সংসদীয় রাজনীতির তামাশা by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
চলতি নবম জাতীয় সংসদের চারটি অধিবেশনের বিষয় নিয়ে ‘সংসদের চার অধিবেশনে জনস্বার্থ উপেক্ষিত’—এই শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে আমার দেশ পত্রিকায়। এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘চলতি নবম জাতীয় সংসদের চারটি অধিবেশনে উপেক্ষিত হয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো। সংসদের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে না জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো।
পক্ষান্তরে সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা একে অপরকে খাটো করতে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি, বিষোদগার, গালিগালাজ ও অশালীন বাদানুবাদে লিপ্ত হচ্ছেন। চলছে দুই জাতীয় নেতার লাশ-কবর আর জানাজা নিয়ে টানাটানি। বিতর্কিত করা হচ্ছে মরহুম এই নেতাদের। রাজপথের সস্তা রাজনীতি উঠে আসছে সংসদের মতো রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে। সরকারি দলের হাইকমান্ড থেকেই বিষোদগারের নোংরা রাজনীতির সূত্রপাত হওয়ায় উত্সাহিত হচ্ছেন অধস্তনরা। শুরু থেকে স্পিকার এসব অসংসদীয় ও অশালীন বক্তব্যের লাগাম টেনে না ধরার কারণেই এর মাত্রা বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন অনেকে। সংসদের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।’ (সূত্র : আমার দেশ-৬ মার্চ, ২০১০)
রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে বিগত চারটি অধিবেশনে যা ঘটেছে তাকে দুঃখজনক বা এরকম হওয়া উচিত হয়নি-না বলে বলা উচিত এ সবই হচ্ছে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির তামাশা। জনস্বার্থ রক্ষার কথা বলে নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করার ইতিহাস এদেশে নতুন নয় বরং বলা চলে শুরু থেকেই এটা হয়ে আসছে। যার কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে এদেশে যখন সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, এদেশের জনগণ সেটাকে প্রথম অবস্থায় স্বাগত জানায়। তার পরে যখন দেখে নতুন শাসকরাও জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে চলছে তখন সেই জনগণই আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। পরিবর্তিত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেও অবস্থার তারতম্য না ঘটায় জনগণ রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের ক্ষমতাকে চিহ্নিত করে এই বলে, রাজনীতি হচ্ছে এক ধরনের ব্যবসা। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে ব্যবসা ভালো হয়, না পারলে কিছুটা মন্দায় পড়তে হয়। জনগণের এ উপলব্ধি থাকলেও প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বিকল্প কিছু দৃশ্যমান না হওয়ার কারণে তারা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার মধ্যেই ঘুরপাক খায়। আর এ সুযোগে জনগণ কর্তৃক যাদের প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিদায় নেয়ার কথা তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় বহাল-তবিয়তে থেকে জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে তামাশা করতে থাকে। তামাশা এই কারণে বলছি, বিদ্যমান সংসদের মূল লক্ষ্য জনস্বার্থ রক্ষা করা নয়, মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেয়া, যেমনটা তারা করেছে মন্ত্রিসভায় রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টিকে অনুমোদন দিয়ে। এটাই হচ্ছে বিগত দিনের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে জনগণ যাতে করে প্রতিবাদী না হয়ে উঠতে পারে সেই লক্ষ্যে জনগণকে কোনো একটি বিষয়ে ব্যস্ত রাখার কৌশল হিসেবে সংসদে কাদা ছোড়াছুড়ির বিষয়টি খুব সচেতনভাবেই সচল রাখার প্রচেষ্টা চলে। এ কারণে বিষয়টিকে সংসদীয় রাজনীতির তামাশা বলাই যুক্তিযুক্ত। সংসদীয় রাজনীতি বলার কারণ হচ্ছে এ রাজনীতি জনগণের জন্য নয়, সংসদ সদস্যদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। তাই দেখা যায়, সংসদ সদস্যদের সুবিধা দেয়ার বিষয় যখন উত্থাপিত হয় তখন সরকারি দল ও বিরোধী দল বিরোধ ভুলে যায়, এক্ষেত্রে কোনো উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় না। জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে এরা অভ্যস্ত।
কিন্তু কেন এরকম হয় এটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর এখন অনেকেই জানে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের বিষয় নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য থেকেই বিষয়টি অনেকের জানা হয়ে গেছে। এরকম একটি বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, দেশের গ্যাসসম্পদের মজুদ ৫০ বছরের জন্য রেখে বিদেশে রফতানির কথা বলার কারণে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেননি ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরোক্ত কথাটির মর্ম একটাই—আর তা হলো বিদেশি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের চাহিদামাফিক চলতে সম্মত না হলে এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসা যায় না। অর্থাত্ এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এ দেশীয়দের হাতে নেই, এ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় বিদেশি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—এদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জাতীয় সার্বভৌমত্ব কতটুকু? হোক না সে ক্ষমতা সংসদীয় অথবা সামরিক। এ অবস্থাকে মেনে নেয়ার কারণে সংসদে জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়। উপেক্ষিত হয় না সেই বিষয়গুলো যেগুলো মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা পূরণ করে। ক্ষমতায় বসে বসেই সাগরের গ্যাস ব্লকের কয়েকটা বিদেশী কোম্পানিকে ত্বড়িতগতিতে দিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বন্দর ব্যবহারসহ ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার সমঝোতা, চুক্তি এই কারণে দ্রুত অগ্রসর হয়। এগুলোই হচ্ছে এদেশে সংসদীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সংসদীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জনস্বার্থের বিষয় থাকলে জনস্বার্থরক্ষার প্রশ্নে বাকবিতণ্ডা হতো। কিন্তু সেটা হয় না এটাই হচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা। ফলে প্রচলিত সংসদীয় ক্ষমতাকে গণমুখী করে তোলার লক্ষ্যে সমালোচনা করা, সংসদে কাদা ছোড়াছুড়ি, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার প্রশ্নে স্পিকারের হস্তক্ষেপকে প্রশংসা করা নিতান্তই হাস্যকর বরং এর থেকে অনেক কর্যকর বিষয় হচ্ছে জনস্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে সংসদের কার্যকলাপের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে কথা বলা অথবা বিতর্ক করা। কোন কোন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, নির্বাচিত সংসদের কার্যক্রম জনস্বার্থ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা এখন অনেক জরুরি। এ ধরনের বক্তব্য ও বিতর্ক থেকে সমাজে জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র ক্ষমতার ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন দরকার তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠত, আর এ স্পষ্টতাকে কেন্দ্র করে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের রাজনীতির ভিত্তি রচিত হতো। জাতীয় ক্ষেত্রে জনগণের রাজনীতির এই ভিত্তি গড়ে ওঠার ওপরই নির্ভর করে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত রাজনীতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ।
বর্তমানে সংসদীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি চলছে এই রাজনীতির ধারা চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত সংসদীয় ক্ষমতা অর্জনের ভিত্তি হিসেবে বিদেশি মহাশক্তিধরদের আনুকূল্য প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। বিদেশি মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণ যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের কার্যকর পথ হিসেবে এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বিষয় হয়ে থাকবে, সেখানে সংসদীয় রাজনীতিতে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হতেই থাকবে। ব্যক্তিক্রম হিসেবে সংসদীয় রাজনীতি যদি জনস্বার্থের প্রশ্নে ক্রিয়াশীল হতে থাকে তবে সেই সংসদীয় ক্ষমতা দেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্র তথা বিদেশি মহাশক্তিধরদের কোপানলে পড়বে—এটাই স্বাভাবিক। আর এদের কোপানলে পড়লে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উচ্ছেদের এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এ কারণে সংসদীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা সব সময় চেষ্টা করে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনে যা করা প্রয়োজন, তাকে দুর্বল করা। জনগণের করের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার এ কারণেই হয়। দেশীয় উত্পাদনশীল খাতের বিকাশের প্রয়োজনে জনগণের করের অর্থ ব্যবহারের প্রশ্নে যত্নশীল হওয়ার মনোভাব এই কারণেই এদেশে লক্ষণীয় নয়। তাছাড়া বিদেশি মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণে ক্ষমতায় বসে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে জনগণের করের অর্থ যদি তারা ব্যবহার করতে না পারে তবে ক্ষমতায় বসে লাভ কি? শুধু তাই নয়, গোপন এবং অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনও এর সঙ্গে জড়িত। এই কারণে এদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, অথবা সিন্ডিকেট গঠন করে অযাচিতভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হয়। ক্ষমতাধররা গোপন ও অবৈধভাবে যে অর্থ উপার্জন করে তার কোনো নথিপত্র থাকে না, ফলে এটা ধরাও মুশকিল। চাকরি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা যে ক্ষমতাধররা হাতিয়ে নিচ্ছে বিষয়টা কমবেশী সবার জানা থাকলেও এর কোনো প্রমাণপত্র থাকে না। তাছাড়া সরকারি অর্থ যেসব কাজে ব্যয় হয় সেখানেও যে নয়ছয় চলে এটা ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তরা খুব ভালো করেই জানে। মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণে অস্বীকৃতি জানালে বা অক্ষম হলে অনেক মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও, দুর্নীতি দমন কমিটিসহ তথাকথিত সুশীল সমাজের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। তাদের চাহিদামাফিক চললে সেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে উল্লিখিত সংস্থাগুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। অর্থাত্ এরা মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণের দেশীয় সামাজিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। চাহিদাপূরণে সক্ষম হলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম বা দুর্নীতি এদেশে বিচারিকভাবে অব্যাহতি পেয়ে যায় পুরস্কারস্বরূপ। এই অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া প্রচলিত সংসদীয় ক্ষমতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন (কাদা ছোড়াছুড়ি অর্থে) আনার জন্য নানামুখী সমালোচনা করে তাকে জনস্বার্থের উপযোগী করে তোলার প্রচেষ্টা এক ধরনের প্রতারণা বৈ কিছু নয়। হয়তোবা দেখা যাবে তারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন অথবা কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুবিধাভোগী হিসেবেই সমাজে বিদ্যমান। অর্থাত্ সংসদীয় রাজনীতির তামাশার পেছনে মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা পূরণে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি নিজেদের আখের গোছানোর মানসিকতা ক্রিয়াশীল। এক্ষেত্রে সংসদীয় রাজনীতির এ তামাশা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ একটাই আর সেটা হলো জনস্বার্থে সংসদের কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়া এবং সংসদ কাজগুলো ঠিকমত করছে কিনা সেই প্রশ্নে সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করার সাংবিধানিক গ্যারান্টি সৃষ্টি করা। অন্যথায় সংসদীয় রাজনীতির তামাশা এদেশে চলতেই থাকবে। অন্যথায় সংসদীয় রাজনীতির তামাশা এদেশে চলতেই থাকবে।
জনস্বার্থে সংসদের কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়ার কথা বললে অনেকে হয়তো বলবেন, এটাতো সংবিধানে ঠিক করাই আছে। সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে যা বলা আছে সেটাই হচ্ছে সংসদের কার্যপরিধি। কিন্তু বাস্তবতা বলে অন্য কথা। এসব মূলনীতির কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। এসব মূলনীতি অমান্য করে সংসদীয় কার্যকলাপ চললে তার প্রতিবাদে সাংবিধানিকভাবে জনগণের কিছু করার থাকে না। এ জন্য সংবিধানে বলা আছে, এসব মূলনীতি আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য হবে না। অর্থাত্ এসব মূলনীতির কোনো কার্যকর প্রয়োগ থেকে সংসদ বিচ্যুত হলে জনগণের কিছু করার ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও যারা সমাজ প্রগতির নামে ’৭২ সালের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেন তারা প্রকৃত অর্থে সংসদের কার্যকলাপের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে বাদ দিয়েই চলতে চান। সংসদের কার্যকলাপের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব না থাকার ফল কী দাঁড়িয়েছে সেটা গত ৩৮ বছরের বাংলাদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একটি দেশের সমৃদ্ধির জন্য ৩৮ বছর সময় মোটেই কম নয়, বরং বিশ্বের কিছু দেশের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এর থেকে অনেক কম সময়ের মধ্যেই তারা তাদের দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং ক্রমেই তারা তাদের দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে চলেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মালয়েশিয়া বা ভিয়েতনামের কথা।
দেশকে উন্নত করতে হলে কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। দেশকে সমৃদ্ধিশালী করার ক্ষেত্রে অর্থের যোগানদার যারা তাদের জীবনের প্রতি যত্নশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যোগানকৃত অর্থের উত্পাদনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যারা অগ্রসর চিন্তার অধিকারী তারা তথ্য-প্রমাণসহ দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীতে একটা জীবের মধ্যে নিজের প্রয়োজনের থেকে বেশি সম্পদ সৃষ্টির ক্ষমতা আছে। আর সেটা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তি। উত্পাদনশীল কাজে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যবহার তার প্রয়োজনের থেকে বেশি সম্পদ তৈরি করে। মানুষের এ শ্রমশক্তিকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ বেশি সম্পদ তৈরি হয় সেই সম্পদই হচ্ছে একটা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর শক্তি। এ শক্তিকে একটা দেশের অর্থনীতিতে তখনই ধরে রাখা এবং নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরিতে কাজে লাগানো সম্ভব যখন এ শ্রমশক্তিকে কেন্দ্র করে উত্পাদিত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করা হয়। আর এই বাজার নিশ্চিত করা সম্ভব শুধু ভোগ্যপণ্য উত্পাদনকে কেন্দ্র করে নয়, বরং উত্পাদনের উপায় হিসাবে যা কাজ করে (কাঁচামাল, জ্বালানি, লৌহ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) তা উত্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোগ্যপণ্য উত্পাদনের বিকাশের ফলে। এটাই হচ্ছে অগ্রসর চিন্তাকে অনুসরণ করে দেশের অর্থনীতিকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিলে দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট পণ্যের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে ওঠে। পণ্যের বাজারের নিশ্চয়তা শ্রমশক্তিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত সম্পদকে দেশীয় অর্থনীতিতে ধরে রাখার কার্যকর হাতিয়ার।
সংসদকে জনস্বার্থে কার্যকর হিসেবে দেখতে চাইলে দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার বিষয়বস্তুকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে অনুসরণ করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমাদের দেশের সংসদ সদস্যরা জনস্বার্থে দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার উল্লিখিত অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ না করে অনুসরণ করেন মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষাকারী মুক্তবাজার অর্থনীতিকে। এই প্রশ্নে সংসদ সদস্যদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জনস্বার্থে কার্যকর নয় এমন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যখন সংসদের সরকারি দল এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের কোনো বিতর্ক হয় না তখন একথা স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, জনগণের করের অর্থ খরচ করে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি সেই সংসদ জনস্বার্থে কার্যকর হতেই পারে না। ফলে এ ধরনের সংসদে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, গালিগালাজ ইত্যাদি হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং সংসদীয় রাজনীতির এই তামাশা যে স্বাভাবিক বিষয় এটাই আমাদের বুঝতে হবে এবং জনস্বার্থে কার্যকর সংসদ গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবে দেশীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে সংসদকে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য করার পথেই জনগণ ও দেশের উন্নতিকামী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগোতে হবে। এই কাজে দেশের জনগণের সাফল্যই কেবল সংসদকে জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিতর্কের তামাশা থেকে মুক্ত করবে।
রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে বিগত চারটি অধিবেশনে যা ঘটেছে তাকে দুঃখজনক বা এরকম হওয়া উচিত হয়নি-না বলে বলা উচিত এ সবই হচ্ছে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির তামাশা। জনস্বার্থ রক্ষার কথা বলে নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করার ইতিহাস এদেশে নতুন নয় বরং বলা চলে শুরু থেকেই এটা হয়ে আসছে। যার কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতাকে এদেশে যখন সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, এদেশের জনগণ সেটাকে প্রথম অবস্থায় স্বাগত জানায়। তার পরে যখন দেখে নতুন শাসকরাও জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে চলছে তখন সেই জনগণই আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। পরিবর্তিত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেও অবস্থার তারতম্য না ঘটায় জনগণ রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের ক্ষমতাকে চিহ্নিত করে এই বলে, রাজনীতি হচ্ছে এক ধরনের ব্যবসা। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে ব্যবসা ভালো হয়, না পারলে কিছুটা মন্দায় পড়তে হয়। জনগণের এ উপলব্ধি থাকলেও প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বিকল্প কিছু দৃশ্যমান না হওয়ার কারণে তারা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার মধ্যেই ঘুরপাক খায়। আর এ সুযোগে জনগণ কর্তৃক যাদের প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিদায় নেয়ার কথা তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় বহাল-তবিয়তে থেকে জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে তামাশা করতে থাকে। তামাশা এই কারণে বলছি, বিদ্যমান সংসদের মূল লক্ষ্য জনস্বার্থ রক্ষা করা নয়, মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেয়া, যেমনটা তারা করেছে মন্ত্রিসভায় রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টিকে অনুমোদন দিয়ে। এটাই হচ্ছে বিগত দিনের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে জনগণ যাতে করে প্রতিবাদী না হয়ে উঠতে পারে সেই লক্ষ্যে জনগণকে কোনো একটি বিষয়ে ব্যস্ত রাখার কৌশল হিসেবে সংসদে কাদা ছোড়াছুড়ির বিষয়টি খুব সচেতনভাবেই সচল রাখার প্রচেষ্টা চলে। এ কারণে বিষয়টিকে সংসদীয় রাজনীতির তামাশা বলাই যুক্তিযুক্ত। সংসদীয় রাজনীতি বলার কারণ হচ্ছে এ রাজনীতি জনগণের জন্য নয়, সংসদ সদস্যদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। তাই দেখা যায়, সংসদ সদস্যদের সুবিধা দেয়ার বিষয় যখন উত্থাপিত হয় তখন সরকারি দল ও বিরোধী দল বিরোধ ভুলে যায়, এক্ষেত্রে কোনো উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় না। জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে এরা অভ্যস্ত।
কিন্তু কেন এরকম হয় এটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর এখন অনেকেই জানে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের বিষয় নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য থেকেই বিষয়টি অনেকের জানা হয়ে গেছে। এরকম একটি বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, দেশের গ্যাসসম্পদের মজুদ ৫০ বছরের জন্য রেখে বিদেশে রফতানির কথা বলার কারণে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেননি ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরোক্ত কথাটির মর্ম একটাই—আর তা হলো বিদেশি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের চাহিদামাফিক চলতে সম্মত না হলে এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসা যায় না। অর্থাত্ এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এ দেশীয়দের হাতে নেই, এ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় বিদেশি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—এদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জাতীয় সার্বভৌমত্ব কতটুকু? হোক না সে ক্ষমতা সংসদীয় অথবা সামরিক। এ অবস্থাকে মেনে নেয়ার কারণে সংসদে জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়। উপেক্ষিত হয় না সেই বিষয়গুলো যেগুলো মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা পূরণ করে। ক্ষমতায় বসে বসেই সাগরের গ্যাস ব্লকের কয়েকটা বিদেশী কোম্পানিকে ত্বড়িতগতিতে দিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বন্দর ব্যবহারসহ ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার সমঝোতা, চুক্তি এই কারণে দ্রুত অগ্রসর হয়। এগুলোই হচ্ছে এদেশে সংসদীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সংসদীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জনস্বার্থের বিষয় থাকলে জনস্বার্থরক্ষার প্রশ্নে বাকবিতণ্ডা হতো। কিন্তু সেটা হয় না এটাই হচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা। ফলে প্রচলিত সংসদীয় ক্ষমতাকে গণমুখী করে তোলার লক্ষ্যে সমালোচনা করা, সংসদে কাদা ছোড়াছুড়ি, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার প্রশ্নে স্পিকারের হস্তক্ষেপকে প্রশংসা করা নিতান্তই হাস্যকর বরং এর থেকে অনেক কর্যকর বিষয় হচ্ছে জনস্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে সংসদের কার্যকলাপের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে কথা বলা অথবা বিতর্ক করা। কোন কোন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, নির্বাচিত সংসদের কার্যক্রম জনস্বার্থ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা এখন অনেক জরুরি। এ ধরনের বক্তব্য ও বিতর্ক থেকে সমাজে জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র ক্ষমতার ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন দরকার তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠত, আর এ স্পষ্টতাকে কেন্দ্র করে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের রাজনীতির ভিত্তি রচিত হতো। জাতীয় ক্ষেত্রে জনগণের রাজনীতির এই ভিত্তি গড়ে ওঠার ওপরই নির্ভর করে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত রাজনীতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ।
বর্তমানে সংসদীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি চলছে এই রাজনীতির ধারা চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত সংসদীয় ক্ষমতা অর্জনের ভিত্তি হিসেবে বিদেশি মহাশক্তিধরদের আনুকূল্য প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। বিদেশি মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণ যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের কার্যকর পথ হিসেবে এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বিষয় হয়ে থাকবে, সেখানে সংসদীয় রাজনীতিতে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হতেই থাকবে। ব্যক্তিক্রম হিসেবে সংসদীয় রাজনীতি যদি জনস্বার্থের প্রশ্নে ক্রিয়াশীল হতে থাকে তবে সেই সংসদীয় ক্ষমতা দেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্র তথা বিদেশি মহাশক্তিধরদের কোপানলে পড়বে—এটাই স্বাভাবিক। আর এদের কোপানলে পড়লে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উচ্ছেদের এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। এ কারণে সংসদীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা সব সময় চেষ্টা করে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনে যা করা প্রয়োজন, তাকে দুর্বল করা। জনগণের করের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার এ কারণেই হয়। দেশীয় উত্পাদনশীল খাতের বিকাশের প্রয়োজনে জনগণের করের অর্থ ব্যবহারের প্রশ্নে যত্নশীল হওয়ার মনোভাব এই কারণেই এদেশে লক্ষণীয় নয়। তাছাড়া বিদেশি মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণে ক্ষমতায় বসে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে জনগণের করের অর্থ যদি তারা ব্যবহার করতে না পারে তবে ক্ষমতায় বসে লাভ কি? শুধু তাই নয়, গোপন এবং অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনও এর সঙ্গে জড়িত। এই কারণে এদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, অথবা সিন্ডিকেট গঠন করে অযাচিতভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হয়। ক্ষমতাধররা গোপন ও অবৈধভাবে যে অর্থ উপার্জন করে তার কোনো নথিপত্র থাকে না, ফলে এটা ধরাও মুশকিল। চাকরি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা যে ক্ষমতাধররা হাতিয়ে নিচ্ছে বিষয়টা কমবেশী সবার জানা থাকলেও এর কোনো প্রমাণপত্র থাকে না। তাছাড়া সরকারি অর্থ যেসব কাজে ব্যয় হয় সেখানেও যে নয়ছয় চলে এটা ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তরা খুব ভালো করেই জানে। মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণে অস্বীকৃতি জানালে বা অক্ষম হলে অনেক মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও, দুর্নীতি দমন কমিটিসহ তথাকথিত সুশীল সমাজের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। তাদের চাহিদামাফিক চললে সেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে উল্লিখিত সংস্থাগুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। অর্থাত্ এরা মহাশক্তিধরদের চাহিদা পূরণের দেশীয় সামাজিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। চাহিদাপূরণে সক্ষম হলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম বা দুর্নীতি এদেশে বিচারিকভাবে অব্যাহতি পেয়ে যায় পুরস্কারস্বরূপ। এই অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া প্রচলিত সংসদীয় ক্ষমতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন (কাদা ছোড়াছুড়ি অর্থে) আনার জন্য নানামুখী সমালোচনা করে তাকে জনস্বার্থের উপযোগী করে তোলার প্রচেষ্টা এক ধরনের প্রতারণা বৈ কিছু নয়। হয়তোবা দেখা যাবে তারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন অথবা কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুবিধাভোগী হিসেবেই সমাজে বিদ্যমান। অর্থাত্ সংসদীয় রাজনীতির তামাশার পেছনে মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা পূরণে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি নিজেদের আখের গোছানোর মানসিকতা ক্রিয়াশীল। এক্ষেত্রে সংসদীয় রাজনীতির এ তামাশা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ একটাই আর সেটা হলো জনস্বার্থে সংসদের কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়া এবং সংসদ কাজগুলো ঠিকমত করছে কিনা সেই প্রশ্নে সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করার সাংবিধানিক গ্যারান্টি সৃষ্টি করা। অন্যথায় সংসদীয় রাজনীতির তামাশা এদেশে চলতেই থাকবে। অন্যথায় সংসদীয় রাজনীতির তামাশা এদেশে চলতেই থাকবে।
জনস্বার্থে সংসদের কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়ার কথা বললে অনেকে হয়তো বলবেন, এটাতো সংবিধানে ঠিক করাই আছে। সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে যা বলা আছে সেটাই হচ্ছে সংসদের কার্যপরিধি। কিন্তু বাস্তবতা বলে অন্য কথা। এসব মূলনীতির কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। এসব মূলনীতি অমান্য করে সংসদীয় কার্যকলাপ চললে তার প্রতিবাদে সাংবিধানিকভাবে জনগণের কিছু করার থাকে না। এ জন্য সংবিধানে বলা আছে, এসব মূলনীতি আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য হবে না। অর্থাত্ এসব মূলনীতির কোনো কার্যকর প্রয়োগ থেকে সংসদ বিচ্যুত হলে জনগণের কিছু করার ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও যারা সমাজ প্রগতির নামে ’৭২ সালের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেন তারা প্রকৃত অর্থে সংসদের কার্যকলাপের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে বাদ দিয়েই চলতে চান। সংসদের কার্যকলাপের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব না থাকার ফল কী দাঁড়িয়েছে সেটা গত ৩৮ বছরের বাংলাদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একটি দেশের সমৃদ্ধির জন্য ৩৮ বছর সময় মোটেই কম নয়, বরং বিশ্বের কিছু দেশের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এর থেকে অনেক কম সময়ের মধ্যেই তারা তাদের দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং ক্রমেই তারা তাদের দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে চলেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মালয়েশিয়া বা ভিয়েতনামের কথা।
দেশকে উন্নত করতে হলে কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। দেশকে সমৃদ্ধিশালী করার ক্ষেত্রে অর্থের যোগানদার যারা তাদের জীবনের প্রতি যত্নশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যোগানকৃত অর্থের উত্পাদনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যারা অগ্রসর চিন্তার অধিকারী তারা তথ্য-প্রমাণসহ দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীতে একটা জীবের মধ্যে নিজের প্রয়োজনের থেকে বেশি সম্পদ সৃষ্টির ক্ষমতা আছে। আর সেটা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তি। উত্পাদনশীল কাজে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যবহার তার প্রয়োজনের থেকে বেশি সম্পদ তৈরি করে। মানুষের এ শ্রমশক্তিকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ বেশি সম্পদ তৈরি হয় সেই সম্পদই হচ্ছে একটা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর শক্তি। এ শক্তিকে একটা দেশের অর্থনীতিতে তখনই ধরে রাখা এবং নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরিতে কাজে লাগানো সম্ভব যখন এ শ্রমশক্তিকে কেন্দ্র করে উত্পাদিত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করা হয়। আর এই বাজার নিশ্চিত করা সম্ভব শুধু ভোগ্যপণ্য উত্পাদনকে কেন্দ্র করে নয়, বরং উত্পাদনের উপায় হিসাবে যা কাজ করে (কাঁচামাল, জ্বালানি, লৌহ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) তা উত্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোগ্যপণ্য উত্পাদনের বিকাশের ফলে। এটাই হচ্ছে অগ্রসর চিন্তাকে অনুসরণ করে দেশের অর্থনীতিকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিলে দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট পণ্যের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে ওঠে। পণ্যের বাজারের নিশ্চয়তা শ্রমশক্তিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত সম্পদকে দেশীয় অর্থনীতিতে ধরে রাখার কার্যকর হাতিয়ার।
সংসদকে জনস্বার্থে কার্যকর হিসেবে দেখতে চাইলে দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার বিষয়বস্তুকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে অনুসরণ করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমাদের দেশের সংসদ সদস্যরা জনস্বার্থে দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার উল্লিখিত অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ না করে অনুসরণ করেন মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষাকারী মুক্তবাজার অর্থনীতিকে। এই প্রশ্নে সংসদ সদস্যদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জনস্বার্থে কার্যকর নয় এমন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যখন সংসদের সরকারি দল এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের কোনো বিতর্ক হয় না তখন একথা স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, জনগণের করের অর্থ খরচ করে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি সেই সংসদ জনস্বার্থে কার্যকর হতেই পারে না। ফলে এ ধরনের সংসদে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিষয় নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, গালিগালাজ ইত্যাদি হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং সংসদীয় রাজনীতির এই তামাশা যে স্বাভাবিক বিষয় এটাই আমাদের বুঝতে হবে এবং জনস্বার্থে কার্যকর সংসদ গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবে দেশীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে সংসদকে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য করার পথেই জনগণ ও দেশের উন্নতিকামী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগোতে হবে। এই কাজে দেশের জনগণের সাফল্যই কেবল সংসদকে জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন বিতর্কের তামাশা থেকে মুক্ত করবে।
No comments