স্মরণ- সেই দিনটির কথা by ফরিদ আহমেদ
আজ হুমায়ূন আহমেদের চেহলাম। তাঁকে যেদিন সমাহিত করা হলো, সেই দিনটি নিয়ে ফরিদ আহমেদের একটি স্মৃতিচারণা ছাপা হলো ২৩ জুলাই। ইকবাল ভাই (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) টেবিলের ওপর রাখা টিস্যু বক্স থেকে দুটো টিস্যু হাতে নিয়ে চোখ দুটো ভালো করে মুছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম কুদ্দুছ, চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ। ড্রয়িংরুমে নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল নোভা, নুহাশ। এখন আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না ওদের। আরশাদ, অপু ও ইয়াসমীন ভাবির সঙ্গে আমিও বসে আছি ড্রয়িংরুমে।
সন্ধ্যারাতে মিরপুরে ছোট চাচা আহসান হাবীবের বাসা থেকে সাংবাদিকদের নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল নোভা। মিরপুরে মায়ের কাছে দুপুর থেকেই ছিলেন ইকবাল ভাই। সন্ধ্যার পর ইয়াসমীন ভাবি নোভাদের নিয়ে মিরপুরে এসেছেন, ভাবির ফোন পেয়ে আমিও এসেছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বাচ্চু ভাই ও গোলাম কুদ্দুছ ভাই আগে থেকেই সংসদ ভবন এলাকায় মন্ত্রীর বাসায় অপেক্ষা করছিলেন, আমরা এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর এলেন চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ। মন্ত্রীসহ বাচ্চু ভাই, কুদ্দুছ ভাই, সাগর ভাই, সিরাজ ভাই ও ইকবাল ভাই রাত ১০টার দিকে দখিন হাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে তাঁরা জেনে গেলেন নোভা-নুহাশের মনের ইচ্ছার কথা। দখিন হাওয়া থেকে রাত একটার দিকে ফিরে এলেন তাঁরা। ইকবাল ভাইয়ের বিষণ্ন মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী হয়েছে। নোভা-নুহাশের ইচ্ছার প্রতিফলন নেই ইকবাল ভাইয়ের চোখেমুখে।
২৪ জুলাই। সকাল নয়টায় বারডেম হাসপাতালে এলাম। কাল রাতেই সিদ্ধান্ত ছিল—ইকবাল ভাই-ভাবি নোভাদের নিয়ে আসবেন। ইকবাল ভাইকে ফোন করলাম। রাস্তায় আছেন। বারডেমের সামনের রাস্তা মিডিয়ার গাড়িতে বোঝাই। করিডর উৎসুক জনতায় পূর্ণ। জনতা ও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে হিমঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। এখানে পুলিশের আরেক দফা ব্যারিকেড। ভিভিআইপি সিকিউরিটি। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন মোহাম্মদ আলী (হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী শ্বশুর) সাহেব। গোয়েন্দা অফিসার লেখক মোস্তাক বললেন, আর দেরি করা যাবে না। আবার ইকবাল ভাইকে ফোন করলাম, ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়ি এগোতে পারছে না। ইকবাল ভাই মোস্তাক সাহেবের সঙ্গে আমার ফোনে কথা বললেন। কফিন তোলা হলো নির্দিষ্ট বাহিনীর কাঁধে। ভেতরের দরজা দিয়ে হিমগাড়িতে নেওয়া হলো কফিন। ফোনে ইকবাল ভাইকে তাঁর গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বললাম। যাত্রা শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় নুহাশপল্লীর উদ্দেশে। এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে গাড়ির বহর এগিয়ে চলেছে। হুমায়ূন আহমেদ বহুবার পরিচিত এ পথ দিয়ে নুহাশপল্লীতে গেছেন। যাত্রাপথে হয়তো গাড়ির জানালা নামিয়ে প্রকৃতি দেখেছেন। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়েছেন। গাড়ির প্লেয়ারে বাজিয়েছেন প্রিয় কোনো রবীন্দ্রসংগীত। আজ হিমগাড়িতে হিমশীতল বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভিআইপি মর্যাদায় রাজকীয় বহরে যাচ্ছেন।
বেলা ১১টায় পিরুজালী গ্রামে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলাম, এখানকার দৃশ্য আজ অন্য রকম। চার কিলোমিটার দূর থেকেই মানুষের সারি—উদ্দেশ্য নুহাশপল্লী। আমরা নুহাশপল্লীতে ঢুকে দেখলাম, অনেক মানুষের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমে ইকবাল ভাইকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম লিচুতলায় টানানো শামিয়ানার দিকে। শামিয়ানার চতুর্দিকে নাইলনের দড়ি দিয়ে সীমানা আটকে দেওয়া হয়েছে উৎসুক মানুষ সামলাতে। নুহাশপল্লীর এক মাঝবয়সী কর্মী কবর খুঁড়ে মাটি সরিয়ে রাখছেন আর কাঁদছেন তাঁর প্রিয় স্যারের জন্য। আমরা আসার কিছুক্ষণ পর কফিনবাহী গাড়িবহর প্রবেশ করল নুহাশপল্লীতে। হাজার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের সঙ্গে প্রকৃতিও অঝোরধারায় বর্ষণ ঝরাল। আরেক দফা জানাজা শেষে বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট, অগণিত তরুণের প্রিয় হিমুর স্রষ্টাকে শায়িত করা হলো। কবরে মাটি দিয়ে আমরা সরে এলাম। ইকবাল ভাই নুহাশপল্লীর কটেজের সামনে বারান্দায় নোভা, শীলা, নুহাশসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একত্রে দাঁড়িয়ে মিডিয়ায় কিছু বললেন।
হুমায়ূন-কন্যাদের ইচ্ছা বাবার কবরে যাবে। কয়েক দফায় বৃষ্টি হয়েছে, হাজারো মানুষের পদচারণে মাঠজুড়ে কাদাপানি। সবুজ নরম ঘাস মাড়িয়ে কাদাপানিতে আমরা হাঁটতে লাগলাম কবরের দিকে। তখনো লিচুতলার শামিয়ানা ঘিরে মানুষের ভিড়। আমি শামিয়ানার সীমানা-দড়ি উঁচু করে ধরলাম। নিচ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল শীলা, নোভা, নুহাশ। তাদের অনুসরণ করেন ইয়াসমীন ভাবি, ইকবাল ভাই, আরশাদ ও অপু। অন্য আত্মীয়রা শামিয়ানার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন। দোয়া পড়া শেষ করে শীলা শান্ত পায়ে কবরের দিকে এগোতে থাকল, ওকে অনুসরণ করল নুহাশ। শীলার হাতে একটি সাদা রঙের ফুলের কুঁড়ি দেখেছি। শীলা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নতজানু হয়ে প্রিয় বাবার কবরের মাটি স্পর্শ করল আর ফুলের কুঁড়িটা মাটির ওপর আলতো করে রাখল। কয়েক মুহূর্ত নীরব-নিস্তব্ধ। অপলক চোখে অন্যরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। বুঝতে পারলাম অপ্রকাশিত সব শ্রদ্ধা নিবেদন করছে মেয়েটি।
বাবার কবরের স্পর্শ নিয়েই তিন ভাইবোন গাড়িতে উঠে বসল। আবারও ইকবাল ভাইয়ের গাড়ি অনুসরণ করে আমার গাড়িও বেরিয়ে এল নুহাশপল্লীর সদর দরজা দিয়ে। শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে হূদয়ে হুমায়ূন আহমেদের স্পর্শ ধারণ করে ঢাকার পথ ধরলাম।
ফরিদ আহমেদ
প্রকাশক, সময় প্রকাশন
সন্ধ্যারাতে মিরপুরে ছোট চাচা আহসান হাবীবের বাসা থেকে সাংবাদিকদের নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল নোভা। মিরপুরে মায়ের কাছে দুপুর থেকেই ছিলেন ইকবাল ভাই। সন্ধ্যার পর ইয়াসমীন ভাবি নোভাদের নিয়ে মিরপুরে এসেছেন, ভাবির ফোন পেয়ে আমিও এসেছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বাচ্চু ভাই ও গোলাম কুদ্দুছ ভাই আগে থেকেই সংসদ ভবন এলাকায় মন্ত্রীর বাসায় অপেক্ষা করছিলেন, আমরা এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর এলেন চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ। মন্ত্রীসহ বাচ্চু ভাই, কুদ্দুছ ভাই, সাগর ভাই, সিরাজ ভাই ও ইকবাল ভাই রাত ১০টার দিকে দখিন হাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে তাঁরা জেনে গেলেন নোভা-নুহাশের মনের ইচ্ছার কথা। দখিন হাওয়া থেকে রাত একটার দিকে ফিরে এলেন তাঁরা। ইকবাল ভাইয়ের বিষণ্ন মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী হয়েছে। নোভা-নুহাশের ইচ্ছার প্রতিফলন নেই ইকবাল ভাইয়ের চোখেমুখে।
২৪ জুলাই। সকাল নয়টায় বারডেম হাসপাতালে এলাম। কাল রাতেই সিদ্ধান্ত ছিল—ইকবাল ভাই-ভাবি নোভাদের নিয়ে আসবেন। ইকবাল ভাইকে ফোন করলাম। রাস্তায় আছেন। বারডেমের সামনের রাস্তা মিডিয়ার গাড়িতে বোঝাই। করিডর উৎসুক জনতায় পূর্ণ। জনতা ও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে হিমঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। এখানে পুলিশের আরেক দফা ব্যারিকেড। ভিভিআইপি সিকিউরিটি। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন মোহাম্মদ আলী (হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী শ্বশুর) সাহেব। গোয়েন্দা অফিসার লেখক মোস্তাক বললেন, আর দেরি করা যাবে না। আবার ইকবাল ভাইকে ফোন করলাম, ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়ি এগোতে পারছে না। ইকবাল ভাই মোস্তাক সাহেবের সঙ্গে আমার ফোনে কথা বললেন। কফিন তোলা হলো নির্দিষ্ট বাহিনীর কাঁধে। ভেতরের দরজা দিয়ে হিমগাড়িতে নেওয়া হলো কফিন। ফোনে ইকবাল ভাইকে তাঁর গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বললাম। যাত্রা শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় নুহাশপল্লীর উদ্দেশে। এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে গাড়ির বহর এগিয়ে চলেছে। হুমায়ূন আহমেদ বহুবার পরিচিত এ পথ দিয়ে নুহাশপল্লীতে গেছেন। যাত্রাপথে হয়তো গাড়ির জানালা নামিয়ে প্রকৃতি দেখেছেন। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়েছেন। গাড়ির প্লেয়ারে বাজিয়েছেন প্রিয় কোনো রবীন্দ্রসংগীত। আজ হিমগাড়িতে হিমশীতল বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভিআইপি মর্যাদায় রাজকীয় বহরে যাচ্ছেন।
বেলা ১১টায় পিরুজালী গ্রামে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলাম, এখানকার দৃশ্য আজ অন্য রকম। চার কিলোমিটার দূর থেকেই মানুষের সারি—উদ্দেশ্য নুহাশপল্লী। আমরা নুহাশপল্লীতে ঢুকে দেখলাম, অনেক মানুষের ভিড়। গাড়ি থেকে নেমে ইকবাল ভাইকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম লিচুতলায় টানানো শামিয়ানার দিকে। শামিয়ানার চতুর্দিকে নাইলনের দড়ি দিয়ে সীমানা আটকে দেওয়া হয়েছে উৎসুক মানুষ সামলাতে। নুহাশপল্লীর এক মাঝবয়সী কর্মী কবর খুঁড়ে মাটি সরিয়ে রাখছেন আর কাঁদছেন তাঁর প্রিয় স্যারের জন্য। আমরা আসার কিছুক্ষণ পর কফিনবাহী গাড়িবহর প্রবেশ করল নুহাশপল্লীতে। হাজার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের সঙ্গে প্রকৃতিও অঝোরধারায় বর্ষণ ঝরাল। আরেক দফা জানাজা শেষে বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট, অগণিত তরুণের প্রিয় হিমুর স্রষ্টাকে শায়িত করা হলো। কবরে মাটি দিয়ে আমরা সরে এলাম। ইকবাল ভাই নুহাশপল্লীর কটেজের সামনে বারান্দায় নোভা, শীলা, নুহাশসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একত্রে দাঁড়িয়ে মিডিয়ায় কিছু বললেন।
হুমায়ূন-কন্যাদের ইচ্ছা বাবার কবরে যাবে। কয়েক দফায় বৃষ্টি হয়েছে, হাজারো মানুষের পদচারণে মাঠজুড়ে কাদাপানি। সবুজ নরম ঘাস মাড়িয়ে কাদাপানিতে আমরা হাঁটতে লাগলাম কবরের দিকে। তখনো লিচুতলার শামিয়ানা ঘিরে মানুষের ভিড়। আমি শামিয়ানার সীমানা-দড়ি উঁচু করে ধরলাম। নিচ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল শীলা, নোভা, নুহাশ। তাদের অনুসরণ করেন ইয়াসমীন ভাবি, ইকবাল ভাই, আরশাদ ও অপু। অন্য আত্মীয়রা শামিয়ানার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন। দোয়া পড়া শেষ করে শীলা শান্ত পায়ে কবরের দিকে এগোতে থাকল, ওকে অনুসরণ করল নুহাশ। শীলার হাতে একটি সাদা রঙের ফুলের কুঁড়ি দেখেছি। শীলা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নতজানু হয়ে প্রিয় বাবার কবরের মাটি স্পর্শ করল আর ফুলের কুঁড়িটা মাটির ওপর আলতো করে রাখল। কয়েক মুহূর্ত নীরব-নিস্তব্ধ। অপলক চোখে অন্যরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। বুঝতে পারলাম অপ্রকাশিত সব শ্রদ্ধা নিবেদন করছে মেয়েটি।
বাবার কবরের স্পর্শ নিয়েই তিন ভাইবোন গাড়িতে উঠে বসল। আবারও ইকবাল ভাইয়ের গাড়ি অনুসরণ করে আমার গাড়িও বেরিয়ে এল নুহাশপল্লীর সদর দরজা দিয়ে। শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে হূদয়ে হুমায়ূন আহমেদের স্পর্শ ধারণ করে ঢাকার পথ ধরলাম।
ফরিদ আহমেদ
প্রকাশক, সময় প্রকাশন
No comments