কলকাতা থেকে বাংলাদেশের মিউজিক অনেক এগিয়েঃ সোমলতা by ফাহিম ফয়সাল

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই সময়ের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী সোমলতা আচার্য্য চৌধুরী। প্লে-ব্যাকের মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয় হলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক গানেও দারুণ দক্ষ। সম্প্রতি তিনি ও তার ব্যান্ড দল ‘সোমলতা অ্যান্ড দ্যা এসেস্’ বেশ ক’টি সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

এদেশের মেয়ে হলেও এবারই প্রথম বাংলাদেশে সোমলতা আসেন। ঢাকায় একাধিক স্টুডিও কনসার্ট আর স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই সোমলতা আলাদাভাবে বাংলানিউজের মুখোমুখি হন। সোমলতার সঙ্গে কথোপকথনের নির্বাচিত অংশ পাঠকের জন্য।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশে কবে এসেছেন? কী কী অনুষ্ঠান করছেন?
সোমলতা : বাংলাদেশে এসেছি গত ১৫ জুন শুক্রবার। ১৯ জুন মঙ্গলবার পর্যন্ত আছি। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আরটিভির বর্ষা উৎসবে গান গাওয়াটা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য আরটিভি রকস্টার স্টুডিও কনসার্টে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করলাম। টিভি চ্যানেলেগুলোর মধ্যে ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান, আরটিভির মিউজিক্যাল শো, এটিএন নিউজের তারকা আড্ডা আর একুশে টিভির তারকা আড্ডায় অংশ নিয়েছি।  এছাড়াও রিহ্যাব সামার ফেয়ার এর সমাপনী অধিবেশনের কনসার্টে পারফর্ম করলাম।

বাংলানিউজ : আপনার পূর্বপুরুষ তো বাংলাদেশেই বাস করতেন। কোন অঞ্চলে ছিল তাদের আদি নিবাস?
সোমলতা : হ্যাঁ, আমি আসলে এদেশেরই মেয়ে। যদিও এবারই প্রথম আমার মাতৃভূমিতে আসার সুযোগ হলো। আমি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ির মেয়ে। আমার ঠাকুরদা ছিলেন জমিদার। আর মায়ের বাড়ি নোয়াখালিতে। আমার পূর্বপুরুষদের এসব স্মৃতিময় জায়গায় বেড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

বাংলানিউজ : কার অনুপ্রেরণায় আপনি গানের প্রতি  ঝুঁকলেন?
সোমলতা : পড়ালেখায় আমার হাতেখড়ি হবার আগেই গানে হাতেখড়ি হয়। এর কারণ হচ্ছে আমার ঠাকুর মা চাইতেন, আমার মা গান শিখুক। মা যখন গানের তালিম নিতেন তখন আমি ছোট হলেও মায়ের সাথে বসতাম। এটা দেখে আমাকে গান শেখানোর প্রতি ঠাকুর মা আগ্রহী হয়ে উঠেন।  ঠাকুর মায়ের অনুপ্রেরণাতেই আমি গানে তালিম নেই। এভাবেই গানের প্রতি ঝুঁকে পড়া।



বাংলানিউজ : কবে থেকে প্রফেশনালি গান করা শুরু করেন?
সোমলতা : ২০০৬ সালের দিকে আমি প্রফেশনালি গান করা শুরু করি। প্রথমে আমি প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে যাত্রা শুরু করি। প্রথম গান করি একটি টেলিছবিতে। প্লে-ব্যাক ছাড়াও আমি বিজ্ঞাপনের অনেক জিঙ্গেল করেছি। আমাকে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেয় টিভি চ্যানেল তারা মিউজিকের ‘টেক এ ব্রেক’ অনুষ্ঠানটি । প্রথম প্লে-ব্যাক করি ‘ক্রস কানেকশন’ ছবিতে। ছবিটি ২০০৯ সালে মুক্তি পায়।

বাংলানিউজ :  কোন কাজটিকে আপনি আপনার ক্যারিয়রের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন?
সোমলতা : আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ ছবিটি। গতবছর মুক্তি পাওয়া এ ছবিতে আমি মোট ৬টি গান গাই। এরমধ্যে আমার একক গান ছিলো ৪টি। বাকি দুটির একটিতে ছিলেন অঞ্জন দত্ত, অন্য গানটিতে ছিলেন অঞ্জন দত্ত ও কবির সুমন। এ ছবিতে আমার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’ ও ‘তুমি আসবে বলে’ গান দুটো দিয়েই আমি সবার নজরে চলে আসি।

বাংলানিউজ : এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া কী কী ছবিতে আপনি গান করেছেন?
সোমলতা : ‘ক্রস কানেকশন’ (২০০৯), ‘ইউ টার্ন’ (২০১০), ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ (২০১১), ‘সেভেন ডেজ’ (২০১১), ‘বক্স নং ১৩১৩’, ‘বেডরুম’ (২০১২) এবং ‘ইলার চার অধ্যায়’ (২০১২) ছবিতে আমি প্লে-ব্যাক করেছি। আরও প্রায় ১০টি ছবি আছে মুক্তির অপেক্ষায় যেগুলোতে আমি গান গেয়েছি।

বাংলানিউজ : ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’ ও ‘মায়াবন বিহারিণী’ গান দুটো নিয়ে বলুন?
সোমলতা : রবীন্দ্র সংগীত আমার খুব ভালো লাগে। তবে যে স্টাইলে সবাই রবীন্দ্র সংগীত গায়, তা আমার পছন্দ নয়। বড় হওয়ার পর গানের কথা বুঝে সুর আয়ত্ত করে নিজের অনুভূতি দিয়ে তা গাওয়ার চেষ্টা করছি। ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’ গানটি জনপ্রিয় হওয়ার পর রূপম ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। তিনি ‘মায়াবন বিহারিণী’ গানটি অন্যভাবে পরিবেশনের কথা ভেবেছিলেন। আর তা আমাকে বলায় আমিও রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু একবারও ভাবিনি, আমার গাওয়া গানটি এতটা জনপ্রিয় হবে।

বাংলানিউজ : এবার বলুন আপনার একক অ্যালবামের কথা?
সোমলতা : ২০০৯ সালে পূজায় এসেছে আমার প্রথম একক অ্যালবাম ‘চুপকথা’। এরপর আরেকটি অ্যালবামের কাজ শুরু করেছি। নানাজন নানাভাবে অ্যালবামটি করতে বলছেন। এখনও ঠিক করি নি অ্যালবামটি ঠিক কিভাবে করবো।

বাংলানিউজ : যে কোন গানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে কোন বিষয়টিকে আপনি মনে করেন?
সোমলতা : গানের কথা আর সুর দুটোই। আসল কথা হচ্ছে আবেগ। আমি মনে করি, শিল্পী গানটির মর্ম বুঝে কতোটা ফিলিংস নিয়ে গানটি গাইছে তার আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলানিউজ : বাংলাদেশের মানুষ ও গান সম্পর্কে আপনার ধারনা?
সোমলতা : বাংলাদেশ অনেক সুন্দর একটি দেশ। তবে এদেশের মানুষ অনেক অতিথি পরায়ন। বাংলাদেশের মানুষরা ভীষণ আন্তরিক আর প্রাণ খোলা। আর একেক জায়গার দর্শক-শ্রোতা একেক রকম। সত্যি বলতে কি, পশ্চিমবঙ্গে আমাকে ও আমার গানকে অনেকেই চিনে না। সেই হিসেবে বাংলাদেশে তো আরো চেনার কথা নয়। কিন্তু দেখলাম এদেশে সঙ্গীতপ্রিয় মানুষদের কাছে আমার গান বেশ জনপ্রিয়। আমার জনপ্রিয় গানগুলোর বেশিরভাগই এদেশের মানুষের কাছেই পৌছেছে। এদেশে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আর বাংলাদেশের গানতো অসাধারণ। আমাদের কলকাতার বাংলাগান থেকে এদেশের মিউজিক অনেক এগিয়ে। এখানকার মিউজিশিয়ানরা অনেক যতœ সহকারে কাজ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের  ব্যান্ডসঙ্গীত তো খুবই উচ্চ মানের।

বাংলানিউজ : এ পর্যন্ত কি কি পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন?
সোমলতা : ইটিভির ‘দাদা না দিদি’তে গানের বিগসাইট ‘বেস্ট ডিসকভারী অ্যাওয়ার্ড’, স্টার জলসার ‘বেস্ট নিউ কামার অ্যাওয়ার্ড’, আনন্দলোক ‘স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড’, টেলিসিন অ্যাওয়ার্ড এর ‘বেস্ট ফিমেল সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড’। আর ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ ছবির গানগুলো পেয়েছে ‘ন্যাশনাল মিউজক অ্যাওয়ার্ড’। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।

বাংলানিউজ : আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বা মূহুর্ত কোনটি?
সোমলতা : আমি অঞ্জন দত্তের ছেলে নীল দত্তের কাছে অফার পেয়ে টেলিফিল্মে গান গাই। এরপর অঞ্জন দত্তের সাথে পরিচয় হয়। আমার জীবনের স্মরণীয় মূহুর্ত হচ্ছে যেদিন আমি ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ ছবির গানের জন্য অফার পাই।

বাংলানিউজ : গানের পাশাপাশি অভিনয়ের অফার পান?
সোমলতা : অভিনয়ের অনেক অফার পাই। কিন্তু কখনো ভাবিনি অভিনয় করবো। আর ভবিষ্যতেও কোন অভিনয় করার ইচ্ছা নেই।

বাংলানিউজ : বাংলাদেশের গান গাওয়ার অফার পেলে কি গাইবেন?
সোমলতা : অবশ্যই। আমার নিজের দেশে কাজ করার সুযোগ পেলে আমি তা লুফে নেব। প্লে-ব্যাক, অ্যালবামসহ গানের যে কোন অফার পেলে আমি অবশ্যই গাইবো।

বাংলানিউজ : ভালো লাগা আর খারাপ লাগা সম্পর্কে জানতে চাই।
সোমলতা : আড্ডা দেয়া আমি খুব উপভোগ করি। আর রাত জেগে কাজ করা আমার খুব অপছন্দ।

বাংলানিউজ : গান ছাড়া আপনি অন্য কোনো পেশায় জড়িত আছেন কি ?
সোমলতা : গান গাওয়ার পাশাপাশি গান আমি বর্তমানে আশুতোষ কলেজে মনোবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।

বাংলানিউজ : আপনার নিজস্ব ব্যান্ড সম্পর্কে জানতে চাই।
সোমলতা : আমার ব্যান্ডের নাম ‘সোমলতা অ্যান্ড দ্যা এসেস’। এই ব্যান্ডের সদস্য আছে মোট ছয় জন। আমার সঙ্গে সবাই তারা এবার ঢাকায় এসেছেন। ব্যান্ডের লাইনআপ হলো- অর্ণব রায় (লিড গীটার), অর্ণব সেন (কি-বোর্ড), অভিষেক ব্যাণার্জি (ড্রামস), অভিষেক ভট্টাচার্য (বেস গীটার), কিঞ্জল ভট্টাচার্য (ম্যানেজার) ও সোমলতা আচার্য্য চৌধুরী (ভোকাল)। আমাদের সবার মাঝেই রয়েছে দারুণ বন্ধুত্ব।

বাংলানিউজ : আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা আর স্বপ্ন কি নিয়ে?
সোমলতা : পরিকল্পনা বা স্বপ্ন হচ্ছে আগামী ১০ বছর পরও যেন ঠিকমত গান গাইতে পারি। নিজেকে এমন জায়গায় দেখতে চাই যেখানে নিজস্ব জীবন ও গানের ধারা ঠিক থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.