সময়ের প্রতিবিম্ব-গণপিটুনি নয়, গণহত্যা by এবিএম মূসা
আমিনবাজারে ছয় ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছে। কীভাবে ঝরে পড়ল ছয়টি তরতাজা প্রাণ? আমার স্নেহভাজন নবীন সাংবাদিকেরা এ ধরনের মৃত্যুর খবর নানাভাবে, ভাষার বৈচিত্র্যে অথবা মারপ্যাঁচে বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করেন। কখনো ট্রাকচাপা পড়ে, কখনো খাদে পড়ে, তথাকথিত ক্রসফায়ারের গুলিতে মরণ হয়েছে, তাঁদের এমন রিপোর্ট হরহামেশাই পড়ছি।
অনেক বছর আগে রুবেলকে ল্যাম্পপোস্টে মাথা ঠুকিয়ে হত্যা করেছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। লিমন ভাগ্যবান, ‘ক্রসফায়ারের’ গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বুকে নয়, পায়ে লাগাতে বেঁচে গেছে। আমিনবাজারেও সাতজনের একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে, পিটুনিতে খুন হয়নি।
কিছুদিন আগে খবর পড়ছিলাম, মিরসরাইয়ে ৪৪ কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ। এটিকে সাংবাদিকের ভাষায় অথবা চলতি বিবরণে বলা হচ্ছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। অথচ এটি আইনি ভাষায় অবহেলাজনিত খুনের জন্য চালককে দায়ী বলা যেত। যা হোক, এ ধরনের খবর তো হরহামেশাই পত্রিকায় দেখছি, কয়েক দিন পর ভুলে যাচ্ছি। চারজনের মৃত্যুর খবর চাপা দিচ্ছে ১০ জনের লাশ। লঞ্চডুবিতে এক বছরে ৫০ জনের ডুবে মরার খবর পরের বছরে ১০০ জনের ডুবন্ত মানুষের সঙ্গে ডুবে যায়। নৌমন্ত্রী বলেন দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ব্যস, হয়ে গেল। তারপর যেমনটি তেমন। একটি পড়ি, ভুলে যাই, কিছুদিন পর আরেকটি মরণের মিছিলের খবর পড়ে কিছুদিনের জন্য শোকাহত হই। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার, সময় সব শোক ভুলিয়ে দেয়। পুত্রশোক ভুলে যান মা, বন্ধুরা ভুলে যান সহপাঠীকে। যে পুলিশ বলে তদন্ত চলছে, ‘সেই চলা কখন থেমে গেছে, কেউ খবর রাখে না। এত সব হত্যা আর মৃত্যুর খবর পড়ছি প্রায় প্রতি দিন, আর আবৃত্তি করি সুকান্তের কবিতা—‘অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার/ দেখি এ দেশে মৃত্যুরই কারবার’। মনে হয় সুকান্ত বেঁচে থাকলে ‘এ দেশে’ কথাটি সংশোধন করে ‘এই সময়ে’ লিখতেন।
মরণের মিছিলে মিরসরাইয়ের পর যোগ হলো ঢাকার কাছেই আমিনবাজারে ছয় ছাত্র-যুবক। প্রথমে কিছু পত্রিকায় খবরের মূল প্রকাশটি হচ্ছে, ‘গণপিটুনিতে’ ছয় ছাত্র নিহত। সব পত্রিকায় প্রায় একই বক্তব্য, তবে ভিন্ন ধরনের। কোনো পত্রিকার শিরোনাম, ‘ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে খুন’ বহুল প্রচারিত অন্য একটি পত্রিকার শিরোনাম ‘সন্দেহের নির্মম বলি’। সর্বসাধারণে প্রচারিত দৈনিকটির শিরোনাম ‘প্রাণ গেল ছয় ছাত্রের’। অথচ কথাটি হবে ‘প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো’। একটি প্রতিবেদন তো হতভাগা যুবকদের গাঁজাখোরই বানিয়ে দিল। প্রিয় সাংবাদিক কনিষ্ঠজনদের বলছি, ভুল, তোমাদের সব রিপোর্টই ভুল; বার্তা সম্পাদকদের বলছি, সব শিরোনাম বিভ্রান্তিকর। কারও গণপ্রাণ যায়নি, সন্দেহের নির্মম বলি নয় সেই ছয়জন। ছয়জনকে পরিকল্পিত অথবা অপরিকল্পিতভাবে ‘হত্যা’ করা হয়েছে।
কেন, কীভাবে, কোন অপরাধে এই কিশোরদের কারা খুন করল, তা পুলিশ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি, পারলেও সরাসরি বলছে না, অথবা করেনি, জানলেও বলবে না। যারা দলবেঁধে দা-চাপাতি, সড়কি-বল্লম নিয়ে এসে ঘেরাও করে পিটিয়ে মারল ছয় কিশোরকে, তাদের কাউকে আজ পর্যন্ত খুঁজে পেল না আমার ছোট ভাই সাংবাদিকেরা? পুলিশ একজনকে খুঁজে পেলেও তাকে ‘বাদী’ করে নিহত হতভাগাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা সাজানো হয়েছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এক কিশোরকে ডাকাত বানিয়েছে, মৃত ছয়জনের কপালে ডাকাতের ছাপ দিয়েছে। যে কিশোরটি বেঁচে গেল, মনে হচ্ছে বেঁচে যাওয়াই কাল হয়েছে। গণপিটুনি দেওয়া খুনিদের দা-কিরিচ তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামলা সাজানো হবে। এখন তার অবস্থা ভিক্ষে চাই না, কুত্তা সামলান। প্রাসঙ্গিক কারণেই স্মরণ করছি, লিমন-কাহিনি। র্যাবের গুলিতে একটি পা হারিয়ে সেই বেচারা উল্টো মামলায় আসামি হয়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে।
এতসব অপ-প্রতিবেদনের মধ্যে ভালো লাগল সোমবার রাতে বৈশাখী টিভিতে প্রচারিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানের দুই তরুণ সাংবাদিকের কিছু তথ্যসমৃদ্ধ সরাসরি বক্তব্য। সেই দুজনের একজন হচ্ছেন বৈশাখীর সাভার প্রতিনিধি আবদুল হালিম, অপরজন যুগান্তর-এর জাভেদ মোস্তফা। তাঁদের বক্তব্যের মাঝে উঠে এসেছে প্রকৃত তথ্যের পুরো পশ্চাৎপট। তাঁরাই অন্যান্য মাধ্যমের প্রতিবেদকের বক্তব্য ছাপিয়ে সরাসরি বলেছেন ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে, এটি একটি ‘অপরাধপ্রবণ এলাকা’। এই সত্যটি স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানেন, পুলিশ জানত, স্থানীয় অধিবাসীরা তো বলছেন বহুদিন ধরে আতঙ্কে রয়েছেন। জনপ্রতিনিধি আর সেখানকার বেআইনিভাবে বালু আহরণকারীরা জানেন। জানত না সাত কিশোর, তাই ‘অপরাধপ্রবণ’ এলাকায় অজান্তে অনুপ্রবেশ করে ‘গণপিটুনিতে’ একজন বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছে ছয়জন।
বৈশাখী টেলিভিশনের আলোচনায় দুই সাংবাদিক-প্রতিবেদক সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কীভাবে এখানে সন্ত্রাসী বা ডাকাত ধরতে গিয়ে বা অন্য কোনো কারণে অনুপ্রবেশ করে অতীতে র্যাব আর পুলিশের সদস্যরা খুন হয়েছেন। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা নিত্য চাঁদা আদায় করছেন ‘মাদকদ্রব্যের ঘাঁটি’ থেকে। দুই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের দুই গডফাদার নদীর তথা রাজনৈতিক অঙ্গনের দুই পাশে থাকলেও হাতে হাত মিলিয়ে এলাকাটির সব অনৈতিক কার্যক্রম সমঝোতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন। কী মজার ব্যাপার, সরকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের অথবা খাতুনগঞ্জ-ইসলামপুরের সিন্ডিকেটের আড়তদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না, সেসব এলাকায় ঢুঁ মারে না। তেমনি আমিনবাজারের মাদকের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ও হাত দেয় না, হয়তো হাত পাতে। টেলিভিশনে দুই রিপোর্টার তো পরোক্ষে বলেন, কাদের ‘পরোক্ষ তদারকিতে’ চলে এ ব্যবসা।
স্বাভাবিকভাবেই মাদক ব্যবসায়ী ডনদের এলাকাটিতে ক্রেতা-বিক্রেতা ব্যতীত অন্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তারা অঘোষিত সান্ধ্য আইন জারি করেছে সেই এলাকায়। সব কটি পত্রিকার খবর পড়ে আমার মনে হয়েছে, অজান্তে বাঘের গুহায় অথবা কেউটে সাপের গর্ত-ভর্তি এলাকায় ঢুকে পড়েছিল ছয় কিশোর। এই বয়সে শবে বরাতের আনন্দ উদ্যাপনে আমরাও দলবেঁধে ঘুরে বেড়িয়েছি। সারা বছর যেসব ছেলে পশ্চিম দিকে মাটিতে একটি ঢুঁ-ও মারে না, সে রাতে জামাতে নামাজ পড়ে হইহল্লা করে বেরিয়ে পড়ে, এপাড়া থেকে ওপাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। তাই তো মিরপুর-গাবতলী থেকে নামাজ শেষে ঘুরতে বেরিয়ে কাছেই আমিনবাজারে যাবে, ইটভাটা বা অবৈধ বালুমহালের ঘুমটিঘরে আড্ডা দেবে, এটা তো অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ যে মাদক ক্রেতা-বিক্রেতা, তাদের পৃষ্ঠপোষক, এলাকার মাতব্বর অথবা ‘টহলদার’ (কাদের জন্য টহল জানি না) পুলিশের সদস্য ব্যতীত অন্যদের জন্য প্রবেশ এমনকি এলাকার জনসাধারণের যাওয়া নিষিদ্ধ, তা এই সাত কিশোর বুঝতে পারেনি। তাই তথাকথিত ‘গণপিটুনিতে’ কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিক ভাইদের ভাষায় ‘প্রাণ গেল’ অথবা ‘গণপিটুনির শিকার’ হলো ছয় কিশোর। আর আমি সরাসরি বলছি, গণহত্যার শিকার হয়েছে। যা হোক, বুধবারের পত্রিকায় অন্তত কয়েকটি পত্রিকা আগের ভুল প্রকাশটি সংশোধন করে শিরোনাম দিয়েছে, ‘ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা।’
আমার কাছে অবাক লাগছে, কারা অথবা নির্দিষ্ট কতজন মিলে ছয়টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিল, আজও সেই খোঁজটি পেলেন না গণমাধ্যমের প্রতিনিধি। ‘সর্বনাশ, কারা যেন আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে’, এই কথাটি মসজিদের মাইকে কে ঘোষণা দিল, জানান দিল এলাকার টহলদারিদের, মাদক ব্যবসার পাহারাদারদের? কারা এলোপাতাড়ি পেটাল ‘ডাকাত সন্দেহে’ টংঘরে বিশ্রামরত ছয় কিশোরকে, কোথা থেকে তাদের হঠাৎ উদয় ঘটল? পেটোয়া বাহিনীর কারও একটি নামও পত্রিকার পাতায় দেখলাম না। পুলিশ বড়দেশী গ্রামে খুঁজে পেল না, যারা ‘ডাকাত পিটিয়ে’ খুন করার মহোৎসবে মেতেছিল তাদের মাঝে?
অতীতের কিছু ঘটনার বিবরণী রয়েছে প্রথম আলোর প্রথম প্রতিবেদনে। অনেকগুলো বাড়িতে কতিপয় ডাকাতির বিবরণ রয়েছে। সব ডাকাতির খবর সংগৃহীত হয়েছে বলে মনে হয় না। বলা হয়েছে, এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, ডাকাতদের উৎপাত আগেও ছিল। বাড়িতে, বালুমহালের টংঘরে নদীতে চলাচলরত ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা নৌযানে ডাকাতি হয়েছে ও হচ্ছে। ক্ষুব্ধ বক্তব্য রয়েছে গ্রামবাসীর। এসব সবই ভয়ংকর সত্য, অসহায় গ্রামবাসীর প্রতিরোধের নিজস্ব ব্যবস্থাও সমর্থন করি। যে সত্যটি গ্রামবাসী কোনো পত্রিকার কোনো প্রতিবেদককে জানায়নি, তা হলে এত বছর ধরে এত যে ঘটনা ঘটেছে, এর আগে কি কোনো রাতে এমনি করে মসজিদের মাইকে পিটুনি দেওয়ায় লোক জড়ো করা হয়েছে? দূর বা নিকট অতীতে কোনো ‘গণপিটুনিতে’ ডাকাত সন্দেহে একজনও খুন হয়েছে কি গ্রামবাসীর হাতে? অবশ্যই হয়নি, হলে নিশ্চয়ই গণমাধ্যমে খবর হতো। নিরীহ গো-বেচারা ছয়টি কিশোর খুন হয়েছে, কারণ আগেই বলেছি, তারা নেকড়ের ডেরায় ঢুকে পড়েছিল, না জেনে কেউটে সাপের গর্তে ভরা বালুর চরে একটুখানি অবকাশ যাপন করতে গিয়েছিল। সেই বাঘ আর কেউটের আস্তানা যারা পাহারা দিত, তারাই কি নির্মমভাবে কপালে ডাকাত কলঙ্কের ছাপ মেরে হত্যা করেছে ছয় যুবককে? তারা কারা, তা কি সাভার থানা কর্তৃপক্ষ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল জানে না?
এসব প্রশ্নের জবাব চাই অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে নয়। কারণ, এমন দাবি করা বর্তমান অবস্থায় বাতুলতা অথবা নিরর্থক। জবাব চাই, ছয় যুবকের কপালে সেঁটে দেওয়া কলঙ্কের ছাপটি মুছে ফেলার জন্য, ব্যারিস্টার হতে না পারা নিহত কিশোরটির পিতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ভাবাতে চাই, নৃশংস গণহত্যা ঘটে গেল অথচ দুদিন নিশ্চুপ রইলেন আমাদের বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরে বলেন তদন্ত হবে। অবশ্যই হবে, হতে থাকবে, আর আমিনবাজারের নিষিদ্ধ এলাকাটির কার্যক্রমও চলমান থাকবে।
রবিঠাকুরের কবিতাংশ দিয়ে প্রতিবেদনে ইতি টানছি—
‘আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশী সংগীতহারা,
অমাবস্যায় কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে,
অতঃপর কবির প্রশ্ন:
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
তুমি কি বেসেছ ভালো।
কবির এই প্রশ্ন আমাদেরও, ছয় যুবকের স্বজনদেরও। যাঁরা নিত্য বলেন এ দেশ থেকে বিচার উঠে গেছে, তাঁরা অবশ্য ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আপাতত এমন প্রশ্ন করেন না।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
কিছুদিন আগে খবর পড়ছিলাম, মিরসরাইয়ে ৪৪ কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ। এটিকে সাংবাদিকের ভাষায় অথবা চলতি বিবরণে বলা হচ্ছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। অথচ এটি আইনি ভাষায় অবহেলাজনিত খুনের জন্য চালককে দায়ী বলা যেত। যা হোক, এ ধরনের খবর তো হরহামেশাই পত্রিকায় দেখছি, কয়েক দিন পর ভুলে যাচ্ছি। চারজনের মৃত্যুর খবর চাপা দিচ্ছে ১০ জনের লাশ। লঞ্চডুবিতে এক বছরে ৫০ জনের ডুবে মরার খবর পরের বছরে ১০০ জনের ডুবন্ত মানুষের সঙ্গে ডুবে যায়। নৌমন্ত্রী বলেন দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ব্যস, হয়ে গেল। তারপর যেমনটি তেমন। একটি পড়ি, ভুলে যাই, কিছুদিন পর আরেকটি মরণের মিছিলের খবর পড়ে কিছুদিনের জন্য শোকাহত হই। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার, সময় সব শোক ভুলিয়ে দেয়। পুত্রশোক ভুলে যান মা, বন্ধুরা ভুলে যান সহপাঠীকে। যে পুলিশ বলে তদন্ত চলছে, ‘সেই চলা কখন থেমে গেছে, কেউ খবর রাখে না। এত সব হত্যা আর মৃত্যুর খবর পড়ছি প্রায় প্রতি দিন, আর আবৃত্তি করি সুকান্তের কবিতা—‘অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার/ দেখি এ দেশে মৃত্যুরই কারবার’। মনে হয় সুকান্ত বেঁচে থাকলে ‘এ দেশে’ কথাটি সংশোধন করে ‘এই সময়ে’ লিখতেন।
মরণের মিছিলে মিরসরাইয়ের পর যোগ হলো ঢাকার কাছেই আমিনবাজারে ছয় ছাত্র-যুবক। প্রথমে কিছু পত্রিকায় খবরের মূল প্রকাশটি হচ্ছে, ‘গণপিটুনিতে’ ছয় ছাত্র নিহত। সব পত্রিকায় প্রায় একই বক্তব্য, তবে ভিন্ন ধরনের। কোনো পত্রিকার শিরোনাম, ‘ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে খুন’ বহুল প্রচারিত অন্য একটি পত্রিকার শিরোনাম ‘সন্দেহের নির্মম বলি’। সর্বসাধারণে প্রচারিত দৈনিকটির শিরোনাম ‘প্রাণ গেল ছয় ছাত্রের’। অথচ কথাটি হবে ‘প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো’। একটি প্রতিবেদন তো হতভাগা যুবকদের গাঁজাখোরই বানিয়ে দিল। প্রিয় সাংবাদিক কনিষ্ঠজনদের বলছি, ভুল, তোমাদের সব রিপোর্টই ভুল; বার্তা সম্পাদকদের বলছি, সব শিরোনাম বিভ্রান্তিকর। কারও গণপ্রাণ যায়নি, সন্দেহের নির্মম বলি নয় সেই ছয়জন। ছয়জনকে পরিকল্পিত অথবা অপরিকল্পিতভাবে ‘হত্যা’ করা হয়েছে।
কেন, কীভাবে, কোন অপরাধে এই কিশোরদের কারা খুন করল, তা পুলিশ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি, পারলেও সরাসরি বলছে না, অথবা করেনি, জানলেও বলবে না। যারা দলবেঁধে দা-চাপাতি, সড়কি-বল্লম নিয়ে এসে ঘেরাও করে পিটিয়ে মারল ছয় কিশোরকে, তাদের কাউকে আজ পর্যন্ত খুঁজে পেল না আমার ছোট ভাই সাংবাদিকেরা? পুলিশ একজনকে খুঁজে পেলেও তাকে ‘বাদী’ করে নিহত হতভাগাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা সাজানো হয়েছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এক কিশোরকে ডাকাত বানিয়েছে, মৃত ছয়জনের কপালে ডাকাতের ছাপ দিয়েছে। যে কিশোরটি বেঁচে গেল, মনে হচ্ছে বেঁচে যাওয়াই কাল হয়েছে। গণপিটুনি দেওয়া খুনিদের দা-কিরিচ তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামলা সাজানো হবে। এখন তার অবস্থা ভিক্ষে চাই না, কুত্তা সামলান। প্রাসঙ্গিক কারণেই স্মরণ করছি, লিমন-কাহিনি। র্যাবের গুলিতে একটি পা হারিয়ে সেই বেচারা উল্টো মামলায় আসামি হয়ে এক পায়ে খুঁড়িয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে।
এতসব অপ-প্রতিবেদনের মধ্যে ভালো লাগল সোমবার রাতে বৈশাখী টিভিতে প্রচারিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানের দুই তরুণ সাংবাদিকের কিছু তথ্যসমৃদ্ধ সরাসরি বক্তব্য। সেই দুজনের একজন হচ্ছেন বৈশাখীর সাভার প্রতিনিধি আবদুল হালিম, অপরজন যুগান্তর-এর জাভেদ মোস্তফা। তাঁদের বক্তব্যের মাঝে উঠে এসেছে প্রকৃত তথ্যের পুরো পশ্চাৎপট। তাঁরাই অন্যান্য মাধ্যমের প্রতিবেদকের বক্তব্য ছাপিয়ে সরাসরি বলেছেন ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে, এটি একটি ‘অপরাধপ্রবণ এলাকা’। এই সত্যটি স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানেন, পুলিশ জানত, স্থানীয় অধিবাসীরা তো বলছেন বহুদিন ধরে আতঙ্কে রয়েছেন। জনপ্রতিনিধি আর সেখানকার বেআইনিভাবে বালু আহরণকারীরা জানেন। জানত না সাত কিশোর, তাই ‘অপরাধপ্রবণ’ এলাকায় অজান্তে অনুপ্রবেশ করে ‘গণপিটুনিতে’ একজন বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছে ছয়জন।
বৈশাখী টেলিভিশনের আলোচনায় দুই সাংবাদিক-প্রতিবেদক সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কীভাবে এখানে সন্ত্রাসী বা ডাকাত ধরতে গিয়ে বা অন্য কোনো কারণে অনুপ্রবেশ করে অতীতে র্যাব আর পুলিশের সদস্যরা খুন হয়েছেন। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা নিত্য চাঁদা আদায় করছেন ‘মাদকদ্রব্যের ঘাঁটি’ থেকে। দুই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের দুই গডফাদার নদীর তথা রাজনৈতিক অঙ্গনের দুই পাশে থাকলেও হাতে হাত মিলিয়ে এলাকাটির সব অনৈতিক কার্যক্রম সমঝোতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন। কী মজার ব্যাপার, সরকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের অথবা খাতুনগঞ্জ-ইসলামপুরের সিন্ডিকেটের আড়তদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না, সেসব এলাকায় ঢুঁ মারে না। তেমনি আমিনবাজারের মাদকের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ও হাত দেয় না, হয়তো হাত পাতে। টেলিভিশনে দুই রিপোর্টার তো পরোক্ষে বলেন, কাদের ‘পরোক্ষ তদারকিতে’ চলে এ ব্যবসা।
স্বাভাবিকভাবেই মাদক ব্যবসায়ী ডনদের এলাকাটিতে ক্রেতা-বিক্রেতা ব্যতীত অন্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তারা অঘোষিত সান্ধ্য আইন জারি করেছে সেই এলাকায়। সব কটি পত্রিকার খবর পড়ে আমার মনে হয়েছে, অজান্তে বাঘের গুহায় অথবা কেউটে সাপের গর্ত-ভর্তি এলাকায় ঢুকে পড়েছিল ছয় কিশোর। এই বয়সে শবে বরাতের আনন্দ উদ্যাপনে আমরাও দলবেঁধে ঘুরে বেড়িয়েছি। সারা বছর যেসব ছেলে পশ্চিম দিকে মাটিতে একটি ঢুঁ-ও মারে না, সে রাতে জামাতে নামাজ পড়ে হইহল্লা করে বেরিয়ে পড়ে, এপাড়া থেকে ওপাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। তাই তো মিরপুর-গাবতলী থেকে নামাজ শেষে ঘুরতে বেরিয়ে কাছেই আমিনবাজারে যাবে, ইটভাটা বা অবৈধ বালুমহালের ঘুমটিঘরে আড্ডা দেবে, এটা তো অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ যে মাদক ক্রেতা-বিক্রেতা, তাদের পৃষ্ঠপোষক, এলাকার মাতব্বর অথবা ‘টহলদার’ (কাদের জন্য টহল জানি না) পুলিশের সদস্য ব্যতীত অন্যদের জন্য প্রবেশ এমনকি এলাকার জনসাধারণের যাওয়া নিষিদ্ধ, তা এই সাত কিশোর বুঝতে পারেনি। তাই তথাকথিত ‘গণপিটুনিতে’ কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিক ভাইদের ভাষায় ‘প্রাণ গেল’ অথবা ‘গণপিটুনির শিকার’ হলো ছয় কিশোর। আর আমি সরাসরি বলছি, গণহত্যার শিকার হয়েছে। যা হোক, বুধবারের পত্রিকায় অন্তত কয়েকটি পত্রিকা আগের ভুল প্রকাশটি সংশোধন করে শিরোনাম দিয়েছে, ‘ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা।’
আমার কাছে অবাক লাগছে, কারা অথবা নির্দিষ্ট কতজন মিলে ছয়টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিল, আজও সেই খোঁজটি পেলেন না গণমাধ্যমের প্রতিনিধি। ‘সর্বনাশ, কারা যেন আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়েছে’, এই কথাটি মসজিদের মাইকে কে ঘোষণা দিল, জানান দিল এলাকার টহলদারিদের, মাদক ব্যবসার পাহারাদারদের? কারা এলোপাতাড়ি পেটাল ‘ডাকাত সন্দেহে’ টংঘরে বিশ্রামরত ছয় কিশোরকে, কোথা থেকে তাদের হঠাৎ উদয় ঘটল? পেটোয়া বাহিনীর কারও একটি নামও পত্রিকার পাতায় দেখলাম না। পুলিশ বড়দেশী গ্রামে খুঁজে পেল না, যারা ‘ডাকাত পিটিয়ে’ খুন করার মহোৎসবে মেতেছিল তাদের মাঝে?
অতীতের কিছু ঘটনার বিবরণী রয়েছে প্রথম আলোর প্রথম প্রতিবেদনে। অনেকগুলো বাড়িতে কতিপয় ডাকাতির বিবরণ রয়েছে। সব ডাকাতির খবর সংগৃহীত হয়েছে বলে মনে হয় না। বলা হয়েছে, এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, ডাকাতদের উৎপাত আগেও ছিল। বাড়িতে, বালুমহালের টংঘরে নদীতে চলাচলরত ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা নৌযানে ডাকাতি হয়েছে ও হচ্ছে। ক্ষুব্ধ বক্তব্য রয়েছে গ্রামবাসীর। এসব সবই ভয়ংকর সত্য, অসহায় গ্রামবাসীর প্রতিরোধের নিজস্ব ব্যবস্থাও সমর্থন করি। যে সত্যটি গ্রামবাসী কোনো পত্রিকার কোনো প্রতিবেদককে জানায়নি, তা হলে এত বছর ধরে এত যে ঘটনা ঘটেছে, এর আগে কি কোনো রাতে এমনি করে মসজিদের মাইকে পিটুনি দেওয়ায় লোক জড়ো করা হয়েছে? দূর বা নিকট অতীতে কোনো ‘গণপিটুনিতে’ ডাকাত সন্দেহে একজনও খুন হয়েছে কি গ্রামবাসীর হাতে? অবশ্যই হয়নি, হলে নিশ্চয়ই গণমাধ্যমে খবর হতো। নিরীহ গো-বেচারা ছয়টি কিশোর খুন হয়েছে, কারণ আগেই বলেছি, তারা নেকড়ের ডেরায় ঢুকে পড়েছিল, না জেনে কেউটে সাপের গর্তে ভরা বালুর চরে একটুখানি অবকাশ যাপন করতে গিয়েছিল। সেই বাঘ আর কেউটের আস্তানা যারা পাহারা দিত, তারাই কি নির্মমভাবে কপালে ডাকাত কলঙ্কের ছাপ মেরে হত্যা করেছে ছয় যুবককে? তারা কারা, তা কি সাভার থানা কর্তৃপক্ষ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল জানে না?
এসব প্রশ্নের জবাব চাই অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে নয়। কারণ, এমন দাবি করা বর্তমান অবস্থায় বাতুলতা অথবা নিরর্থক। জবাব চাই, ছয় যুবকের কপালে সেঁটে দেওয়া কলঙ্কের ছাপটি মুছে ফেলার জন্য, ব্যারিস্টার হতে না পারা নিহত কিশোরটির পিতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ভাবাতে চাই, নৃশংস গণহত্যা ঘটে গেল অথচ দুদিন নিশ্চুপ রইলেন আমাদের বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরে বলেন তদন্ত হবে। অবশ্যই হবে, হতে থাকবে, আর আমিনবাজারের নিষিদ্ধ এলাকাটির কার্যক্রমও চলমান থাকবে।
রবিঠাকুরের কবিতাংশ দিয়ে প্রতিবেদনে ইতি টানছি—
‘আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশী সংগীতহারা,
অমাবস্যায় কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে,
অতঃপর কবির প্রশ্ন:
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
তুমি কি বেসেছ ভালো।
কবির এই প্রশ্ন আমাদেরও, ছয় যুবকের স্বজনদেরও। যাঁরা নিত্য বলেন এ দেশ থেকে বিচার উঠে গেছে, তাঁরা অবশ্য ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আপাতত এমন প্রশ্ন করেন না।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments