সময়ের প্রতিধ্বনি-প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ এবং বাংলাদেশে আইএসআই কানেকশন by মোস্তফা কামাল

শুধু আইএসআই নয়, বাংলাদেশে এখন অনেক গোয়েন্দা সংস্থাই বেশ তৎপর। পাকিস্তান আমল থেকেই এ অঞ্চলে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতার সময় তো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কৌশলগত যুদ্ধই ঘোষণা করেছিল।

সেই যুদ্ধে একদিকে ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আর অন্যদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি (বর্তমান নাম এফএসবি)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আটকে দিতে সিআইএ-আইএসআই জোটের তৎপরতা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সেই ইতিহাস নিশ্চয়ই আমাদের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সুধী সমাজের বিজ্ঞ প্রতিনিধিরা ভুলে যাননি। স্বাধীনতার পরও বঙ্গবন্ধু সরকারকে ব্যর্থ করতে খোদ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভূমিকা নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণে আছে! এও স্মরণে আছে, বাংলাদেশে যখন দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছিল তখন খাদ্য বোঝাই মার্কিন নৌবহর পাঠিয়েও আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই কথা ভেবে এখন নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন লজ্জায় মুখ ঢাকে।
পাকিস্তানের কারণে সৌদি আরব এবং চীনও তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষাবলম্বন করেছিল। কিন্তু বীরের জাতিকে কী আর দাবিয়ে রাখা যায়! শত বাধা, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ঠিকই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এখন এই দেশগুলো বাংলাদেশের বন্ধু বটে! তবে এই দেশটির ওপর প্রভাব বলয় তৈরি করতে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নানামুখী তৎপরতা চলছেই। শুধু যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র সক্রিয় তা নয়, এখানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, চীনা গোয়েন্দা সংস্থা এমএসএস, যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬, মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও তৎপর রয়েছে।
বাংলাদেশে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা নিয়ে এর আগেও আমি একাধিক নিবন্ধ লিখেছি। আমরা আগেও বলেছি, বাংলাদেশের বিজয় লাভ করা ছিল আইএসআইর জন্য বড় বিপর্যয়। আর এ সুযোগে বাংলাদেশে প্রভাব বলয় তৈরি করে র। সেই প্রভাব বলয় ভাঙতে একাত্তর সাল থেকেই বড় ধরনের তৎপরতা চালায় আইএসআই। এ ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়।
স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ছিল আইএসআই এবং তার মিত্র শক্তির বড় সাফল্য। সেই সাফল্যের হাত ধরেই এ দেশের মাটিতে শেকড় গেড়ে বসে আইএসআই। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, ইসলামী দলগুলোকে অর্থ সহায়তা থেকে শুরু করে এ দেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে প্রভাব বলয় তৈরি করে এই সংস্থাটি। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত-আফগানিস্তানজুড়ে আইএসআই শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে সক্ষম হয়। আফগানিস্তানে আইএসআইয়ের সহযোগিতায় তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে এবং টানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ না করলে হয়তো তালেবান শাসকদের কোনো কালেই ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশে সরকার বদলেও আইএসআইয়ের ভূমিকা থাকে বলে ধারণা করা হয়। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাই শুধু নয়, সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে অশান্ত করার পেছনে আইএসআইয়ের হাত রয়েছে বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই অভিযোগ করে। এমনও দেখা গেছে, আইএসআই আতঙ্কে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রীতিমতো তটস্থ থাকে।
বাংলাদেশের কোনো সরকার অতীতে আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেনি। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, '১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া আইএসআইয়ের কাছ থেকে পাঁচ কোটি রুপি নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে যেহেতু নিয়েছিলেন, ১৯৯৬ সালেও নিয়েছেন। ২০০১ সালে আরো বেশি টাকা নিয়েছেন। আইএসআইয়ের কাছ থেকে টাকা খেয়ে দালালি করে তিনি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। যাঁরা টাকা নিয়ে আরেক দেশের দালালি করছেন, তাঁদের সেই দেশে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।' (কালের কণ্ঠ, ১১ মার্চ ২০১২)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি না তা আমরা জানি না। তবে বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইএসআইয়ের যোগাযোগের তথ্য আমরা জানি। জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য আইএসআই, 'র'সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে। ভোটে জেতার পর সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায়ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রভাব খাটিয়ে থাকে। শেখ হাসিনা যদি সরকারি সূত্রে আইএসআইকে অর্থ দেওয়ার তথ্যটি পেয়ে থাকেন, তাহলে আমরা ধরে নেব তাঁর অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে পারেন এবং দেশের স্বার্থেই তা জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। অন্যথায় শেখ হাসিনার নিজের জন্যই ক্ষতিকর হবে। অতি কথনের জন্য অতীতেও তাঁকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে।
আইএসআই বিশ্বের সেরা ১০টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে। আইএসআই ইচ্ছা করলে শেখ হাসিনা সরকারকে বড় ধরনের বিপদে ফেলতে পারে। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জীবনের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই একটি বড় গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতটা শোভন হয়েছে, তা বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।
তবে এটাও ঠিক, কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী বাজেট জোগাবে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা; এটা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এতে ওই রাজনৈতিক দলটি সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার তল্পিবাহকে পরিণত হয়। দলটি যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে সেই সরকারকে দিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করিয়ে নেবে ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি। আমরা জানি না, বিএনপির সঙ্গে আইএসআইয়ের যোগাযোগ ছিল কি না কিংবা কতটা মজবুত ছিল।
অভিযোগ আছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ দেশে জঙ্গি উত্থানের পেছনে আইএসআইয়ের ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সরকারের একটি অংশ এবং আইএসআইয়ের জোগসাজশে জঙ্গিরা সংগঠিত হয়। তখন জঙ্গি তৎপরতায় প্রশাসনও বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিল। এসব বিষয়ে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর হাতে তথ্য রয়েছে। দেশের স্বার্থেই এসব তথ্য প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করি। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গিরা সংগঠিত হতে পারলে আফগানিস্তানের পরিণতি মেনে নিতে হবে।
আফগানিস্তানেও তালেবান জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করে আইএসআইয়ের হাত ধরে। তালেবান জঙ্গিরা আইএসআইয়ের কাছ থেকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা পেয়েছিল। এর ফলে তারা অতি দ্রুত আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে সরকার উৎখাত করে তালেবানি শাসন কায়েম করে।
জঙ্গিদের পরবর্তী টার্গেট ছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী তারা অগ্রসরও হচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর জঙ্গি দমন অভিযান জোরদার করায় তাদের তৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে জঙ্গিদের বিনাশ করা এখনো সম্ভব হয়নি। এখনো জঙ্গিরা বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের মদদে তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ আপাতত ঝুঁকিমুক্ত এ কথা বলা যায়। কিন্তু পাকিস্তান এখনো ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অংশ জঙ্গিগোষ্ঠীকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। এর তথ্যপ্রমাণ মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সরকারের আমলে জঙ্গি দমনে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ১০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু তা খুব একটা কাজে আসেনি। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়াও পারভেজ মোশাররফ সরকার তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে চুক্তি করে জঙ্গি দমন অভিযান বন্ধ করে দেয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরেও আইএসআই ভূমিকা রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন সরকারকে বোঝানো হয়েছিল, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পাকিস্তানের অনেক সেনাসদস্য হতাহত হয়েছে। এটাকে পাকিস্তানের জনগণ ভালো চোখে দেখছে না। এতে ঘরে ঘরে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। পরে বাধ্য হয়েই মোশাররফ সরকার জঙ্গি দমন অভিযান বন্ধ করে। এটা টের পেয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তা ছাড়া আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পাকিস্তানে আশ্রয় পেয়েছে। তাদের অবস্থানের সব তথ্য আইএসআই জানত বলে অভিযোগ আছে।
গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে সিআইএ এবং আইএসআইয়ের মধ্যে চুক্তি থাকলেও লাদেন কিংবা অন্য জঙ্গিদের অবস্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো তথ্য দেয়নি আইএসআই। সংগতকারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার আইএসআইয়ের ওপর আস্থা হারায়। জারদারি সরকারও কঠিন চাপের মুখে পড়ে। একপর্যায়ে জারদারি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে আইএসআইয়ের রাজনৈতিক উইং বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর চাপে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে জারদারি সরকার এবং সেনাবাহিনী ও আইএসআই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রেসিডেন্ট জারদারি এমনও মনে করেন, তাঁর সরকারকে বিপদে ফেলতে আইএসআই নানা অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট এবং সেনাবাহিনীর বর্তমান আঁতাতের পেছনে আইএসআইয়ের হাত রয়েছে বলে ক্ষমতাসীন সরকারের একটি পক্ষ মনে করছে।
সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশ ও দেশের বাইরে আইএসআইয়ের কর্মকাণ্ড প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আস্থার সংকটেও পড়েছে বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের এই গোয়েন্দা সংস্থাটি। আস্থা ফিরিয়ে আনতে সংস্থাটিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে সংস্থাটি নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.