বিশেষ সাক্ষাৎকার-ট্রাইব্যুনালের শক্তি-সামর্থ্য আরও বাড়ানো দরকার by শাহরিয়ার কবির
লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার ইসলামপুরে। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকে (সম্মান) অধ্যয়নকালে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি।
১৯৭২ সালে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ-আদালতের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার পর ১৯৯২ সালে সরকার কর্তৃক পদচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অব্যাহতভাবে সক্রিয় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ দেশি-বিদেশি বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হচ্ছে আগামী ১০ আগস্ট থেকে। ওই দিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হবে। একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে আপনি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন, এটাকে কেমন অর্জন বলে মনে করছেন?
শাহরিয়ার কবির দেখুন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২০ বছর ধরে এটি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে। শহীদ পরিবারগুলোও এই দাবিতে সোচ্চার ছিল। বিচারের দাবি উঠেছিল ১৯৭২ সাল থেকেই। বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গোলাম আযমকে যখন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির করা হয়, তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় গোলাম আযম পাকিস্তানের নাগরিক। গণ-আদালত হয়েছে। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। এখন একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাকে প্রাথমিক বিজয় বলে মনে করছি।
প্রথম আলো বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও তো বিষয়টি ছিল।
শাহরিয়ার কবির মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অনেক কিছুই পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিক রয়েছে বলেই আমরা মনে করি। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১০ সালের মার্চে ট্রাইব্যুনাল করেছে, এখন ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হচ্ছে।
প্রথম আলো বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীদের পক্ষ থেকেও সম্প্রতি একই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে খণ্ডন করবেন?
শাহরিয়ার কবির প্রকৃতপক্ষে সরকার বিচারের উদ্যোগ শুরু করার পর থেকেই ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক—দুভাবেই এটা চলছে। এই বিচার ও আইন প্রশ্নবিদ্ধ করতে জামায়াতে ইসলামী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহযোগীরা বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইনজীবীদের ভাড়া করেছেন। আইনজীবীদের ভাড়া করা হলে তাঁরা তাঁদের পক্ষে নানা কিছু হাজির করার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মনে করছে, এটা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির সমমানের হতে হবে। আইসিসি গঠিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে; আর সেখানে বলা হয়েছে, এই আদালত গঠনের আগে ঘটে যাওয়া অপরাধ বিচারের এখতিয়ার তাঁদের নেই। আর যেসব দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে, সেখানে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার আইসিসির নেই। আমাদের দেশে যেহেতু নিজস্ব উন্নত বিচারব্যবস্থা আছে, সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে আইসিসির নিয়ম-কানুন বা বিধিবিধান আমাদের মেনে চলতে হবে।
প্রথম আলো এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক না ‘ডমেস্টিক’ এ নিয়েও তো প্রশ্ন তুলেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীরা।
শাহরিয়ার কবির এই বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ ঘটেছে, তা আন্তর্জাতিক; কিন্তু এর বিচারের বিষয়টি অভ্যন্তরীণ। এই অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে একটি আইন হয়েছে। এখানে যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে, অপরাধ ঘটেছে বাংলাদেশে, অপরাধ হয়েছে এ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে, এর শিকার হয়েছেন এ দেশের জনগণ। এই অপরাধের বিচার করার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে এবং এটা দেশের সার্বভৌম অধিকারের বিষয়। কোনো কারণে আমরা যদি তা করতে না পারি, তখন আন্তর্জাতিক বিচারের প্রশ্ন আসতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে, সেসব দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আমরা যেমন প্রশ্ন তুলি না, তেমনি আমাদের যে আইন হয়েছে ১৯৭৩ সালে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। এই আইনটি একটি অনন্য আইন। বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য একটি ডমেস্টিক ল করেছে। ১৯৭৩ সালের আইনে সুস্পষ্টভাবে গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের ক্ষেত্রেও তা করা হয়নি। বলা যায়, ১৯৭৩-এর এই আইন হচ্ছে মাদার অব আইসিসি। এই বিচারের জন্য আমরা অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহায়তা চাই, আর সেটা হচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহযোগিতা, যাতে আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারি।
প্রথম আলো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এক আইনজীবী যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল ‘ডমেস্টিক’ হলে দেশের প্রচলিত আইনের নানা সুযোগ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পাওয়া উচিত।
শাহরিয়ার কবির দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে এই বিচার সম্ভব নয় বলেই ১৯৭৩ সালে আইন করা হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে, একাত্তরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলেছে, তা বিশেষ ধরনের অপরাধ। একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে। অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক ও বিশেষ ধরনের। প্রচলিত আইনে এর বিচার সম্ভব নয়, তাতে এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। প্রচলিত আইনের সাক্ষীর যে বিধান রয়েছে, তা এখানে কার্যকর থাকলে হবে না। একটি উদাহরণ দিই, শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন খালেদ মজুমদার। হত্যার উদ্দেশ্যে যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সাক্ষী শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখেছেন, খালেদ মজুমদারকে তাঁরা শনাক্তও করেছেন, কিন্তু তাঁকে হত্যার কোনো চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ফলে প্রচলিত ফৌজদারি আইনে সাক্ষীর বিধান দিয়ে যুদ্ধাপরাধ বা গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার করা যায় না। একাত্তরে যে গণহত্যা ঘটেছে, তা কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে ঘটেনি, রাজনৈতিক কারণে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে গণহত্যা চালানো হয়েছে। ন্যুরেমবার্গসহ বিশ্বে এ ধরনের যত ট্রাইব্যুনাল হয়েছে, সব কয়টি বিশেষ আইনের অধীনেই হয়েছে।
প্রথম আলো সম্প্রতি আমরা দেখলাম যে ট্রাইব্যুনালের কিছু কার্যবিধি পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন বিধানে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আপত্তি ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা কেটে যাবে বলে মনে করেন কি?
শাহরিয়ার কবির এই বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা পর্যবেক্ষণ সরকার ও ট্রাইব্যুনাল যে বিবেচনায় নিয়েছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। বিচারের প্রয়োজনে ও বিচারের অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কার্যবিধির পরিবর্তন করা হয়েছে, প্রয়োজনে আরও সংশোধনীও করা যেতে পারে। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এই বিচার তো কোনো ক্যামেরা ট্রায়াল হচ্ছে না। যে কেউ দেখতে পারবেন যে আমরা আন্তর্জাতিক মানের বিচার করতে পারছি কি না। আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধাপরাধের বিচারই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, নানা প্রশ্ন অনেক মহলে রয়েছে।
প্রথম আলো সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক, সেটাই তো আপনাদের চাওয়া ছিল। এখন মনে হচ্ছে কিছু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।
শাহরিয়ার কবির সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে হবে, এমন দাবি বাস্তবসম্মত নয়। ৪০ বছর পর কাজটি খুবই কঠিন। বঙ্গবন্ধুর সময় ১১ হাজারের বেশি যুদ্ধাপরাধী আটক ছিল। এখন তাদের খোঁজ পাওয়া কঠিন হবে। ঢালাও বিচার করতে গেলে জটিলতা দেখা দেবে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, শীর্ষ অপরাধী ও জেলা-থানা পর্যায়ে যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচার নিশ্চিতের চেষ্টা করে যাওয়া। কেউ একটা বিবৃতি দিয়েছে বা রাজনৈতিক কারণে দালালি করেছে, তাদের বাদ দেওয়া যায়। আমরা শুনেছি, সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। বর্তমান বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, অপরাধীদের শীর্ষে যার নাম, সেই গোলাম আযমকে এখনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন? মীর কাশেম আলী এবং এ টি এম আজহারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। আমরা দেখছি যে তারা বাইরে থেকে বিচার বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। এই চিহ্নিত ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
প্রথম আলো ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পাশাপাশি সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের একটি দাবি আপনাদের ছিল। সেটা থেকে আপনারা কি সরে এসেছেন?
শাহরিয়ার কবির এই বিচারের উদ্যোগ যখন নেওয়া হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। তাঁদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের উদ্যোগের বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার পক্ষে। এখানে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, একাত্তরে যে অপরাধ হয়েছে তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির অপরাধ বা আক্রোশ নয়। যারা এই অপরাধ করেছে, তারা করেছে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে, দলের নির্দেশে। রাজনৈতিক বিবেচনায়ই তারা নারীকে গনিমতের মাল বিবেচনায় ধর্ষণ করেছে, হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন চালিয়েছে। এসব করতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করছে রাজনৈতিক কারণেই। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা খুবই প্রাসঙ্গিক এ ক্ষেত্রে। তাঁর বাবাকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল মাওলানা মান্নানের নির্দেশে। মাওলানা মান্নান এখন প্রয়াত। ১৯৭৩-এর আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় মৃত ব্যক্তিকে বিচারের আওতা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মাওলানা মান্নানের বিচারের কোনো সুযোগ আর নেই। নুজহাত চৌধুরীর প্রশ্ন, তাঁর বাবার হত্যার সঙ্গে দুটি নাম জড়িত—একটি মাওলানা মান্নান ও অন্যটি আলবদর বাহিনী। একজন মৃত ব্যক্তির বিচার করা না গেলেও সেই সংগঠনের বিরুদ্ধে কেন বিচার চলবে না? ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে ছয়টি সংগঠনের বিচার হয়েছে এবং চারটি সংগঠন যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। সেই সংগঠনগুলোকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে আমাদের অবস্থান থেকে সরে আসিনি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা বিবেচনায় নেওয়ার কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। একাত্তর সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শুনেই দেশ স্বাধীন করেছিলাম।
প্রথম আলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের লোকবল, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তার সামর্থ্য, আর্থিক ক্ষমতা—এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
শাহরিয়ার কবির এই প্রতিষ্ঠানটির শক্তি-সামর্থ্য বাড়ানোর দাবি আমরা শুরু থেকেই করে আসছি। বর্তমানে যাঁরা তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কোনো ছুটি না নিয়ে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের কারণেই বিচার-প্রক্রিয়া এত দূর এগিয়েছে। তবে আমি মনে করি, সুষ্ঠু ও যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরও যোগ্য, দক্ষ, সৎ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অঙ্গীকারবদ্ধ তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, প্রতিষ্ঠানটির লোকবল বাড়ানো দরকার। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে শত শত আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা সহায়তা করেছিলেন বলেই এক বছরের মধ্যে ২১ জনের বিচারকাজ শেষ করা গিয়েছিল। সেই বিচার হয়েছিল যুদ্ধের পরপরই, যা আমরা করতে যাচ্ছি ৪০ বছর পর। কাজটি খুবই কঠিন। অনেক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক সাক্ষী বেঁচে নেই। ফলে পর্যাপ্ত ও দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী ছাড়া এই দুরূহ কাজ শেষ করা যাবে না। আমার মনে হয়, সরকার এক ধরনের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার অভিজ্ঞতা আর মানসিকতা থেকেই ট্রাইব্যুনালের জনবল ঠিক করেছে। বিষয়টি যে ৪০ বছর আগে ঘটে যাওয়া গণহত্যার, তা বিবেচনায় নেয়নি। এই গণহত্যা-সম্পর্কিত অনেক তথ্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বিচারের জন্য এগুলো জোগাড় করা খুবই জরুরি। ট্রাইব্যুনালের লোকবল, অর্থ ও রসদ বাড়ানোর জোর দাবি সরকারের প্রতি আমাদের রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিকভাবে পুরো স্বাধীনতা দিতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হচ্ছে আগামী ১০ আগস্ট থেকে। ওই দিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হবে। একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে আপনি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন, এটাকে কেমন অর্জন বলে মনে করছেন?
শাহরিয়ার কবির দেখুন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২০ বছর ধরে এটি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে। শহীদ পরিবারগুলোও এই দাবিতে সোচ্চার ছিল। বিচারের দাবি উঠেছিল ১৯৭২ সাল থেকেই। বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গোলাম আযমকে যখন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির করা হয়, তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় গোলাম আযম পাকিস্তানের নাগরিক। গণ-আদালত হয়েছে। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। এখন একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাকে প্রাথমিক বিজয় বলে মনে করছি।
প্রথম আলো বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও তো বিষয়টি ছিল।
শাহরিয়ার কবির মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের অনেক কিছুই পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিক রয়েছে বলেই আমরা মনে করি। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১০ সালের মার্চে ট্রাইব্যুনাল করেছে, এখন ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হচ্ছে।
প্রথম আলো বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীদের পক্ষ থেকেও সম্প্রতি একই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে খণ্ডন করবেন?
শাহরিয়ার কবির প্রকৃতপক্ষে সরকার বিচারের উদ্যোগ শুরু করার পর থেকেই ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক—দুভাবেই এটা চলছে। এই বিচার ও আইন প্রশ্নবিদ্ধ করতে জামায়াতে ইসলামী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহযোগীরা বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইনজীবীদের ভাড়া করেছেন। আইনজীবীদের ভাড়া করা হলে তাঁরা তাঁদের পক্ষে নানা কিছু হাজির করার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মনে করছে, এটা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির সমমানের হতে হবে। আইসিসি গঠিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে; আর সেখানে বলা হয়েছে, এই আদালত গঠনের আগে ঘটে যাওয়া অপরাধ বিচারের এখতিয়ার তাঁদের নেই। আর যেসব দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে, সেখানে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার আইসিসির নেই। আমাদের দেশে যেহেতু নিজস্ব উন্নত বিচারব্যবস্থা আছে, সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে আইসিসির নিয়ম-কানুন বা বিধিবিধান আমাদের মেনে চলতে হবে।
প্রথম আলো এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক না ‘ডমেস্টিক’ এ নিয়েও তো প্রশ্ন তুলেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীরা।
শাহরিয়ার কবির এই বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ ঘটেছে, তা আন্তর্জাতিক; কিন্তু এর বিচারের বিষয়টি অভ্যন্তরীণ। এই অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে একটি আইন হয়েছে। এখানে যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে, অপরাধ ঘটেছে বাংলাদেশে, অপরাধ হয়েছে এ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে, এর শিকার হয়েছেন এ দেশের জনগণ। এই অপরাধের বিচার করার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে এবং এটা দেশের সার্বভৌম অধিকারের বিষয়। কোনো কারণে আমরা যদি তা করতে না পারি, তখন আন্তর্জাতিক বিচারের প্রশ্ন আসতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে, সেসব দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আমরা যেমন প্রশ্ন তুলি না, তেমনি আমাদের যে আইন হয়েছে ১৯৭৩ সালে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। এই আইনটি একটি অনন্য আইন। বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য একটি ডমেস্টিক ল করেছে। ১৯৭৩ সালের আইনে সুস্পষ্টভাবে গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের ক্ষেত্রেও তা করা হয়নি। বলা যায়, ১৯৭৩-এর এই আইন হচ্ছে মাদার অব আইসিসি। এই বিচারের জন্য আমরা অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহায়তা চাই, আর সেটা হচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহযোগিতা, যাতে আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারি।
প্রথম আলো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এক আইনজীবী যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল ‘ডমেস্টিক’ হলে দেশের প্রচলিত আইনের নানা সুযোগ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পাওয়া উচিত।
শাহরিয়ার কবির দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে এই বিচার সম্ভব নয় বলেই ১৯৭৩ সালে আইন করা হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে, একাত্তরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলেছে, তা বিশেষ ধরনের অপরাধ। একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে। অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক ও বিশেষ ধরনের। প্রচলিত আইনে এর বিচার সম্ভব নয়, তাতে এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। প্রচলিত আইনের সাক্ষীর যে বিধান রয়েছে, তা এখানে কার্যকর থাকলে হবে না। একটি উদাহরণ দিই, শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন খালেদ মজুমদার। হত্যার উদ্দেশ্যে যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সাক্ষী শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখেছেন, খালেদ মজুমদারকে তাঁরা শনাক্তও করেছেন, কিন্তু তাঁকে হত্যার কোনো চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ফলে প্রচলিত ফৌজদারি আইনে সাক্ষীর বিধান দিয়ে যুদ্ধাপরাধ বা গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার করা যায় না। একাত্তরে যে গণহত্যা ঘটেছে, তা কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে ঘটেনি, রাজনৈতিক কারণে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে গণহত্যা চালানো হয়েছে। ন্যুরেমবার্গসহ বিশ্বে এ ধরনের যত ট্রাইব্যুনাল হয়েছে, সব কয়টি বিশেষ আইনের অধীনেই হয়েছে।
প্রথম আলো সম্প্রতি আমরা দেখলাম যে ট্রাইব্যুনালের কিছু কার্যবিধি পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন বিধানে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আপত্তি ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা কেটে যাবে বলে মনে করেন কি?
শাহরিয়ার কবির এই বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা পর্যবেক্ষণ সরকার ও ট্রাইব্যুনাল যে বিবেচনায় নিয়েছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। বিচারের প্রয়োজনে ও বিচারের অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কার্যবিধির পরিবর্তন করা হয়েছে, প্রয়োজনে আরও সংশোধনীও করা যেতে পারে। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এই বিচার তো কোনো ক্যামেরা ট্রায়াল হচ্ছে না। যে কেউ দেখতে পারবেন যে আমরা আন্তর্জাতিক মানের বিচার করতে পারছি কি না। আর একটি কথা বলা প্রয়োজন, পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধাপরাধের বিচারই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, নানা প্রশ্ন অনেক মহলে রয়েছে।
প্রথম আলো সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক, সেটাই তো আপনাদের চাওয়া ছিল। এখন মনে হচ্ছে কিছু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।
শাহরিয়ার কবির সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে হবে, এমন দাবি বাস্তবসম্মত নয়। ৪০ বছর পর কাজটি খুবই কঠিন। বঙ্গবন্ধুর সময় ১১ হাজারের বেশি যুদ্ধাপরাধী আটক ছিল। এখন তাদের খোঁজ পাওয়া কঠিন হবে। ঢালাও বিচার করতে গেলে জটিলতা দেখা দেবে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, শীর্ষ অপরাধী ও জেলা-থানা পর্যায়ে যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচার নিশ্চিতের চেষ্টা করে যাওয়া। কেউ একটা বিবৃতি দিয়েছে বা রাজনৈতিক কারণে দালালি করেছে, তাদের বাদ দেওয়া যায়। আমরা শুনেছি, সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। বর্তমান বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, অপরাধীদের শীর্ষে যার নাম, সেই গোলাম আযমকে এখনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন? মীর কাশেম আলী এবং এ টি এম আজহারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। আমরা দেখছি যে তারা বাইরে থেকে বিচার বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। এই চিহ্নিত ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
প্রথম আলো ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পাশাপাশি সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের একটি দাবি আপনাদের ছিল। সেটা থেকে আপনারা কি সরে এসেছেন?
শাহরিয়ার কবির এই বিচারের উদ্যোগ যখন নেওয়া হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। তাঁদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের উদ্যোগের বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার পক্ষে। এখানে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, একাত্তরে যে অপরাধ হয়েছে তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির অপরাধ বা আক্রোশ নয়। যারা এই অপরাধ করেছে, তারা করেছে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে, দলের নির্দেশে। রাজনৈতিক বিবেচনায়ই তারা নারীকে গনিমতের মাল বিবেচনায় ধর্ষণ করেছে, হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন চালিয়েছে। এসব করতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করছে রাজনৈতিক কারণেই। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা খুবই প্রাসঙ্গিক এ ক্ষেত্রে। তাঁর বাবাকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল মাওলানা মান্নানের নির্দেশে। মাওলানা মান্নান এখন প্রয়াত। ১৯৭৩-এর আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় মৃত ব্যক্তিকে বিচারের আওতা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মাওলানা মান্নানের বিচারের কোনো সুযোগ আর নেই। নুজহাত চৌধুরীর প্রশ্ন, তাঁর বাবার হত্যার সঙ্গে দুটি নাম জড়িত—একটি মাওলানা মান্নান ও অন্যটি আলবদর বাহিনী। একজন মৃত ব্যক্তির বিচার করা না গেলেও সেই সংগঠনের বিরুদ্ধে কেন বিচার চলবে না? ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে ছয়টি সংগঠনের বিচার হয়েছে এবং চারটি সংগঠন যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। সেই সংগঠনগুলোকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমরা সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে আমাদের অবস্থান থেকে সরে আসিনি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা বিবেচনায় নেওয়ার কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। একাত্তর সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শুনেই দেশ স্বাধীন করেছিলাম।
প্রথম আলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের লোকবল, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তার সামর্থ্য, আর্থিক ক্ষমতা—এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
শাহরিয়ার কবির এই প্রতিষ্ঠানটির শক্তি-সামর্থ্য বাড়ানোর দাবি আমরা শুরু থেকেই করে আসছি। বর্তমানে যাঁরা তাঁদের কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কোনো ছুটি না নিয়ে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের কারণেই বিচার-প্রক্রিয়া এত দূর এগিয়েছে। তবে আমি মনে করি, সুষ্ঠু ও যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার জন্য আরও যোগ্য, দক্ষ, সৎ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অঙ্গীকারবদ্ধ তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, প্রতিষ্ঠানটির লোকবল বাড়ানো দরকার। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে শত শত আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা সহায়তা করেছিলেন বলেই এক বছরের মধ্যে ২১ জনের বিচারকাজ শেষ করা গিয়েছিল। সেই বিচার হয়েছিল যুদ্ধের পরপরই, যা আমরা করতে যাচ্ছি ৪০ বছর পর। কাজটি খুবই কঠিন। অনেক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক সাক্ষী বেঁচে নেই। ফলে পর্যাপ্ত ও দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবী ছাড়া এই দুরূহ কাজ শেষ করা যাবে না। আমার মনে হয়, সরকার এক ধরনের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার অভিজ্ঞতা আর মানসিকতা থেকেই ট্রাইব্যুনালের জনবল ঠিক করেছে। বিষয়টি যে ৪০ বছর আগে ঘটে যাওয়া গণহত্যার, তা বিবেচনায় নেয়নি। এই গণহত্যা-সম্পর্কিত অনেক তথ্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বিচারের জন্য এগুলো জোগাড় করা খুবই জরুরি। ট্রাইব্যুনালের লোকবল, অর্থ ও রসদ বাড়ানোর জোর দাবি সরকারের প্রতি আমাদের রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিকভাবে পুরো স্বাধীনতা দিতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির ধন্যবাদ।
No comments