সাড়ে তিন বছরের মূল্যায়ন সুখকর নয় ॥ বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে সরকার -গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ১৫০ থেকে ২২৫ মে.ও. বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের by রশিদ মামুন
বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে সরকার। সরকারের সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও একটি ছাড়া অন্য বড় কেন্দ্রগুলোর কাজ শুরু করাই সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বড় কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হলেও যোগ্য কোন প্রতিষ্ঠানই পাওয়া যায়নি।
এতে সরকারের মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে, এসব বিষয় মাথায় রেখে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে এখন ১৫০ থেকে ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
বিদ্যুত বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুত বিভাগ গত সাড়ে তিন বছরের কাজের মূল্যায়ন করে দেখেছে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের অগ্রগতি একেবারেই ভাল নয়। বিদ্যুত উৎপাদনের মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় যেসব বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে তার একটিও যথাসময়ে উৎপাদনে আসছে না। এখনও কোন বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য অর্থ সংস্থানই করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। কাজেই বড়র বদলে এখন মাঝারি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকেই শ্রেয় বলে মনে করা হচ্ছে। কাজেই ভবিষ্যতের সব প্রকল্পই ১০০ থেকে ২২৫ মেগাওয়াটের মধ্যে রাখা হবে। তবে কয়লাভিত্তিক বড় প্রকল্পগুলোর কাজ, যা এরই মধ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা চালিয়ে যাওয়া হবে।
সৌদি যুবরাজ আল ওয়ালিদ বিন তালাল আব্দুল আজিজ আল সৌদ বিবিয়ানা-১ প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিদ্যুত বিভাগে সৌদি যুবরাজের কোম্পানি কিংডম হোল্ডিং কোম্পানি বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণের আগ্রহের কথা জানিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। আজ সৌদি যুবরাজের কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন তাদেরও মাঝারি ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে বলা হবে। চাইলে দুটি বিদ্যুত কেন্দ্রও তাদের দেয়া হতে পারে।
বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঝারি কেন্দ্র হলে উদ্যোক্তাদের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ সহজ হয়। এছাড়া চাইলেই ছোট ছোট ইউনিট প্রয়োজনে বন্ধ রাখা যায়। ছোট বিদ্যুত কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ কাজও অনেকটা সহজ। এখন পর্যন্ত ইজিসিবির নারায়ণগঞ্জের দুটি কেন্দ্র ছাড়া অন্যগুলোর অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। এর মধ্যে হরিপুর কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলছে। আর সিদ্ধিরগঞ্জ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বেসরকরী উদ্যোক্তারা বড় কেন্দ্র নির্মাণে একেবারেই অগ্রসর হতে পারেনি।
সরকারী পরিকল্পনায় চলতি বছরে ১১ বেসরকারী বিদ্যুত কেন্দ্র (আইপিপি) চালু হওয়ার কথা। এতে উৎপাদন বাড়বে ৮৫২ মেগাওয়াট। কিন্তু এগুলোর কয়েকটির ভূমি উন্নয়ন কাজই শুরু হয়নি। মোট ১৪ আইপিপির মধ্যে ১৩টির জন্য এখনও অর্থের সংস্থান করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকের পর অর্থ মন্ত্রণালয়কে আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করার নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক দফা বৈঠকের পরও এ বিষয়ে কোন সুরাহা হয়নি। আজ মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের আরও একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনায় দেখা যায় আগামী নবেম্বর থেকে’ ১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সরকারী ২৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা। এর মধ্যে ২০১৩তে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ঘোড়াশাল ২০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের। কয়েক দফা দরপত্র আহ্বান করেও সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে না চাওয়ায় বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ কৌশল পরিবর্তন করে ঘোড়াশালে পিকিংয়ের বদলে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে। একই বছর ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে ইজিসিবির সিদ্ধিরগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট। স্পেনভিত্তিক আইসোলাক্স কোম্পানিকে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কাজ দেয়া হয়েছে। এখনও নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। একই মাসে উৎপাদনে আসার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ভোলা ১৫০ থেকে ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র। এখনও যার চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্রের। এর মধ্যে জুনে বড় পুকুরিয়া ২৫০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদনে আসার এখনও পর্যন্ত কার্যকর কোন অগ্রগতি নেই। ওই বছর ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ভেড়ামারা ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের। যার অগ্রগতিও চলছে ঢিমেতালে। পরের বছর ২০১৫তে দুটি সরকারী বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদনে আসার কথা। এর মধ্যে মার্চে উৎপাদনে আসার কথা আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট। সম্প্রতি কেন্দ্রটি নির্মাণের চুক্তি হয়েছে।
বেসরকারী খাতে এখন পর্যন্ত গ্যাস এবং দ্বৈত জ্বালানির বড় তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্রের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এই তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ পেয়েছে সামিট গ্রুপ। এর মধ্যে বিবিয়ানা-১ ২০১২ ডিসেম্বর, বিবিয়ানা-২ ২০১৩ জানুয়ারি এবং মেঘনাঘাট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রের গ্যাসভিত্তিক ইউনিটটি ২০১৩ এবং ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক ইউনিট ২০১৪ -এর জানুয়ারিতে উৎপাদনে আসার কথা। এর প্রতিটি বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ৩০০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট করে। বিদ্যুত কেন্দ্র তিনটি নিয়ে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে।
সম্প্রতি দেখা গেছে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সম্প্রতি পাঁচটি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পের দরপত্র প্রাথমিক অবস্থায় বাতিল করেছে। দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় মূল্যায়ন কমিটি তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চলতি বছর ২২ জানুয়ারি পিডিবি আইপিপি ভিত্তিক পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ করার জন্য স্পন্সরভিত্তিক দরপত্র আহবান করে। প্রকল্পগুলো ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ৬০০-৮০০ মেগাওয়াট। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে তিনটি ১০০-৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র।
পিডিবি সূত্র জানায়, গত ২৬ জুলাই বিউবোর বোর্ড মিটিংয়ে পাঁচটি দরপত্রের সবই ‘নন-রেস্পনসিভ’ হিসেবে বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। বিউবোর এই সিদ্ধান্ত গত রবিবার বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
কয়েক দফা সময় বৃদ্ধির পর দরপত্র জমা দেয়ার দিন ছিল গত ৭ জুন। পাঁচটি প্রকল্পের জন্য মোট ৯টি দরপত্র জমা পড়ে। কিন্তু প্রস্তাব মূল্যায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায় কোন দরদাতাই দরপত্রের শর্ত পূরণ করে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে পারেনি।
No comments