রম্যারম্য কথকতা-সর্বসহিষ্ণু বিধাতার কথা by রণজিৎ বিশ্বাস
বিধাতা যে সর্বসহিষ্ণু প্রমাণ করতে পারেন? : পারি। যেমন- নজরুল গেয়ে গেলেন, 'এই জগতের ধূলিমাখা যত অসহায় সন্তান/মাগে প্রতিকার উত্তর দাও আদি পিতা ভগবান', বিধাতা কিন্তু মাইন্ড করেননি। তাঁকে সব কথা মনের সুখে বলতে দিয়েছেন।
ভূপেন হাজারিকা সাহসের তোড়েজোড়ে গলা কাঁপিয়ে গাইলেন- 'জীবন-নাটকের নাট্যকার যে বিধাতাপুরুষ, নাটক লেখার তার নেই কোনো হাত' তখনো বিধাতা কিছু মনে করেননি। তার গলা চেপে ধরেননি।
: বিধাতা আর কখন কিছু মনে করেন না, জানেন?
: জানব না কেন?! এ সবই তো আমার গবেষণার বিষয়।
: এক-দুই করে বলুন।
: একবার বিধাতা খুব খেপে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি মোটেই ক্ষিপ্ত হননি।
বড় শান্ত মেজাজে জবাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক বিটকেলে ছাত্রের। আমার ক্লাসফ্রেন্ড। মেধার দৌড়ে আমার চেয়ে অনেক ভালো। ক্লাসের ৩১০ জন ছাত্রের মধ্যে ওর রোল নম্বর ছিল ৩০৯; আমি ওকে ফলো করছিলাম। আমার রোল নম্বরটি ছিল ওর পরেরটি।
বিধাতার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। একদিন সে জানতে চেয়েছিল, প্রভু তুমি তো সর্বক্ষমতাবান। কিন্তু আমার মনে একটা সংশয় উপস্থিত হয়েছে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে। তুমি আমাদের দেশটাকে পুরোপুরি শুদ্ধ, সুন্দর- চমৎকার করে দিতে পারছ না কেন?!
কেন দেশটাকে রাহুমুক্ত করার জন্য 'কালপ্রিটস্য কালপ্রিট' যুদ্ধাপরাধীদের- যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে পারছি না!
কেন যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী ও সন্ত্রাসীদের বিচারের কথা শুনলে কিছু ভ্রষ্ট ও নষ্ট মানুষের মাথা আরো নষ্ট হয়ে যায়? তুমি কি বলতে পারো কখন আমাদের দেশটি নষ্ট সাম্প্রদায়িক ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িক মানুষের অপচ্ছায়া থেকে মুক্ত হবে?
বিধাতা তাকে বকা দিতে পারতেন, ধমক দিতে পারতেন, কঠিন কোনো শাস্তি দিতে পারতেন, পরীক্ষায় তাকে ফেল করিয়ে দিতে পারতেন, তার ভাতের থালা থেকে ডিমভরা ইলিশ টুকরোটি তুলে নিয়ে আমার পাতে পাঠিয়ে দিতে পারতেন, তার বিবাহে বিলম্ব ঘটিয়ে দিতে পারতেন, তার পেটে প্রচণ্ড একটা গুঁতো দিতে পারতেন নাভি বরাবর। কিন্তু তেমন কিছুই তিনি করেননি। মৃদু হেসে শুধু বলেছিলেন, শোন বালক- অত হতাশ হোসনে, তোদের কাজেকর্মে ভুলভাল যতই থাকুক, আমি এ বয়সী বিধাতা, কিন্তু জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে আমার মৃত্যু বা কোনো অপমৃত্যু হওয়ার আগে তোদের পূতপবিত্র ও রক্তস্নাত দেশটিকে মেরামত করে যেতে পারি।
দুই. বিধাতা এত সহিষ্ণু যে তাদেরও ক্ষমা করেন, যারা তাকে ছোট করে, ক্ষুদ্র করে, ভাগ করে ও তাকে সাম্প্রদায়িক করে তোলে।
কিছু লোক আছে, যারা মনে করে বিধাতা শুধু তাদেরই সৃষ্টি করেছেন, তাদেরই দেখভাল করেন; অন্যদের সুখ-দুঃখ ও সাফল্য-ব্যর্থতার দিকে তিনি তাকালেনই না, তাকালেও কানাচোখ ব্যবহার করেন। তারা নিজেদের বিশ্বাসের লোকগুলোর পরপার যাত্রার খবর শুনে যে প্রার্থনা করেন, অন্য লোকদের বেলায় তার বিপরীত প্রার্থনা করেন। কোনাকুনি বিপরীত!
তিন. এটিই শেষ।
এক সংশয়বাদী ভয়াবহভাবে আগুন লাগা ভবনে আটকে পড়েছিলেন। বাঁচতে হলে লাফিয়ে পড়া ছাড়া তার দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। লাফ তো লাফ, তাও আবার ১০তলা থেকে।
তিনি অনুভব করলেন, এ সময় অন্তত বিধাতার নাম মুখে নিয়ে লাফ দেওয়া ভালো। এই জীবন-মরণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবলেন, বিধাতার নাম নিয়ে লাফ যে দেব আমি, কোন বিধাতার নাম নেব?! কোন বিধাতা বড়?! কোন বিধাতা শ্রেষ্ঠ? আমার বিধাতা? না, করিমের বিধাতা? না, সমীরের বিধাতা?, না, ডেভিডের বিধাতা? না, সর্দারজির বিধাতা? না, মুৎসুদ্দির বিধাতা?! না, গাঞ্জাওয়ালার বিধাতা?!
: তারপর কী করলেন তিনি? সেই বিপদাপন্ন মানুষ?!
: কী করলেন, তার আগে বলি মৃত্যুমুখে পড়ার পরও লোকটির মনে যে এমন কঠিন ও উদ্ভট যত ভাবনাচিন্তার আলোড়ন, বিধাতা তাতেও কিছু মনে করেননি! লোকটি চোখ বুজে লাফিয়ে পড়ার সময় বলল, আমার বিধাতার নামে দিলাম লাফ, যা করে করবে ওর বিধাতা।
: বিধাতা তারপর কী করলেন?!
: তিনি যা ভালো বুঝলেন, তাই করলেন!
: সময় অনেক গেল। এবার বিধাতার-
সহিষ্ণুতার আর একটি মাত্র এগজাম্পল দিয়ে গল্পটা শেষ করুন।
: এগুলোকে আপনি গল্প বলছেন?! যা হোক, গল্প বললে গল্প, সত্য মানলে সত্য। বিধাতার সর্বসহিষ্ণুতার চার নম্বর এগজাম্পলটি শুনুন।
: এক ভিক্ষুক, আমার চেয়েও সিরিয়াস, বেশ কয়েক দিন উপাসনালয়ের সামনে থালা পেতে বসলেন। কোনো দিন পেলেন সাত টাকা, কোনো দিন সাঁইত্রিশ, কোনো দিন পঁয়তাল্লিশ, কোনো দিন পঞ্চান্ন। একদিন তিনি স্থান পাল্টালেন।
বসলেন শুঁড়িখানার সামনে। যে লোকটি প্রথম বেরোল, সে বড় তাচ্ছিল্যে তার থালায় ফেলল ১০০ টাকার নোট, দ্বিতীয় জন ৫০০ টাকার নোট।
তখন ভিক্ষুকটি ওপরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি কোথায় থাক প্রভু, আর ঠিকানা দাও কোথায়?!
এই অভিযোগ শোনার পরও বিধাতা কিছু মনে করেননি। তিনি সর্বসহিষ্ণু, তিনি মুচকে মুচকে হেসেছিলেন। তাঁকে যারা ভুল বোঝে, তাদের ওপর তিনি মোটেই ক্রুদ্ধ হন না। রাগ করতে তিনি জানেনই না!
লেখক : শ্রমজীবী, কথাসাহিত্যিক
: বিধাতা আর কখন কিছু মনে করেন না, জানেন?
: জানব না কেন?! এ সবই তো আমার গবেষণার বিষয়।
: এক-দুই করে বলুন।
: একবার বিধাতা খুব খেপে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি মোটেই ক্ষিপ্ত হননি।
বড় শান্ত মেজাজে জবাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক বিটকেলে ছাত্রের। আমার ক্লাসফ্রেন্ড। মেধার দৌড়ে আমার চেয়ে অনেক ভালো। ক্লাসের ৩১০ জন ছাত্রের মধ্যে ওর রোল নম্বর ছিল ৩০৯; আমি ওকে ফলো করছিলাম। আমার রোল নম্বরটি ছিল ওর পরেরটি।
বিধাতার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। একদিন সে জানতে চেয়েছিল, প্রভু তুমি তো সর্বক্ষমতাবান। কিন্তু আমার মনে একটা সংশয় উপস্থিত হয়েছে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে। তুমি আমাদের দেশটাকে পুরোপুরি শুদ্ধ, সুন্দর- চমৎকার করে দিতে পারছ না কেন?!
কেন দেশটাকে রাহুমুক্ত করার জন্য 'কালপ্রিটস্য কালপ্রিট' যুদ্ধাপরাধীদের- যথাপ্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে পারছি না!
কেন যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী ও সন্ত্রাসীদের বিচারের কথা শুনলে কিছু ভ্রষ্ট ও নষ্ট মানুষের মাথা আরো নষ্ট হয়ে যায়? তুমি কি বলতে পারো কখন আমাদের দেশটি নষ্ট সাম্প্রদায়িক ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িক মানুষের অপচ্ছায়া থেকে মুক্ত হবে?
বিধাতা তাকে বকা দিতে পারতেন, ধমক দিতে পারতেন, কঠিন কোনো শাস্তি দিতে পারতেন, পরীক্ষায় তাকে ফেল করিয়ে দিতে পারতেন, তার ভাতের থালা থেকে ডিমভরা ইলিশ টুকরোটি তুলে নিয়ে আমার পাতে পাঠিয়ে দিতে পারতেন, তার বিবাহে বিলম্ব ঘটিয়ে দিতে পারতেন, তার পেটে প্রচণ্ড একটা গুঁতো দিতে পারতেন নাভি বরাবর। কিন্তু তেমন কিছুই তিনি করেননি। মৃদু হেসে শুধু বলেছিলেন, শোন বালক- অত হতাশ হোসনে, তোদের কাজেকর্মে ভুলভাল যতই থাকুক, আমি এ বয়সী বিধাতা, কিন্তু জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে আমার মৃত্যু বা কোনো অপমৃত্যু হওয়ার আগে তোদের পূতপবিত্র ও রক্তস্নাত দেশটিকে মেরামত করে যেতে পারি।
দুই. বিধাতা এত সহিষ্ণু যে তাদেরও ক্ষমা করেন, যারা তাকে ছোট করে, ক্ষুদ্র করে, ভাগ করে ও তাকে সাম্প্রদায়িক করে তোলে।
কিছু লোক আছে, যারা মনে করে বিধাতা শুধু তাদেরই সৃষ্টি করেছেন, তাদেরই দেখভাল করেন; অন্যদের সুখ-দুঃখ ও সাফল্য-ব্যর্থতার দিকে তিনি তাকালেনই না, তাকালেও কানাচোখ ব্যবহার করেন। তারা নিজেদের বিশ্বাসের লোকগুলোর পরপার যাত্রার খবর শুনে যে প্রার্থনা করেন, অন্য লোকদের বেলায় তার বিপরীত প্রার্থনা করেন। কোনাকুনি বিপরীত!
তিন. এটিই শেষ।
এক সংশয়বাদী ভয়াবহভাবে আগুন লাগা ভবনে আটকে পড়েছিলেন। বাঁচতে হলে লাফিয়ে পড়া ছাড়া তার দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। লাফ তো লাফ, তাও আবার ১০তলা থেকে।
তিনি অনুভব করলেন, এ সময় অন্তত বিধাতার নাম মুখে নিয়ে লাফ দেওয়া ভালো। এই জীবন-মরণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবলেন, বিধাতার নাম নিয়ে লাফ যে দেব আমি, কোন বিধাতার নাম নেব?! কোন বিধাতা বড়?! কোন বিধাতা শ্রেষ্ঠ? আমার বিধাতা? না, করিমের বিধাতা? না, সমীরের বিধাতা?, না, ডেভিডের বিধাতা? না, সর্দারজির বিধাতা? না, মুৎসুদ্দির বিধাতা?! না, গাঞ্জাওয়ালার বিধাতা?!
: তারপর কী করলেন তিনি? সেই বিপদাপন্ন মানুষ?!
: কী করলেন, তার আগে বলি মৃত্যুমুখে পড়ার পরও লোকটির মনে যে এমন কঠিন ও উদ্ভট যত ভাবনাচিন্তার আলোড়ন, বিধাতা তাতেও কিছু মনে করেননি! লোকটি চোখ বুজে লাফিয়ে পড়ার সময় বলল, আমার বিধাতার নামে দিলাম লাফ, যা করে করবে ওর বিধাতা।
: বিধাতা তারপর কী করলেন?!
: তিনি যা ভালো বুঝলেন, তাই করলেন!
: সময় অনেক গেল। এবার বিধাতার-
সহিষ্ণুতার আর একটি মাত্র এগজাম্পল দিয়ে গল্পটা শেষ করুন।
: এগুলোকে আপনি গল্প বলছেন?! যা হোক, গল্প বললে গল্প, সত্য মানলে সত্য। বিধাতার সর্বসহিষ্ণুতার চার নম্বর এগজাম্পলটি শুনুন।
: এক ভিক্ষুক, আমার চেয়েও সিরিয়াস, বেশ কয়েক দিন উপাসনালয়ের সামনে থালা পেতে বসলেন। কোনো দিন পেলেন সাত টাকা, কোনো দিন সাঁইত্রিশ, কোনো দিন পঁয়তাল্লিশ, কোনো দিন পঞ্চান্ন। একদিন তিনি স্থান পাল্টালেন।
বসলেন শুঁড়িখানার সামনে। যে লোকটি প্রথম বেরোল, সে বড় তাচ্ছিল্যে তার থালায় ফেলল ১০০ টাকার নোট, দ্বিতীয় জন ৫০০ টাকার নোট।
তখন ভিক্ষুকটি ওপরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি কোথায় থাক প্রভু, আর ঠিকানা দাও কোথায়?!
এই অভিযোগ শোনার পরও বিধাতা কিছু মনে করেননি। তিনি সর্বসহিষ্ণু, তিনি মুচকে মুচকে হেসেছিলেন। তাঁকে যারা ভুল বোঝে, তাদের ওপর তিনি মোটেই ক্রুদ্ধ হন না। রাগ করতে তিনি জানেনই না!
লেখক : শ্রমজীবী, কথাসাহিত্যিক
No comments