চলতি পথে-বরিশালের শংকর মঠ by দীপংকর চন্দ
নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে কলেজ রোড ধরে এগিয়ে চলল আমাদের রিকশা। ব্রজমোহন কলেজ পড়ল পথে। কলেজটি আধুনিক বরিশালের নির্মাতা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে প্রতিষ্ঠিত। ব্রজমোহন দত্তের পূর্বপুরুষ কানকুব্জ থেকে বাংলাদেশে আসেন।
কথিত আছে, মহারাজ আদিশুরের সঙ্গে যে পাঁচজন শরীররক্ষী ক্ষত্রীয় বা কায়স্থ বাংলাদেশে আসেন, তাঁরা হলেন মকরন্দ ঘোষ, দশরথ বসু, বিরাট গুহ, কালিদাস মিত্র ও পুরুষোত্তম দত্ত। প্রথম চারজন ব্রাহ্মণের দাসত্ব স্বীকার করেছিলেন বলে তৎকালীন ব্রাহ্মণশাসিত সমাজব্যবস্থায় কৌলিন্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু পুরুষোত্তম দত্ত দাসত্ব স্বীকার তো করেনইনি, বরং সদম্ভে বলেছিলেন, ‘দত্ত কারও ভৃত্য নয়, শুধু সঙ্গে এসেছে।’ এই তেজস্বী পুরুষোত্তম দত্ত প্রতিষ্ঠিত দত্ত বংশের ত্রিবিংশতিতম পুরুষ ব্রজমোহন দত্ত।
সে যা-ই হোক, ব্রজমোহন কলেজ পেছনে ফেলে সামনে এগোলাম আমরা। এগোতে এগোতে দেয়ালঘেরা একটি নান্দনিক স্থাপনার দিকে আকর্ষিত হলো আমাদের দৃষ্টি। রিকশা থামিয়ে নেমে এলাম নিচে। গ্রিলে তৈরি মজবুত ফটক অতিক্রম করে ঢুকলাম ভেতরে। সিমেন্টে বাঁধানো সরু পথ চলে গেছে অনেকটা দূর অবধি। পথের বাঁ পাশে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেহগনি গাছের বক্ররৈখিক বিস্তার। ডান পাশে বড় একটি জলাশয়। জলাকীর্ণ সেই জলাশয়টির পাড় ঘেঁষে একসারি কাঁঠালগাছ ছুটে গেছে ঘাট অবধি। অনাড়ম্বর ছোট্ট ঘাটের পাশে দুর্গামণ্ডপ ও কালীমন্দির। এর ঠিক কাছেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণকারী অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনাটি। তিন গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপনাটির দুই পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি গম্বুজ। সাদা টাইলসে বাঁধানো বৃহদাকার গম্বুজটি স্থাপনার কেন্দ্রভাগে। গম্বুজশীর্ষে ধাতুনির্মিত ‘ওঁ’ চিহ্ন প্রোথিত। ঠিক তার উপরিভাগেই প্রোথিত একটি ধাতব ত্রিশূল। স্থাপনাটির পরিচয়? হ্যাঁ, এটিই বরিশালের বিখ্যাত শংকর মঠ—অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বনামধন্য বিপ্লবী স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর সাধনপীঠ।
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর আসল নাম সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল উজিরপুরে। সতীশ চন্দ্রের বাবা ষষ্ঠীচরণ মুখোপাধ্যায় গলাচিপা থানার দারোগা ছিলেন। ১৮৮৪ সালের ১২ আগস্ট বাবার কর্মস্থল গলাচিপায় জন্মগ্রহণ করেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি ১৯০১ সালে উজিরপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এর পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় তাঁর। কারণ, পুরো ভারতবর্ষ তখন স্বদেশি আন্দোলনের প্রবল স্রোতে উন্মাতাল। সেই স্রোত থেকে নিজেকে দূরে রাখা সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো কলেজপড়ুয়া তীক্ষ দেশপ্রেমসমৃদ্ধ ছাত্রের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কলেজ ছেড়ে বরিশালে ফিরে এলেন তিনি। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের নিবিড় সান্নিধ্যে এলেন। আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার প্রয়াসে যোগ দিলেন বিএম স্কুলে শিক্ষকতার কাজে। সে সময় বিএম স্কুল ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরাই নেতৃত্ব দিতেন বরিশালকেন্দ্রিক ব্রিটিশবিরোধী প্রথাসিদ্ধ আন্দোলনে। কিন্তু সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের কথা ভাবতেন। তিনি ভাবতেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্তের প্রথাসিদ্ধ আন্দোলন আরও বেগবান হতে পারে সংঘবদ্ধ বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ ধরনের ভাবনা থেকেই সাড়া জাগানো বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির আদলে গড়ে ওঠা বরিশাল স্বদেশ-বান্ধব সমিতির সঙ্গে যুক্ত হলেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। গোপন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁরা ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন ইংরেজ প্রশাসনকে।
১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতির একাংশের উদ্যোগে গঠিত হলো যুগান্তর নামের একটি অতিবিপ্লবী দল। বরিশালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় যুগান্তরের পরিচালক বারীন্দ্র ঘোষের সঙ্গে সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের যোগাযোগ হলো। বারীন্দ্র ঘোষ সতীশ চন্দ্রকে যুগান্তরের অনুরূপ একটি বিপ্লবী দল গঠন করতে বললেন। ১৯০৮ সালে বিএম স্কুলের ছাত্র নরেন্দ্র মোহন ঘোষ চৌধুরীর সহায়তায় বরিশালে অতিবিপ্লবী দল গঠন করলেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসেই অতিবিপ্লবী দলগুলোর কার্যক্রম বেআইনি ঘোষণা করল সরকার এবং সেই সংগঠনগুলোর সদস্যদের ওপর শুরু করল অকথ্য নির্যাতন। সরকারি এই নির্যাতনের প্রতিবাদে বিএম স্কুলের চাকরি ছাড়লেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৯১১ সালে তিনি গয়াধামে গেলেন। স্বামী শংকরানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়ে প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী নাম গ্রহণ করলেন। ১৯১২ সালে বরিশালে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন শংকর মঠ। কালক্রমে এই মঠই হয়ে উঠল বরিশালে বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল, স্বাধীনতার বৈপ্লবিক মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার তীর্থকেন্দ্র।
বিপ্লবের এই তীর্থকেন্দ্রের অভ্যন্তরে তিনটি কক্ষ। পরিচ্ছন্ন সিঁড়ি আর কলাপসিবল গেটের বাধা টপকে আমাদের ভেতরে যেতে সাহায্য করলেন মঠের পূজারি অসীম চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, মঠের কেন্দ্রীয় কক্ষটিতে রয়েছে কষ্টিপাথরে নির্মিত একটি শিবলিঙ্গ। পশ্চিম দিকের কক্ষটিতে শংকরানন্দের বিগ্রহ এবং পূর্ব দিকের কক্ষটি স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর সমাধিমন্দির। ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম আমরা। অনুভব করার চেষ্টা করলাম অগ্নিযুগের সেই মানুষগুলোর আদর্শ-অনুভূতিকে, যাঁদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অতিক্রম করেছিলাম স্বাধীনতার এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান।
দীপংকর চন্দ
সে যা-ই হোক, ব্রজমোহন কলেজ পেছনে ফেলে সামনে এগোলাম আমরা। এগোতে এগোতে দেয়ালঘেরা একটি নান্দনিক স্থাপনার দিকে আকর্ষিত হলো আমাদের দৃষ্টি। রিকশা থামিয়ে নেমে এলাম নিচে। গ্রিলে তৈরি মজবুত ফটক অতিক্রম করে ঢুকলাম ভেতরে। সিমেন্টে বাঁধানো সরু পথ চলে গেছে অনেকটা দূর অবধি। পথের বাঁ পাশে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেহগনি গাছের বক্ররৈখিক বিস্তার। ডান পাশে বড় একটি জলাশয়। জলাকীর্ণ সেই জলাশয়টির পাড় ঘেঁষে একসারি কাঁঠালগাছ ছুটে গেছে ঘাট অবধি। অনাড়ম্বর ছোট্ট ঘাটের পাশে দুর্গামণ্ডপ ও কালীমন্দির। এর ঠিক কাছেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণকারী অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনাটি। তিন গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপনাটির দুই পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি গম্বুজ। সাদা টাইলসে বাঁধানো বৃহদাকার গম্বুজটি স্থাপনার কেন্দ্রভাগে। গম্বুজশীর্ষে ধাতুনির্মিত ‘ওঁ’ চিহ্ন প্রোথিত। ঠিক তার উপরিভাগেই প্রোথিত একটি ধাতব ত্রিশূল। স্থাপনাটির পরিচয়? হ্যাঁ, এটিই বরিশালের বিখ্যাত শংকর মঠ—অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বনামধন্য বিপ্লবী স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর সাধনপীঠ।
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর আসল নাম সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল উজিরপুরে। সতীশ চন্দ্রের বাবা ষষ্ঠীচরণ মুখোপাধ্যায় গলাচিপা থানার দারোগা ছিলেন। ১৮৮৪ সালের ১২ আগস্ট বাবার কর্মস্থল গলাচিপায় জন্মগ্রহণ করেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি ১৯০১ সালে উজিরপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এর পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় তাঁর। কারণ, পুরো ভারতবর্ষ তখন স্বদেশি আন্দোলনের প্রবল স্রোতে উন্মাতাল। সেই স্রোত থেকে নিজেকে দূরে রাখা সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো কলেজপড়ুয়া তীক্ষ দেশপ্রেমসমৃদ্ধ ছাত্রের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কলেজ ছেড়ে বরিশালে ফিরে এলেন তিনি। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের নিবিড় সান্নিধ্যে এলেন। আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার প্রয়াসে যোগ দিলেন বিএম স্কুলে শিক্ষকতার কাজে। সে সময় বিএম স্কুল ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরাই নেতৃত্ব দিতেন বরিশালকেন্দ্রিক ব্রিটিশবিরোধী প্রথাসিদ্ধ আন্দোলনে। কিন্তু সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলনের কথা ভাবতেন। তিনি ভাবতেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্তের প্রথাসিদ্ধ আন্দোলন আরও বেগবান হতে পারে সংঘবদ্ধ বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ ধরনের ভাবনা থেকেই সাড়া জাগানো বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির আদলে গড়ে ওঠা বরিশাল স্বদেশ-বান্ধব সমিতির সঙ্গে যুক্ত হলেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। গোপন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁরা ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন ইংরেজ প্রশাসনকে।
১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতির একাংশের উদ্যোগে গঠিত হলো যুগান্তর নামের একটি অতিবিপ্লবী দল। বরিশালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় যুগান্তরের পরিচালক বারীন্দ্র ঘোষের সঙ্গে সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের যোগাযোগ হলো। বারীন্দ্র ঘোষ সতীশ চন্দ্রকে যুগান্তরের অনুরূপ একটি বিপ্লবী দল গঠন করতে বললেন। ১৯০৮ সালে বিএম স্কুলের ছাত্র নরেন্দ্র মোহন ঘোষ চৌধুরীর সহায়তায় বরিশালে অতিবিপ্লবী দল গঠন করলেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসেই অতিবিপ্লবী দলগুলোর কার্যক্রম বেআইনি ঘোষণা করল সরকার এবং সেই সংগঠনগুলোর সদস্যদের ওপর শুরু করল অকথ্য নির্যাতন। সরকারি এই নির্যাতনের প্রতিবাদে বিএম স্কুলের চাকরি ছাড়লেন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৯১১ সালে তিনি গয়াধামে গেলেন। স্বামী শংকরানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়ে প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী নাম গ্রহণ করলেন। ১৯১২ সালে বরিশালে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন শংকর মঠ। কালক্রমে এই মঠই হয়ে উঠল বরিশালে বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল, স্বাধীনতার বৈপ্লবিক মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার তীর্থকেন্দ্র।
বিপ্লবের এই তীর্থকেন্দ্রের অভ্যন্তরে তিনটি কক্ষ। পরিচ্ছন্ন সিঁড়ি আর কলাপসিবল গেটের বাধা টপকে আমাদের ভেতরে যেতে সাহায্য করলেন মঠের পূজারি অসীম চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, মঠের কেন্দ্রীয় কক্ষটিতে রয়েছে কষ্টিপাথরে নির্মিত একটি শিবলিঙ্গ। পশ্চিম দিকের কক্ষটিতে শংকরানন্দের বিগ্রহ এবং পূর্ব দিকের কক্ষটি স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর সমাধিমন্দির। ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম আমরা। অনুভব করার চেষ্টা করলাম অগ্নিযুগের সেই মানুষগুলোর আদর্শ-অনুভূতিকে, যাঁদের অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অতিক্রম করেছিলাম স্বাধীনতার এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান।
দীপংকর চন্দ
No comments