নদীতেও আছে বোস্তামী কাছিম by ইফতেখার মাহমুদ

শত বছর ধরে ধারণা ছিল, ‘বোস্তামী কাছিম’ শুধু চট্টগ্রামে বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারের পুকুরে পাওয়া যায়। সম্প্রতি বন্য প্রাণী-বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন ন্যাচারাল রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের (ক্যারিনাম) নেতৃত্বে একদল দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানী দেশের চারটি এলাকায় এ কাছিমের সন্ধান পেয়েছেন।


শ্রীমঙ্গল, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা ও মুহুরী নদীতে এ কাছিমের জাত খুঁজে নিশ্চিত করেছে বিশ্বের বন্য প্রাণী-বিষয়ক মৌলিক গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান জার্মানির ড্রেসডেনে অবস্থিত মিউজিয়াম অব জুওলজি। প্রাণিবিদ্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ভার্টিভেট জুওলজিতে বাংলাদেশের নদী-জলাশয়ে বোস্তামী কাছিম পাওয়ার বিষয় নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৩১ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী ম্যালকম স্মিথ তাঁর ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভারতবর্ষে ‘নিলসোনিয়া নিগরিকেন টার্টেল’ বা বোস্তামী কাছিম একমাত্র বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারে পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, হজরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (র.) ইরান থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় এ কাছিমগুলো নিয়ে আসেন। প্রাণিবিজ্ঞানীদেরও ধারণা জন্মায়, বোস্তামী কাছিম বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলের প্রাণী নয়। সাম্প্রতিক এ গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, বোস্তামী কাছিম বাংলাদেশ অঞ্চলের নিজস্ব প্রাণী।
১৯৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) অন্যতম বিপন্নপ্রায় প্রাণীর তালিকায় বোস্তামী কাছিমের নাম উঠে আসে। বলা হয়ে থাকে, বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজার ছাড়া বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলে এ প্রাণীর দেখা মেলে না। সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী পিটার গ্রাসবাগ তাঁর পিএইচডি গবেষণার মাধ্যমে দেখান, ভারতের আসামের বেশ কয়েকটি মন্দিরের পুকুরে বোস্তামী কাছিম রয়েছে। সেই থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, তা হলে আসাম ও বাংলাদেশের নদী-জলাশয়ে এ প্রাণীর বসবাস রয়েছে।
বাংলাদেশের নদীতে বোস্তামী কাছিম খুঁজে পাওয়া গবেষণা দলের প্রধান এস এম এ রশিদ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের চারটি এলাকায় এ কাছিমের জাত পাওয়া যাওয়ায় আমাদের মনে হচ্ছে, দেশের অন্যান্য এলাকাতেও এদের বিচরণ রয়েছে।’ বাংলাদেশের কোনো একটি এলাকা থেকে সংগ্রহ করে কাছিমগুলো বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারে রাখা হতে পারে বলে মত দেন তিনি।
শুরুটা ২০০৯ সালে, ক্যারিনামের নির্বাহী পরিচালক এস এম এ রশিদ এবং অস্ট্রীয় বিজ্ঞানী পিটার গ্রাসবাগ বাংলাদেশে মিঠা পানির কাছিমের ব্যবসা নিয়ে একটি গবেষণা করছিলেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল বাজারে একবার কিছু কাছিম বিক্রি হচ্ছিল। তাঁরা সেখানে একটি বেশ ভিন্ন ধরনের কাছিম দেখতে পান। তাৎক্ষণিকভাবে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য কাছিমটির শরীর থেকে কিছু কোষ সংগ্রহ করেন তাঁরা।
পরে ২০১০ সালে তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানিকছড়িতে জেলেদের বড়শিতে ধরা পড়া একটা কাছিম দেখতে পান। বোস্তামী কাছিমের মতো মনে হওয়ায় সেটিরও কোষ ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য সংগ্রহ করা হয়। ২০১১-১২ সালে এ প্রজাতির কাছিম মুহুরী নদী ও নেত্রকোনার একটি জলাশয় থেকেও সংগ্রহ করে গবেষক দল।
ইতিমধ্যে ড. গ্রাসবাগ জানান, জার্মানির ড্রেসডেনে অবস্থিত মিউজিয়াম অব জুওলজিতে কয়েক প্রজাতির কাছিম শনাক্ত করার জন্য গবেষণা চলছে। সেখানে সংগ্রহ করা কোষের নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করানো সম্ভব। ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা গেল দুটি টিস্যুর নমুনা, দুটিরই নিলসোনিয়া নিগ্রিক্যান্স বা বোস্তামী কাছিমের। আরও জানা গেল, এ প্রজাতির বাহ্যিক রঙের কয়েক প্রকার রয়েছে, যা বয়স বা স্থানের কারণে হতে পারে।
আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে মোট ২৬০ জাতের কাছিম রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৩০ প্রজাতির, যার ছয়টি ছাড়া বাকি সবগুলোর নাম বিপন্নপ্রায় প্রাণীর তালিকায় উঠেছে। শত বছরের ওপরে আয়ু নিয়ে জন্ম নেওয়া বোস্তামী কাছিমের যে কটি জাত দেশের বিভিন্ন নদী-জলাশয়ে পাওয়া গেছে, তার দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। তবে বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারের কাছিমগুলোর দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত। খয়েরি ও কালচে রঙের এ প্রাণী মূলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.