সময়ের প্রতিধ্বনি-সরকারের যে ভুলগুলো শোধরানো প্রয়োজন by মোস্তফা কামাল

গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হবে বলে আশা করছে। এখন পর্যন্ত ১৭৫ আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো। তবে ৬০ আসনের অবস্থা খুব খারাপ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি এসব তথ্য দিয়েছেন।


এর আগে ২০০১ সালেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগকে এভাবেই আশাবাদী করে তুলেছিল। পরে দেখা গেল, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩০ আসনে বিজয়ী হয়। এখন তারা ১৭৫ আসন (কোনো কোনো পত্রিকায় ১৭০ আসনের কথা বলা হয়েছে) ধরে রাখতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। সভায় প্রধানমন্ত্রী তিন মাস আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। একই সঙ্গে দলীয় এমপিদের নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং এলাকায় যোগাযোগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দল মিটিয়ে ফেলা ছাড়াও সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বৈঠকে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের সংসদ সদস্যদের আগ্নেয়াস্ত্র না দেখিয়ে নিজ সংসদীয় এলাকার জনগণের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, শুধু উন্নয়ন করলেই ভোট পাওয়া যায় না। এলাকায়ও যেতে হয়।
গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বেশ আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন এবং বেশ লম্ফঝম্ফও করছেন বলে মনে হচ্ছে। শুরুতেই বলেছি, ২০০১ সালেও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার আগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দিয়ে মাঠপর্যায়ে জরিপ করিয়েছিলেন। তা ছাড়া ছাত্রলীগ-যুবলীগের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী গ্রুপ গঠন করে তাদের দিয়েও জরিপ করানো হয়েছিল। ওই জরিপেও দেখা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা এবং দলীয় লোকদের দিয়ে করানো জরিপ রিপোর্টগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। সংগত কারণেই এবারের গোয়েন্দা রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। রিপোর্টে বলা উচিত ছিল, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে যেসব কাজ সম্পন্ন করতে পারলে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হবে। অথবা বলতে হতো, ক্ষমতাসীন দল এই ভালো কাজগুলো করেছে, এ কারণেই তারা আগামীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে।
আমার দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিগত সাড়ে তিন বছরে বেশ কিছু ভুল করেছে এবং এখনো ভুল পথেই হাঁটতে। তাদের ভুলগুলো শোধরাতে না পারলে আবার ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের বন্ধুরাও এ কথাটিই বলবেন। ভুলগুলো এখানে তুলে ধরছি।
১. মন্ত্রীদের কথা বলা বন্ধ করতে হবে। তাঁরা যদি আগামী ছয় মাস কথা বলা বন্ধ রেখে কাজে মনোযোগ দেন, তাহলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মন্ত্রীদের বেফাঁস কথার কারণে সরকারকে বিভিন্ন সময় বিব্রত হতে হয়েছে। তার পরও যে মন্ত্রীদের বেফাঁস কথা বলা বন্ধ হয়েছে তা নয়। তারা অনর্গল যা মুখে আসে তা-ই বলছেন। বেশি বলার কারণেই তাঁরা অনেক কথাই বেফাঁস বলেন। বিশ্বের আর কোনো দেশের মন্ত্রীরা এত বেশি কথা বলেন কি না সন্দেহ।
২. ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। তাতে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারলে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা হবে। অথচ বিগত সাড়ে তিন বছরে নিত্যপণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। আর যে পণ্যের দাম একবার বাড়ে, তা আর কমে না। ফলে সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বাঁচাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ ধারকর্জ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে। অনেকের ঋণের বোঝা বাড়ছে। বস্তিবাসী থেকে শুরু করে স্বল্প ও মধ্য-আয়ের মানুষের পুষ্টির একমাত্র অবলম্বন ছিল ডিম। সেই ডিমের হালি এখন ৪০ টাকা। মাছ-মাংস কেনার সামর্থ্য যাদের নেই, তারা যে ডিম খাবে, তা-ও তাদের জন্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে! অথচ সরকারের মন্ত্রীদের মুখে বড় বড় বুলি আমরা শুনতে পাই।
সামনে রোজা। আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা জোট বেঁধে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছেন। সরকার তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সরকারও এ কথা স্বীকার করছে যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এরা কারা? তাদের খুঁজে বের করা কি এতই কঠিন! বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বারবার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার কথা বলা হলেও কার্যত তা কিছুই করা হয়নি। ফলে বাজার চলে গেছে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে না পারলে সরকারের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
৩. সাধারণ মানুষ যে কতটা কষ্টে আছে, তা সরকারও নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সরকার নিজেও ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। এমনিতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের নাভিশ্বাস ওঠার মতো অবস্থা। তার ওপর দফায় দফায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে কষ্ট কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত বছর চারবার জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এ বছর জুলাই মাসে আবার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এখন কমে যাচ্ছে। এ ধরনের গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যারা পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁরা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন বলে মনে হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের অন্তত দশবার ভাবা উচিত।
৪. হত্যা, গুম, অপহরণসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি সরকারের জন্য আরেকটি বিপদের কারণ। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। এ কারণে তিনি পুলিশকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, মানুষের বেডরুম পাহারা দেওয়া নাকি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া তো সরকারের দায়িত্ব! সেটা নিশ্চিত করতে পারলে তো আর বেডরুম পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না!
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেল। অথচ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কোনো হদিসই দিতে পারছে না। আর এ জন্য যে তারা জবাবদিহি করবে, তারও কোনো বালাই নেই। গণতান্ত্রিক সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। অথচ সরকারের আচার-আচরণে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। তাহলে কি হত্যা, গুম, অপহরণ চলতেই থাকবে? এর কোনো প্রতিকার হবে না?
৫. গত কয়েক মাসে যে বিষয়টি লক্ষ করা গেছে তা হচ্ছে, সরকার এখন আর সমালোচনা মোটেই সহ্য করতে পারছে না। সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনে বিরোধী দল পুরোপুরি কোণঠাসা। তারা যে সমাবেশ করবে, সেখানেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। আর এসব বিষয় মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়। তাই মিডিয়া সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সাংবাদিকদের তুখোড় সমালোচনা করছেন। সাংবাদিকরা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পুলিশ বিনা উস্কানিতে সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করছে। সন্ত্রাসীরা গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না; সাংবাদিকদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। এর পরও দোষ চাপানো হচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর। সরকারের এই নীতি পরিহার করা খুবই জরুরি।
৬. কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়ে রীতিমতো লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই বিদ্যুৎ কিনতেই সরকারের বিপুল অর্থ চলে যাচ্ছে। সাধারণত বিদ্যুৎ খাতে নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে এক-দুই বছরের জন্য কুইক রেন্টালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। পাশাপাশি সরকারের উচিত ছিল বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া। কিন্তু সেদিকে সংশ্লিষ্টদের খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে সরকারের দেউলিয়া হতে খুব একটা সময় লাগবে না। তবে বিদ্যুতের এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের উচিত দ্রুত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া। এ ছাড়া বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বাস-প্রাইভেট কার নতুন করে সিএনজিতে রূপান্তর বন্ধ করা যেতে পারে। যাদের গাড়ি কেনার সামর্থ্য আছে, তারা তেল কিনে গাড়ি চালাতে সক্ষম।
৭. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম একটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সমগ্র জাতি বর্তমান সরকারকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। সে অনুযায়ী বিচার-প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার বড় ধরনের ঝুঁকিও নিয়েছে এবং বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুল আলীমসহ শীর্ষপর্যায়ের রাজাকারদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। এসব নেতাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের প্রবল আপত্তি ছিল। তার পরও সরকার তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারকাজ শুরু করেছে। এ জন্য সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তাদের বিচারকাজ বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের মধ্যেই শেষ করতে হবে।
সরকার যেন দেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে পুঁজি করে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চিন্তা না করে, সে রকম চিন্তা থেকেই যদি সরকার ইস্যুটিকে জিইয়ে রাখাতে চায়, তাহলে বড় ধরনের ভুল করবে। আমরা আশা করি, সরকার উপরোলি্লখিত ভুলগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে এবং তা শোধরানোর জন্য আন্তরিক উদ্যোগ নেবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.