সিলেট সীমান্তে বিএসএফ-এর হামলা by বদরুদ্দীন উমর
বেশ কিছুদিন থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) সীমান্তবর্তী এলাকায় বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে তাদেরকে হতাহত করছে। ১ জানুয়ারি ২০০০ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ সাল পর্যন্ত দশ বছরে বিএসএফ-এর গুলিতে ৮৭৩ জন নিরীহ বাংলাদেশী নিহত, ৮৬৯ জন আহত হয়েছিল।
এছাড়া অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছিল যথাক্রমে ৯০৯ ও ১৪ জনকে। ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর বিএসএফ-এর ওই হামলা অব্যাহতভাবেই চলে আসছে। হাজার হাজার মাইল সীমান্ত জুড়ে এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ছোট-বড় আকারে এভাবে চলে এলেও কয়েক সপ্তাহ ধরে সিলেট ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তে বিএসএফ-এর ওই সন্ত্রাসী তত্পরতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যাতে সরকারি ও বিডিআর-এর কর্তৃপক্ষকেও উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এইভাবে বিএসএফ-এর গোলাগুলি বর্ষণ ও বাংলাদেশের নাগরিক হত্যার বিষয়টিসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য কয়েকদিন আগে বিডিআর-এর মহাপরিচালক দিল্লিতে বিএসএফ-এর মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন। ১১ মার্চ ওই বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় যে, এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে তার জন্য তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিডিআর-এর মহাপরিচালক দিল্লিতে থাকার সময়েও সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিবর্ষণ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, দিল্লিতে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিডিআর-এর মহাপরিচালক ঢাকা আসার পরও সিলেটের জৈন্তাপুর-তামাবিল সীমান্তে বিএসএফ আগের মতোই বেশ বড় আকারে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়। এবার তারা কিছুসংখ্যক ভারতীয় নাগরিককেও বাংলাদেশ ভারতের মধ্যবর্তী এলাকায় ঢুকিয়ে দিয়ে ঘর-বাড়ি তৈরি ও মাছ ধরার কাজে নামিয়ে দিয়েছে।
ওই ঘটনা সম্পর্কে সংবাদপত্র-রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৪ মার্চ সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে বিডিআর ও বিএসএফ-এর মধ্যে তিন ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময় হয়। এর কারণ ভারতীয় বিএসএফ জৈন্তাপুর সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে এসে বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে ১৫ জন আহত হয়। ওই এলাকার গ্রামবাসীরা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ভেতর দিকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। (উধরষু ঝঃধত্ ১৫.৩.১০)
প্রথম দফা সংঘর্ষ হয় বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে ঢুকে বাঙ্কার তৈরি করার পরদিন। এরপর দুই পক্ষের পতাকা বৈঠকের পর বিএসএফ বাংলাদেশ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরে ১৪ মার্চ নতুন করে আবার ঘটনা ঘটে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে ৪০ জন ভারতীয় মুক্তারপুর-জৈন্তীয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। এর একঘণ্টা পর প্রবেশ করে আরও ১০০ জন। এভাবে ভেতরে প্রবেশ করে তারা ডিবির হাওর এলাকার মন্দিরটিলায় বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি শুরু করে। এটা দেখে বাংলাদেশী গ্রামবাসীরা তাদেরকে সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বলার পর দু’পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এই অবস্থায় বেলা দুটোর দিকে বিএসএফ গ্রামবাসী ও বিডিআর-এর লোকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এরপর বিডিআরও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলে দুই পক্ষে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ১ হাজার রাউন্ড গুলিবিনিময় হয়। এরপর ভারতীয়রা জায়গা ছেড়ে নিজেদের এলাকায় চলে যায়। সিলেটে ২১ নম্বর রাইফেল ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেনেন্ট কর্নেল জহিরুল আলম বলেন, ভারতীয়দের এই আক্রমণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে কথা বলার সময় বিডিআর-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মহম্মদ মঈনুল ইসলাম ঘটনাটিকে ‘খুব দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, বিডিআর ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর বিএসএফ তাদের গুলি বন্ধ করে। তিনি মন্তব্য করেন, দিল্লিতে তাদের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটা নিচের দিকে সীমান্তবর্তী এলাকায় না পৌঁছানোর কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে! ১১ মার্চ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, এ কথা সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হলো, অথচ নিচের দিকে কোনো খবরই পৌঁছাল না, বা তাদেরকে খবর দেয়ার ব্যবস্থা হলো না, এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। চুক্তির পর সংবাদপত্র ইত্যাদির আগে যারা এ ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কাছেই তো খবর প্রথম পৌঁছানোর কথা। যাই হোক, দিল্লিতে চুক্তি স্বাক্ষরের পর আবার একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় বিডিআর মহাপরিচালকের একথা বলা ছাড়া বোধ হয় আর করার কিছু ছিল না। তবে এ নিয়ে তারা সীমান্তে পতাকা বৈঠকের ব্যবস্থা করায় বিএসএফ-এর গোলাগুলি বর্ষণ আপাতত বন্ধ আছে এবং এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে।
কিন্তু শান্তি ফিরে এলেও ওই এলাকার লোকদের মনে আতঙ্ক পুরোদস্তুর আছে এবং তারা এখনও গ্রামছাড়া। গ্রামে ফেরার জন্য তাদের মধ্যে শান্তি বিষয়ে যে আস্থার প্রয়োজন সেটা এখনও পর্যন্ত ফিরে আসেনি।
১৫ মার্চ তামাবিল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট-এ বিডিআর ও বিএসএফ-এর পতাকা বৈঠকে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে অঙ্গীকার করা হয় যে, বাংলাদেশের এলাকায় তাদের সদ্য তৈরি করা ‘বর্ডার পোস্ট’ ও ‘সাব পোস্ট’গুলো তারা সরিয়ে নেবে। এগুলো বাংলাদেশের এলাকায় কয়েকদিন আগে সীমান্ত থেকে ১২০ গজ ভেতরে তৈরি করা হয়েছিল। এ বৈঠকে বিডিআর-এর পক্ষ থেকে বিএসএফকে বলা হয় যে, ২০০৯ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা যেন নিজেদের সীমানার মধ্যে থাকে। বিডিআর-এর জহিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন যে, গত বছরের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বিএসএফ বার বার সীমান্তে উস্কানিমূলক তত্পরতা চালিয়েছে।
১৫ মার্চ যে পতাকা বৈঠক হয়েছে এটা তাদের মধ্যকার দ্বিতীয় বৈঠক। প্রথম বৈঠক হয়েছিল এর ২৪ ঘণ্টা আগে শনিবার বিকেলে পাদুয়া-প্রতাপপুর সীমান্তে। সেখানে বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে এসে ২৫টি বাঙ্কার তৈরি করেছিল।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এভাবে বিএসএফ-এর নিয়মিত আগ্রাসন, ভেতরে প্রবেশ ও নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে তাদেরকে হতাহত করা কোনো স্বাভাবিক ও সাধারণ ব্যাপার নয়। যে কোনো দু’ দেশের সীমান্তে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটতে পারে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যেভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়মিত বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর হামলা করে ও বাংলাদেশের এলাকার ওপর চড়াও হয়, এটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাদের শক্তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে ভারত পরিণত হয়েছে একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সব চরিত্র গুণই এখন ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে পাওয়া যায়। তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী তত্পরতা কতভাবে চালায় তার বিশদ বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়; তবে এটা অবশ্যই বলা চলে যে, প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে তারা বন্ধুত্বের ও মৈত্রীর সম্পর্কের কথা বলে যে আচরণ করে তার মধ্যে এর পরিচয় অবশ্যই পাওয়া যায়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ যে প্রায়ই একতরফাভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সীমান্ত এলাকায় নিয়মিতভাবে এমনি করে জনগণের ওপর গুলি চালিয়ে মানুষকে হতাহত করে এর মধ্যে নিঃসন্দেহে তাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রেরই প্রতিফলন ঘটে।
দেখা যায় যে, বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশের সীমান্তবাসী জনগণের ওপর গুলি চালায় তার কোনো বোধগম্য কারণ থাকে না। এ কারণে এসব ঘটনার পর বিডিআর-এর সঙ্গে পতাকা বৈঠকের পর তারা নিজেদের জায়গায় ফেরত যায় এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সম্প্রতি সংঘটিত যে সীমান্ত সংঘর্ষের উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে তারপরও পরপর দুটি পতাকা বৈঠক হয়েছে এবং তারা আবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এ সময়ে যে সংঘর্ষ সিলেটের জৈন্তীয়া-তামাবিল সীমান্তে হয়েছে সেটা ঘটেছে দিল্লিতে দুই পক্ষের সীমান্ত বাহিনীর প্রধানদের যৌথ বৈঠকের পর। এটা ছিল এমন বৈঠক যা সম্প্রতি নানা ধরনের সীমান্ত সংঘর্ষের মীমাংসার জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, বিএসএফ আর একতরফাভাবে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় গুলিবর্ষণ করে এলাকার নিরীহ নাগরিকদেরকে হতাহত করবে না। সাময়িকভাবে হলেও তাদেরকে বাধ্য করবে না নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভেতর দিকে পালিয়ে আসতে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তাদের কথা ও কাজের মধ্যে যে গরমিল এতদিন ধরে দেখা গেছে তার কোনো পরিবর্তন সহজে হবে এটা ভাবার কারণ নেই। দুই পক্ষের দিল্লি বৈঠকের পর আবার একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে এ ব্যাপারে উত্সাহিত এবং আস্থাশীল হওয়া মুশকিল ব্যাপার।
একটি সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা যায় যে, সিলেট সীমান্তবর্তী পশ্চিম খাসিয়া পার্বত্য জেলার ডোমিয়াসিয়াতে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া ভারতের আণবিক শক্তি বিভাগের কথা অনুযায়ী মেঘালয়ের দক্ষিণ উপত্যকায় গ্র্যানাইটসহ অন্য ধরনের কঠিন শিলার মজুত আছে। ইতোমধ্যে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউরেনিয়াম করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (টঈওখ) পশ্চিম খাসিয়া পার্বত্য এলাকায় ইউরেনিয়াম খননের একটি প্রোজেক্ট হাতে নেয়। এর বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন পরিবেশবাদী মহলের প্রতিবাদের ফলে মেঘালয়ে ইউরেনিয়াম খননের বিষয়ে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী নভেম্বর মাসেই একটি কমিটি গঠন করেন।
২০১০ সালের মার্চে অর্থাত্ এ মাসেই কমিটি তার প্রথম বৈঠকে ইউরেনিয়াম খনন এলাকার ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে কিনা সেটা দেখার জন্য বৈজ্ঞানিক মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। (ঐড়ষরফধু ১২.৩.২০১০)
সিলেট সীমান্তে এখন কিছুদিন ধরে ভারতীয় বিএসএফ নিয়মিতভাবে যে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের এলাকার মধ্যে ঢুকে বাড়ি-ঘর তৈরির চেষ্টা পর্যন্ত করছে, নিজেদের বেসামরিক লোকজন পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তাতে এ সন্দেহ অমূলক নয় যে, এই এলাকাতেও তারা ইউরেনিয়াম সন্ধান পেয়েছে অথবা তাদের ইউরেনিয়াম খনির পার্শ্ববর্তী এলাকা নিরাপদ রাখার জন্য সেখানে তারা নিজেদের দখল কায়েমের চেষ্টা করছে। সেটা হলে, এই অঞ্চলে বিএসএফ-এর আগ্রাসন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখলেও, অদূরভবিষ্যতে তাদের এই তত্পরতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করার নয়।
১৭.৩.২০১০
ওই ঘটনা সম্পর্কে সংবাদপত্র-রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৪ মার্চ সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে বিডিআর ও বিএসএফ-এর মধ্যে তিন ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময় হয়। এর কারণ ভারতীয় বিএসএফ জৈন্তাপুর সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে এসে বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে ১৫ জন আহত হয়। ওই এলাকার গ্রামবাসীরা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ভেতর দিকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। (উধরষু ঝঃধত্ ১৫.৩.১০)
প্রথম দফা সংঘর্ষ হয় বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে ঢুকে বাঙ্কার তৈরি করার পরদিন। এরপর দুই পক্ষের পতাকা বৈঠকের পর বিএসএফ বাংলাদেশ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরে ১৪ মার্চ নতুন করে আবার ঘটনা ঘটে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে ৪০ জন ভারতীয় মুক্তারপুর-জৈন্তীয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। এর একঘণ্টা পর প্রবেশ করে আরও ১০০ জন। এভাবে ভেতরে প্রবেশ করে তারা ডিবির হাওর এলাকার মন্দিরটিলায় বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি শুরু করে। এটা দেখে বাংলাদেশী গ্রামবাসীরা তাদেরকে সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বলার পর দু’পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এই অবস্থায় বেলা দুটোর দিকে বিএসএফ গ্রামবাসী ও বিডিআর-এর লোকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এরপর বিডিআরও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলে দুই পক্ষে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ১ হাজার রাউন্ড গুলিবিনিময় হয়। এরপর ভারতীয়রা জায়গা ছেড়ে নিজেদের এলাকায় চলে যায়। সিলেটে ২১ নম্বর রাইফেল ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেনেন্ট কর্নেল জহিরুল আলম বলেন, ভারতীয়দের এই আক্রমণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
ডেইলি স্টার-এর সঙ্গে কথা বলার সময় বিডিআর-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মহম্মদ মঈনুল ইসলাম ঘটনাটিকে ‘খুব দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, বিডিআর ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর বিএসএফ তাদের গুলি বন্ধ করে। তিনি মন্তব্য করেন, দিল্লিতে তাদের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটা নিচের দিকে সীমান্তবর্তী এলাকায় না পৌঁছানোর কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে! ১১ মার্চ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, এ কথা সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হলো, অথচ নিচের দিকে কোনো খবরই পৌঁছাল না, বা তাদেরকে খবর দেয়ার ব্যবস্থা হলো না, এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। চুক্তির পর সংবাদপত্র ইত্যাদির আগে যারা এ ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কাছেই তো খবর প্রথম পৌঁছানোর কথা। যাই হোক, দিল্লিতে চুক্তি স্বাক্ষরের পর আবার একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় বিডিআর মহাপরিচালকের একথা বলা ছাড়া বোধ হয় আর করার কিছু ছিল না। তবে এ নিয়ে তারা সীমান্তে পতাকা বৈঠকের ব্যবস্থা করায় বিএসএফ-এর গোলাগুলি বর্ষণ আপাতত বন্ধ আছে এবং এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে।
কিন্তু শান্তি ফিরে এলেও ওই এলাকার লোকদের মনে আতঙ্ক পুরোদস্তুর আছে এবং তারা এখনও গ্রামছাড়া। গ্রামে ফেরার জন্য তাদের মধ্যে শান্তি বিষয়ে যে আস্থার প্রয়োজন সেটা এখনও পর্যন্ত ফিরে আসেনি।
১৫ মার্চ তামাবিল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট-এ বিডিআর ও বিএসএফ-এর পতাকা বৈঠকে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে অঙ্গীকার করা হয় যে, বাংলাদেশের এলাকায় তাদের সদ্য তৈরি করা ‘বর্ডার পোস্ট’ ও ‘সাব পোস্ট’গুলো তারা সরিয়ে নেবে। এগুলো বাংলাদেশের এলাকায় কয়েকদিন আগে সীমান্ত থেকে ১২০ গজ ভেতরে তৈরি করা হয়েছিল। এ বৈঠকে বিডিআর-এর পক্ষ থেকে বিএসএফকে বলা হয় যে, ২০০৯ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা যেন নিজেদের সীমানার মধ্যে থাকে। বিডিআর-এর জহিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন যে, গত বছরের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বিএসএফ বার বার সীমান্তে উস্কানিমূলক তত্পরতা চালিয়েছে।
১৫ মার্চ যে পতাকা বৈঠক হয়েছে এটা তাদের মধ্যকার দ্বিতীয় বৈঠক। প্রথম বৈঠক হয়েছিল এর ২৪ ঘণ্টা আগে শনিবার বিকেলে পাদুয়া-প্রতাপপুর সীমান্তে। সেখানে বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে এসে ২৫টি বাঙ্কার তৈরি করেছিল।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এভাবে বিএসএফ-এর নিয়মিত আগ্রাসন, ভেতরে প্রবেশ ও নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে তাদেরকে হতাহত করা কোনো স্বাভাবিক ও সাধারণ ব্যাপার নয়। যে কোনো দু’ দেশের সীমান্তে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটতে পারে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যেভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়মিত বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর হামলা করে ও বাংলাদেশের এলাকার ওপর চড়াও হয়, এটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাদের শক্তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে ভারত পরিণত হয়েছে একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সব চরিত্র গুণই এখন ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে পাওয়া যায়। তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী তত্পরতা কতভাবে চালায় তার বিশদ বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়; তবে এটা অবশ্যই বলা চলে যে, প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে তারা বন্ধুত্বের ও মৈত্রীর সম্পর্কের কথা বলে যে আচরণ করে তার মধ্যে এর পরিচয় অবশ্যই পাওয়া যায়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ যে প্রায়ই একতরফাভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সীমান্ত এলাকায় নিয়মিতভাবে এমনি করে জনগণের ওপর গুলি চালিয়ে মানুষকে হতাহত করে এর মধ্যে নিঃসন্দেহে তাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রেরই প্রতিফলন ঘটে।
দেখা যায় যে, বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশের সীমান্তবাসী জনগণের ওপর গুলি চালায় তার কোনো বোধগম্য কারণ থাকে না। এ কারণে এসব ঘটনার পর বিডিআর-এর সঙ্গে পতাকা বৈঠকের পর তারা নিজেদের জায়গায় ফেরত যায় এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সম্প্রতি সংঘটিত যে সীমান্ত সংঘর্ষের উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে তারপরও পরপর দুটি পতাকা বৈঠক হয়েছে এবং তারা আবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এ সময়ে যে সংঘর্ষ সিলেটের জৈন্তীয়া-তামাবিল সীমান্তে হয়েছে সেটা ঘটেছে দিল্লিতে দুই পক্ষের সীমান্ত বাহিনীর প্রধানদের যৌথ বৈঠকের পর। এটা ছিল এমন বৈঠক যা সম্প্রতি নানা ধরনের সীমান্ত সংঘর্ষের মীমাংসার জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, বিএসএফ আর একতরফাভাবে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় গুলিবর্ষণ করে এলাকার নিরীহ নাগরিকদেরকে হতাহত করবে না। সাময়িকভাবে হলেও তাদেরকে বাধ্য করবে না নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভেতর দিকে পালিয়ে আসতে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তাদের কথা ও কাজের মধ্যে যে গরমিল এতদিন ধরে দেখা গেছে তার কোনো পরিবর্তন সহজে হবে এটা ভাবার কারণ নেই। দুই পক্ষের দিল্লি বৈঠকের পর আবার একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে এ ব্যাপারে উত্সাহিত এবং আস্থাশীল হওয়া মুশকিল ব্যাপার।
একটি সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা যায় যে, সিলেট সীমান্তবর্তী পশ্চিম খাসিয়া পার্বত্য জেলার ডোমিয়াসিয়াতে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া ভারতের আণবিক শক্তি বিভাগের কথা অনুযায়ী মেঘালয়ের দক্ষিণ উপত্যকায় গ্র্যানাইটসহ অন্য ধরনের কঠিন শিলার মজুত আছে। ইতোমধ্যে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউরেনিয়াম করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (টঈওখ) পশ্চিম খাসিয়া পার্বত্য এলাকায় ইউরেনিয়াম খননের একটি প্রোজেক্ট হাতে নেয়। এর বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন পরিবেশবাদী মহলের প্রতিবাদের ফলে মেঘালয়ে ইউরেনিয়াম খননের বিষয়ে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী নভেম্বর মাসেই একটি কমিটি গঠন করেন।
২০১০ সালের মার্চে অর্থাত্ এ মাসেই কমিটি তার প্রথম বৈঠকে ইউরেনিয়াম খনন এলাকার ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে কিনা সেটা দেখার জন্য বৈজ্ঞানিক মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। (ঐড়ষরফধু ১২.৩.২০১০)
সিলেট সীমান্তে এখন কিছুদিন ধরে ভারতীয় বিএসএফ নিয়মিতভাবে যে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের এলাকার মধ্যে ঢুকে বাড়ি-ঘর তৈরির চেষ্টা পর্যন্ত করছে, নিজেদের বেসামরিক লোকজন পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তাতে এ সন্দেহ অমূলক নয় যে, এই এলাকাতেও তারা ইউরেনিয়াম সন্ধান পেয়েছে অথবা তাদের ইউরেনিয়াম খনির পার্শ্ববর্তী এলাকা নিরাপদ রাখার জন্য সেখানে তারা নিজেদের দখল কায়েমের চেষ্টা করছে। সেটা হলে, এই অঞ্চলে বিএসএফ-এর আগ্রাসন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখলেও, অদূরভবিষ্যতে তাদের এই তত্পরতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করার নয়।
১৭.৩.২০১০
No comments