রেলগাড়ি ঝমাঝম by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব ধ্যানস্থ অবস্থায় যোগাসনে বসিয়া আছেন। শিষ্য তাহার পদপ্রান্তে উপবিষ্ট। গুরুদেবের মুখমণ্ডল হইতে এক অলৌকিক বিভা চতুষ্পার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। তাহা দেখিয়া শিষ্য রীতিমত অভিভূত। প্রভু যে বিশ্ব-সংসারের প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী, এতদবিষয়ে শিষ্যের মনে কোনো দ্বিধা নাই। এক সময়ে গুরুদেবের ধ্যান ভঙ্গ হইল। তিনি শিষ্যের দিকে চাহিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম।’
শিষ্য সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসিল, প্রভু! ইহা তো কেবল একটি ছড়ার প্রথমাংশ।
হ্যাঁ। গুরুদেব পুনরায় সহাস্যে আবৃত্তি করিলেন, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’।
মহাত্মন! ইহার মাজেজা কি?
মাজেজা অবশ্যই আছে। গুরুদেব বলিলেন, চলিত রেলগাড়ির শব্দ শুনিলে বোঝা যাইবে উহাতে ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’ কথাটি সারাক্ষণ অনুরণিত হইতেছে। ইহা গাড়ির সচলতার প্রতীক। এই প্রসঙ্গে বলিতে হয়, সফট মার্শাল ল’ দিয়া ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল মইন উ আহমদ যে কত বড় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, উহা তাহার কাছে না গেলে বোঝা যায় না।
রেল গাড়ির সহিত জেনারেল মইন ইউ আহমদের সম্পর্ক কী শিষ্য তাহা বুঝিতে পারিল না। সে প্রশ্ন করিল, আপনি কি তাহার কাছে গিয়াছেন প্রভু?
কাছে যাওয়ার অর্থ কেবল তাহার সান্নিধ্যলাভ নহে। গুরুদেব জানাইলেন, কাছে যাওয়ার অর্থ হইতেছে তাহার চিন্তা ও দর্শনকে অনুধাবন করা। তিনি যে দেশকে রেলগাড়ির সহিত তুলনা করিয়াছিলেন, তাহাতে বোঝা যায়, তিনি কত বড় মনীষী। সম্ভবত তিনি বাল্যকালে ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’ ছড়াটি আবৃত্তি করিতেন। তবে আমি তাহার বই পাঠ করিয়া এই তথ্যটি সম্পর্কে কনফারমেশন পাই নাই।
শিষ্য নিশ্চুপ রহিল। প্রভুর বক্তব্যের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিতে পারিল না।
গুরুদেব পুনরায় কহিলেন, দেশকে রেলগাড়ির সহিত তুলনা করা কোনো সাধারণ ব্যাপার নহে। জেনারেল মইন কোনো সাধারণ ব্যক্তিও নহেন। তিনি সেনাপ্রধান হইয়াও রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে সুশীল সমাজকে গণতন্ত্রের ব্যাপারে সবক দিয়াছিলেন।
প্রভু! তিনি আমাদিগকে আলু খাইতেও উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। শিষ্য জানাইল।
বত্স! উহাকে কেবল আলু খাওয়া হিসাবে দেখিলে চলিবে না। উহা ছিল একপ্রকার জীবনদর্শন। আলুর নানাবিধ আইটেম দ্বারা তিনি মানুষের জীবনকে মহিমান্বিত করায় ব্রতী হইয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় এইবার আলুর বাম্পার ফলন হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল মইন নির্দেশিত আলুর মহিমা আমরা ভুলিতে বসিয়াছি।
স্যার! অদ্য কী আমরা আলুদর্শন সম্পর্কে ‘আলুচনা’ করিব?
না, বত্স! না। আমাদের আলোচনা কিঞ্চিত্ লাইনচ্যুত হইয়াছে। আমরা জেনারেল মইন কথিত রেলগাড়িটি কী অবস্থায় চলিতেছে, তাহা বুঝিতে চেষ্টা করিব।
হুজুর। গোস্তাকি মাফ করিলে এ বিষয়ে আমার অভিমত বলিতে পারি!
তুমি নির্ভয়ে বলো।
আমার ধারণা, নির্বাচনের পর রেলগাড়িটি গণতন্ত্রের রেললাইন ধরিয়া সামনে আগাইয়া যাইতেছে। তবে উহার গন্তব্যের কোনো ইস্টিশন নাই।
তোমাকে ইতোপূর্বে আমার স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের কথা বলিয়াছিলাম। উহা কি বিস্মৃত হইয়াছ?
কিছুই বিস্মৃত হই নাই প্রভু! আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, রেলগাড়িটি একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে অগ্রসর হইতেছে। সম্ভবত সম্মুখে একটি বিপজ্জনক সেতু রহিয়াছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আপনি দেখিতে পাইলেন সুড়ঙ্গের সামনে একটি প্ল্যাকার্ডে লিখিত আছে : ‘সাবধান! সামনে বিপদ।’ উহা দেখিয়া আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
সাধু! তোমার স্মৃতিশক্তির তারিফ না করিয়া পারিতেছি না। এক্ষণে বলো সরকার ও বিরোধী দলের মূল সমস্যা কি?
উহাদের সাপ ও নেউলের সম্পর্কই মূল সমস্যা। উভয় পক্ষ কেহ কাহাকেও সহ্য করিতে পারে না। শিষ্য বলিল, বিরোধী দল সংসদে যোগদান করিলে রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি হইবে আশা করা হইয়াছিল। কিন্তু সরকারি দল ও বিরোধী দল সংসদে দুই নেতার লাশের রাজনীতি শুরু করিল। এইসব লইয়া অধিবেশনকালে প্রায় হাতাহাতি মারামারির যোগাড়। দেরিতে হইলেও মাননীয় স্পিকার অবশ্য একটি শক্ত অবস্থান লইয়াছেন। তবে উহাতে পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক হইবে, তাহা এখনই বলা যায় না।
গুরুদেব বলিলেন, সংসদের ঘটনা সম্পর্কে তুমি যথাযথ অবহিত রহিয়াছ। তবে রাজনীতি আজকাল সংসদের চৌহদ্দি অতিক্রম করিয়া মাঠে-ময়দানে চলিয়া যাইতেছে। আমি তাহা লইয়া শঙ্কিত।
কেন প্রভু?
আগামী ১৮ই মার্চ হইতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফর শুরু হইবে। দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের লইয়া এই জন্য ১৬টি দল করা হইয়াছে। অন্যদিকে আগামী ২৭ মার্চ হইতে বিএনপি বিভাগীয় পর্যায়ে গণসংযোগ অভিযান আরম্ভ করিবে। ঐদিন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের মহাসমাবেশে যোগদান করিবেন। পর্যায়ক্রমে ৬টি বিভাগের মহাসমাবেশেই তাহার যোগদানের কথা রহিয়াছে। একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে মুখোমুখি হইলে যে কোনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিতে পারে। গুরুদেব কহিলেন।
মহাত্মন! উভয় দল এতদিন কেবল প্রয়াত দুই নেতাকে লইয়া নেতিবাচক রাজনীতিতে মাতিয়াছিল। এইবার তাহারা আগামী প্রজন্মের দুই অবশ্যম্ভাবী নেতাকে লইয়া রাজনীতির আকাশে ঝড় তুলিয়াছে। এই দুই ভবিষ্যত্ নেতা হইতেছেন তারেক রহমান এবং সজীব ওয়াজেদ জয়। এতদিন তারেক রহমানের নানাবিধ দুর্নীতির কাহিনী আওয়ামী লীগের সমালোচনার খোরাক হইয়াছিল। এইবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিদ্যুত্ সেক্টর ও ভিওআইপি’র দুর্নীতির কথা বিএনপির সমালোচনার খোরাক হইয়াছে।
বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমান এই দেশের ভবিষ্যত্ কাণ্ডারি। গুরুদেব বলিলেন, দুইজনের মধ্যেই যে অমিত সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা কোনোরূপেই ব্যাহত করা উচিত নহে। দেশের স্বার্থেই উভয়কে কর্দমাক্ত রাজনীতিতে ঠেলিয়া দেওয়া ঠিক হইবে না। কিন্তু আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করিব ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইতে বহুদূরে সরিয়া আসিয়াছি।
উহা কি প্রভু?
আমাদের বড় মুরুব্বি আমেরিকা প্রতি বত্সর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে। উহা রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ২০০৯-এর বাংলাদেশ সম্পর্কিত যে মূল্যায়ন রিপোর্ট পাওয়া গিয়াছে, উহাতে আমাদের দেশের চিত্রটি মোটেই সুখকর নহে।
গুরুদেব তাহার ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া ‘২০০৯ হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট : বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টটি স্ক্রিনের উপরে তুলিয়া আনিলেন। শিষ্য উহা পাঠ করিল। অনলাইনে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ড বাড়িয়াছে শতকরা ৩ ভাগ। সরকার এই সকল হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। এতদ্ব্যতীত বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়িয়াছে শতকরা ৩ দশমিক ৩ ভাগ। এই সকল সহিংসতার শিকার হইয়াছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীগণ।
শিষ্য আরও পাঠ করিল : ‘জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইলেও দেশটির মানবাধিকার রেকর্ডে খুবই সামান্য পরিমাণ উন্নতি হইয়াছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, খেয়াল-খুশিমত গ্রেফতার ও আটক, সাংবাদিকদের হয়রানিসহ মারাত্মক সব নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়াছে। বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) বিদ্রোহের ঘটনায় অভিযুক্তদের নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তদন্তে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হইয়াছে।
দীর্ঘ প্রতিবেদনটি পাঠের পর শিষ্য জিজ্ঞাসিল, মহাত্মন! আমাদের মহামুরুব্বি আমেরিকার এই রিপোর্ট কতখানি সত্য?
রিপোর্টের তথ্যাদি সঠিক নহে বলিয়া আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু দাবি করিয়াছেন। তাহার মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্বাপেক্ষা অনেক ভালো। তাহার এই বক্তব্যটি কেবল সরকারের নহে, দেশের মানুষের বলিয়া শামসুল হক টুকু দাবি করেন। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার একেএম শহীদুল হক দাবি করিয়াছেন, রাজধানীর কোনো থানায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটে নাই। গুরুদেব জানাইলেন।
শিষ্য বলিল, স্যার! ডিএমপি কমিশনারের সাম্প্রতিক অনেক বক্তব্যেই আমি বিভ্রান্ত।
তিনি কি বক্তব্য দিয়াছেন?
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে পরিবহন ধর্মঘট হয়, সেই সম্পর্কে ডিএমপি কমিশনার বলিয়াছেন, পরিবহনে চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা তিনি জানেন না। এইরূপ কোনো অভিযোগও করা হয় নাই।
বিষয়টি সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?
সম্প্রতি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়বিষয়ক স্থায়ী কমিটির দুই সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের নিকট পরিবহনে চাঁদাবাজির উল্লেখ করিয়াছেন। উহাতে আমি বিভ্রান্ত এই জন্য যে, সংসদ সদস্য ও ডিএমপি কমিশনারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে যে কোনো একটি বক্তব্য সত্য, অন্যটি অসত্য। এমপিদ্বয় এবং পুলিশ কমিশনারের মধ্যে কে সত্য কথা বলিতেছেন তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।
তাহাদের উভয়পক্ষই সত্য কথা বলিয়াছেন। গুরুদেব রহস্যভরে কহিলেন।
ইহা কিভাবে সম্ভব প্রভু?
সংসদ সদস্যদ্বয় কেবল পরিবহনে চাঁদাবাজির উল্লেখ করেন নাই, কাহার অনুপ্রেরণায় উহা ঘটিতেছে তাহার নামও উল্লেখ করিয়াছেন।
তাহা হইলে কি পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য অসত্য?
না। উহাও তাহার দিক হইতে সত্য। পুলিশ কমিশনার চাঁদাবাজির জন্য কাহাকেও চিহ্নিত করিতে পারেন নাই। কারণ নীরব চাঁদাবাজি হইলে তিনি উহা জানিবেন কি প্রকারে? তিনি যাহা দেখেন নাই তাহা স্বীকার করিয়া অসত্য বক্তব্য নিশ্চয়ই দিতে পারেন না। নীরব চাঁদাবাজগণ সরব না হইলে পুলিশ কমিশনারের কিছুই করণীয় নাই।
স্যার! তিনি তো পুলিশ হেফাজতে কাহারও মৃত্যুর কথাও স্বীকার করেন না।
ইহাও অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা পুলিশগণ কেহই স্বীকার করে না। এমতাবস্থায় কমিশনার মহোদয় কোন তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে বলিবেন যে, পুলিশ হেফাজতে কাহারও মৃত্যু হইয়াছে? যতদিন পুলিশগণ স্বপ্রণোদিত হইয়া তাহাদের অপরাধ স্বীকার না করিবে, ততদিন কমিশনার সাহেব পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর কথাও নৈতিকভাবে স্বীকার করিতে পারেন না।
প্রভু! এই যদি দেশের অবস্থা হয়, তাহা হইলে চলিবে কিভাবে?
বত্স! তুমি অযথা উত্কণ্ঠিত হইয়াছ। দেশ তো রেলগাড়ির ন্যায় লাইন ধরিয়া ভালোই চলিতেছে। এই জন্যই তো কোনো অজ্ঞাত ছড়াকার ছড়া কাটিয়াছিলেন, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম!’
তাহা হইলে কি দেশের অবস্থা লইয়া আমাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নাই?
কিঞ্চিত্ কারণ আছে। গুরুদেব ঈষত্ হাস্য সহকারে কহিলেন, ওই ছড়ার পরবর্তী চরণ হইল : ‘পা পিছলে আলুর দম।’
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
হ্যাঁ। গুরুদেব পুনরায় সহাস্যে আবৃত্তি করিলেন, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’।
মহাত্মন! ইহার মাজেজা কি?
মাজেজা অবশ্যই আছে। গুরুদেব বলিলেন, চলিত রেলগাড়ির শব্দ শুনিলে বোঝা যাইবে উহাতে ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’ কথাটি সারাক্ষণ অনুরণিত হইতেছে। ইহা গাড়ির সচলতার প্রতীক। এই প্রসঙ্গে বলিতে হয়, সফট মার্শাল ল’ দিয়া ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল মইন উ আহমদ যে কত বড় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, উহা তাহার কাছে না গেলে বোঝা যায় না।
রেল গাড়ির সহিত জেনারেল মইন ইউ আহমদের সম্পর্ক কী শিষ্য তাহা বুঝিতে পারিল না। সে প্রশ্ন করিল, আপনি কি তাহার কাছে গিয়াছেন প্রভু?
কাছে যাওয়ার অর্থ কেবল তাহার সান্নিধ্যলাভ নহে। গুরুদেব জানাইলেন, কাছে যাওয়ার অর্থ হইতেছে তাহার চিন্তা ও দর্শনকে অনুধাবন করা। তিনি যে দেশকে রেলগাড়ির সহিত তুলনা করিয়াছিলেন, তাহাতে বোঝা যায়, তিনি কত বড় মনীষী। সম্ভবত তিনি বাল্যকালে ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’ ছড়াটি আবৃত্তি করিতেন। তবে আমি তাহার বই পাঠ করিয়া এই তথ্যটি সম্পর্কে কনফারমেশন পাই নাই।
শিষ্য নিশ্চুপ রহিল। প্রভুর বক্তব্যের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিতে পারিল না।
গুরুদেব পুনরায় কহিলেন, দেশকে রেলগাড়ির সহিত তুলনা করা কোনো সাধারণ ব্যাপার নহে। জেনারেল মইন কোনো সাধারণ ব্যক্তিও নহেন। তিনি সেনাপ্রধান হইয়াও রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে সুশীল সমাজকে গণতন্ত্রের ব্যাপারে সবক দিয়াছিলেন।
প্রভু! তিনি আমাদিগকে আলু খাইতেও উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। শিষ্য জানাইল।
বত্স! উহাকে কেবল আলু খাওয়া হিসাবে দেখিলে চলিবে না। উহা ছিল একপ্রকার জীবনদর্শন। আলুর নানাবিধ আইটেম দ্বারা তিনি মানুষের জীবনকে মহিমান্বিত করায় ব্রতী হইয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় এইবার আলুর বাম্পার ফলন হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল মইন নির্দেশিত আলুর মহিমা আমরা ভুলিতে বসিয়াছি।
স্যার! অদ্য কী আমরা আলুদর্শন সম্পর্কে ‘আলুচনা’ করিব?
না, বত্স! না। আমাদের আলোচনা কিঞ্চিত্ লাইনচ্যুত হইয়াছে। আমরা জেনারেল মইন কথিত রেলগাড়িটি কী অবস্থায় চলিতেছে, তাহা বুঝিতে চেষ্টা করিব।
হুজুর। গোস্তাকি মাফ করিলে এ বিষয়ে আমার অভিমত বলিতে পারি!
তুমি নির্ভয়ে বলো।
আমার ধারণা, নির্বাচনের পর রেলগাড়িটি গণতন্ত্রের রেললাইন ধরিয়া সামনে আগাইয়া যাইতেছে। তবে উহার গন্তব্যের কোনো ইস্টিশন নাই।
তোমাকে ইতোপূর্বে আমার স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের কথা বলিয়াছিলাম। উহা কি বিস্মৃত হইয়াছ?
কিছুই বিস্মৃত হই নাই প্রভু! আপনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, রেলগাড়িটি একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে অগ্রসর হইতেছে। সম্ভবত সম্মুখে একটি বিপজ্জনক সেতু রহিয়াছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আপনি দেখিতে পাইলেন সুড়ঙ্গের সামনে একটি প্ল্যাকার্ডে লিখিত আছে : ‘সাবধান! সামনে বিপদ।’ উহা দেখিয়া আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
সাধু! তোমার স্মৃতিশক্তির তারিফ না করিয়া পারিতেছি না। এক্ষণে বলো সরকার ও বিরোধী দলের মূল সমস্যা কি?
উহাদের সাপ ও নেউলের সম্পর্কই মূল সমস্যা। উভয় পক্ষ কেহ কাহাকেও সহ্য করিতে পারে না। শিষ্য বলিল, বিরোধী দল সংসদে যোগদান করিলে রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি হইবে আশা করা হইয়াছিল। কিন্তু সরকারি দল ও বিরোধী দল সংসদে দুই নেতার লাশের রাজনীতি শুরু করিল। এইসব লইয়া অধিবেশনকালে প্রায় হাতাহাতি মারামারির যোগাড়। দেরিতে হইলেও মাননীয় স্পিকার অবশ্য একটি শক্ত অবস্থান লইয়াছেন। তবে উহাতে পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক হইবে, তাহা এখনই বলা যায় না।
গুরুদেব বলিলেন, সংসদের ঘটনা সম্পর্কে তুমি যথাযথ অবহিত রহিয়াছ। তবে রাজনীতি আজকাল সংসদের চৌহদ্দি অতিক্রম করিয়া মাঠে-ময়দানে চলিয়া যাইতেছে। আমি তাহা লইয়া শঙ্কিত।
কেন প্রভু?
আগামী ১৮ই মার্চ হইতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফর শুরু হইবে। দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের লইয়া এই জন্য ১৬টি দল করা হইয়াছে। অন্যদিকে আগামী ২৭ মার্চ হইতে বিএনপি বিভাগীয় পর্যায়ে গণসংযোগ অভিযান আরম্ভ করিবে। ঐদিন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের মহাসমাবেশে যোগদান করিবেন। পর্যায়ক্রমে ৬টি বিভাগের মহাসমাবেশেই তাহার যোগদানের কথা রহিয়াছে। একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে মুখোমুখি হইলে যে কোনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিতে পারে। গুরুদেব কহিলেন।
মহাত্মন! উভয় দল এতদিন কেবল প্রয়াত দুই নেতাকে লইয়া নেতিবাচক রাজনীতিতে মাতিয়াছিল। এইবার তাহারা আগামী প্রজন্মের দুই অবশ্যম্ভাবী নেতাকে লইয়া রাজনীতির আকাশে ঝড় তুলিয়াছে। এই দুই ভবিষ্যত্ নেতা হইতেছেন তারেক রহমান এবং সজীব ওয়াজেদ জয়। এতদিন তারেক রহমানের নানাবিধ দুর্নীতির কাহিনী আওয়ামী লীগের সমালোচনার খোরাক হইয়াছিল। এইবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিদ্যুত্ সেক্টর ও ভিওআইপি’র দুর্নীতির কথা বিএনপির সমালোচনার খোরাক হইয়াছে।
বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমান এই দেশের ভবিষ্যত্ কাণ্ডারি। গুরুদেব বলিলেন, দুইজনের মধ্যেই যে অমিত সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা কোনোরূপেই ব্যাহত করা উচিত নহে। দেশের স্বার্থেই উভয়কে কর্দমাক্ত রাজনীতিতে ঠেলিয়া দেওয়া ঠিক হইবে না। কিন্তু আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করিব ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইতে বহুদূরে সরিয়া আসিয়াছি।
উহা কি প্রভু?
আমাদের বড় মুরুব্বি আমেরিকা প্রতি বত্সর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে। উহা রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ২০০৯-এর বাংলাদেশ সম্পর্কিত যে মূল্যায়ন রিপোর্ট পাওয়া গিয়াছে, উহাতে আমাদের দেশের চিত্রটি মোটেই সুখকর নহে।
গুরুদেব তাহার ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া ‘২০০৯ হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট : বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টটি স্ক্রিনের উপরে তুলিয়া আনিলেন। শিষ্য উহা পাঠ করিল। অনলাইনে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ড বাড়িয়াছে শতকরা ৩ ভাগ। সরকার এই সকল হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। এতদ্ব্যতীত বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়িয়াছে শতকরা ৩ দশমিক ৩ ভাগ। এই সকল সহিংসতার শিকার হইয়াছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীগণ।
শিষ্য আরও পাঠ করিল : ‘জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইলেও দেশটির মানবাধিকার রেকর্ডে খুবই সামান্য পরিমাণ উন্নতি হইয়াছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, খেয়াল-খুশিমত গ্রেফতার ও আটক, সাংবাদিকদের হয়রানিসহ মারাত্মক সব নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়াছে। বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) বিদ্রোহের ঘটনায় অভিযুক্তদের নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তদন্তে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হইয়াছে।
দীর্ঘ প্রতিবেদনটি পাঠের পর শিষ্য জিজ্ঞাসিল, মহাত্মন! আমাদের মহামুরুব্বি আমেরিকার এই রিপোর্ট কতখানি সত্য?
রিপোর্টের তথ্যাদি সঠিক নহে বলিয়া আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু দাবি করিয়াছেন। তাহার মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্বাপেক্ষা অনেক ভালো। তাহার এই বক্তব্যটি কেবল সরকারের নহে, দেশের মানুষের বলিয়া শামসুল হক টুকু দাবি করেন। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার একেএম শহীদুল হক দাবি করিয়াছেন, রাজধানীর কোনো থানায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটে নাই। গুরুদেব জানাইলেন।
শিষ্য বলিল, স্যার! ডিএমপি কমিশনারের সাম্প্রতিক অনেক বক্তব্যেই আমি বিভ্রান্ত।
তিনি কি বক্তব্য দিয়াছেন?
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে পরিবহন ধর্মঘট হয়, সেই সম্পর্কে ডিএমপি কমিশনার বলিয়াছেন, পরিবহনে চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা তিনি জানেন না। এইরূপ কোনো অভিযোগও করা হয় নাই।
বিষয়টি সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?
সম্প্রতি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়বিষয়ক স্থায়ী কমিটির দুই সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের নিকট পরিবহনে চাঁদাবাজির উল্লেখ করিয়াছেন। উহাতে আমি বিভ্রান্ত এই জন্য যে, সংসদ সদস্য ও ডিএমপি কমিশনারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে যে কোনো একটি বক্তব্য সত্য, অন্যটি অসত্য। এমপিদ্বয় এবং পুলিশ কমিশনারের মধ্যে কে সত্য কথা বলিতেছেন তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।
তাহাদের উভয়পক্ষই সত্য কথা বলিয়াছেন। গুরুদেব রহস্যভরে কহিলেন।
ইহা কিভাবে সম্ভব প্রভু?
সংসদ সদস্যদ্বয় কেবল পরিবহনে চাঁদাবাজির উল্লেখ করেন নাই, কাহার অনুপ্রেরণায় উহা ঘটিতেছে তাহার নামও উল্লেখ করিয়াছেন।
তাহা হইলে কি পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য অসত্য?
না। উহাও তাহার দিক হইতে সত্য। পুলিশ কমিশনার চাঁদাবাজির জন্য কাহাকেও চিহ্নিত করিতে পারেন নাই। কারণ নীরব চাঁদাবাজি হইলে তিনি উহা জানিবেন কি প্রকারে? তিনি যাহা দেখেন নাই তাহা স্বীকার করিয়া অসত্য বক্তব্য নিশ্চয়ই দিতে পারেন না। নীরব চাঁদাবাজগণ সরব না হইলে পুলিশ কমিশনারের কিছুই করণীয় নাই।
স্যার! তিনি তো পুলিশ হেফাজতে কাহারও মৃত্যুর কথাও স্বীকার করেন না।
ইহাও অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা পুলিশগণ কেহই স্বীকার করে না। এমতাবস্থায় কমিশনার মহোদয় কোন তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে বলিবেন যে, পুলিশ হেফাজতে কাহারও মৃত্যু হইয়াছে? যতদিন পুলিশগণ স্বপ্রণোদিত হইয়া তাহাদের অপরাধ স্বীকার না করিবে, ততদিন কমিশনার সাহেব পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর কথাও নৈতিকভাবে স্বীকার করিতে পারেন না।
প্রভু! এই যদি দেশের অবস্থা হয়, তাহা হইলে চলিবে কিভাবে?
বত্স! তুমি অযথা উত্কণ্ঠিত হইয়াছ। দেশ তো রেলগাড়ির ন্যায় লাইন ধরিয়া ভালোই চলিতেছে। এই জন্যই তো কোনো অজ্ঞাত ছড়াকার ছড়া কাটিয়াছিলেন, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম!’
তাহা হইলে কি দেশের অবস্থা লইয়া আমাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নাই?
কিঞ্চিত্ কারণ আছে। গুরুদেব ঈষত্ হাস্য সহকারে কহিলেন, ওই ছড়ার পরবর্তী চরণ হইল : ‘পা পিছলে আলুর দম।’
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
No comments