তীরে এসে তরী ডুবছে?- ০ মসিউর পদত্যাগ না করায় বিশ্বব্যাংকের চার শর্ত পূরণ হচ্ছে না- ০ চার শর্ত পূরণ হলে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে এখনও মনে করে ইআরডি -০ অপরদিকে চূড়ান্ত প্রস্তাব দিল মালয়েশিয়া by হামিদ-উজ-জামান মামুন

বিশ্বব্যাংকের দেয়া শর্ত যথাযথ পূরণ না করায় পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের অনীহা। সেই সঙ্গে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে দাতাদের অর্থায়নের পুরো প্রক্রিয়াই ভেস্তে যেতে বসেছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান পদত্যাগ না করায় শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরী ডুবছে।


কেননা এর আগে চার শর্তের মধ্যে তিনটি শর্তই পুরোপুরি এবং একটি শর্তের বেশিরভাগ অংশই পূরণ করেছে সরকার। এখন বাকি শুধু ওই উপদেষ্টার পদত্যাগ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, পুরোপুরি চারটি শর্ত পূরণ হলে এখনও বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেই সঙ্গে বাকি দাতাদের অর্থায়নও নিশ্চিত হয়ে যাবে। এছাড়া যা করতে হবে তা আর মাত্র তিন দিনের মধ্যেই করতে হবে। অন্যদিকে এ সেতুতে অর্থায়নের চূড়ান্ত প্রস্তাব দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। সোমবার বিকেলে সেতু ভবনে মালয়েশিয়া সরকারের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বিশেষ দূত দাতোসেরি সামি ভেল্যু যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে চূড়ান্ত প্রস্তাবের কপি হস্তান্তর করেন।
এ সময় যোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে দাতাদের অর্থায়ন প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের সকলের সঙ্গেই আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া তাদের ব্যাপারটি অর্থ মন্ত্রণালয় দেখবে। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ বিবেচনায় ব্যাটেবলে সংযোগ হলেই চুক্তি হবে মালয়েশিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এ প্রস্তাবে টেকনিক্যাল, কনস্ট্রাকশন ও ডিজাইনের দিকটি বলা হয়েছে। আমাদের টেকনিক্যাল কমিটি প্রস্তাবটি যাচাই করবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় কমিটির কাছে পরামর্শ দেয়া হবে। সমন্বয় কমিটি ঠিক করবে কিভাবে কাজটি সুষ্ঠুভাবে শুরু করা যায়।
এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ মনে করছে যথাযথভাবে শর্তপূরণ করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধপত্র পাঠালে এখনও বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে। সে সম্ভাবনা রয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে টানাপোড়েন সত্ত্বে¡ও গত কয়েক মাসে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে আলোচনা করে সহজ শর্তে প্রায় ৬৬ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে ইআরডি। এগুলো হচ্ছে, দুর্যোগকালে দ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ৩০ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের একটি ফান্ড, তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ এবং সোলার পাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নে ইডকলের জন্য ১৫ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ আগামী সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায় অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এছাড়া স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ প্রকল্পের জন্য ১৩ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেগোসিয়েশন হবে আজ মঙ্গলবার। এসব বিবেচনায় ইআরডি মনে করছে এখনও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়নি।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারের সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর চুক্তির আগে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) প্রকল্পে সহ-অর্থায়নকারী হিসেবে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। সেখানে শর্ত ছিল যদি প্রকল্পের কোন সহ-অর্থায়নকারী চলে যায় তাহলে অন্যদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি অকার্যকর হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি পুনর্বিবেচনা না করায় চলতি মাসেই দুই দাতা সংস্থার ঋণ চুক্তি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে স্বল্প সুদে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি পুনর্বিবেচনা না করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সহ-অর্থায়নকারীদের ঋণ চুক্তি বাতিল হবে বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলে ঋণ চুক্তি বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে অনেক কিছু ঘটে থাকে। তবে দুই দাতা সংস্থার ঋণ চুক্তির মেয়াদ আরও কয়েক দিন আছে। এছাড়া তিনি জোর দিয়ে বলেন, পদ্মা সেতু যে কোন মূল্যেই হোক হবে।
চলতি মাসেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুই দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) ঋণ চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় এডিবি ও জাইকার ঋণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতুতে সহ-অর্থায়নকারী হওয়ায় আইনী জটিলতার কারণে পদ্মা সেতুতে সংস্থা দুটির অর্থায়ন সম্ভব কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি তেরেসা খো বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
Ÿিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে গত ২৩ জুলাই পদ্মা সেতু নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও পরবর্তীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী আবুল হোসেন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ এক মাস পর অবশেষে গত ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপতি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এর ফলে সংবিধানের ৫৮ (১) (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৩ জুলাই থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনের মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্র গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি মন্ত্রীই ছিলেন। এছাড়া শর্ত মেনে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেনকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হলেও প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের পদত্যাগটি ঝুলে ছিল। গত কয়েকদিন ধরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছিল তাঁর পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু সোমবার বিকেলে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করছেন না বলে জানা গেছে। এর ফলে বিশ্বব্যাংকের সব শর্ত পূরণ করেও পূর্ণাঙ্গভাবে পূরণ করা হলো না। ফলে পদ্মা সেতুতে দাতাদের অর্থায়নের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল তাও ফুরিয়ে আসছে।
সূত্র জানায়, শুরু থেকেই বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণে মনোযোগী ছিল না সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২শ’ ৯৭ কোটি ডলারের প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১শ’ ২০ কোটি ডলার, এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং জাইকা ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার কথা ছিল। এছাড়া আইডিবির ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা। বাকি অর্থের যোগান দেবে সরকার। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত ২৯ জুন ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এর পর সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়।

No comments

Powered by Blogger.