আন্তর্জাতিক-চোরাবালিতে মিসরের বিপ্লব by সারা খোরশিদ

মিসর এখন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আইনি বিশেষজ্ঞ ও অপিনিয়ন লিডারদের বিতর্কের মধ্যে পড়ে মিসরবাসী যে বিপ্লবের জন্য প্রাণপাত করেছিল, তার আসল উদ্দেশ্যই বিস্তৃত হতে পারেন। মার্কিন সরকার মিসরে সত্যিকার গণতন্ত্র চায় কিনা সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।


তারা সামরিক ও বেসামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সামরিক বাহিনীকে গণতান্ত্রিক উত্তরণ মেনে নিতে বাধ্য করতে পারে। তারা কি মিসরবাসীর বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখাবে?

মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থী মোহাম্মেদ মুরসি খুব সম্ভব দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। তবে এ সপ্তাহের শেষ দিকে মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হলেও মিসরের প্রথম পপুলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে গণতন্ত্রের জন্য মাইলফলক বলা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের সংসদ বিলুপ্ত করা সংক্রান্ত রায় এবং প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্ব খর্ব করে দেওয়া সামরিক বাহিনীর ঘোষণা মুরসিকে একনায়কত্ববাদী সামরিক কাউন্সিলের কর্তৃত্বাধীনে 'ঠুঁটো জগন্নাথে' পরিণত করবে। সামরিক কাউন্সিল শিগগিরই তাদের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেবে_ এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
সামরিক সুপ্রিম কাউন্সিল ক্ষমতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আঁটসাঁট করেছে। তারা আইন প্রণয়ন ও জাতীয় বাজেট প্রণয়নের অধিকার নিজেদের এখতিয়ারে রেখে দিয়েছে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য প্যানেল মনোনয়নেও তাদের একচ্ছত্র অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং তাদের কাজের ব্যাপারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণের অধিকার রহিত করা হয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্টের হাতে যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার রাখা হলেও এর ওপর সামরিক সুপ্রিম কাউন্সিলের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা থাকছে।
কয়েক মাস ধরেই এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, সামরিক বাহিনী অত সহজে ক্ষমতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবে না এবং তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেবে না।
হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আমি যখন গত মার্চে সাংবিধানিক সংশোধনীর ওপর অনুষ্ঠিত গণভোটে 'না' ভোট দিই, তখন সেটা অবশ্যই ছিল সামরিক বাহিনী পরিচালিত সমগ্র উত্তরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। এই ট্রকিয়া অব্যাহত থাকায় সামরিক কাউন্সিল ইসলামী ব্রাদারহুড প্রভাবাধীন সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে পেরেছে এবং তারা আইন প্রণয়নের অধিকারটাও নিজেদের কাছে রেখে দিতে পেরেছে।
ওই সাংবিধানিক সংশোধনী এবং গণভোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল মিসরের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে আরব দেশটির গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটছে মর্মে ভুল ধারণা বদ্ধমূল করার জন্য। গত ১৯ মার্চ অনেক মিসরবাসী গর্বের সঙ্গে তাদের ভোট প্রদানের চিহ্ন হিসেবে অমোচনীয় কালি মাখা আঙুল প্রদর্শন করেছিল। তাদের আশা ছিল, এর ফলে দেশটিতে বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। সামরিক কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তিরাও এটাই দেখাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু বিকৃত এই রোডম্যাপ গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার মাধ্যমে মিসরের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করার উদ্দেশ্যতাড়িত এবং মিসরের জনগণকে সামরিক বাহিনী প্রদর্শিত রোডম্যাপ মেনে চলতে বাধ্য করার জন্যই। রেফারেন্ডাম, প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ফাঁদে ফেলে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।
মোবারক সরকার কখনোই ক্ষমতা ত্যাগ করেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট কেবল তার টাইটেল খুইয়েছেন মাত্র। তবে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে এবং তার শাস্তি ঘোষিত হয়েছে। মোবারকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীকেও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো শাস্তি ঘোষিত হয়নি। এটা ছাড়া প্রায় সবকিছুই বিপ্লবপূর্ব অবস্থায় যেমন ছিল, তেমনই আছে। সামরিক বাহিনীর কমান্ডাররা ও সরকারের মন্ত্রীদেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। হাজার হাজার বেসামরিক মিসরীয় এখন বিচারের অপেক্ষায়। বেসামরিক ব্যক্তিদের বিনা ওয়ারেন্টে সামরিক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর এক সামরিক ফরমানবলে ন্যস্ত করে কার্যত সাধারণ মানুষের ওপর অবিচারে স্টিমরোলার চালানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
আসলে সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সবার ক্ষমতা ও এখতিয়ার নির্দিষ্ট করা ছাড়া কেবল সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেই কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে আগুয়ান হওয়া যায় না। যেখানে আইনের শাসনের উপস্থিতি আছে, সেখানে গণতন্ত্র টিকে থাকে। রাজনৈতিক ও আইনি বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত একটি দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি পাওয়া কঠিন। মিসরের আদালত সংসদের বৈধতা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। তারা সংসদ বিলুপ্ত করার আগে একটুও ভাবেনি যে, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে কীভাবে এবং কোথায় শপথ নেবেন ।
মিসর এখন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আইনি বিশেষজ্ঞ ও অপিনিয়ন লিডারদের বিতর্কের মধ্যে পড়ে মিসরবাসী যে বিপ্লবের জন্য প্রাণপাত করেছিল, তার আসল উদ্দেশ্যই বিস্তৃত হতে পারেন।
মার্কিন সরকার মিসরে সত্যিকার গণতন্ত্র চায় কিনা সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তারা সামরিক ও বেসামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সামরিক বাহিনীকে গণতান্ত্রিক উত্তরণ মেনে নিতে বাধ্য করতে পারে। তারা কি মিসরবাসীর বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখাবে?

সারা খোরশিদ :ইসলাম অনলাইনের সাবেক সম্পাদক
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.