মৃগী রোগ বেরিয়ে আসুন কুসংস্কার থেকে কেস হিস্ট্রি
বিয়ের কিছুদিন পরেই শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে হয়েছে রহিমাকে। কি তার অপরাধ? তার অপরাধ হলো সে হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, মুখ দিয়ে লালা পড়ে। খিঁচুনির মধ্যে প্রস্রাব করে দেয়। আর কিছু বলতে পারে না। এ রকম অনেক রহিমার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
মুখে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় থাকে পোড়াদাগ ও আঘাতের ক্ষতচিহ্ন থাকে। পানিতে গোসল করতে গিয়ে অনেক রোগীর অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঘটে। কে তাদের খবর রাখে। পাড়াপ্রতিবেশীরা বলে আলগা দোষ, বাতাস লাগছে অথবা জিনে ধরছে। কারণ অসুখ হলে তো সব সময় থাকবে। নিশ্চয় বাতাস লাগছে। কারণ অমাবস্যা- পূর্ণিমায় বেড়ে যায় এ রকম হাজারো ব্যাখ্যা থাকে ফকির-কবিরাজ, তাবিজ-কবজওলাদের কাছে।
সামাজিক কুসংস্কার
অনেকে মনে করে মৃগী একটি আছরের ব্যাপার, আলগা দোসের ব্যাপার, বাতাস লেগেছে, জিন-ভূতের ব্যাপার। এ রোগের কোন সঠিক চিকিৎসা নেই। এই রোগীর লেখাপড়া, বিয়েশাদী, সংসার কিছু হবে না।
অনেকে মনে করে মৃগী একটা প্রাকৃতিক অভিশাপ। ফলে রোগটি গোপন করে রাখে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কারণ, তারা মনে করে, রোগটি জানাজানি হলে পরিবারের জন্য ক্ষতি হবে। মেয়েটির বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে। এ রকম ধারণার বশবর্তী হয়ে চিকিৎসা না করিয়ে আরো ক্ষতি করা হচ্ছে। বিয়ের পর মেয়েটি যখন শ্বশুরবাড়ি যায় এবং সেখানে এই রোগ আক্রমণ করে তখন তার বিয়ে টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। সুতরাং রোগটি গোপন না করে চিকিৎসা করানোই উত্তম।
মৃগী রোগ কি?
মৃগীরোগ ব্রেনের একটি অসুখ; যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বাচ্চাদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
রোগের লক্ষণ
১। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
২। শরীরে খিঁচুনি শুরু হওয়া।
৩। জিহ্বা ও দাঁতে কামড় লাগা।
৪। খিঁচুনির সময় প্রস্রাব-পায়খানা হয়ে যাওয়া।
৫। জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে তার চারপাশের ঘটনা বলতে পারে কিনা- বিষয়গুলোই মৃগীরোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে।
৬। খিঁচুনির পরে মাথা ব্যথা, শুয়ে থাকা, কিছু সময় ধরে চুপচাপ থাকা।
কয়েকটি উদাহরণ
এক: হঠাৎ করে যে কোন বয়সের একজন মানুষ অজ্ঞান হয়ে, চোখ-মুখ উল্টিয়ে ফেলল এবং তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল। এ সময় এটাও দেখবেন, উৎসাহী দু’য়েকজন তার নাকের সামনে জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদি ধরছে।
দুই: কোন শিশু হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। চোখের পাতা নড়ে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বাবা-মা অনেক সময় ভাবেন, এটা ছেলের কাব্যিক ভাব। ছেলে তার কবি হয়ে উঠছে। কখনও হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়।
তিন: আপাতত মানসিকভাবে সুস্থ একজন লোক হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করল। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করল। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করল। আবার কয়েক মিনিট পর সুস্থ হয়ে গেল।
চার: এ রকম দেখা গেছে পানিতে গোসল করতে গিয়ে খিঁচুনি উঠে ডুবে গেছে।
পাঁচ: কেউ কেউ বলে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখি, চোখে আলোর ঝিলিক দেখি। এর পর আর কিছু বলতে পারি না।
এ রকম বিভিন্নভাবে মৃগী রোগী ডাক্তারের কাছে আসতে পারে।
মৃগীরোগ উঠলে আশপাশের লোকদের কি করণীয়?
মৃগীরোগীর মুখে অনেকেই চামড়ার জুতা, গরুর হাড়, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরে। এসব স্রেফ কুসংস্কার। এসবে আসলে কোন কাজ হয় না। বরং ক্ষতিই হয়। মৃগী হঠাৎ শুরু হয়ে আবার এমনিতেই থেমে যায়। সাধারণত এ ধরনের এ্যাটাক আধ মিনিট বা এক মিনিট থাকে। এজন্য কোন কিছু করার দরকার নেই। অনেকে অস্থির হয়ে রোগীর হাত-পা চেপে ধরে, মাথায় পানি দেয়, অস্থির হয়ে মুখে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আসলে এসব কিছু করার দরকার নেই। রোগটা নিজে নিজেই থেমে যাবে। তারপর সাধারণত রোগী ঘুমিয়ে পড়ে। কারো কারো অবশ্য মাথাব্যথা হয়। তবে করণীয় হলো। রোগীটি যেমন করছে, করতে দেয়া। শুধু দেখতে হবে যে রোগীর আশপাশে ধারালো অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, আগুন ইত্যাদি যেন না থাকে। যাতে সে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। জোরে ঠেসে ধরলেই বরং ক্ষতি হতে পারে। রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে বা ক্লিনিকে স্থানান্তর করা দরকার। যেখানে ডাক্তাররা সঠিক ব্যবস্থা নেবেন।
রোগীর জন্য পরামর্শ
১। নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন।
২। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৩। সময়মত ঘুমান।
৪। উত্তেজনা প্রশমন করুন।
৫। পানিতে নামবেন না।
৬। খিঁচুনির মাত্রা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত আগুনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন।
৭। গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন।
৮। গাছে উঠবেন না।
৯। ভ্রমণে সঙ্গে ওষুধ রাখুন।
১০। ধূমপান বর্জন করুন।
১১। রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শের ফটোকপি ও বাসার ফোন নম্বর সর্বক্ষণিক রাখুন।
সবশেষে সকলের প্রতি উপদেশ
সামাজিক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে নিয়মিত চিকিৎসা নিন; সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করুন।
ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, ০১৮১৭০২৮২৭৭
সামাজিক কুসংস্কার
অনেকে মনে করে মৃগী একটি আছরের ব্যাপার, আলগা দোসের ব্যাপার, বাতাস লেগেছে, জিন-ভূতের ব্যাপার। এ রোগের কোন সঠিক চিকিৎসা নেই। এই রোগীর লেখাপড়া, বিয়েশাদী, সংসার কিছু হবে না।
অনেকে মনে করে মৃগী একটা প্রাকৃতিক অভিশাপ। ফলে রোগটি গোপন করে রাখে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কারণ, তারা মনে করে, রোগটি জানাজানি হলে পরিবারের জন্য ক্ষতি হবে। মেয়েটির বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে। এ রকম ধারণার বশবর্তী হয়ে চিকিৎসা না করিয়ে আরো ক্ষতি করা হচ্ছে। বিয়ের পর মেয়েটি যখন শ্বশুরবাড়ি যায় এবং সেখানে এই রোগ আক্রমণ করে তখন তার বিয়ে টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। সুতরাং রোগটি গোপন না করে চিকিৎসা করানোই উত্তম।
মৃগী রোগ কি?
মৃগীরোগ ব্রেনের একটি অসুখ; যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বাচ্চাদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
রোগের লক্ষণ
১। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
২। শরীরে খিঁচুনি শুরু হওয়া।
৩। জিহ্বা ও দাঁতে কামড় লাগা।
৪। খিঁচুনির সময় প্রস্রাব-পায়খানা হয়ে যাওয়া।
৫। জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে তার চারপাশের ঘটনা বলতে পারে কিনা- বিষয়গুলোই মৃগীরোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে।
৬। খিঁচুনির পরে মাথা ব্যথা, শুয়ে থাকা, কিছু সময় ধরে চুপচাপ থাকা।
কয়েকটি উদাহরণ
এক: হঠাৎ করে যে কোন বয়সের একজন মানুষ অজ্ঞান হয়ে, চোখ-মুখ উল্টিয়ে ফেলল এবং তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল। এ সময় এটাও দেখবেন, উৎসাহী দু’য়েকজন তার নাকের সামনে জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদি ধরছে।
দুই: কোন শিশু হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। চোখের পাতা নড়ে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বাবা-মা অনেক সময় ভাবেন, এটা ছেলের কাব্যিক ভাব। ছেলে তার কবি হয়ে উঠছে। কখনও হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়।
তিন: আপাতত মানসিকভাবে সুস্থ একজন লোক হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করল। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করল। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করল। আবার কয়েক মিনিট পর সুস্থ হয়ে গেল।
চার: এ রকম দেখা গেছে পানিতে গোসল করতে গিয়ে খিঁচুনি উঠে ডুবে গেছে।
পাঁচ: কেউ কেউ বলে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখি, চোখে আলোর ঝিলিক দেখি। এর পর আর কিছু বলতে পারি না।
এ রকম বিভিন্নভাবে মৃগী রোগী ডাক্তারের কাছে আসতে পারে।
মৃগীরোগ উঠলে আশপাশের লোকদের কি করণীয়?
মৃগীরোগীর মুখে অনেকেই চামড়ার জুতা, গরুর হাড়, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরে। এসব স্রেফ কুসংস্কার। এসবে আসলে কোন কাজ হয় না। বরং ক্ষতিই হয়। মৃগী হঠাৎ শুরু হয়ে আবার এমনিতেই থেমে যায়। সাধারণত এ ধরনের এ্যাটাক আধ মিনিট বা এক মিনিট থাকে। এজন্য কোন কিছু করার দরকার নেই। অনেকে অস্থির হয়ে রোগীর হাত-পা চেপে ধরে, মাথায় পানি দেয়, অস্থির হয়ে মুখে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আসলে এসব কিছু করার দরকার নেই। রোগটা নিজে নিজেই থেমে যাবে। তারপর সাধারণত রোগী ঘুমিয়ে পড়ে। কারো কারো অবশ্য মাথাব্যথা হয়। তবে করণীয় হলো। রোগীটি যেমন করছে, করতে দেয়া। শুধু দেখতে হবে যে রোগীর আশপাশে ধারালো অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, আগুন ইত্যাদি যেন না থাকে। যাতে সে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। জোরে ঠেসে ধরলেই বরং ক্ষতি হতে পারে। রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে বা ক্লিনিকে স্থানান্তর করা দরকার। যেখানে ডাক্তাররা সঠিক ব্যবস্থা নেবেন।
রোগীর জন্য পরামর্শ
১। নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন।
২। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৩। সময়মত ঘুমান।
৪। উত্তেজনা প্রশমন করুন।
৫। পানিতে নামবেন না।
৬। খিঁচুনির মাত্রা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত আগুনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন।
৭। গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন।
৮। গাছে উঠবেন না।
৯। ভ্রমণে সঙ্গে ওষুধ রাখুন।
১০। ধূমপান বর্জন করুন।
১১। রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শের ফটোকপি ও বাসার ফোন নম্বর সর্বক্ষণিক রাখুন।
সবশেষে সকলের প্রতি উপদেশ
সামাজিক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে নিয়মিত চিকিৎসা নিন; সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করুন।
ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, ০১৮১৭০২৮২৭৭
No comments