দেখার ভেতরে বাইরেঃ বাইশের লাল ঘোড়া-২ by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
শুরু করেছিলাম কবি আবিদ আনোয়ারের ‘বাইশের লাল ঘোড়া’ কবিতার দু’টি পংক্তি দিয়ে। ২১ ফেব্রুয়ারীতে পরম শ্রদ্ধা মমতায় যারা শহীদ মিনারে ফুল রেখে আসেন -২২শের লাল ঘোড়া তা নির্মূল করে দেয়। এই লালঘোড়া আমাদের প্রশাসন-যা পরিচালিত হয় দেশপ্রেমহীন, জাতিত্ববোধহীন, ক্ষমতান্ধ সরকার দ্বারা। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য সরকারই পরিচালিত হয় প্রশাসন দ্বারা।
এর মধ্যে থাকে ব্যক্তিক বা শ্রেণী স্বার্থের গাঁটছড়া; যার সঙ্গে জনস্বার্থ বা গণচেতনার কোন সম্পর্কই নেই। সম্পর্ক নেই বলেই একুশের চেতনা-বাইশ তারিখেই শেষ হয়ে যায়। সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর কথা ফ্রেবুয়ারি মাস জুড়ে রাজনৈতিক নেতা-বড় বড় বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী প্রমুখের মুখে বার বার শোনা যায়-শোনা যায় নানা পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণের কথা। তার পর ফেব্রুয়ারী ফুরায়-নটে গাছটি মুড়ায়। সব কিছু বাঁধা পড়ে থাকে লাল ফিতার বাঁধনে। একমাত্র লাভ হিসাবে পাওয়া যায় মাস জুড়ে বইমেলা। যদিও সে মেলায় বাংলা সাহিত্য কতটা উপকৃত হলো তা কিছুতেই তুলনায় আসতে পারে না-তথাকথিত পাঠক প্রিয় তরল লেখার বিক্রি বাণিজ্যের সাথে।
আবিদ আনোয়ার বলেছেন-লাল ঘোড়া নগর দাপিয়ে, ‘কাঁচা-টিনশেড থেকে ইটের দরদালান’ কাঁপিয়ে ‘উড়ুক্কু পায়ে’ কেশর ফুলিয়ে, রাজপথের মিছিলে হাহাকার তুলে ছুটে বেড়ায়। রাজা-উজির-নাজির আসে যায়-‘মরে যায় মহারাজও’, শুধু লাল ঘোড়া নামক সাধের পক্ষীরাজ বেঁচে থাকে অবিকল। অর্থাত্ সব কিছু বদলে গেলেও লাল ঘোড়ার স্বভাব বদলায় না। এই লাল ঘোড়ার জন্ম হয়েছে উপনিবেশবাদী শক্তির হাতে। মাহুত যেমন হাতিকে ব্যবহার করে হাতি ধরার জন্য-তেমনি এদেশের মানুষের স্বভাব জানে-এমন এক শ্রেণীর আমলা এবং উপশাসক জন্ম দিয়েছে তারা এদেশের মানুষের মধ্য থেকেই। এদের রক্তে স্বাধীনতা, জাত্যাভিমান, এমনকি দেশপ্রেমের অনুমাত্রও অবশিষ্ট রাখেনি বিদেশী শাসকেরা। এরা ব্যক্তি ও শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কিছুই সহ্য করতে পারে না। তাই সমাজ চেতনা-গণচেতনা, মানুষের স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেমকে প্রায়ই এরা প্রতিপক্ষ বলে ভাবে। স্বাধীন ভূখন্ডকে শোষণ ক্ষেত্রে পরিণত করার জন্যে প্রথমেই এরা রাজনীতিকে করে তোলে কলুষিত এবং জনসম্পৃক্ততাহীন। বিদেশী প্রভুর প্রশিক্ষিত জনস্বার্থ দলনের এই চরিত্রগুলো সম্পর্কে আবিদের কবিতা বলছে-‘যবনিকাহীন ধারাবাহিকের চরিত্রগুলো আজো/অসি ঝলকিয়ে অভিষেক করে ক্ষুধিত সরফরাজ’। এদেরে সরফরাজি, মোড়লি বা কর্তাগিরির কারণেই ভাষার চেতনা-স্বাধীনতার চেতনা-বিজয়ের চেতনার আয়ুষ্কাল হয় নির্দিষ্ট দিবসব্যাপী মাত্র। এই লালঘোড়া কখনো শাসক বেশে কখনো আমলা বেশে এবং প্রায়শ দুই এর সম্মিলনে চেতনাগ্রাসী হয়ে ওঠে। নষ্টদের অধিকারে নিয়ে যায় সব কিছু-রাজনীতি-সমাজ চরিত্র-সংস্কৃতি-বোধ-ইতিহাস-সব। অনেক দিন আগে একটা গানে লিখেছিলাম, ‘চাটুকার লেখে/সত্যকে ঢেকে/ইতিহাসে মিছে কথা,/অসত্য তাই পেয়ে যায় অমরতা।’ গানটি লিখেছিলাম তাজমহল নিয়ে। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সম্রাট শাজাহানের কথা মনে হয়নি, মনে হয়েছে হাজার হাজার শ্রমশিল্পীর কথা যাদের নাম ইতিহাসে নেই। ইতিহাস লেখা হয় ক্ষমতার অসির নীচে বসে। এখন মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে এখন অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ঘটনাটা অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই উল্লেখ করছি। চট্টগ্রামে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে বলেছেন-সবাই বঙ্গবন্ধুর মত ‘বক্তৃতাবাজি’ করলে তো হবে না। তার এই ঔদ্ধত্যের বিপুল প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হতে দেখে গর্ব অনুভব করেছি। কিন্তু তখনই আবার মনে পড়ে গেছে, ভারতীয় হাইকমিশনার ও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ভারতের এক বালখিল্য সাংবাদিকের সীমাহীন ধৃস্ট উক্তির কথা। আমার স্বাধীন সার্বভৌমদেশকে ‘বাফার স্টেট’ বলে গালি দিয়েছে সে বিনা দ্বিধায়-বিনা বাধায়। এ নিয়ে কিছু কিছু পত্র-পত্রিকায় কিছু লেখালিখি হলেও সরকার দলীয় নেতা-নেত্রীদের কোন প্রবল প্রতিবাদ করতে দেখিনি। তা হলে কি দেশের চেয়ে ব্যক্তিবড়? হোন তিনি বঙ্গবন্ধুর মত বিশাল ব্যক্তিত্ব, তবু? আমরা তো শুনে আসছি-ব্যক্তির চেয়ে দল বড়-দলের চেয়ে দেশ বড়। কোনটা সত্যি? হ্যাঁ ব্যক্তি বিশাল হতে পারেন-মহান হতে পারেন, তাঁকে নিয়ে দেশ গর্ব করতে পারে-কিন্তু কখনোই তিনি দেশের চেয়ে বড় হতে পারেন না। ব্যক্তি দেশের চেয়ে বড় হলে ব্যক্তিস্বার্থ দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে যায়। আর ব্যক্তির স্বার্থে বদলে যায় দেশের ইতিহাস-ভূগোল, কৃষ্টি, সভ্যতা এবং সামাজিক সত্য।
লাল ঘোড়ার কথায় ফিরে যাই আবার। লাল ঘোড়াও শুধু একুশের ফুল নয়-ষোলই ডিসেম্বরের গৌরব, ছাব্বিশে মার্চের স্বপ্ন সব খেয়ে যেতে পারে, হয়ে উঠতে পারে সর্বভুক যদি তাকে গণইচ্ছার লাগাম এবং চাবুকের শাসনে না রাখা যায়। সেই লাগাম এবং চাবুকের নাম তারুণ্য। আমাদের একুশের সংগ্রাম সফল করেছে তরুণেরা-আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খার জন্ম হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের বুকে, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামে ইপিআর-এর তরুণ ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহ, তরুণ যুবা ৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়ার যুদ্ধঘোষণা, তরুণ ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন, ক্যাপ্টেন হারুন সহ সমস্ত বাঙালি সেনা-যার নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ অফিসারবৃন্দ এবং প্রধান ছিলেন স্বয়ং মেজর জিয়া। স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক গবেষক মাসুদুল হক রচিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা মিথ ও দলিল’ গ্রন্থে অনেক প্রামাণ্য দলিল আছে। ও বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না। সবশেষে যা বলতে চাই তা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নব্বই শতাংশই ছিলেন তরুণ ছাত্র জনতা। তাই তরুণ্যকে যতই নানা প্রলোভনে বিপথগামী করার চেষ্টা হোকনা কেন-তারুণ্য আবার জাগবেই। লাল ঘাৈড়া সেদিন বুঝবে, তারুণ্যের কশাঘাতে শাসন কেমন!
লেখক : গীতিকার ও সাংবাদিক
আবিদ আনোয়ার বলেছেন-লাল ঘোড়া নগর দাপিয়ে, ‘কাঁচা-টিনশেড থেকে ইটের দরদালান’ কাঁপিয়ে ‘উড়ুক্কু পায়ে’ কেশর ফুলিয়ে, রাজপথের মিছিলে হাহাকার তুলে ছুটে বেড়ায়। রাজা-উজির-নাজির আসে যায়-‘মরে যায় মহারাজও’, শুধু লাল ঘোড়া নামক সাধের পক্ষীরাজ বেঁচে থাকে অবিকল। অর্থাত্ সব কিছু বদলে গেলেও লাল ঘোড়ার স্বভাব বদলায় না। এই লাল ঘোড়ার জন্ম হয়েছে উপনিবেশবাদী শক্তির হাতে। মাহুত যেমন হাতিকে ব্যবহার করে হাতি ধরার জন্য-তেমনি এদেশের মানুষের স্বভাব জানে-এমন এক শ্রেণীর আমলা এবং উপশাসক জন্ম দিয়েছে তারা এদেশের মানুষের মধ্য থেকেই। এদের রক্তে স্বাধীনতা, জাত্যাভিমান, এমনকি দেশপ্রেমের অনুমাত্রও অবশিষ্ট রাখেনি বিদেশী শাসকেরা। এরা ব্যক্তি ও শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কিছুই সহ্য করতে পারে না। তাই সমাজ চেতনা-গণচেতনা, মানুষের স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেমকে প্রায়ই এরা প্রতিপক্ষ বলে ভাবে। স্বাধীন ভূখন্ডকে শোষণ ক্ষেত্রে পরিণত করার জন্যে প্রথমেই এরা রাজনীতিকে করে তোলে কলুষিত এবং জনসম্পৃক্ততাহীন। বিদেশী প্রভুর প্রশিক্ষিত জনস্বার্থ দলনের এই চরিত্রগুলো সম্পর্কে আবিদের কবিতা বলছে-‘যবনিকাহীন ধারাবাহিকের চরিত্রগুলো আজো/অসি ঝলকিয়ে অভিষেক করে ক্ষুধিত সরফরাজ’। এদেরে সরফরাজি, মোড়লি বা কর্তাগিরির কারণেই ভাষার চেতনা-স্বাধীনতার চেতনা-বিজয়ের চেতনার আয়ুষ্কাল হয় নির্দিষ্ট দিবসব্যাপী মাত্র। এই লালঘোড়া কখনো শাসক বেশে কখনো আমলা বেশে এবং প্রায়শ দুই এর সম্মিলনে চেতনাগ্রাসী হয়ে ওঠে। নষ্টদের অধিকারে নিয়ে যায় সব কিছু-রাজনীতি-সমাজ চরিত্র-সংস্কৃতি-বোধ-ইতিহাস-সব। অনেক দিন আগে একটা গানে লিখেছিলাম, ‘চাটুকার লেখে/সত্যকে ঢেকে/ইতিহাসে মিছে কথা,/অসত্য তাই পেয়ে যায় অমরতা।’ গানটি লিখেছিলাম তাজমহল নিয়ে। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সম্রাট শাজাহানের কথা মনে হয়নি, মনে হয়েছে হাজার হাজার শ্রমশিল্পীর কথা যাদের নাম ইতিহাসে নেই। ইতিহাস লেখা হয় ক্ষমতার অসির নীচে বসে। এখন মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে এখন অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ঘটনাটা অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই উল্লেখ করছি। চট্টগ্রামে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে বলেছেন-সবাই বঙ্গবন্ধুর মত ‘বক্তৃতাবাজি’ করলে তো হবে না। তার এই ঔদ্ধত্যের বিপুল প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হতে দেখে গর্ব অনুভব করেছি। কিন্তু তখনই আবার মনে পড়ে গেছে, ভারতীয় হাইকমিশনার ও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ভারতের এক বালখিল্য সাংবাদিকের সীমাহীন ধৃস্ট উক্তির কথা। আমার স্বাধীন সার্বভৌমদেশকে ‘বাফার স্টেট’ বলে গালি দিয়েছে সে বিনা দ্বিধায়-বিনা বাধায়। এ নিয়ে কিছু কিছু পত্র-পত্রিকায় কিছু লেখালিখি হলেও সরকার দলীয় নেতা-নেত্রীদের কোন প্রবল প্রতিবাদ করতে দেখিনি। তা হলে কি দেশের চেয়ে ব্যক্তিবড়? হোন তিনি বঙ্গবন্ধুর মত বিশাল ব্যক্তিত্ব, তবু? আমরা তো শুনে আসছি-ব্যক্তির চেয়ে দল বড়-দলের চেয়ে দেশ বড়। কোনটা সত্যি? হ্যাঁ ব্যক্তি বিশাল হতে পারেন-মহান হতে পারেন, তাঁকে নিয়ে দেশ গর্ব করতে পারে-কিন্তু কখনোই তিনি দেশের চেয়ে বড় হতে পারেন না। ব্যক্তি দেশের চেয়ে বড় হলে ব্যক্তিস্বার্থ দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে যায়। আর ব্যক্তির স্বার্থে বদলে যায় দেশের ইতিহাস-ভূগোল, কৃষ্টি, সভ্যতা এবং সামাজিক সত্য।
লাল ঘোড়ার কথায় ফিরে যাই আবার। লাল ঘোড়াও শুধু একুশের ফুল নয়-ষোলই ডিসেম্বরের গৌরব, ছাব্বিশে মার্চের স্বপ্ন সব খেয়ে যেতে পারে, হয়ে উঠতে পারে সর্বভুক যদি তাকে গণইচ্ছার লাগাম এবং চাবুকের শাসনে না রাখা যায়। সেই লাগাম এবং চাবুকের নাম তারুণ্য। আমাদের একুশের সংগ্রাম সফল করেছে তরুণেরা-আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খার জন্ম হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের বুকে, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামে ইপিআর-এর তরুণ ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহ, তরুণ যুবা ৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়ার যুদ্ধঘোষণা, তরুণ ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন, ক্যাপ্টেন হারুন সহ সমস্ত বাঙালি সেনা-যার নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ অফিসারবৃন্দ এবং প্রধান ছিলেন স্বয়ং মেজর জিয়া। স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক গবেষক মাসুদুল হক রচিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা মিথ ও দলিল’ গ্রন্থে অনেক প্রামাণ্য দলিল আছে। ও বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না। সবশেষে যা বলতে চাই তা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নব্বই শতাংশই ছিলেন তরুণ ছাত্র জনতা। তাই তরুণ্যকে যতই নানা প্রলোভনে বিপথগামী করার চেষ্টা হোকনা কেন-তারুণ্য আবার জাগবেই। লাল ঘাৈড়া সেদিন বুঝবে, তারুণ্যের কশাঘাতে শাসন কেমন!
লেখক : গীতিকার ও সাংবাদিক
No comments