সরল গরল- নির্বাচনকালে সংসদ বিলোপের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট by মিজানুর রহমান খান
সাংবিধানিক বিতর্ক ৪ মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যাওয়া সারা বিশ্বেই বিরল ঘটনা। উন্নত সংসদীয় গণতন্ত্রেও এক-দেড় বছর আগে থাকতেই সংসদ ভেঙে নির্বাচন করা হয়। ১৯৮৪ সালের পরে হাউস অব কমন্স গড়ে চার বছরে ভেঙেছে। অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র একবার সংসদ মেয়াদ অবসানের কারণে ভেঙে গেছে।
তবে প্রতিটি দেশই সংসদ কীভাবে ভেঙে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে রীতিনীতিসহ আইনও করে নিয়েছে। যেমন, ১৯৯৩ সালের পরে অস্ট্রেলিয়া নিয়ম করেছে, তারা সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে আরেকটি ফরমান দিয়ে এটি মুলতবি করবে। এ ছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে সংসদ বিলোপের ক্ষণটিতে তাদের গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা ছুড়ে বিদায়ী অভিবাদন জানায়।
বাংলাদেশে মেয়াদ অবসানের কারণে এবং দলীয় সরকারের আমলে সংসদ ভাঙার একমাত্র ও প্রথম সুযোগ আসে ১৯৯৬ সালে। পঞ্চম সংসদ ১৯৯৬ সালের ৪ এপ্রিল ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের তীব্র চাপের মুখে তা ভেঙে গেল ১৩৩ দিন আগে, ২৪ নভেম্বরে। দেখা গেল, বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র লিখলেন। এমনকি টেলিফোনেও সে জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। ২৬ নভেম্বর ভোরের কাগজ-এর প্রথম পাতায় সাংবাদিক সানাউল্লাহর একটি বিশেষ প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো, তখনো কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংসদ ভাঙার নিয়ম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এর প্রমাণ, সানাউল্লাহ লিখেছেন, ‘সংবিধানের কোন ধারার অধীনে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভাঙতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিলেন, সরকারি ঘোষণায় তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। বাসস শুধু বলেছে সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে।’ এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছিল। এই প্রতিবেদককে সেদিন কোনো দলের নেতাই কিন্তু এ বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
লেখকের ধারণা, বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদ ভাঙা ও নির্বাচনসংক্রান্ত বিধানাবলি অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক। সংবিধানের ৫৭(২), ৭২, ১২৩(৩ক) এবং দলের বিপক্ষে ভোট দিলে আসন শূন্য হওয়াসংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদ পরস্পরের মধ্যে গুরুতর সংঘাত সৃষ্টি করেছে। এ রকম একটি অবস্থা সংবিধানে অবশ্যই থাকতে পারে না। কিন্তু টিকে আছে, কারণ দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত চাহিদা তা মিটিয়ে থাকে। দুই দল ও তাদের নেত্রীর সুবিধা অনুযায়ী, সংবিধান কাটাছেঁড়া ও ব্যাখ্যা করার সংস্কৃতি চলছে বাংলাদেশে!
এবিএম মূসা যেমনটা বলেছেন যে ‘সংসদ রাখা না-রাখা নয়, সরকার কেমন থাকবে—সেটাই বড় প্রশ্ন।’ হ্যাঁ, সেটা সত্য, মাত্র এক দিনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। কিন্তু সংসদ ভেঙে দেওয়া না-দেওয়া এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদে সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করার নিয়তি জড়িত। আমরা এক দিনের নির্বাচনের জন্য হাপিত্যেশ করতে গিয়ে সেটা ভুলতে পারি না। আর সেটা ঠিক করতে পারলে তত্ত্বাবধায়কসর্বস্ব রাজনীতি থেকে আমরা বেরোতে পারব।
ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা এল কে আদভানি ১২ আগস্ট বলেছেন, পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করার আগে যাতে নির্বাচন না হয়, সে বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে মনমোহন সিং এবং সংসদ নেতা বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা উভয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তবে আদভানি তাঁর ব্লগে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এ কথা বলে যে ‘এ বিষয়টি সামগ্রিক নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি আশা করেছেন, প্রণব মুখার্জি এখন তাঁর দলনিরপেক্ষ জায়গা থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হবেন।’
আমরাও ব্রিটিশ আদলে একটি ফিক্সড সংসদ আইন চাই। যদিও এ দেশে মেয়াদপূর্তির আগে কেউ আগাম নির্বাচন সেরে ফেলার ঝুঁকি নেবেন না। কিন্তু এ থেকে আমরা সম্ভবত একটি সুবিধা পেতে পারি। নির্বাচনী ফল ঘোষণার পরদিন থেকেই সরকার পতন ও আগাম নির্বাচন দাবি করে সংসদ বয়কটকরণ প্রতিহত করার কাজে এই ওষুধ কিছুটা কাজে দিতে পারে।
এর আগের লেখায় ব্রিটেন ও ভারতের সাংবিধানিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আরও একটু বিস্তারিত দেখে নিই। আধুনিক সংসদের মেয়াদ কত হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই নানামুখী চিন্তাভাবনার স্রোত বইছে। সংসদ বিলুপ্তির বিষয়ে ফ্রান্সের সংবিধানে তিনটি বাধানিষেধ আছে। যখন কোনো অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী মেয়াদে দায়িত্বরত থাকবেন বা জরুরি অবস্থা থাকবে, তখন সংসদ ভাঙা যাবে না। এ ছাড়া একটি সংসদ থেকে পরের সংসদ নির্বাচনের মধ্যে অন্তত ১২ মাস সময় থাকবে। সংসদ বিলুপ্তির পরে ২০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। ভারতের রাজ্যসভার মতো ফ্রান্সের সংবিধানও বলেছে, সিনেট কখনো বিলুপ্ত হবে না। জার্মানিতেও উচ্চকক্ষ (বুন্দেসরাত) কখনো বিলুপ্ত হয় না। সংসদীয় গণতন্ত্রে উচ্চকক্ষ বিরাট ভূমিকা রাখে। আমাদের দুই বড় দল জেদ ধরে আছে যে এটা তারা কিছুতেই হতে দেবে না। এর সঙ্গে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক দেখে না।
ইতালিতে সংসদ বিলোপে প্রধানমন্ত্রীর কোনো আনুষ্ঠানিক ভূমিকা নেই। প্রেসিডেন্টই নতুন নির্বাচনের আয়োজন করেন। সংসদ ও সিনেট সাধারণত পাঁচ বছরের মেয়াদে হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের এক বা উভয় কক্ষের স্পিকারদের সঙ্গে আলোচনা করে বিলোপ করতে পারেন এবং সংসদ বিলোপ করার ৭০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশ ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে তথাকথিত স্থিতিশীল সরকার বজায় রাখতে চেয়েছে। কিন্তু ইতালি সংসদের চৌহদ্দির মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। ইতালি সে কারণে ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল মধ্যবর্তী ৩৩ বছরে গড়ে প্রতি ১১ মাসে একটি করে নতুন সরকার প্রত্যক্ষ করেছে।
সুইডেনের সংবিধান কতগুলো অভিনব বিধান করেছে। এর আওতায় সুইডেনের সংসদ (রাইক্সদাগ) প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও কোনো একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে। বাংলাদেশে সৈয়দ আবুল হোসেনের মিডিয়া ট্রায়ালই হলো, অমন বিধান থাকলে সংসদীয় বিচারও বসত বা দাবি উঠত।
ভারতীয় সংবিধানের মতো স্পেনের সংবিধানেও বেসামরিক কর্তৃত্বে সামরিক আইন জারির সুযোগ রাখা হয়েছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জরুরি অবস্থা কিংবা সিজ (সামরিক আইন) বহাল থাকা অবস্থায় সংসদ বিলোপ করা যাবে না। তবে আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ও রয়েছে। যদি সংবিধানের সম্পূর্ণ রিভিশন প্রস্তাব করা হয় এবং সেই প্রস্তাব সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত হয়, তাহলে সংসদের বিলোপ ঘটানো যাবে। বাংলাদেশকে সংবিধানের একটি সম্পূর্ণ রিভিশনে যেতে হবে।
জাপানে নিম্নকক্ষ বাস্তবে বিলোপ করার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সে জন্য তাঁকে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভার তোয়াক্কা করতে হয় না।
ব্রিটেনের রানির মতো জাপান সম্রাটের কোনো একক ক্ষমতা নেই। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ এলে তাঁকে তা ভেঙে দিতে হবে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী তারো আসো আস্থা ভোটে বিরোধী দলকে মোকাবিলায় সফল হওয়ার পরও সংসদ ভেঙে দেন।
নিউজিল্যান্ডের সংসদ বাংলাদেশের মতো এক কক্ষবিশিষ্ট। এখানে সংসদ বিলোপের পর সাধারণ নির্বাচন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সাধারণত গভর্নর জেনারেল একটি সংসদের অবসান ঘটান। রেওয়াজ অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে দিয়ে তিনি পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠক কখন হবে, তার একটি ঘোষণা দেন। পরে নতুন সরকারের পরামর্শক্রমে তিনি এই তারিখ যদিও বদলাতে পারেন, কিন্তু তাঁকে একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার তাগিদ থেকেই গভর্নর জেনারেল সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ।
মনে হচ্ছে, কানাডাকে অনুসরণ করেছে ব্রিটেন। কানাডায় প্রতি চার বছর অন্তর নির্বাচন হয়। ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত কানাডার স্থায়ী মেয়াদের সংসদ আইন ছিল না। ওই বছরে নতুন আইন করে বলা হয়, প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচন চার বছর পরবর্তী প্রতি অক্টোবর মাসের তৃতীয় সোমবার অনুষ্ঠিত হবে। শুরুর তারিখ হচ্ছে ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর। এর কারণ হিসেবে কানাডীয় সরকারের কনস্টিটিউশন ইউনিট বলেছে, ‘ঘন ঘন সংখ্যালঘু সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রবণতা থেকে স্থিতিশীল সরকার গড়ে তোলা এর অন্যতম লক্ষ্য। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণে ক্ষমতাসীন সরকার যাতে অবাঞ্ছিত সুবিধা ভোগ না করতে পারে, সে জন্য সংসদ নির্বাচনের তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচনকালে সংসদ রাখা না-রাখার প্রশ্নটিকে আর সব সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। বাংলাদেশ সংসদের মেয়াদ চার বছর করাই উত্তম। আদভানিকে সমর্থন করে বলতে চাই, সংসদসংক্রান্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকে নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে একসঙ্গে দেখতে হবে। তবে ভারতে সংসদ রেখে সংসদ করার বিধান কিন্তু সংবিধানে লেখা নেই। বিশ্বের অন্য কোনো সংবিধানে আছে কি না, জানি না।
আগামীকাল শেষ পর্ব: সংসদ ভেঙে দিতে বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধন দরকার
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
বাংলাদেশে মেয়াদ অবসানের কারণে এবং দলীয় সরকারের আমলে সংসদ ভাঙার একমাত্র ও প্রথম সুযোগ আসে ১৯৯৬ সালে। পঞ্চম সংসদ ১৯৯৬ সালের ৪ এপ্রিল ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের তীব্র চাপের মুখে তা ভেঙে গেল ১৩৩ দিন আগে, ২৪ নভেম্বরে। দেখা গেল, বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র লিখলেন। এমনকি টেলিফোনেও সে জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। ২৬ নভেম্বর ভোরের কাগজ-এর প্রথম পাতায় সাংবাদিক সানাউল্লাহর একটি বিশেষ প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো, তখনো কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংসদ ভাঙার নিয়ম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এর প্রমাণ, সানাউল্লাহ লিখেছেন, ‘সংবিধানের কোন ধারার অধীনে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভাঙতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিলেন, সরকারি ঘোষণায় তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। বাসস শুধু বলেছে সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে।’ এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছিল। এই প্রতিবেদককে সেদিন কোনো দলের নেতাই কিন্তু এ বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
লেখকের ধারণা, বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদ ভাঙা ও নির্বাচনসংক্রান্ত বিধানাবলি অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক। সংবিধানের ৫৭(২), ৭২, ১২৩(৩ক) এবং দলের বিপক্ষে ভোট দিলে আসন শূন্য হওয়াসংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদ পরস্পরের মধ্যে গুরুতর সংঘাত সৃষ্টি করেছে। এ রকম একটি অবস্থা সংবিধানে অবশ্যই থাকতে পারে না। কিন্তু টিকে আছে, কারণ দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত চাহিদা তা মিটিয়ে থাকে। দুই দল ও তাদের নেত্রীর সুবিধা অনুযায়ী, সংবিধান কাটাছেঁড়া ও ব্যাখ্যা করার সংস্কৃতি চলছে বাংলাদেশে!
এবিএম মূসা যেমনটা বলেছেন যে ‘সংসদ রাখা না-রাখা নয়, সরকার কেমন থাকবে—সেটাই বড় প্রশ্ন।’ হ্যাঁ, সেটা সত্য, মাত্র এক দিনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। কিন্তু সংসদ ভেঙে দেওয়া না-দেওয়া এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদে সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করার নিয়তি জড়িত। আমরা এক দিনের নির্বাচনের জন্য হাপিত্যেশ করতে গিয়ে সেটা ভুলতে পারি না। আর সেটা ঠিক করতে পারলে তত্ত্বাবধায়কসর্বস্ব রাজনীতি থেকে আমরা বেরোতে পারব।
ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা এল কে আদভানি ১২ আগস্ট বলেছেন, পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করার আগে যাতে নির্বাচন না হয়, সে বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে মনমোহন সিং এবং সংসদ নেতা বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা উভয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তবে আদভানি তাঁর ব্লগে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এ কথা বলে যে ‘এ বিষয়টি সামগ্রিক নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি আশা করেছেন, প্রণব মুখার্জি এখন তাঁর দলনিরপেক্ষ জায়গা থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হবেন।’
আমরাও ব্রিটিশ আদলে একটি ফিক্সড সংসদ আইন চাই। যদিও এ দেশে মেয়াদপূর্তির আগে কেউ আগাম নির্বাচন সেরে ফেলার ঝুঁকি নেবেন না। কিন্তু এ থেকে আমরা সম্ভবত একটি সুবিধা পেতে পারি। নির্বাচনী ফল ঘোষণার পরদিন থেকেই সরকার পতন ও আগাম নির্বাচন দাবি করে সংসদ বয়কটকরণ প্রতিহত করার কাজে এই ওষুধ কিছুটা কাজে দিতে পারে।
এর আগের লেখায় ব্রিটেন ও ভারতের সাংবিধানিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আরও একটু বিস্তারিত দেখে নিই। আধুনিক সংসদের মেয়াদ কত হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই নানামুখী চিন্তাভাবনার স্রোত বইছে। সংসদ বিলুপ্তির বিষয়ে ফ্রান্সের সংবিধানে তিনটি বাধানিষেধ আছে। যখন কোনো অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী মেয়াদে দায়িত্বরত থাকবেন বা জরুরি অবস্থা থাকবে, তখন সংসদ ভাঙা যাবে না। এ ছাড়া একটি সংসদ থেকে পরের সংসদ নির্বাচনের মধ্যে অন্তত ১২ মাস সময় থাকবে। সংসদ বিলুপ্তির পরে ২০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। ভারতের রাজ্যসভার মতো ফ্রান্সের সংবিধানও বলেছে, সিনেট কখনো বিলুপ্ত হবে না। জার্মানিতেও উচ্চকক্ষ (বুন্দেসরাত) কখনো বিলুপ্ত হয় না। সংসদীয় গণতন্ত্রে উচ্চকক্ষ বিরাট ভূমিকা রাখে। আমাদের দুই বড় দল জেদ ধরে আছে যে এটা তারা কিছুতেই হতে দেবে না। এর সঙ্গে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক দেখে না।
ইতালিতে সংসদ বিলোপে প্রধানমন্ত্রীর কোনো আনুষ্ঠানিক ভূমিকা নেই। প্রেসিডেন্টই নতুন নির্বাচনের আয়োজন করেন। সংসদ ও সিনেট সাধারণত পাঁচ বছরের মেয়াদে হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের এক বা উভয় কক্ষের স্পিকারদের সঙ্গে আলোচনা করে বিলোপ করতে পারেন এবং সংসদ বিলোপ করার ৭০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশ ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে তথাকথিত স্থিতিশীল সরকার বজায় রাখতে চেয়েছে। কিন্তু ইতালি সংসদের চৌহদ্দির মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। ইতালি সে কারণে ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল মধ্যবর্তী ৩৩ বছরে গড়ে প্রতি ১১ মাসে একটি করে নতুন সরকার প্রত্যক্ষ করেছে।
সুইডেনের সংবিধান কতগুলো অভিনব বিধান করেছে। এর আওতায় সুইডেনের সংসদ (রাইক্সদাগ) প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও কোনো একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে। বাংলাদেশে সৈয়দ আবুল হোসেনের মিডিয়া ট্রায়ালই হলো, অমন বিধান থাকলে সংসদীয় বিচারও বসত বা দাবি উঠত।
ভারতীয় সংবিধানের মতো স্পেনের সংবিধানেও বেসামরিক কর্তৃত্বে সামরিক আইন জারির সুযোগ রাখা হয়েছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জরুরি অবস্থা কিংবা সিজ (সামরিক আইন) বহাল থাকা অবস্থায় সংসদ বিলোপ করা যাবে না। তবে আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ও রয়েছে। যদি সংবিধানের সম্পূর্ণ রিভিশন প্রস্তাব করা হয় এবং সেই প্রস্তাব সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদিত হয়, তাহলে সংসদের বিলোপ ঘটানো যাবে। বাংলাদেশকে সংবিধানের একটি সম্পূর্ণ রিভিশনে যেতে হবে।
জাপানে নিম্নকক্ষ বাস্তবে বিলোপ করার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সে জন্য তাঁকে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভার তোয়াক্কা করতে হয় না।
ব্রিটেনের রানির মতো জাপান সম্রাটের কোনো একক ক্ষমতা নেই। সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ এলে তাঁকে তা ভেঙে দিতে হবে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী তারো আসো আস্থা ভোটে বিরোধী দলকে মোকাবিলায় সফল হওয়ার পরও সংসদ ভেঙে দেন।
নিউজিল্যান্ডের সংসদ বাংলাদেশের মতো এক কক্ষবিশিষ্ট। এখানে সংসদ বিলোপের পর সাধারণ নির্বাচন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সাধারণত গভর্নর জেনারেল একটি সংসদের অবসান ঘটান। রেওয়াজ অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে দিয়ে তিনি পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠক কখন হবে, তার একটি ঘোষণা দেন। পরে নতুন সরকারের পরামর্শক্রমে তিনি এই তারিখ যদিও বদলাতে পারেন, কিন্তু তাঁকে একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার তাগিদ থেকেই গভর্নর জেনারেল সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ।
মনে হচ্ছে, কানাডাকে অনুসরণ করেছে ব্রিটেন। কানাডায় প্রতি চার বছর অন্তর নির্বাচন হয়। ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত কানাডার স্থায়ী মেয়াদের সংসদ আইন ছিল না। ওই বছরে নতুন আইন করে বলা হয়, প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচন চার বছর পরবর্তী প্রতি অক্টোবর মাসের তৃতীয় সোমবার অনুষ্ঠিত হবে। শুরুর তারিখ হচ্ছে ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর। এর কারণ হিসেবে কানাডীয় সরকারের কনস্টিটিউশন ইউনিট বলেছে, ‘ঘন ঘন সংখ্যালঘু সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রবণতা থেকে স্থিতিশীল সরকার গড়ে তোলা এর অন্যতম লক্ষ্য। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণে ক্ষমতাসীন সরকার যাতে অবাঞ্ছিত সুবিধা ভোগ না করতে পারে, সে জন্য সংসদ নির্বাচনের তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচনকালে সংসদ রাখা না-রাখার প্রশ্নটিকে আর সব সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। বাংলাদেশ সংসদের মেয়াদ চার বছর করাই উত্তম। আদভানিকে সমর্থন করে বলতে চাই, সংসদসংক্রান্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকে নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে একসঙ্গে দেখতে হবে। তবে ভারতে সংসদ রেখে সংসদ করার বিধান কিন্তু সংবিধানে লেখা নেই। বিশ্বের অন্য কোনো সংবিধানে আছে কি না, জানি না।
আগামীকাল শেষ পর্ব: সংসদ ভেঙে দিতে বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধন দরকার
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments