্থাপন করেছেন। ১৯৭২ সালে আলবদর পত্রিকায় এই কাঠামো প্রকাশিত হয়েছিল। কাঠামোটি ছিল এরকম-
১ ইউনিট ৩১৩ ক্যাডেট
২ ইউনিট ৩টি কোম্পানি; প্রত্যেক কোম্পানিতে ছিল ১০৪ জন মুজাহিদ
১ কোম্পানি ৩টি প্লাটুন, প্রত্যেক প্লাটুনে ৩৩ সাজি
১ প্লাটুন ৩টি সেকশন ট্রুপ প্রত্যেক ট্রুপে ছিল ১১ জন আলবদর। প্রত্যেক ইউনিটের নেতৃত্বে ছিল একজন কমান্ডার। তারপর দু’জন ডেপুটি কমান্ডার। জেলা ভিত্তিতে সংগঠন হতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলÑএসব কিছুই ছিল প্রাদেশিক মজলিশে শূরার অধীনে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে আলবদর কমান্ড কীভাবে গঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু তথ্য পাই মনসুর খালেদের গ্রন্থে।
অপারেশন সার্চ লাইটের পর, এর দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে বদলি করা হয়। তার জায়গায় আসেন মেজর জেনারেল আবদুর রহিম। ঢাকা জেলার আলবদর সংগঠিত করার জন্য সংঘের নেতারা দেখা করেন জেনারেল রহিমের সঙ্গে। রহিমের সঙ্গে তাদের “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, হিন্দুস্থানী অনুচরদের দমন ও আলবদর বিষয়ে” আলোচনা হয়। রহিম মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলাপ করে আলবদর গঠনের ব্যাপারে সম্মতি দিলেন। জেনারেল রহিম, লে. কর্নেল আহসান উল্লাহ এক নির্দেশ দেন ঢাকা শহর আলবদর ইউনিট গঠন করার জন্য; আর আলবদরের ইনচার্জ করা হয় ব্রিগেডিয়ার বশীরকে। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদরদের সদর দফতর স্থাপিত হয়। ঢাকায় আলবদরের তিনটি গ্রুপ গঠিত হয়Ñ
‘শহীদ, আবদুল মালেক গ্রুপÑকমান্ডার : আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ‘শহীদ’ আজিজ ভাট্টি গ্রুপÑকমান্ডার : আবদুল হক, গাজী সালাউদ্দিন গ্রুপÑকমান্ডার মুহম্মদ আশরাফুজ্জামান।
আবদুল মালেক ছিলেন জমিয়ত ইসলামী তুলাবার মজলিশে শূরার সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র। ১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংঘের সংঘর্ষে আবদুল মালেক নিহত হন। ছাত্রসংঘ আবদুল মালেককে সব সময় শহীদ বলে উল্লেখ করে। খালেদ তার সম্পর্কে যে আলোচনা [শহীদের অলোচনা] করেছেন স্বাভাবিকভাবেই তা অতিরঞ্জিত। যেমন, আহত মালেককে মেডিকেলে নেওয়া হয়। “সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের নেতা ছিল। সে আবদুল মালেকেেক দেখে তৃপ্তির হাসি হেসে বলে, ‘লেট হিম ডাই’।” জামায়াতের এই ধরনের প্রচারের বিপরীতে অন্যরা কখনই সুবিধা করতে পারেনি।
আজিজ ভাট্টি ছিল পাকিস্তানি সৈনিক। খুব সম্ভব ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে নিহত হয়। আর গাজী সালাহউদ্দিন ইতিহাসখ্যাত গাজী সালাহউদ্দিন।
১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে চট্টগ্রামের নৌঘাঁটি ও সেনানিবাসে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কর্তারা দুটি মিটিং করেন। এরপর ১০ মে লে. কর্নেল আজম ও ফাতেমীর সঙ্গে ছাত্রসংঘের নেতাদের বৈঠক হয়। আলোচনায় চট্টগ্রামের নাজেম বলেন, সেনাবাহিনীকে তারা একটি শর্তে সহায়তা করবে তা হচ্ছেÑ “কোন অপারেশনই তাদের পরামর্শ ব্যতিরেকে হবে না। এ নিয়ে দু’পক্ষের ‘চুক্তি’ও হয়। জুনের মাঝামাঝি, ঢাকার মতো চট্টগ্রামের তিনটি কোম্পানি গঠন করা হয়। কোম্পানি তিনটি হলোÑ
খালেদ বিন ওয়ালিদ
জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর
তারেক বিন রিয়াদ
পুরো চট্টগ্রাম জেলায় ৩৭টি আলবদর প্লাটুন গঠন করা হয়। ২৪ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মেজর জামাল দার, ক্যাপ্টেন পারভেজ সেকান্দার ও মনোয়ার খান আলবদরদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। আলবদরদের সদর দফতর ছিল হোটেল ডালিম। এ হোটেলটি হিন্দু মালিকানায় ছিল যা আলবদররা দখল করেছিল।
এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন, শান্তি কমিটিরও রাজাকার বাহিনীতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল জামায়াত ও সংঘের লোকজন। একই লোক একই সঙ্গে রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আলবদরে কাজ করত। যেমন চট্টগ্রামে ছাত্রসংঘের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাসেম আলী একই সঙ্গে ছিলেন আলবদর হাইকমান্ড, চট্টগ্রাম শহর ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্ট এবং জেলা রাজাকার ও চট্টগ্রাম শহর আলবদর প্রধান। মোহাম্মদ আবদুল বারী ছিলেন মোমেনশাহীর ইসলামপুর থানার আলবদর ক্যাম্প ইনচার্জ, জামালপুর মহকুমা শান্তি কমিটির প্রচার সম্পাদক ও ছাত্রসংঘের সদস্য। তিনি দৈনিক সংগ্রামে লিখেছিলেন “আমি পূর্ব পাকিস্তনের দেশপ্রেমিক ইসলামপন্থী ছাত্র-জনতার নিকট আহ্বান জানাচ্ছি সামরিক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও সাহায্যে নিয়ে দ্রুত প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করতে। বদর বাহিনী ছাড়া শুধু রাজাকার ও পুলিশ দিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা সম্ভব না। আমাদের কাছে রাজাকার, বদর বাহিনী বা মুজাহিদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমরা সবাইকে মনে করি সমান। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তার দালালদের শায়েস্তা করতে আজ তাই প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা প্রয়োজন।” (১৬.৯.১৯৭১)
একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ২৫ নবেম্বর ঢাকা শহর ছাত্রসংঘের কার্যকরী পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। এ কমিটিতে প্রধান জল্লাদ বা খুনী হিসেবে আশরাফুজ্জামানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্য সদস্যরা ছিলেন : ১. মোস্তাফা শওকত ইমরান ২. নূর মোহামদ মল্লিক ৩. একে মোহাম্মদ আলী ৪. আবু মোঃ জাহাঙ্গীর ৫. আ. ক. ম. রুহুল কুদ্দুস ও ৬. সর্দার আবদুল সালাম।
৭. খ্যাতিমান কুখ্যাত কিছু আলবদর
এই শিরোনাম দেখে আপনারা বিভ্রান্ত হতে পারেন। পর পর পরস্পরবিরোধী দুটি বিশেষণ। কিন্তু এর কারণ আছে। আলবদর ঘৃণিত, সুতরাং এর লিডাররা স্বাভাবিকভাবেই কুখ্যাত। কিন্তু এরা তাদের নির্মমতার জন্য ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন। আলবদরদের একটি বড় অংশ, আগেই বলেছি, ১৯৭২ সাল থেকেই সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মিশে গেছে। শুধু তাই নয়, অনেকে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। মীর কাশেম আলীর গ্রেফতার দেখে ৩০ বছরের কেউ বিস্মিত হতে পারেন; কেননা মীর কাশেম এখন এ দেশে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একজন, যিনি তার পক্ষে (তাকে যেন যুদ্ধাপরাধী না করা হয়) লবি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক লবিস্ট ফার্মকে ২৫ লাখ ডলার দিয়েছেন। এত টাকা যিনি লবিস্টকে দিতে পারেন তার টাকার পরিমাণ কত? আলবদর কমান্ডার থাকার সময়ই লুটপাটের মাধ্যমে তার সম্পত্তির ভিত্তি। এখন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনার মালিক হলেও আমাদের বা পূর্ববর্তী জেনারেশনের কাছে এই নামটি একটি ভয়জাগানিয়া নাম। বা মতিউর রহমান নিজামী, যার শ্বেতভ্র শ্মশ্রু দেখে সুফি দরবেশ মনে হতে পারে [তার ডেপুটি মুজাহিদ তাকে ‘অলি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন], তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে জামায়াত-ই-তুলাবার নিজাম-ই আলা, সেই সুবাদে আলবদর বাহিনীর প্রধান। মুজাহিদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান তুলাবার সভাপতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আলবদরের প্রধান। মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামের ইত্যাদি। আলবদররা কী ধরনের হিংস্র ছিল তার খানিকটা বিবরণ পাওয়া যাবে একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় গ্রন্থে। আমি অন্যভাবে একটি উদাহরণ দিই। গত প্রায় চার দশক ধরে আমি ঢাকা বিশ্ব¦দ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। আমার ছাত্রদের মধ্যে সব ধরনের মতাদর্শের তরুণ আছে। আমি প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের মতাদর্শ সম্পর্কে অবহিত নই। তারা জানে আমিও একটি মতাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু তারা যখন তালেব এলম হিসেবে আমার কাছে এসেছে, আমি তাদের সমদৃষ্টিতে দেখেছি। এবং এটি দৃশ্যমান। তাই গত চার দশকে আমার বিরুদ্ধে ছাত্ররা কোন অভিযোগ তোলেনি। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছে। আমার দ্বারও সব সময় তাদের জন্য উন্মুক্ত। চার দশক আগে সে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় ছিল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই আলবদররা সাদা পাজামা ও কুর্তা পরে, মুখে কালো কাপড় বেঁধে তাদের শিক্ষকদের সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে হত্যা করেছে। এইসব শিক্ষকের অধিকাংশ রাজনীতির সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলেন না। পড়াশোনা ও ছাত্র ছাড়া কিছু চিনতেন না। তা হলে ভেবে দেখুন তাদের মনোভঙ্গি কেমন ছিল!
১৯৭১ সালের পুরোটা সময় আলবদরের নেতারা নিরন্তর সভা-সমিতি করে ‘হিন্দুস্তান’কে ধ্বংস করতে বলেছে। ইসলামের নামে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছে। সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আলবদরের গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে নিজামী লিখেছিলেনÑ “আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাক সেনার সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিন শ’ তেরো। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তিন শ’ তেরো জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” (সংগ্রাম ৭.১১.১৯৭১)
চট্টগ্রামের এক সভায় নিজামী বলেন, মুসলমানরা যখন দেশরক্ষায় ব্যর্থ হলো তখন “আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেশকে রক্ষা করেছেন।” (সংগ্রাম ২.৮.১৯৭১)
একই সভায় মীর কাশেম আলী বলেন, “গ্রামে গঞ্জের প্রত্যেকটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে শত্রুর শেষ চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে।”
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা ছিল নিজামীদের ভাই। অগাধ বিশ্বাস ছিল তাদের ওপর। নিজামী তাদের ‘ভাই’ বলায় আপ্লুত হয়ে দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিলÑ
“মূলত আমাদের সেনাবাহিনীতে তিন ধরনের জেহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত মোজাহেদ বীর জোয়ানরা থাকার দরুনই দুশমনরা আমাদের চাইতে সামরিক শক্তিতে পাঁচগুণ বেশি শক্তিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও পাক সেনাবাহিনীর কাছে চরমভাবে পরাজয় বরণ করে।
... আমাদেরকে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, এই পাক সেনাবাহিনীই গত ২৪ বছর ধরে আমদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন ছাড়াও জাতীয় প্রতিটি দুর্যোগে আমাদের সাহায্য করে আসছে। গত বছর উপকূলীয় এলাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত হতাহত মানুষ, বিশেষ করে পচা লাশ দাফন থেকে সকল প্রকার সাহায্যের মধ্য দিয়ে যে মানবিক সেবার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা থেকেই এদেশের মানুষের প্রতি অফুরন্ত দরদেরই পরিচয় পাওয়া যায়। সুতারাং জনাব নিজামী তাদেরকে আমাদের ভাই বলে যথাযথই বলেছেন এবং সেনাবাহিনী ও সাধারণ নাগরিক একাত্ম হয়েই আজ এ দেশবাসী শত্রুর মোকাবেলা করবে।” (৩.৮.১৯৭১)
মুজাহিদ এক সভায় বলেন, “ঘৃণ্য শত্রু ভারতকে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদেরকে আসাম দখল করতে হবে। এ জন্য আপনারা সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।” (সংগ্রাম, ১৫.৯.১৯৭১)
জামালপুরের ইসলামপুর থানার আলবদর কমান্ডার আবদুল বারী আলবদরদের প্রশাংসা করে লিখেছিলেন-
“জামালপুরের বিভিন্ন জায়গায় সীমান্তবর্তী এলাকায় আলবদর বাহিনী সাহসিকতা ও সাফল্যের সাথে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের মোকাবেলা করেছে। আলবদর বাহিনীর তৎপরতা দেখে ভারতীয় অনুচর নাপাক বাহিনীর লোকেরা জামালপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে ক্রমাগত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনীর বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি ছেলেই শিক্ষিত এবং নামাজ পড়ে। ধনসম্পদ ও নারীর প্রতি কোন লোভ নেই। বদর বাহিনীর গত তিন মাসের কাজে কোন চরিত্রগত দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়নি। এ জন্যই জনগণের কাছে বদর বাহিনী দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে। মোমেনশাহী জেলার জনগণের কাছে আশার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রিয় নাম আলবদর। জামালপুরে রেজাকার, পুলিশ, মুজাহিদ ও রেঞ্জাররা পুল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাহারা দিচ্ছে আর পাক ফৌজ ও আলবদর বাহিনী অপারেশন করছে।” (সংগ্রাম ১৬.৯.১৯৭১)
অথচ এসব প্রচারণা যে সত্য নয়, বরং তারা যে ছিল নিছক খুনী, লুটেরা, ধর্ষক তার প্রমাণ আবদুল বারীর ডায়েরির অনেক এন্ট্রির কয়েকটি এন্ট্রি
“১. ঐধরফবৎ অষর ২. ঘধুসঁষ ঐড়য়ঁব ৎং ২৫০০.০০.”
[অর্থাৎ এই দুইজনার কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।]
“তিতপল্লার শিমকুড়া গ্রামÑ জাব্বারের কাছ থেকে ২৯.১০.৭১ [তারিখে] আর তিন হাজার নেওয়ার পরিকল্পনা ২৬.১০.১৯৭১ .. Prostitution Quarter. [অর্থাৎ বেশ্যাপাড়ায় যাওয়া] ২৪.১০.৭১ জধঢ়রহম পধংব .. ঐরহফঁ এরৎষ [অর্থাৎ হিন্দু মেয়ে পেলে ধর্ষণ করা] (চলবে)
No comments